গাজীপুর জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আয়তন: ভাওয়াল অঞ্চল হিসেবে খ্যাত গাজীপুর জেলার আয়তন ১,৭৪১.৫৩ বর্গকিলােমিটার। উত্তরে ময়মনসিংহ ও কিশােরগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী জেলা, পূর্বে নরসিংদী জেলা, পশ্চিমে ঢাকা ও টাঙ্গাইল জেলা। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বংশী, বালু, বানার এ জেলার প্রধান নদনদী। চিলাই নদীর (অবলুপ্ত) দক্ষিণ তীরের পীরাবাড়ি গ্রামটিতে ভাওয়ালের জমিদার জয়দেব নারায়ণ রায়চৌধুরী নিজ বাসগৃহ নির্মাণ করেন। এবং নিজের নামানুসারে এর নাম দেন জয়দেবপুর। ১৮৭৮ সালে কালী। নারায়ণ রায়চৌধুরী রাজা’ খেতাব পান এবং তখন থেকে জয়দেবপুরের। জমিদারবাড়ি রাজবাড়ি’ হিসেবে খ্যাত হয়। বর্তমানে এ ভবনে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় এবং জেলা জজকোর্ট স্থাপিত হয়েছে। পর্যায়ক্রমে গাজী। পীরের নামানুসারে এ জেলার নাম হয় গাজীপুর। বিখ্যাত ভাওয়ালের গড় এ জেলায় অবস্থিত। এ গড়ের গজারি কাঠ পৃথিবী বিখ্যাত। তবে এখন আর সে। বনে তেমন গজারি গাছ নেই। প্রশাসন: গাজীপুর জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। গাজীপুর সদর, কালিয়াকৈর, কালীগঞ্জ, কাপাসিয়া ও শ্রীপুর – এ ৫টি উপজেলা, ৪৬টি ইউনিয়ন, ৭১০টি মৌজা, ১১৬৩টি গ্রাম, ২টি পৌরসভা নিয়ে গাজীপুর জেলার প্রশাসনিক এলাকা গঠিত হয়েছে। উল্লেখযােগ্য প্রতিষ্ঠান: যেসব প্রতিষ্ঠান গাজীপুর জেলাকে উজ্জল করেছে সেগুলাে হলাে, বাংলাদেশ ধান গবেষণা কেন্দ্র (BRRI), বাংলাদেশ কৃষি। গবেষণা কেন্দ্র (BARI), সার্ডি, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, সিকিউরিটি প্রিন্টিং, মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি, সমরাস্ত্র কারখানা, ডিজেল প্লান্ট, বিআইটি, ব্র্যাক ডেইরি, শ্মশানঘাট ইত্যাদি অবস্থিত।
মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ও বধ্যভূমি: জয়দেবপুর রাজবাড়ির পূর্ব পাশের পুকুর, সাতখামাইর, টঙ্গী শহিদ স্মৃতি স্কুল প্রাঙ্গণ, গাছার বধ্যভূমি, জয়দেবপুর চৌরাস্ত রি মােড়ে স্থাপিত ‘জাগ্রত চৌরঙ্গী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য। রাজবাড়িতে জয়দেবপুর মুক্তিযুদ্ধ স্মারক ভাস্কর্য মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে। | বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব: গাজীপুরবাসী তথা সমগ্র দেশ যাদের সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করে, তারা হলেন: মেঘনাদ সাহা (বিজ্ঞানী), গােবিন্দচন্দ্র দাস (কবি), তাজউদ্দিন আহমেদ (রাজনীতিবিদ ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী), শামসুল হক (মুক্তিযােদ্ধা ও রাজনীতিবিদ), রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ (জমিদার), রামেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী (জমিদার), নরেন্দ্র নারায়ণ চৌধুরী (জমিদার, ঢাকার বলধা। গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা)।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, রাজবংশী (কোচ), গারাে, মান্দী। প্রভৃতি জনগােষ্ঠী এ জেলায় বাস করেন। এ জেলায় ২,৭৩০টি মসজিদ, ১৪৩টি মন্দির, ১২টি গির্জা, ৬টি তীর্থস্থান এবং ৪টি মাজার আছে। | শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: এ জেলায় ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়, ২টি কারিগরি ইনস্টিটিউট, ৪টি কৃষি সম্পর্কিত ইনস্টিটিউট, ৩টি কলেজ (সরকারি), ১৯টি কলেজ (বেসরকারি), ১০৮টি মাদ্রাসা, ৩টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (সরকারি), ২৫৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় (বেসরকারি), ৩৯টি নিমমাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৫৩২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় (সরকারি), ১৭৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় (বেসরকারি), ১টি প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, ১টি স্কাউট ট্রেনিং সেন্টার (মৌচাক), ১টি মাদ্রাসা টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ১টি টেলিযােগাযোেগ স্টাফ কলেজ, ১টি কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং ১টি কিশাের অপরাধী সংশােধনী কেন্দ্র রয়েছে। | প্রধান কৃষি ফসল: ধান, পাট, সরিষা, আখ, মরিচ, কচু, হলুদ, আদা ইত্যাদি জেলার প্রধান ফসল। প্রধান রপ্তানি দ্রব্য: বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফল, ঔষধ, কসমেটিকস, সিগারেট, অ্যালুমিনিয়াম, তৈরি পােশাক, মশার কয়েল, পানীয় ইত্যাদি। স্বাস্থ্যকেন্দ্র: ১টি জেলা সদর হাসপাতাল, ৫টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ৩০টি স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র, ৫টি বেসরকারি হাসপাতাল, ২টি আনসার একাডেমি ও সমরাস্ত্র কারখানা হাসপাতাল, ১৫টি উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ৭টি ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ১টি মিশনারি হাসপাতাল, ১০টি এনজিও স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ফুলবাড়িয়ার যুদ্ধ গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানার উত্তরে টাঙ্গাইল জেলার সীমান্তে ফুলবাড়িয়া বাজার অবস্থিত। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ফুলবাড়িয়া বাজারে রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর তৎপরতা ভীষণভাবে বৃদ্ধি পায়। স্থানীয়। চেয়ারম্যানের বাড়িটি ছিল ফুলবাড়িয়ার রাজাকারদের একটা শক্ত ঘাঁটি। লুটতরাজ ও ধরপাকড় ছিল এদের প্রধান কাজ। কিন্তু এ অত্যাচার আর সহ্য। করা যায় না। তাই মুক্তিবাহিনীর দামাল ছেলেরা স্থির করলেন যে, স্থানীয় ২টি রাজাকার ঘাটি এক দিনে এবং একই সঙ্গে আক্রমণ করতে হবে।
এ ২টির ১টি ছিল চেয়ারম্যানের বাড়িতে, অপরটি ছিল বাজারের দক্ষিণ প্রান্তে। মুক্তিবাহিনীর কোম্পানি অধিনায়ক আবুল কালাম আজাদ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১জন সৈনিক। ২টি দলে ভাগ করে এক দলের উপর ভার দিলেন। চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ ও রাজাকারদের জীবিত অবস্থায় পাকড়াও করবে। এবং অপর দল বাজারের দক্ষিণ দিকের ঘাঁটিটি আক্রমণ করে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের খতম করে দেবে। দুই জায়গায় একই সঙ্গে আক্রমণের উদ্দেশ্য – কোনাে ঘাঁটিতে যেন সাহায্য না আসতে পারে। পরিকল্পনা অনুসারে মুক্তিযােদ্ধারা গভীর রাতে নিজ নিজ অবস্থানে হাজির। হয়। যারা চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ করার দায়িত্বে ছিলেন তাদের মধ্যে ১জন ক্রলিং করে যে ঘরে রাজাকাররা ছিল সে ঘরের জানালার কাছে গেলেন এবং জানালা দিয়ে ২টি গ্রেনেড ভিতরে নিক্ষেপ করলেন। আর ২জন বাইরে দরজার কাছে অবস্থান নিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলাে না, অধিকন্তু রাজাকারদের ঘুম ভেঙে গেল। রাজাকারদের। পাহারায় নিযুক্ত ব্যক্তি গুলি চালাতে শুরু করল। এলােপাতাড়ি গুলিতে কাছে। অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধা আজিজ গুলিবিদ্ধ হলেন। ইতােমধ্যে উভয়পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় শুরু হলাে। কিন্তু অবস্থা মুক্তিবাহিনীর অনুকূলে মনে হলাে না। তবুও মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটলেন না, আজিজের লাশ তাঁদের উদ্ধার করতেই হবে। দক্ষিণ দিকের ঘাঁটির কাজ শেষ করে অধিনায়ক আবুল কালাম ছুটে এলেন এবং আজিজের লাশ উদ্ধারের জন্য নতুনভাবে আক্রমণ শুরু করলেন। মুক্তিযােদ্ধা জামান শক্রর গুলি বর্ষণের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে আজিজের লাশ টেনে আনতে লাগলেন আর আবুল কালাম কভারিং ফায়ার দিয়ে জামানকে রক্ষা করতে লাগলেন।
কিন্তু বিপৎসীমার বাইরে আসতে না আসতে শক্রর ১টি গুলি। জামানের পায়ে এসে লাগে। তখন তাঁকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেলেন আরেকজন মুক্তিযােদ্ধা। দুর্ভাগ্যবশত তিনিও আহত হন। কিন্তু তারা তাদের প্রিয় সঙ্গী আজিজের লাশ উদ্ধার করে আনলেন শেষ পর্যন্ত। এ যুদ্ধে রাজাকারদের পক্ষে ১জন নিহত ও ৮জন আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ১জন শহিদ এবং ২জন আহত হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড