You dont have javascript enabled! Please enable it! আক্কেলপুর শহর দখল - সংগ্রামের নোটবুক
আক্কেলপুর শহর দখল
ভূমিকা
মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে বিভিন্ন শহর পাকিস্তানি হানাদারদের কবল থেকে মুক্ত করার উৎসব শুরু হয়ে যায়। জয়পুরহাট জেলায় যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনী ও পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন শহর-বাজার দখল করতে থাকে। মিত্রবাহিনীর আক্রমণের ফলে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অধিকসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পগুলাের পতন ঘটতে থাকে। কিন্তু আক্কেলপুর শহর থেকে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প উচ্ছেদ না হওয়ায় ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা চতুর্মুখী আক্রমণের মাধ্যমে। আক্কেলপুর শহরটি দখল করে শত্রুমুক্ত করেন।
পটভূমি
মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারেরা যখন পর্যুদস্ত ও মনােবলহীন, তখন ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযােগিতায় মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা শনিধন ও নির্মূল করার মানসে আক্কেলপুর শহর এলাকা আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় এ অঞ্চলের পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পগুলাের পতন ঘটতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা অপেক্ষাকৃত দুর্বল ক্যাম্পগুলাে থেকে নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে বিশেষ বিশেষ কিছু ক্যাম্প ও এলাকায় জড়াে হতে থাকে। এভাবে আক্কেলপুর শহরও পাকিস্তানিদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়। তাই স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা আক্কেলপুর শহরটিকে শত্রুমুক্ত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। যেহেতু পূর্বেই আক্কেলপুর শহর দখল করার জন্য ভিন্ন ভিন্নভাবে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আক্রমণ পরিচালনা করা হয়েছিল, সেহেতু পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান মুক্তিবাহিনীর সব সদস্যের জানা ছিল।
ভূমির পরিচিতি
আক্কেলপুর শহরটি দক্ষিণ থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত সান্তাহার-জয়পুরহাট রেললাইনের উপর অবস্থিত। গােপীনাথপুর-বদলগাছির যােগাযােগ সড়কটি এ শহরটিকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অতিক্রম করেছে। আক্কেলপুর শহরটিতে অবাঙালিদের আধিক্য থাকায় এলাকাটা ছিল বেশ জনবহুল। স্টেশন এলাকাটিতে ছােটো-বড়াে কিছু দোকানপাট এবং আশপাশে কিছুসংখ্যক বসতবাড়ি ছিল। আক্কেলপুর থানার বিহারপুরের দীর্ঘ ব্রিজটি ছিল পাকিস্তানি। সৈন্যবাহিনীর দখলে। বিহারপুরের ব্রিজটি ছিল আক্কেলপুর শহরের পূর্ব পাশে তুলসীগঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে জয়পুরহাট এলাকার সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারের দল পশ্চাদপসরণ করে আক্কেলপুর শহরে এসে একত্রীভূত হয়। ফলে আক্কেলপুর শহরে শক্রর নিয়মিত বাহিনীর। সাথে রাজাকার মিলে প্রায় ৩-৪ পাটুন শত্রু ছিল বলে ধারণা করা হয়। আক্কেলপুর শহরের ২টি বিশেষ স্থানে পাকিস্তানিদের স্থায়ী। ক্যাম্প ছিল। এগুলাে হলাে আক্কেলপুর পুরাতন থানা ও রেল স্টেশন। তবে কী পরিমাণ পাকিস্তানি বাহিনী আক্কেলপুর শহরে মােতায়েন ছিল, তার সঠিক তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। খ, মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনীর নির্দিষ্ট সংখ্যা জানা না গেলেও তাদের। সাথে মুক্তিপাগল সাধারণ জনগণের একটি উল্লেখযােগ্য অংশ এ অপারেশনে যােগদান করে। মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযােগিতা মুক্তিবাহিনীর শক্তি-সামর্থ্য বৃদ্ধি করে।
শত্রুপক্ষের বিন্যাস
শত্রুবাহিনী মূলত স্টেশন এলাকাতেই সার্বক্ষণিক প্রহরীর কাজে নিয়ােজিত থাকতাে। রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে টহল কার্যক্রম পরিচালনা করতাে। এ ছাড়া আক্কেলপুর শহরের উত্তরে অবস্থিত আক্কেলপুর রেলসেতু এবং শহরের পূর্বে বিহারপুরে তুলসীগঙ্গা নদীর উপর ব্রিজ নিরাপত্তার দায়িত্ব রাজাকাররা পালন করতাে। তা ছাড়া। সাধারণত খাওয়ার সময় ছাড়া বাকি সময় শত্রুপক্ষ আক্কেলপুর শহরে টহল এবং রেলসেতুর উপর দণ্ডায়মান প্রহরীর কর্তব্যে নিয়ােজিত থাকতাে।
যুদ্ধের বিবরণ
লক্ষ্যবস্তু হিসেবে রেল স্টেশন ও থানাকে নির্বাচন করা হয়। তবে আক্রমণের প্রথমেই আক্কেলপুর শহরের দক্ষিণে অবস্থিত রেল স্টেশনটি দখল করা হয়। রেল স্টেশন দখলের পর শহরের দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর দিক থেকে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করলে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার বাহিনী প্রথমে আক্কেলপুর থানায় জড়াে হতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা গােপীনাথপুরের দিকে পালাতে শুরু করে। থানা দখলের পর মুক্তিবাহিনী আস্তে আস্তে সম্পূর্ণ শহরটিকে আয়ত্তে আনে। এ যুদ্ধে ৭জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে আটক হয়। ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং অন্য ১জন আহত হন। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর আক্কেলপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের কারণ মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমণের তীব্রতায় সীমান্তবর্তী পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পগুলাের পতন ঘটতে থাকে। এ আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি সেনারা ছােটো শহরগুলাের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব রাজাকারদের হাতে অর্পণ করে নিজেরা বিশেষ বিশেষ কৌশলগত অবস্থানে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করে। সে কারণে আক্কেলপুর শহরটিতে মুক্তিবাহিনীকে বড়াে ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় নি। তবে এ অভিযানে মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়ের কারণ নিমরূপ হতে পারে:
ক. মুক্তিবাহিনীর সংখ্যাধিক্য।
খ. উচ্চ মনােবল।
গ, ত্রিমুখী আক্রমণের তীব্রতা।
ঘ, শত্রুকে পুনরায় সংগঠিত হতে না দেওয়া।
ঙ. মিত্রবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহযােগিতা। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ
ক. নিচু মনােবল। খ, শক্তিশালী মিত্রবাহিনী কর্তৃক মুক্তিবাহিনীকে পূর্ণ সমর্থন প্রদান। গ, জনরােষ।
ঘ. পাকিস্তানি বাহিনীর পুনর্গঠিত হওয়ার সুযােগ না পাওয়া। শিক্ষণীয়। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্কেলপুর শহর আক্রমণে নিমে উল্লিখিত বিষয় শিক্ষণীয়:
ক, স্বল্প শিক্ষিত একটি বাহিনীর উচ্চ মনােবল এবং দ্রুত কার্যসম্পাদন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম। খ, সঠিক ও সময়ােচিত পুনর্গঠনে ব্যর্থতা যুদ্ধের পট পরিবর্তন নিশ্চিত।
উপসংহার
আক্কেলপুর যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি মাইলফলক। জয়পুরহাট অঞ্চলে সংঘটিত ক্ষুদ্র ও বড়াে পরিকল্পিত-অপরিকল্পিত সব অভিযানের মধ্যে এ যুদ্ধ। বিশেষ তাৎপর্যবহ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দৃপ্তচিত্তে উত্তোলিত হয়। জয়পুরহাট এলাকায় এ বিজয়ের মাধ্যমে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড