You dont have javascript enabled! Please enable it! কাঁচপুর ব্রিজের কাছে রাজাকারের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার - বানিয়াদী অ্যালাইড জুট মিলের অপারেশন - বৈদ্যের বাজার (সােনারগাঁও) থানা শত্রুমুক্ত - রেললাইন অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
কাঁচপুর ব্রিজের কাছে রাজাকারের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার
ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে আনুমানিক ২০ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়কের শীতলক্ষ্যা নদীর উপর কাঁচপুর ব্রিজটির অবস্থান। একাত্তরে কাঁচপুর ব্রিজটি ছিল না। নৌকা দিয়ে নদী পার হতে হতাে। ১১ ডিসেম্বর কাচপুর ব্রিজের পূর্ব পার্শ্বে নদীর ঘাটে ১জন রাজাকার ও ১জন পাকিস্তানি পুলিশ বাজার করে যাওয়ার সময় নৌকায় ওঠার আগে মুক্তিযােদ্ধা আবুল হােসেন, বারেক মিয়া, আহসান উল্লা, মােস্তফা ও হােসেন মিয়া মিলে রাজাকার ও পুলিশকে পানিতে ডুবিয়ে মেরে ফেলেন। ২টি রাইফেল ও ৪০ রাউন্ড গুলি এবং পাকিস্তানি পুলিশের ব্যাজ ও পােশাক উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা স্লোগান দিতে দিতে ঐ স্থান ত্যাগ করেন।
বানিয়াদী অ্যালাইড জুট মিলের অপারেশন
রূপগঞ্জ থানাধীন শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে বানিয়াদী নামক স্থানে অ্যালাইড জুট মিলে ১২জন পাকিস্তানি সৈন্য মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে ১টি ক্যাম্প স্থাপন করে। ক্যাম্প স্থাপনের পর থেকেই তারা মিল এলাকার পার্শ্ববর্তী গ্রামে হানা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের হয়রানি এবং ছাগল, খাসি, মুরগি, যা কিছু চোখের সামনে পড়ে, সবকিছু গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক নিয়ে আসত। এভাবে অনেক অকথ্য নির্যাতন ডিসেম্বরের পূর্ব পর্যন্ত এলাকাবাসী নীরবে সহ্য করতে থাকে। ১২ ডিসেম্বর মাে, এনায়েত আলীর নেতৃত্বে ১০জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল রাত ২টায় অ্যালাইড মিলের শত্রু ক্যাম্পে ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে আর কোনাে গােলাগুলি না হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদেরও একই ভূমিকায় থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। সতর্কতার সাথে শত্রু সৈন্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানানাে হলে তাদের পক্ষ থেকে আরও সময় চাওয়া হয়। ততক্ষণে কাজে যােগদানের। উদ্দেশ্যে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাে থেকে শত শত শ্রমিক জুট মিল এলাকায় সমবেত হন। সমবেত শ্রমিকেরা ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে” শ্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত করে তােলেন। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি অধিনায়ক শাহ মােহাম্মদ খান মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মাে. এনায়েত আলীর সাথে আলােচনায় বসতে সম্মত হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই অধিনায়কের হুকুমে ৬টি রিভলভার, ৮টি চাইনিজ রাইফেল ও ৫ বাক্স গােলাবারুদ জমা দেয় এবং ১০জন পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। অপর ২জন সৈন্য রাত্রিকালীন যুদ্ধে নিহত হয়। আত্মসমর্পণকারী শত্রু সৈন্যদের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত অ্যালাইড জুট মিলের অফিস ভবনে মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বক্ষণিক প্রহরায় আটক রাখা হয়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন মােতাবেক আত্মসমর্পণের পর তাদের প্রতি সে, আচরণই করা হয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর আটককৃতদের সতর্ক প্রহরায় ঢাকায় আত্মসমর্পণকারীদের ক্যাম্পে পৌছে দেওয়া হয়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. মাে. এনায়েত আলী ২. মাে, আমানউল্লাহ। ৩. জাহিদুল হক। ৪. নাছির উদ্দিন ৫. মেজবাহ উদ্দিন ৬. জজ মিয়া ৭. মাে. মান্নান ৮, আচাল উদ্দিন ৯. সিরাজ উদ্দিন ১০. মাে. আলী হােসেন প্রমুখ।
বৈদ্যের বাজার (সােনারগাঁও) থানা শত্রুমুক্ত
১২ ডিসেম্বর তৎকালীন বৈদ্যের বাজার থানাকে শত্রুমুক্ত এলাকা ঘােষণা করা হয়। বৈদ্যের বাজার থানার মুক্তিযােদ্ধারা আদমজী ও সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজ মুক্ত করার জন্য আদমজী নগরের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউজে আক্রমণ চালান এবং আদমজী নগর আক্রমণের জন্য সামনে। অগ্রসর হতে থাকেন। সারাদিন শক্রর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি বিনিময় হয় এবং শেষ পর্যন্ত শত্রুর আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে। বাধ্য হন। ঐ যুদ্ধে তকালীন বৈদ্যের বাজার থানার ৯জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং ৪জন আহত হন। শহিদদের আদমজীতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা কবর দেয়। আদমজীর সম্মানদী ইউনিয়ন, বৈদ্যের বাজার ইউনিয়ন, বারদী ইউনিয়ন, নােয়াগাঁও ইউনিয়ন, জামপুর ইউনিয়ন ও সাদিপুর ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রাম মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় কেন্দ্র ও নিরাপদ দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। ১২ ডিসেম্বরের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও ১৩ ডিসেম্বর শক্তি সঞ্চয় করে পুনরায় শত্রুর উপর আক্রমণ করে বৈদ্যের বাজার শত্রুমুক্ত করা হয় । ১৩ ডিসেম্বর আক্রমণে ৫-৬জন শত্রু হতাহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। কলাগাছিয়া অপারেশন বন্দর থানার কলাগাছিয়ার নিকটস্থ চৌধুরী রাইস মিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের ১টি ক্যাম্প ছিল। পার্শ্ববর্তী শীতলক্ষ্যা নদীতে ১টি গানবোেট যৌথ বাহিনীর গােলায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুক্তিযােদ্ধা মফিজের নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের ১টি দল লাঙলবন্দ থেকে কলাগাছিয়া যায়। ১৩ ডিসেম্বর ঐ দলের সাথে শত্রুর সারারাত গুলি। বিনিময় হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে আনুমানিক ৫জন শত্রু সৈন্যের মৃত্যু হয়। অতঃপর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে তারা ঐ এলাকায় বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে। পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. ফিজউদ্দিন কালু ২. বাচ্চু ৩. হাশেম ৪, নূর মােহাম্মদ ৫. নুরুল হক ৬, আ, ছাত্তার (মরণ) ৭. আবুল হাশেম ৮. কাশেম ৯, ফালা। ১০. আক্কাছ ১১. আজাদ বক্স মােল্লা ১২. রমজান ১৩. লালু। ১৪, কানুচন্দ্র আইচ ১৫. সুলতান ১৬. নুরুল হুদা।
রেললাইন অপারেশন
১৪ ডিসেম্বর চারদিকে যুদ্ধের তীব্রতা আর স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে প্রচার থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় বিজয় নিশ্চিত। চারদিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যদের চরম বিপর্যয়ের খবর মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আসতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল তখন তুঙ্গে। ১১ ডিসেম্বরের পূর্বে আগরতলা থেকে একের পর এক সংবাদ আসছে মিত্র বাহিনী অচিরেই মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যুক্ত হয়ে শত্রুর মােকাবেলা করবে। ১১ ডিসেম্বর সকালবেলা সংবাদ আসে পূর্ণ প্রস্তুতি নেয়ার জন্য, কারণ, যে-কোনাে সময়ে দাউদকান্দি থেকে মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা। মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্পে অবস্থান নিতে পারে। তাই গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে সেদিন মুক্তিযােদ্ধারা প্রস্তুত হয়ে থাকেন। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, মিত্র বাহিনীর প্রথম অগ্রগামী দল এসে উপস্থিত। মুক্তিযােদ্ধাদের সবুজ সংকেত পেয়ে মিত্র বাহিনীর আগমন শুরু হলাে। ১ দিনের মধ্যেই ২ প্লাটুন সৈন্য এসে কাইকারটেক নামক স্থানে। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে রিপাের্ট করতে শুরু করে। দ্বিতীয় দিনে আবারও বাকি ২ প্লাটুন মিত্র বাহিনীর সৈন্য এসে মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগদান করেন। ১৫ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় তারা এপি সিংয়ের নেতৃত্বে ৪টি গ্রুপে চারদিকে রেকি করতে বের হয়ে যায়। ১ম গ্রুপ গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে এবং ২য় গ্রুপ সাহাবুদ্দিন খান সবুজ ও এপি সিংয়ের নেতৃত্বে বন্দরের কোন কোন স্থানে। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি আছে, তা দুপুর ১টার মধ্যে রেকি সম্পন্ন করে আসে। পরে গিয়াসউদ্দিনকে নিয়ে এপি সিং ও ৪ গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারা বিকাল ৩টায় বৈঠকে মিলিত হয়।
১৫ ডিসেম্বর বিকাল সাড়ে ৪টায় অপারেশনের উদ্দেশ্যে সর্বমােট সাড়ে ৫ প্ল্যাটুন মুক্তিযােদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সেনারা একত্র হয়ে শত্রু ক্যাম্পে হামলার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। দীর্ঘ ১৮ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধের পর পূর্বাঞ্চল কমান্ডের ৪টি এলাকা যৌথ বাহিনীর দখলে আসে। এলাকাগুলাে হলাে: ক, মদনগঞ্জ রেললাইন ক্রস পয়েন্ট। খ, মদনপুর চৌরাস্তা জংশন। গ. কুড়িপাড়া রেল স্টেশন থেকে গােকুল দাসের বাগের চৌরাস্তা পর্যন্ত। ঘ, বন্দর ও কলাবাগ ক্রস পয়েন্ট থেকে নবীগঞ্জ রেল স্টেশন পর্যন্ত। যুদ্ধে মিত্র বাহিনীর ৮জন সৈন্য শহিদ হয় এবং মিত্র বাহিনী ও দাউদকান্দি মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক কাওছারসহ মুক্তিবাহিনীর ২৫জন আহত হয়। মিরকুণ্ডী নামক স্থানে রাস্তার পাশে মিত্র বাহিনীর শহিদ হওয়া ৮জন সৈন্যের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়। শত্রুর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বরে সকাল ১১টায় স্বাধীনতার বিজয় ঘােষণা করা হয়। এ যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে সাহাবুদ্দিন খান সবুজের দল, মাে. সেলিমের দল, মাে, আ, আজিজের দল, তপনের দল, হাজি গিয়াসউদ্দিনের দলসহ বহু মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড