একীভূত বাংলা আরো খারাপ হতে পারে
মিসেস গান্ধী দুই বাংলাকে একীভূত করার আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য শক্ত অবস্থানে রয়েছেন — অন্তত এই মুহূর্তে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার বিষয়ে তার সকল বক্তব্য সত্ত্বেও, মিসেস গান্ধীর মনে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জন্য গোপন একটু সহানুভূতি থাকতেও পারে। তিনি জানেন ‘বাঙালি সমস্যা’ থাকার কি মানে; কিছুদিন আগ পর্যন্তও তাঁর জন্য সেটি ছিল দীর্ঘদিন ধরে বিশৃংখল হয়ে থাকা পশ্চিমবঙ্গ, যেটি কিনা সামরিক দমননীতির জন্য উপযোগী ছিল, এর পাকিস্তানি প্রতিবেশীর চেয়ে অনেকটাই বেশি আকারে। যদি বাংলা দেশের জ্বলন্ত মশাল ওই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের তেলের ড্রামে ছুঁড়ে দেয়া হতো তাহলে ফলাফল বিস্ফোরন্মুখ হতেই পারতো। সেই বিপদের আশঙ্কা আজও পুরোপুরি মিলিয়ে যায়নি। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পূর্ববঙ্গে অভিযান চালানোর সময়জ্ঞান ভারতের জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যশালী হয়েছে। এই অভিযানটি এমন সময় শুরু হয়েছে যখন ভারত সীমান্তের ওপার থেকে আসা যে কোন স্ফুলিঙ্গ থেকে বাঁচতে নিজেকে ইতিমধ্যেই পুরোপুরিভাবে ঢেকে নিয়েছে নিরাপত্তার চাদরে। শুধুমাত্র গতমাসের নিরঙ্কুশ নির্বাচন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে মিস্টার নেহেরুর মৃত্যুর পর সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করেছে তাইই নয়; এমনকি পশ্চিমবঙ্গও তার অংশের কাজটি করেছে গত চার বছরে এবারই প্রথম অ-বিপ্লবী সরকার গঠন করে।
পশ্চিমবঙ্গের নবগঠিত ছয়-দলীয় জোট এই রাজ্যের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের চূড়ান্ত উপায় মোটেও নয়। খুব সামান্য ব্যবধানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে: ২৭৬ টি সিটের মধ্যে মাত্র ১৪০ টি তাদের দখলে রয়েছে। এই জোটের নেতাও খুবই অনুদ্দীপক একজন ব্যক্তি: মিস্টার অজয় মুখার্জি, যিনি কিনা ধারাবাহিকভাবে নিন্দিত একাধিক যুক্তফ্রন্টের রণ-ক্লান্ত প্রবীণ নেতা। এই জোটের অসামঞ্জস্যগুলো এরমধ্যেই দেখা দিতে শুরু করেছে: নবপ্রতিষ্ঠিত সরকার ‘গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ দমন করার জন্য পুলিশ ব্যবহার করবে না মস্কো-পন্থী কমিউনিস্টের উত্থাপিত এরকম একটি দাবি স্থানীয় কংগ্রেস পার্টি ইতিমধ্যেই প্রত্যাখ্যান করেছে। কিন্তু এতসব সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ১৯৬৭ এবং ১৯৭১ সালে সংগঠিত সাধারণ নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে যে যুক্তফ্রন্টগুলো এই রাজ্যটি শাসন করার চেষ্টা করেছে তাদের চেয়ে এই নবগঠিত সরকারের দুটি বড় সুবিধা রয়েছে: মিসেস গান্ধীর কংগ্রেস পার্টির একটি প্রভাবশালী ব্লক এই জোটের অংশ এবং মার্কসবাদীরা এই জোটের বাইরে রয়েছে।
এই জোটে মিসেস গান্ধীর বাঙালি সহকর্মীদের অন্তর্ভূক্তির মানে হচ্ছে এর টিকে থাকার মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকারের কায়েমী স্বার্থ থাকবে। কিন্তু এই দায়িত্বটি দুই দিকেই কাজ করবে। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংযুক্ত থাকার কারণে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সেইসব একই সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হবে যেগুলো মিসেস গান্ধীর হাত বেঁধে রেখেছে পূর্ব বাংলার বর্তমান সঙ্কটে। যতক্ষণ পর্যন্ত ভারতীয় সরকার শুধুমাত্র কঠোর ভাষায় প্রতিনিয়ত তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে – এবং ভাগ্য সহায় হলে, পাকিস্তানের তরফ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের ক্রমাগত অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও, বাক্যবাণ এর চেয়ে তা আর বেশি দূর আগাবে না – তখন পশ্চিমবঙ্গের কতৃপক্ষ তাদের পূর্ব বাঙালি ভাইদের সাথে অন্য আর কোন উপায়ে একাত্মতা ঘোষণা করার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হবে।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার থেকে মার্কসবাদীদের বাদ পড়ে যাওয়ার মানে হচ্ছে এই বিপ্লবী দলটি পুলিশের উপর তাদের নিয়ন্ত্রন থেকেও বঞ্চিত হবে; ক্ষমতায় থাকাকালীন এই বিষয়টি তাদেরকে সাহায্য করেছে ব্যবসায়ী, জমিদার এবং অন্য রাজনীতিকদের হুমকির মুখে রাখতে। কিন্তু মার্কসবাদীদের ক্ষমতা যদিবা কিছুটা কমেও গিয়ে থাকে, তা একেবারে নিঃশেষ হয়ে যেতে আরো অনেক দেরি আছে; যত যাই হোক, মার্কসবাদীরা গত নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুধুমাত্র সবচেয়ে বড় দল হিসেবে উঠে এসেছে তাইই নয় বরং তারা কেন্দ্রীয় সংসদের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের উপর এইটুকু আস্থা রাখা যায় যে, হতাশার দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে, তারা তাদের সব সম্পদ এমন একটি আন্দোলনে ঢালবে যা দিয়ে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানো যায়। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের আকস্মিক উদগীরণ তাদেরকে হয়তো অন্য একটি, আরও বৃহত্তর লক্ষ্যে, নিয়োজিত করবেঃ তা হচ্ছে গণপ্রজাতন্ত্রী বৃহত্তর বাংলার সৃষ্টি।
এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিবিদরা সবাই প্রায় একই সুরে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর বিষয়ে। বস্তুত, স্থানীয় কংগ্রেস পার্টির নেতা এবং নবনিযুক্ত উপ-মুখ্যমন্ত্রী, বিজয় সিংহ নাহার, যিনি কিনা পূর্ব বাঙালিদের সাহায্য করার জন্য একটি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের ডাক দিয়েছেন, তার কন্ঠস্বর আরো জোরালো শোনাচ্ছে মার্কসবাদী নেতা, জ্যোতি বসুর চেয়েও, যিনি চান ভারতীয় সরকার স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাদেরকে অস্ত্র পাঠাবে। পশ্চিমবঙ্গের নকশাল এবং মার্কসবাদীরা পূর্ববঙ্গে তাদের সমমনা দলগুলোকে সাহায্য পাঠাবে এমন কোন সংবাদ নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত দুই বঙ্গের মাঝখানের ৬৫০-মাইল দীর্ঘ সীমান্ত খোলা থাকবে – এবং এই সীমান্ত বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব – পশ্চিম থেকে এই ধরনের সাহায্য যাওয়া হয়তো অবশ্যম্ভাবীই। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে পশ্চিমবাংলার মার্কসবাদীরা এবং পূর্ব পাকিস্তানে তাদের বন্ধুরা, পরবর্তী যৌক্তিক পদক্ষেপটি নেবে কি-না।
এই কাজটি করার লোভ সামলানো খুবই কঠিন হবে। একীভূত বাংলা পাকিস্তানকে বিশ্বের পঞ্চম জনবসতিপূর্ণ দেশের অবস্থান থেকে বিচ্যুত করবে। না চীন না রাশিয়া- ভারত ও পাকিস্তানের সরকারের পেছনে তাদের পূর্ববর্তী সকল রাজনৈতিক বিনিয়োগ সত্বেও – সম্ভাব্য তৃতীয় একটি সমাজতান্ত্রিক দৈত্যকে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত থাকতে পারবে না যদি একীভূত বাংলার আন্দোলন সফলতার মুখ দেখার সম্ভাবনাও দেখা দেয়। সপ্তাহান্তে রাশিয়ানরা প্রথম বিদেশি শক্তি হিসেবে পাকিস্তানি সরকারের কাছে সরাসরি আবেদন জানিয়েছে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য। একটি একীভূত বাঙ্গালী প্রজাতন্ত্রের প্রতি তাদের সমর্থন ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের উপরই কূটনৈতিক চাপে পরিণত হতে পারে। চীনারা খুব সম্ভব বার্মার ভেতর দিয়ে অস্ত্র চোরাচালান করে নিয়ে আসবে।
বাঙালিদেরকে একীভূতকরনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে শুধুমাত্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সর্বশক্তি এবং সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বই নয় বরং একীভূত বাংলার ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন কর্তৃক বাংলাকে দুই ভাগ করার পর বাঙ্গালীদের আন্দোলন এতটাই তীব্র হয়ে ওঠে যে ব্রিটিশরা বাধ্য হয় তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে এবং ছয় বছর পর বাংলাকে আবার একীভূত করে দেয়। ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন একীভূত বাংলার ধারণার সাথে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত। ১৯৪৪ সালে এই দলের একজন মুখপাত্র মুসলিম লীগকে প্রস্তাব দেন যে এই উপমহাদেশকে তিনটি দেশে ভাগ করা হোকঃ ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলা। দুই বছর পর কমিউনিস্টরা বলে দেশভাগের মানে হচ্ছে “জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের এবং দেশ হিসেবে বাংলার অবলুপ্তি”। রাশিয়ানরাও ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত একীভূত বাংলার পক্ষে ছিল, যখন তারা ভারতীয় সরকারের সাথে আরো ভালো সম্পর্কের সুযোগ খুঁজতে শুরু করেছিল। তখন থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্টরা আঞ্চলিক বিশেষত্ব নিয়ে তাদের স্বর নিচু করে ফেলেছে। এখন শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদীরাই সত্যিকারের বাঙালি দেশপ্রেমিক হিসেবে নিজেদেরকে জাহির করছে।
অবশ্যই, কিছু জিনিস বাঙালিদেরকে একীভূত হওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকতে সাহায্য করছে। ১৯৪৭ সাল থেকে ভারতীয় এবং পাকিস্তানী হিসেবে এই দুই বাঙালি জাতি ভিন্ন ধরনের স্বার্থ গড়ে তুলেছে নিজেদের জন্য এবং একসাথে কাজ করার অভ্যাস হারিয়ে ফেলেছে। দুই দিকের বাঙালি জাতির মধ্যেই সেই সময়ে ভয়াবহ ধরনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে, তাই এই ধারণা করা যাবে না যে হিন্দু-মুসলিমের বিভেদ দূর করা যাবে শুধুমাত্র একীভূত বাংলা দেশের আশা দিয়ে। এবং না পশ্চিমে হিন্দুরা না পূর্বের মুসলমানরা বহিরাগত এক শাসকের বদলে অন্য আরেক বহিরাগত শাসকের সম্ভাবনাকে উৎসাহের সাথে মেনে নেবে। পূর্ব বাঙ্গালীদের পক্ষেই বরং এতসব ঝুঁকি নেওয়ার সম্ভাবনা বেশি, কেননা তারা ইতিমধ্যেই স্বাধীন পূর্ব বাংলা গঠনের শপথ নিয়েছে এবং সবধরনের সাহায্যের জন্য তারা মরিয়া হয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মার্কসবাদীরাও হয়তো এই পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত হবে। কিন্তু তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের যথেষ্ট পরিমান সামরিক শক্তি রয়েছে কিনা সেই ধারণার উপর।
এই মুহূর্তে, যখন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব-পাকিস্তানের বেশিরভাগ শহর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এবং মিসেস গান্ধী নয়াদিল্লিতে শক্ত অবস্থানে রয়েছেন, তখন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষভাবে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলার সম্ভাবনা তেমন একটা নেই। তাদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি যদি ফাঁস হয়ে যায় তাহলে তারা দু’দুটি সেনাবাহিনীর তোপের মুখে পড়বে – যে সুযোগের অপেক্ষায় ভারতীয় সরকার হয়তো অনেকদিন থেকেই ছিল। কিন্তু যদি পূর্ব বাংলার যুদ্ধ প্রলম্বিত গেরিলা যুদ্ধে পরিণত হয়ে যা থেকে বাঙালি বিজয়ের একটি ভালো সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং যদি মিসেস গান্ধী, জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হওয়ার পর, নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করেন, তখন হয়তো মার্কসবাদীদের হিসাব পাল্টে যাবে। এজন্যই হয়তো মিসেস গান্ধী মনে মনে আশা করবেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কর্তৃক পূর্ব বঙ্গের দমন-পীড়ন সফল হবে।
Source: The Economist, 10th April, 1971