জ্ঞানব্রতীদের ধিক্কার
পাকিস্তানি ফৌজ পূর্ব বাংলায় যে ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে, বােমা ফেলে একের পর এক শহর বিধ্বস্ত করছে, বিশ্ববিদ্যালয়, গ্রন্থাগার ও ধর্মায়তন ধ্বংস করছে, ধ্বংস করছে, গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে, নিরপরাধ গৃহস্থাদের দলে দলে ঘর থেকে টেনে এনে গুলী করছে, গােটা পৃথিবীতেই তার বিরুদ্ধে তাঁর ধিক্কার উঠেছে। সেকালে চেঙ্গীজ, মিহিরকুলা, এটিলা এবং একালে হিটলার, মুসােলিনী, তােজো, একই কাজ করেছেন অন্যের দেশে আক্রমণকারীর বেশে ঢুকে। স্বদেশে স্বধর্মাবলম্বীর ওপর এমন পাইকারি দস্যুতা ও হুণগিরির দৃষ্টান্ত ইতিহাসেই খুজে পাওয়া যাবে না। এতেই বােঝা যায় পূর্ব বাংলা আর পশ্চিম পাকিস্তান দুটো দেশ, দু জায়গায় মানুষও দুই জাতি। দুইয়ের মধ্যে ভূগােলের যােগ ত কোন কিছু ছিল না তা নেই আজও। কিন্তু অন্তরের এবং সংস্কৃতিক যােগও কি ছিল? নিশ্চয় না।
পৃথিবীর দিকে দিকে পাকিস্তানের এই পাইকারি ঘাতনের বিরুদ্ধে যে নিন্দা ও ছি ছি রব শােনা যাচ্ছে, তাতে সবচেয়ে বড় লক্ষ করার বিষয় হল এই যে, তারা পূর্ব বাংলার ঘটনাকে মােটেই পাকিস্তানের ব্যাপার বলছেন না। আসলে যে একটা সংখ্যাল্প গােষ্ঠী হাজার খানেক মাইল দূর থেকে পৃথক সভ্যতা ও সংস্কৃতিতে সমুন্নত একটা সংখ্যাধিক গােষ্ঠীর ওপর অনুচিত প্রভুত্ব চালানর সুযােগ খুঁজছে এবং তা হাতছাড়া হয়েছে দেখেই খুনের নেশায় মেতেছে, এ তারা বুঝেছেন। পাকিস্তানের এক্তিয়ারভুক্ত একটি অঞ্চল কেন্দ্রীয় শাসনের খবর্দারী অস্বীকার করে বেরিয়ে যেতে চাইছে বলে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ যতই দুনিয়াকে বােকা বানাতে চাক, কারাে চোখেই যে আর ধুলাে দেওয়া যাচ্ছে না, তা বিশ্ব জনমতের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়াতে বুঝা যায়। সবাই নতুন বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিতে বদ্ধ পরিকর। একটা জাগ্রত বিশ্ব জনমত, যা এই স্বৈরাচার ও পাইকারি ঘাতনের প্রতিভূদের অচিরেই ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে।
উপরােক্ত কমিটির সংগঠকদের মধ্যে আছেন প্যারিস, মিউনিক, লন্ডন, ব্রুসেলস, রােম, টোকিও, নানা নামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকবর্গ। আছেন কলম্বিয়া, হার-ভার্ড প্রভৃতি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা। পৃথিবীর সেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা পাইকারি হারে প্রতিবাদের ঝড় তুলেছেন, এতে জঙ্গী দূবমনদের বিবেকের মরা নদীতে হয়ত জোয়ার আসবে না। কিন্তু পাকিস্তানের দায়িত্বশীল নাগরিকদের এবং সংস্কৃতিমান নরনারীর অন্তর নিশ্চয় আলােড়িত হবে। তাঁরা এই নৃশংস খুনী ও নির্লজ্জ বর্বরদের নিশ্চয় গদী থেকে হঠিয়ে দিয়ে প্রকৃত গণতন্ত্রী এবং মানবপ্রেমীদের হাতে শাসন তক্ত তুলে দিতেইে আগ্রহী হবেন। দুৰ্বত্তের দাপট যত ভীষনই হােক, তার ভিত্তি কখনাে দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ এপ্রিল ১৯৭১