You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | চন্দনদিয়ার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
চন্দনদিয়ার যুদ্ধ
সাধারণ
১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের শুরুতেই শিবপুর থানায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাথমিক প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। পরবর্তী সময় দলে দলে গ্রামের লােকজন ভারতে চলে যায় অস্ত্র চালানাের প্রশিক্ষণ নিতে। অস্ত্র প্রশিক্ষণ শেষে শিবপুর ফিরে এসে ৩ নম্বর সেক্টরের অধীনে নিজস্ব এলাকায় যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী শিবপুর থানার মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে দিশেহারা হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে তাদের গাড়ি বহর ও সৈন্যদের ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে। শিবপুর থানার মধ্য দিয়ে তাদের গমনাগমন কখনাে নিরাপদ ছিল না। প্রতিনিয়ত পাকিস্তানি সৈন্যদের বিভিন্ন প্রকার ক্ষতিসাধন করতে থাকেন মুক্তিযােদ্ধারা। এরূপ পরিস্থিতিতে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুটিয়া বাজার এলাকায় এবং শিবপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। তখন ৩ নম্বর সেক্টরের অধীন কাজ করছেন মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের সশস্ত্র মােকাবিলায় তটস্থ ও দিশেহারা। তারা তাদের রসদ সরবরাহ রাস্তা ঠিক রাখতে ব্যস্ত। এ রকম একটা যােগাযােগের রাস্তা ছিল নরসিংদী-শিবপুর-দুলালপুর-মনােহরদী।
উদ্দেশ্য
চন্দনদিয়া গ্রামের সম্মুখ অংশে অ্যামবুশ স্থাপন করা এবং শক্রর বড়াে ধরনের ক্ষতি করে মনােবলের উপর চরম আঘাত হানা।
স্থান ও সময়
সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। নরসিংদী থেকে শিবপুর আসার পথে পুটিয়া বাজারের দেড় কিলােমিটার উত্তরে শাসপুর চৌরাস্তার দক্ষিণ-পূর্ব পাশের গ্রামটির নাম চন্দনদিয়া।
পটভূমি/পরিস্থিতি
স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রারম্ভে শিবপুর থানার অকুতােভয় দামাল ছেলেরা সর্বত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত, স্বল্প প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং কোনােপ্রকার অস্ত্র প্রশিক্ষণ না করেই বিভিন্নভাবে স্থানীয় জনগণ পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ ও গতিরােধ করতে থাকেন। পাকিস্তানি বাহিনীর গমনাগমন পথে। তারা বিভিন্ন প্রকার বাধার সৃষ্টি করেন। দুর্বার প্রতিরােধের মুখে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
নরসিংদী-শিবপুর-মনােহরদী রাস্তা পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম। ক্যাম্পে সৈন্য প্রেরণ ও রসদ সরবরাহের জন্য রাস্তাটা ছিল তাদের জন্য খুবই প্রয়ােজন। তাই তারা পুটিয়া বাজার ও শিবপুর বালিকা বিদ্যালয়ে ক্যাম্প স্থাপন করে। অনুরূপভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এটা ছিল একটা দুঃসাহসিক কাজ, যাতে বিভিন্ন অভিযানের মাধ্যমে শিবপুর থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষতিসাধন করা যায়। পাকিস্তানি বাহিনীকে শিবপুর অতিক্রম করার সময় সর্বদাই অনেক জানমালের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর রসদ সরবরাহ ও অন্যান্য ক্যাপের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করাই ছিল এ অ্যামবুশের মূল লক্ষ্য। সর্বোপরি তাদের মনােবলের উপর প্রচণ্ড আঘাত হেনে দিশেহারা ও তটস্থ করাও ছিল এর অন্তর্গত।
যুদ্ধের বর্ণনা
১৯৭১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। অধিনায়ক মান্নান খানের নেতৃত্বে একটা বড়াে ধরনের অ্যামবুশের পরিকল্পনা করা হয়। স্থান নির্ধারণ করা হয় চন্দনদিয়া গ্রামের সম্মুখ অংশ। প্রয়ােজনীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের পর মান্নান খানের নেতৃত্বে ১টি বড়াে দল শাসপুর চৌরাস্তার দুই প্রান্তে সারারাত অবস্থান নিয়ে বসে থাকে। মান্নান খানের দলকে সাহায্য করার জন্য হাবিলদার মজনু মৃধার নেতৃত্বে আরেকটি দল চন্দনদিয়া পুলের কাছে অবস্থান নেন। এ দলের দায়িত্ব ছিল ২টি। প্রথমত মান্নান খানের দল বিপদে পড়লে পাকিস্তানি সৈন্যদের পিছন থেকে আক্রমণ করা, দ্বিতীয়ত যদি শত্রু আক্রান্ত হয়ে চন্দনদিয়া দিয়ে পালাতে থাকে, তাহলে তাদেরকে সেখানে আক্রমণ করা। আবদুল আলী মৃধার নেতৃত্বে অপর ১টি দল মজনু মৃধার পূর্ব দিকে জাঙ্গালিয়া বটগাছের কাছে অবস্থান নেয়।
পরিকল্পনা অনুয়ায়ী দুই দলই যার যার অবস্থানে সারারাত অবস্থান করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধা তাজুল ইসলামের ভাষ্য মতে, স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে এ অ্যামবুশের অবস্থান সম্পর্কে সংবাদ পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বেই জেনে যায়। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী শাসপুরের রাস্তায় না এসে ভাের রাতে হঠাৎ করে চন্দনদিয়ায় অবস্থানরত মজনু মৃধার দলকে পিছন থেকে আক্রমণ করে। অতর্কিতে এ আক্রমণে মজনু মৃধা, আবদুল আলী মৃধা, আমজাদ, মানিক, ইদ্রিস, নজরুল ও অন্যরা অসীম সাহসের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ মােকাবিলা করতে থাকেন। আমজাদের রাইফেলের গুলি পাকিস্তানি ট্রাকের ড্রাইভারকে বিদ্ধ করে। ফলে নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকটি রাস্তার পাশে উলটে পড়ে এবং ৪জন সৈন্য নিহত হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মজনু মৃধার দলের উপর শত্রুর আক্রমণ তীব্রতর হতে থাকে। এ সময় মজনু মৃধা তার দলকে পিছু হটতে নির্দেশ দেন। পিছনে গমনের সময় প্রথমেই গুলিবিদ্ধ হন মানিক। কিছুক্ষণ পরই মাথায় গুলি লাগে ইদ্রিসের।
মজনু মৃধার দল আক্রান্ত হয়েছে শুনে মান্নান খান তাঁর দলসহ দৌড়ে চলে আসেন চন্দনদিয়ায়। সহযােদ্ধাদের সাহায্য পেয়ে মজনু মৃধা দুঃসাহসিক নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন। তার সিদ্ধান্ত পালটে ফেলেন। অসীম সাহসিকতার সাথে গুলি করতে করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দিকে এগিয়ে যান। তাকে পিছন থেকে ফায়ার সমর্থন দিতে থাকেন মান্নান খান, আমজাদ আর আবদুল বারী মৃধা। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হন। রাস্তার এ পাশে মুক্তিযােদ্ধা এবং অন্য পাশে পাকিস্তানি বাহিনী। শত্রু চিৎকার করতে থাকে এবং বলতে থাকে, “সবকো জিন্দা পাকড়াে, মজনুকো পাকড়াে।” অনেকক্ষণ ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে। মজনু মৃধাসহ বেশ কয়েকজনের গুলি শেষ হয়ে আসতে থাকে। সে সময়। আমজাদ, নজরল ও আবদুল আলী মৃধা ১টি, ২টি করে গুলি করে কভারিং। ফায়ার দিতে থাকেন। অন্য মুক্তিযােদ্ধারা এ সুযােগে পিছনে অবস্থান নিতে থাকেন। এরই মধ্যে এক পর্যায়ে আমজাদের পায়ে গুলি লাগে। আবদুল আলী মৃধার সাহায্যে আমজাদ পালিয়ে আসতে পারলেও নজরুল শক্রর হাতে ধরা পড়েন।
ফলাফল
এ যুদ্ধে আনুমানিক ৭জন শত্রু মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারেন নি। চন্দনদিয়ার যুদ্ধে ২জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। তারা হলেন: মানিক ও ইদ্রিস। নজরুল ১টি রাইফেলসহ পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। উভয় পক্ষেরই ক্ষতি সাধিত হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. দুর্বল পরিকল্পনা: অ্যামবুশ অবস্থানের সম্ভাব্য আগমন রাস্তায় পূর্ব সংকেত প্রদান করার জন্য কোনাে মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ােগ করা হয় নি। পাকিস্তানি বাহিনী যাতে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করতে না পারে, তার জন্য বিকল্প রাস্তায় কোনােরূপ প্রতিরােধ কিংবা প্রতিবন্ধকতার ব্যবস্থা করা হয় নি।
খ. গােপনীয়তাযে-কোনাে মূল্যে গােপনীয়তা রক্ষা করে যথাস্থানে অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হওয়া সার্থক অ্যামবুশ অপারেশনের। পূর্বশর্ত, এ অপারেশনে যা ব্যাহত হয়েছিল।
গ, আকস্মিকতা: এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধারা আকস্মিকতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং তাঁদেরই বিপরীতে পাকিস্তানি বাহিনী তা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। একটি সার্থক অ্যামবুশ পরিচালনায় আকস্মিকতা অর্জনের গুরুত্ব অনেকখানি।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড