জিনারদি রেল স্টেশনে রেইড ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় অ্যামবুশ
সাধারণ
নরসিংদী রেল স্টেশনের ৪ কিলােমিটার পশ্চিম দিকে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পশ্চিমে এবং ঘােড়াশাল রেল স্টেশন থেকে পূর্ব দিকে প্রথম স্টেশনটিই জিনারদি রেল স্টেশন। ঘােড়াশাল পার হয়ে সিলেট অথবা চট্টগ্রাম গমনকারী যে-কোনাে ট্রেন ঐ রেল স্টেশন দিয়েই যাতায়াত করে। তাই ঢাকা থেকে পূর্ব দিকে যে-কোনাে জেলা বা মহকুমা শহরের সাথে যােগাযােগ রক্ষার্থে এবং মেঘনার পূর্ব পাড়ে যুদ্ধরত মেজর খালেদ ও মেজর সফিউল্লাহর বাহিনী দ্বয়ের। বিরুদ্ধে যে-কোনাে অপারেশন পরিচালনার জন্য ঐ রেল স্টেশনটি পাকিস্তানি সেনাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এ গুরুত্ব অনুধাবন করেই পাকিস্তানি সেনারা সেখানে ১টি ক্যাম্প স্থাপন করে (পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প স্থাপনের সঠিক তারিখ জানা যায় নি)। ফলে সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের অবাধ বিচরণ অনেকাংশে বিঘ্নিত হয় এবং পাকিস্তানি সেনারা এলাকাবাসীকে হয়রানি করতে থাকে। তাই নেভাল সিরাজ তার দল নিয়ে ঐ ক্যাম্পে রেইড করার পরিকল্পনা করেন।
ভূমির বর্ণনা/লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান
ঘােড়াশাল-ভৈরব রেললাইন ধরে ঘােড়াশাল থেকে ৫ কিলােমিটার পূর্বে জিনারদি রেল স্টেশন অবস্থিত। রেললাইনের দক্ষিণ পার্শ্বে প্ল্যাটফরম এবং স্টেশন ভবনটি অবস্থিত। রেল স্টেশন থেকে একটি পাকা রাস্তা (১৯৭১ সালে। কাঁচা ছিল) উত্তরে এবং আরেকটি অনুরূপ রাস্তা দক্ষিণে চলে গিয়েছে। রাস্তা ২টির উচ্চতা প্রায় রেল স্টেশন রেললাইনের সমানই ছিল। রেল স্টেশনের চারপাশের জায়গাটি সমতল এবং রেললাইনের রাস্তার প্রায় সমান উচ্চতায় ছিল। রেল স্টেশন ভবনটির কাছেই পূর্ব পার্শ্বে ১টি ভবন ছিল, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান করত এবং সার্বক্ষণিক প্রহরী থাকত। পাকিস্তানি সেনাদের বাসস্থানের সামনে (রেললাইনের উত্তর পার্শ্বে) ১টি ‘L’ আকৃতির ভবন ছিল, যা তারা গােলাবারুদ, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করত | পরিকল্পনা ঐ স্টেশনে রেইড করার জন্য নেভাল সিরাজ তার ৩০-৪০জনের দলকে মােট ৩টি ভাগে ভাগ করেন। ১টি দলকে উত্তর-পশ্চিম কোণে কাঁচা রাস্তার পার্শ্বে পূর্ব দিকে মুখ করে মােতায়েন করার পরিকল্পনা করা হয়। তাদের কাজ ছিল গুদামের উপর গুলি বর্ষণ করা। দ্বিতীয় দলটিকে স্টেশনের পূর্ব পাশে পাকিস্তানি সেনাদের বাসস্থানের দিকে অস্ত্র তাক করে মােতায়েন করার পরিকল্পনা করা হয়। নেভাল সিরাজ এবং আরও ২জন গুদামের উত্তর পাশে অবস্থান গ্রহণ করে গুদামে রেইড করার পরিকল্পনা করেন।
যুদ্ধের বর্ণনা
পরিকল্পনা অনুযায়ী নেভাল সিরাজ যথাসময়ে তার দল নিয়ে টার্গেট এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১৩ আগস্ট বিকাল ৪টায় মুক্তিযােদ্ধারা। নিজ নিজ অবস্থান থেকে পাকিস্তানি সেনাদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তানি সেনারাও পালটা গুলি বর্ষণ করে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর গুলি বিনিময় সাময়িকভাবে বন্ধ হয়। ঠিক সে মুহূর্তেই নেভাল সিরাজ তার সাথে মাত্র ২জন সহযােদ্ধা নিয়ে উত্তর দিক থেকে অতর্কিতে গুদামটিতে প্রবেশ করে। ১৭জন শত্রুকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। ৭জন পাকিস্তানি সেনা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং ১জন নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা রেল স্টেশনের কাগজপত্র, টেলিফোন সেট ও অন্যান্য জিনিসপত্র ধ্বংস করে ফেলেন। নেভাল সিরাজ এ অপারেশনের সাথে সংযােগ রেখে তার অন্য ১টি দলকে রেল স্টেশনের পাশের গ্রামের মধ্যে অ্যামবুশ পাতার নির্দেশ দেন। পরদিন ১৪ আগস্ট পাকিস্তানি সেনাদের ১টি দল সে গ্রামে লুটতরাজ করতে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে। এখানে ২ ঘন্টা যুদ্ধের পর পাকিস্তানি সেনারা তাদের দলের ২টি মৃতদেহ এবং কয়েকজন আহত সেনাকে ফেলে রেখে নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়। এ রেইড ও অ্যামবুশে মুক্তিযােদ্ধারা এক বিরাট বিজয় অর্জন করেন, যার ফলে তারা অনেক অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র লাভ করেন।
ফলাফল
উল্লিখিত রেইডে মুক্তিবাহিনী শক্রর কাছ থেকে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি, ১১টি রাইফেল, ৫৩০০ রাউন্ড গুলি, ১৪টি বেল্ট, ২৮ জোড়া জুতা, ১৭ বস্তা আটা, ১১টি দুধের টিন ও বিপুল পরিমাণ ব্যবহার্য জিনিসপত্র হস্তগত করেন। এ অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনীর ১জন সদস্য (ইব্রাহিম) শহিদ হন। পাকিস্তানি সেনাদের জনবল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায় নি। তবে তাদের প্রায় ১ প্লাটুনের কিছু কম সৈন্য নিয়ে ক্যাম্পটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেখান থেকে শুধু ৭জন পাকিস্তানি সেনা অক্ষত অবস্থায় ফেরত যায়। তাদের বাকি সেনাদের সমস্ত হাতিয়ার, গােলাবারুদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র মুক্তিযােদ্ধারা দখল করে নেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. উপযুক্ত সময় নির্বাচন: নেভাল সিরাজ ভালােভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, ঐ সময় পাকিস্তানি সেনারা অসতর্ক থাকে এবং তাই তিনি উপযুক্ত সময়ে রেইড পরিচালনা করেন। আকস্মিকতা: যে-কোনাে অপারেশনে আকস্মিকতা (সারপ্রাইজ) একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ অপারেশনে পাকিস্তানি সেনারা রেল স্টেশনের মতাে এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দিনের বেলায় স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযােদ্ধারা এ ধরনের অপারেশন করতে পারেন, তা কল্পনায়ও আনতে পারেন নি। মনােবল: মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ছিল অত্যন্ত উঁচু। তারা নিজের মনের টানে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করেন। অন্যদিকে, পাকিস্তানি সেনারা তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না। ‘ ঘ. তথ্যসংগ্রহ; যে-কোনাে অপারেশনে তথ্যসংগ্রহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে সাধারণ জনগণ পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি, দৈনন্দিন কার্যক্রম ও অভ্যাস সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধাদের তথ্য দিয়েছিল, যার জন্য এত সহজে ১টি প্রশিক্ষিত সৈন্যদলের উপর এত সফল। রেইড করা সম্ভব হয়েছিল।
যুদ্ধের বর্ণনা
মুক্তিযােদ্ধা কাদির প্রায় ১২০জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রেল স্টেশনে রেইড করেন। পাকিস্তানি সেনাদের জনবল, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্রের বিস্তারিত তথ্য জেনেও কেবল মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার দৃঢ়সংকল্পের জন্যই মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্প রেইড করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা রেল স্টেশনের পূর্ব পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁরা নীরবে প্রহরীকে নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হন, ফলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পরও মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পটি দখল করতে ব্যর্থ হন। এদিকে ঘােড়াশালের পূর্ব দিকে জিনারদি রেল স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। সেদিক থেকেও পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এবং ৬ ঘণ্টায় তেমন কোনাে ফলাফল অর্জন করতে পেরে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন।
ফলাফল
ঐ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি এবং পাকিস্তানি সেনাদেরও কোনাে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ জানা যায় নি। এতে আপাতদৃষ্টিতে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে বিজয় না হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনার পর ঐ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের অপকর্মের তৎপরতা। কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। তাদের মধ্যে একটি ভীতি কাজ করছিল এবং মনােবল কমে গিয়েছিল। এভাবেই দিন যত যেতে থাকে, ততই পাকিস্তানি সেনাদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, এসব ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সহজতর হতে থাকে।
ঘােড়াশাল ব্রিজ ও রেলস্টেশন রেইড
সাধারণ
ঢাকা-ভৈরব রেললাইনে পলাশ থানায় শীতলক্ষ্যা নদীর উপর ঘােড়াশালের প্রসিদ্ধ রেলসেতুটি অবস্থিত। ঢাকার সাথে দেশের পূর্বাঞ্চলে রেল যােগাযােগ রক্ষার জন্য এ সেতুর গুরুত্ব অপরিসীম। মেঘনার পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধরত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিরুদ্ধে পরিচালিত যে-কোনাে অপারেশনে এ অক্ষে সামরিক সরবরাহ লাইন সচল রাখা, নরসিংদী তথা দেশের পূর্বাঞ্চলে অসামরিক প্রশাসনকে সচল রাখা এবং সাধারণ জনগণের চলাচলের জন্য এ ব্রিজটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকিস্তানি বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এর গুরুত্ব অনুধাবন করে যুদ্ধের প্রথম দিকেই (সঠিক তারিখ জানা যায় নি) ঘােড়াশাল রেল স্টেশনে ১টি ক্যাম্প স্থাপন করে এবং জুলাই মাসের শেষের দিকে ব্রিজটির দুই পার্শ্বে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্রহরী মােতায়েন করে। পাকিস্তানি। সেনাদের এ ধরনের মােতায়েনের ফলে এ এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল। ব্যাহত হয় এবং ঐ ক্যাম্পে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন ও তাদেরকে নির্যাতন করে। অন্যদিকে, অসামরিক প্রশাসন সচল থাকায় বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি বাধাগ্রস্ত হয়। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে নরসিংদী এলাকায় যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধা কাদির প্রথমে ব্রিজটি ধ্বংসের চেষ্টা চালান। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতার কারণে সে চেষ্টা সফল হয় নি। তখন মুক্তিযােদ্ধা কাদির বুঝতে পারেন যে, ব্রিজ ধ্বংসের আগে রেল স্টেশনের। ক্যাম্পে রেইড করতে হবে। এ যুদ্ধের সঠিক তারিখ ও সময় জানা যায় নি, তবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী আগস্টের প্রথম সপ্তাহে এ রেইড পরিচালনা করা হয়।
লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান ও পরিকল্পনা
ঘােড়াশাল রেলসেতুর ঠিক পূর্ব পাশেই রেল স্টেশন অবস্থিত। রেল স্টেশনটি পাশের এলাকা থেকে আনুমানিক ৪০ ফুট উপরে অবস্থিত। ঐ এলাকায় আর কোনাে প্রাধান্য বিস্তারকারী ভূমি ছিল না। তাই ঐ ক্যাম্পে রেইড করা ছিল একটি দুঃসাহসিক কাজ। তা ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উচ্চ মনােবলের কারণে এ রেইড করার পরিকল্পনা করেন। দলের অধিনায়ক মুক্তিযােদ্ধা কাদির তার। সহযােদ্ধাদের নিয়ে রেল স্টেশনের পূর্ব দিকে রেললাইনের পার ঘেঁষে রেললাইনের উপর পশ্চিম দিকে মুখ করে অবস্থান গ্রহণ করার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তারা প্রহরীকে নীরবে নিরস্ত্র করে রেল স্টেশনের ভিতরে বিশ্রামরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন।
যুদ্ধের বর্ণনা
মুক্তিযােদ্ধা কাদির প্রায় ১২০জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে রেল স্টেশনে রেইড করেন। পাকিস্তানি সেনাদের জনবল, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক অস্ত্রের বিস্তারিত তথ্য জেনেও কেবল মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার দৃঢ়সংকল্পের জন্যই মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্প রেইড করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা রেল স্টেশনের পূর্ব পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। কিন্তু তাঁরা নীরবে প্রহরীকে নিরস্ত্র করতে ব্যর্থ হন, ফলে দুই পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরু হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টা গুলি বিনিময়ের পরও মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পটি দখল করতে ব্যর্থ হন। এদিকে ঘােড়াশালের পূর্ব দিকে জিনারদি রেল স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প ছিল। সেদিক থেকেও পাকিস্তানি সেনাদের সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা থাকায় এবং ৬ ঘণ্টায় তেমন কোনাে ফলাফল অর্জন করতে পেরে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন।
ফলাফল
ঐ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি এবং পাকিস্তানি সেনাদেরও কোনাে ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ জানা যায় নি। এতে আপাতদৃষ্টিতে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনাে বিজয় না হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ঘটনার পর ঐ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের অপকর্মের তৎপরতা। কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। তাদের মধ্যে একটি ভীতি কাজ করছিল এবং মনােবল কমে গিয়েছিল। এভাবেই দিন যত যেতে থাকে, ততই পাকিস্তানি সেনাদের উপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বেড়ে যায়। অন্যদিকে, এসব ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্বাধীনতা যুদ্ধের গুরুত্ব বাড়তে থাকে এবং আমাদের স্বাধীনতা অর্জন সহজতর হতে থাকে।
চিনিষপুর তিতাস গ্যাস সাব-স্টেশনে রেইড
সাধারণ মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি যাতে পাকিস্তান সরকার অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে না পারে অথবা বহির্বিশ্বে বাংলাদেশে যে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে না, তার প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার জন্য অথবা পাকিস্তান সরকার, বেসরকারি বা ব্যবসায়ী মহলকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন। ধরনের কর্মকাণ্ড করতেন। চিনিষপুরে তিতাস গ্যাস সাব-স্টেশন রেইড তারই একটি অংশ। উদ্দেশ্য ঢাকা-সিলেট গ্যাস সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। যুদ্ধের স্থান ও সময় চিনিষপুর তিতাস গ্যাস সাব-স্টেশনটি নরসিংদী রেল স্টেশনের ১.৫ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে এবং ভেলানগর বাজার থেকে ১ কিলােমিটার। দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ঘটনার সঠিক তারিখ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে ঐ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা আবদুর রশিদ ভূইয়ার মতে সেপটেম্বর মাসের। প্রথম সপ্তাহে রাত আনুমানিক ৯টার সময় উল্লিখিত ঘটনাটি ঘটে। পটভূমি/পরিস্থিতি নরসিংদী সদর থানা এলাকায় প্রায় সব ছােটো-বড়াে খণ্ডযুদ্ধগুলাে নেভাল সিরাজের অংশগ্রহণ কিংবা পরিকল্পনায় সংগঠিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সাথে পাকিস্তান সরকারকে বিপদে ফেলাই ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান উদ্দেশ্য। সেপ্টেম্বর মাসে হানাদার বাহিনী যখন। নরসিংদীতে তাদের অবস্থান পাকাপােক্ত করে মুক্তিযােদ্ধাদের সমূলে নির্মূল করা নিয়ে ব্যস্ত এবং পাশাপাশি বহির্বিশ্বে প্রচার করছিল যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ অবস্থায় যে-কোনাে ধরনের ছােটো অভিযান। পরিচালনা করে মুক্তিযুদ্ধ যে চলছে, তা প্রমাণ করা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। যুদ্ধের বর্ণনা চিনিষপুর তিতাস গ্যাস সাব-স্টেশনটি নিরাপত্তার জন্য কোনাে পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গার্ড দেওয়া অথবা কোনাে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয় নি।
এ অবস্থায় নেভাল সিরাজের পরিকল্পনা ও আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ঐ রেইডটি পরিচালনা করা হয়। এদিন আনুমানিক ৯টার সময় উল্লিখিত গ্যাস সাব স্টেশনের ২০০ গজ উত্তর দিকে ইদগা মাঠে আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে মােট ৫জন (আবদুর রশিদ ভূঁইয়া, খান মাহমুদ, মতিউর রহমান, নজরুল খন্দকার) একত্র হন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আবুল কালাম আজাদ ও আবদুর রশিদ ভূঁইয়া গ্যাস পাইপ সংযােগে এক্সপ্লোসিভ বা বিস্ফোরক স্থাপন করেন এবং সাথে সংযোগকারী তার বিস্ফোরকের সাথে সংযােগ দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যান। পরবর্তী সময় সবকিছু সুষ্ঠুভাবে নিরীক্ষা করে তারের মাথায় আগুন লাগিয়ে ঐ গ্যাস সংযােগটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করা হয়। কথিত আছে যে, গ্যাস বিস্ফোরণের আগুনের লেলিহান শিখা ৩০-৪০ কিলােমিটার দূর থেকে খালি চোখে দেখা যেত। ফলাফল ঢাকা-সিলেট গ্যাস সংযােগ সম্পূর্ণভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং আশপাশের এলাকাগুলাে গ্যাস সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হয়। ঐ রেইডে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনােরূপ ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: শান্তিকালীন ও যুদ্ধকালীন সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলাের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা উচিত। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানি। সেনারা নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। মুক্তিবাহিনী: দূরদর্শিতা এবং সার্বিক ও সুষ্ঠু পরিকল্পনার ফলেই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে চিনিষপুর গ্যাস সাব-স্টেশনটি উড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। যার ফলে পাকিস্তানি সেনাদের মনােবল ভেঙে যায়। এবং একই সাথে পাকিস্তান সরকার সাময়িকভাবে বিচলিত হয়।