মহাদেবপুর ব্রিজ অপারেশন
ঢাকা-আরিচা সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মহাদেবপুর নামক স্থানে মুক্তিযােদ্ধারা ১টি ব্রিজ ধ্বংস করেন, যা মহাদেবপুর ব্রিজ অপারেশন নামে পরিচিত। ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ছিল পাকিস্তানি। সেনাদের প্রধান যােগাযােগ মাধ্যম। এ পথ দিয়ে রসদ সরঞ্জামসহ পাকিস্তানি। সেনারা যাতায়াত করত। রণকৌশলগত দিক বিবেচনা করে এ ব্রিজটি ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজটি ধ্বংস করে। যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেন। এটি কোনাে সংঘবদ্ধ আক্রমণ ছিল না। বীর মুক্তিযােদ্ধা মােক্তার খানের নেতৃত্বে এ অপারেশন পরিচালিত হয়।
নিরালীতে খণ্ডযুদ্ধ
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া থানাধীন নিরালীতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক খণ্ডযুদ্ধ হয়। পাকিস্তানি সেনারা টাঙ্গাইল থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে ১টি নৌকাযােগে নিরালীর ভিতর দিয়ে আসার চেষ্টা করলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের প্রতিরােধ করে। প্রবল প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তানি সেনারা ধলেশ্বরী নদীর তীরে কেদারপুর গ্রামে। অবস্থান নেয় এবং গুলি বর্ষণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে ১জন পাকিস্তানি সেনা আহত হয়। পিছু হটে যাওয়ার সময় তারা ঐ আহত সৈন্যকে ফেলেই চলে যায়। ফলে সেখানেই সে মৃত্যুবরণ করে।
বায়নলিপুরের যুদ্ধ
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে উত্তরে অবস্থিত সাটুরিয়া থানায় বায়নলিপুরে পাকিস্তানি সেনাদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ঐ যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং পরিচালনা করেন মুক্তিযােদ্ধা মনজুর আহম্মেদ। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা পুনাইল তালুকদার এলাকায় ক্যাম্প করে অবস্থান করছিলেন। টাঙ্গাইলে ধাওয়া খেয়ে এক দল। পাকিস্তানি সেনা বায়নলিপুরের এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়, ঐ সংবাদ পাওয়ার পরই মুক্তিযােদ্ধারা ঐ বাড়ির চারদিক থেকে ঘেরাও করে গুলি বর্ষণ শুরু করেন। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে প্রায় আড়াই ঘন্টা যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে ৩জন পাকিস্তানি সেনা চাইনিজ জি-৩ রাইফেলসহ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। ২জন পাকিস্তানি সেনাকে দুর্ব্যবহারের জন্য সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয় এবং আমিন নামে অপর ১জনকে অস্ত্র মুক্ত করে রাখা হয় এবং দেশ। স্বাধীন হওয়ার পর তাকে ক্যাপটেন হালিম চৌধুরীর কাছে সমর্পণ করা হয়। এ যুদ্ধে স্থানীয় ১জন শহিদ এবং মুক্তিযােদ্ধা শাহজাহান আহত হন।
সাটুরিয়া থানা আক্রমণ-২
মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে উত্তর-পূর্বে টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর ও মির্জাপুর থানার সীমান্তে সাটুরিয়া থানা অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর মাে. আবদুল বাতেন ও দেলােয়ার হােসেন হারিছ ৩ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাসহ দৌলতপুর থানার কালিয়া বাজার স্কুলে অবস্থানরত ছিলেন। ৩টি কোম্পানি দিয়ে দৌলতপুর, ঘিওর ও নাগরপুর থানায় একযােগে আক্রমণ চালানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। কমর উদ্দিনের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী রাজাকারের সহযােগিতায় সাটুরিয়া এলাকায় গণহত্যা চালাবে। তারা ইতােমধ্যে বিভিন্ন গ্রাম ও এলাকা চিহ্নিত করে ফেলেছে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে দগ্রাম কলেজে এসে অবস্থান গ্রহণ করেন এবং সাটুরিয়া আক্রমণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। ঘিওর পৌঁছার পর পাকিস্তানি গণহত্যা পাটির সাথে ২০ নভেম্বর রাত ১০টার সময় মুখােমুখি সংঘর্ষ হয় এবং পাকিস্তানিরা নিজ অবস্থান প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। মাজারের কাছে পৌছার পর গাজীখালী খালের পাড় দিয়ে ১টি কোম্পানি উত্তর পার্শ্বে, ১টি কোম্পানি পশ্চিমে এবং ১টি কোম্পানি পূর্ব দিকে পাঠানাে হয় এবং পাকিস্তানি অবস্থান চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলা হয়। সারারাত বিরামহীন সংঘর্ষ চলে এবং ভাের ৬টার দিকে চন্দ্রাখালী খালের উপর ব্রিজের কাছে শক্রর মেশিনগানের ফায়ারে মুক্তিযােদ্ধা জিয়ারত আলী শহিদ হন। পাকিস্তানিদের উদ্ধার করার জন্য ঢাকা-আরিচা রাস্তা বরাবর গোলরা হয়ে পাকিস্তানি ১টি ব্যাটালিয়ন আসে। অবশেষে গােলন্দাজ ফায়ারের কভারে তারা নিজেদের প্রত্যাহার করতে সমর্থ হয়। এর মাধ্যমে সাটুরিয়া পাকিস্তানি ক্যাম্প চূড়ান্তভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসে। এ জন্য অত্র এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা প্রতি বছর দিনটি বিশেষ মর্যাদা ও গৌরবের সাথে উদ্যাপন করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড