You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.09 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | বিশ্বব্যাপী নিরক্ষতা দূরীকরণ অভিযান | জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল কি ভাদ্রে পাকবে? | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৯ই জানুয়ারী, বুধবার, ১৯৭৪, ২৪শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বিশ্বব্যাপী নিরক্ষতা দূরীকরণ অভিযান

বিশ্বব্যাপী প্রায় বয়স্ক নিরক্ষর ব্যক্তির সংখ্যা ৮০ কোটি। ইউনেস্কোর সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে এ কথা পরিবেশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী নিরক্ষরতা দূরীকরণের আট বছর মেয়াদী অভিযানের শেষ পর্বেও নিরক্ষর ব্যক্তির সংখ্যা ১০ কোটির মতো বেড়েছে। রাষ্ট্রসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় ১৯৬৬ সালে বিশ্বের নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযান শুরু হয়। পনেরোটি রাষ্ট্র এই অভিযানের জন্যে বেছে নেওয়া হয়। এই দেশগুলোর মধ্যে আটটি স্বশাসিত। এদেশগুলো হচ্ছে, ইকুয়েডোর, ইথিওপিয়া, ইরান, মাদাগাস্কার, মালি, সুদান, তানজানিয়া, আফগানিস্তান, কেনিয়া, নাইজেরিয়া ও জাম্বিয়া।
উল্লেখ যে, আন্তর্জাতিক পরামর্শ কমিটি গত বছরের শেষে তেহরানে এক বৈঠকে মিলিত হয়।
নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে আট বছরব্যাপী অভিযান চালিয়েও রাষ্ট্রসংঘের সহযোগিতায় গঠিত বিশেষ কমিটির পক্ষে বিশ্বব্যাপী বিশেষতঃ নির্বাচিত কয়েকটি দেশ থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপকে দূরীভূত করা করা সম্ভব হয়নি। বরং এ কয়েক বছরে নিরক্ষর ব্যক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ থেকে স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে, নিশ্চয়ই এমন কোনো গলদ কোথাও রয়েছে যার জন্যে নিরক্ষরতার অভিশাপ মুক্ত হওয়া সম্ভবপর হচ্ছে না। একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে, উন্নয়নশীল দেশেই নিরক্ষরতার সংখ্যা বেশী। এর অন্যতম কারণ হলো দারিদ্র্যের অভিশাপ। গাছের গোড়া কেটে পানি ঢালা যে কথা উন্নয়নশীল দেশগুলোর নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান চালানোও সেই কথা। শিক্ষার আলো পেতে হলে যেটুকু সময় ও আর্থিক সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন তা উন্নয়নশীল দেশের গরীব মানুষগুলোর নেই। সভ্যতার ধারা পিলহঁজ তারাই থাকে অন্ধকারে এই একটি মাত্র কারণে।
অথচ পাশাপাশি অন্য আরেকটি ছবি আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে ছবি হলো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর ছবি। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানও চালানো হয়েছে ও এখনো হচ্ছে। তাছাড়া আজ যে শিশুটির জন্ম হলো তার শিক্ষার দায়দায়িত্ব সরকারের। সরকার স্বহস্তে এ দায়িত্ব নেয়ার ফলে নিরক্ষরের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া দূরে থাকুক ক্রমশঃ হ্রাস পায়। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অন্য অবস্থা বিরাজমান। উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে আরো একটি সমস্যা বিদ্যমান। এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হয় শিক্ষার হার বৃদ্ধি পেলে। শিক্ষিত যুবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সেই সব শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের ক্ষমতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর নেই। অর্থনৈতিক বৈষম্য, শাসন ও শোষণের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষ তাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এতে সমস্যা বাড়ে বৈ কমে না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সিংহলে স্নাতক শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করার পর এমনি সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে। এতে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, নিরক্ষরতা দূরীকরণ অভিযানের সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থাও জড়িত। শুধুমাত্র এক পেশে নীতি অবলম্বন করে নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে যে সফলকাম হওয়া যাবে না আট বছরব্যাপী নিরক্ষরতাবিরোধী অভিযানই তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল কি ভাদ্রে পাকবে?

দেশে সবুজ বিপ্লব আনতে বা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে আমাদের বা আমাদের কর্তৃপক্ষের উৎসাহ, গালভরা বুলি আর পরিকল্পনার অন্ত নেই। কিন্তু, ঐ পর্যন্তই এর পরে যে বিষাদ চিত্র তা’ আমাদের সবারিই জানা আছে।
যে কোনো উৎসাহের প্রকৃত অভিপ্রকাশের জন্যে যে কয়েকটি কষ্ট স্বীকারের প্রয়োজন আছে কিংবা যে কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার জন্যে যে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ, পূর্ব প্রস্তুতি ইত্যাদির প্রয়োজন আছে, তা’ আমাদের মাথার মণিরা জেনেও জানেন না। ফলে, আমাদের যতোই উৎসাহ আর পরিকল্পনা থাকুক না কেন, শেষ পর্যন্ত বিদেশ থেকে খয়রাত করে আমাদের দেশের মানুষকে খাওয়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। আর এমন বিদেশ নির্ভরশীলতা আমাদের একটি নিয়মিত জাতীয় ফ্যাশন বা বৈশিষ্ট্য হিসেবে গড়ে উঠেছে। অথচ, আমরা নিজেরাই যে এক্ষেত্রে এক গগণচুম্বী সম্পদ ও সম্ভাবনার মালিক তা’ আমরা জেনেও লক্ষ্য করিনা। ধিক, আমাদের এ দৈন্য বা দীন মানসিকতা।
গতকাল একটি স্থানীয় দৈনিকে ‘ইরি চাষীরা উদ্বিগ্ন’ শিরোনামে যে সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছে তা’ আমাদেরও উৎকন্ঠা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কারণ, এ উদ্বিগ্নতা শুধু চাষীকূলেরই নয়, আমাদের সমগ্র জাতিরও। যেহেতু, এর উপরই আমাদের ভবিষ্যত খাদ্যাবস্থা নির্ভর করছে, এবং এ সম্পর্কে আমাদেরও যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবার কারণ আছে।
১৫ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ই জানুয়ারী বা সম্পূর্ণ পৌষ মাসই বাংলাদেশে ইরি ধান চাষের একমাত্র শ্রেষ্ঠ সময় এবং এই সময়তেই কৃষককূল বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত-খামারে ইরি বুনে দেশের খাদ্য চাহিদা মেটায়।
কিন্তু, শুধু চাষ করতে চাইলেই তো আর চাষ করা যায়না। এজন্যে কিছু পদ্ধতি, কিছু পূর্ব প্রস্তুতি, কিছু আয়োজন আর কিছু প্রয়োজনও আছে। এদিক থেকে পৃথিবীর যে কোনো দেশের কৃষকের চেয়ে আমাদের দেশের কৃষকের চাহিদা খুবই কম ও নগণ্য। কারণ, তুলনামূলকভাবে আমাদের চাষাবাদ অনেকটা শাশ্বত, পৌরাণিক বা অবৈজ্ঞানিক। অথচ আমরা এই সামান্য চাহিদাটুকুও কৃষককে মেটাতে কতো কুন্ঠিত কতো অনীহ।
পৌষ মাস শেষ হতে আর মাত্র ৬ দিন বাকী। চাষের জন্যে কৃষকের হাতে যা কিছু সরঞ্জামাদি দিতে হবে তা’ এই ছ’দিনের মধ্যেই পৌঁছে দিতে হবে। তা’ না হলে ইরি মৌসুম পাওয়া যাবেনা এবং চাষও সম্ভব হবে না। মাঘ পর্যন্ত ইরি রোপণ করা যায় সত্যি কিন্তু এতে ফলন ভালো হয়না। আবার ফসল পাকতে দেরী হয়ে জৈষ্ঠের ঝড় বৃষ্টিতে ফসলের দারুণ ক্ষতিও হয়।
পৌষের মৌসুম ধরতে আর মাত্র ছ’দিন হাতে থাকলেও, কৃষকের হাতে এখনো পর্যন্ত কোনো কোনো স্থানে কর্তৃপক্ষ বীজ, সার বা পানিসেচ সরঞ্জাম পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ। এতে কৃষককূল সহ আমরা সবাই শুধু হতাশাই দেখতে পাচ্ছি।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে পাওয়ার পাম্প ও ডিজেল মেশিন পৌঁছে দেবার কথা ছিল। অথচ এখনো পর্যন্ত শতকরা ১০ ভাগ ক্ষেত্রেও কৃষি সরঞ্জাম পৌঁছানো হয়নি বলে অভিযোগ। কৃষি উন্নয়ন সংস্থার ৩৩ হাজার হাত পাম্পের প্রায় ২০ হাজারই বিকল অবস্থায় পড়ে আছে। প্রকৌশল সংস্থার কাছ থেকে যে ১২ হাজার নতুন মেশিন পাবার কথা ছিল, তারই কোনো নিশ্চয়তা নেই।
সরকার চলতি মৌসুমে পাম্পের সাহায্যে ১৪ লক্ষ একর জমিতে পানি সেচের যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তা’ ৪ লক্ষ একরেও সম্ভব হবেনা বলে অনুমিত হচ্ছে। আবার গভীর নলকূপের সাহায্যে ১ লক্ষ ২৯ হাজার একর এবং অগভীর নলকূপের সাহায্যে আরো ৫ লক্ষ ৩২ হাজার একর জমিতে পানি সেচের যে পরিকল্পনা আছে, তার ডিজেল মেশিনের অভাবে অক্রিয় আছে। এদিকে দেরীর জন্যে ইরির চারাও শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
তার উপর আছে লালফিতার দৌরাত্ম্য, বড় কর্তাদের গড়িমসি, অনভিজ্ঞ অধঃস্তন কর্মকর্তাদের উপর দায়িত্ব বর্তিয়ে গা-বাঁচানো ইত্যাদি।
চলতি মৌসুমে প্রায় ২১ লক্ষ একর জমিতে ইরি চাষের আশা করা হয়েছিল এবং এ আশা পূর্ণ হলে দেশের খাদ্য ঘাটতিও অনেকটা আয়ত্তে আনা যেতো।
অথচ বর্তমানে যা অবস্থা আছে তা’ দূর করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিক ভাবেই যদি যুদ্ধকালীন জরুরূ অবস্থার ভিত্তিতে যাবতীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ না করেন তবে নির্ঘাৎ দেশকে আগামীতে না খেয়ে দুর্ভিক্ষে মারা যেতে হবে। কারণ তেলের ঘাপলা যাবে, বিশ্বের অবস্থা এমনিতেই খুব নাজুক। সুতরাং খয়রাত বা সাহায্য কোনোটাই পাবার সম্ভাবনাই নেই। একমাত্র ভরসা এই ফসল। এ না হলে দেশের দুর্ভিক্ষ কেউ রোধ করতে পারবেনা। তাই, অত্যন্ত ক্ষেদের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে, জ্যৈষ্ঠের কাঁঠাল কি ভাদ্রে পাকবে?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন