সাজাপুরের অভিযান
ভূমিকা
বগুড়া সদর থানার সাজাপুরে অবস্থিত সাজাপুর মাদ্রাসাটি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অস্থায়ী ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। পাকিস্তানি। বাহিনী ও তাদের সহায়তাকারী রাজাকাররা এলাকার আদর্শ এ শিক্ষাঙ্গনটিকে অভিযান আর অত্যাচার পরিচালনার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতাে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনী মাদ্রাসাটিকে রাজাকারদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও ব্যবহার করতাে।
যুদ্ধের পটভূমি
সাজাপুরের এ অস্থায়ী ক্যাম্পটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আশপাশের সাধারণ জনগণের উপর প্রায়ই অত্যাচার চালাতাে। বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর সদস্য হিসেবে সন্দেহভাজন অনেক নিরীহ মানুষকে ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হতাে। মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করার অপরাধে অনেক নিরীহ মানুষকেও এরা নির্মমভাবে হত্যা করতাে। এসব অত্যাচারের প্রতিশােধ হিসেবে মুক্তিবাহিনী ক্যাম্পটিতে আক্রমণের পরিকল্পনা করে।
ভূমির পরিচিতি
বগুড়া শহর থেকে দক্ষিণে আনুমানিক প্রায় ৬-৭ কিলােমিটার এবং বগুড়া সেনানিবাস থেকে ৩ কিলােমিটার উত্তরে এলাকাটি অবস্থিত। সাজাপুরের উত্তরে বেতগাড়ি, পূর্বে সুজাবাদ, পশ্চিমে ডেমনপুকুর নামের কয়েকটি গ্রাম অবস্থিত। মাদ্রাসার পাশের বগুড়া-ঢাকা মহাসড়কটি স্বাধীনতার পূর্বেও ঢাকার সাথে যােগাযােগ রক্ষায় ব্যবহৃত হতাে।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: প্রায় ১০০-এর অধিক রাজাকার এবং ২০-২৫জন পাকিস্তানি সেনা।
খ. মুক্তিবাহিনী: ৭ নম্বর সেক্টরের ৩টি গ্রুপ আনুমানিক ৫০-৬০জন। মুক্তিযােদ্ধা। শত্রুপক্ষের অবস্থান। পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প ছিল সাজাপুর মাদ্রাসায়। যুদ্ধের বিবরণ মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছােটো ছােটো দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন গ্রামে অস্থায়ীভাবে । অবস্থান করতাে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরদের অত্যাচারের কাহিনী শােনার পর মুক্তিবাহিনীর ছােটো দলগুলাে একত্র হয়ে মাদ্রাসায় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পে রেইডের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর ভােরবেলায় ৫০-৬০জন। মুক্তিযােদ্ধা ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে লক্ষ্যবস্তু মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। উপদলগুলাের নেতৃত্ব দেন আব্দুস সবুর, জহুরুল ইসলাম, সাবেরী, আবুল ফজল ও নজীবুর রহমান। পূর্বেই তারা মাদ্রাসায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনা। ও রাজাকারদের ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। পরবর্তী সময় উপদল। ৩টি সকাল ৭টার সময় লক্ষ্যস্থলে পৌছে মাদ্রাসার উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থান গ্রহণ করে। এ সময় পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা মাদ্রাসার ভিতর অবস্থান করছিল। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের আগমন তারা লক্ষ্য করতে পারেনি।
অবস্থান গ্রহণের পরবর্তী সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের উপর আকস্মিকভাবে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু করে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল রাজাকার সদস্যরা পালানাের চেষ্টা করলে। তাদের ২০-২২জন সদস্য নিহত হয়। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের কারণ মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল ক্যাম্পটিতে হয়রানিমূলক ফায়ার করে পাকিস্তানি। সেনা ও রাজাকারদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করা, যা সফল হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। এ অভিযানের পর পাকিস্তানি সেনারা ঐ এলাকা পরিত্যাগ করে চলে যায়। সফলতার কারণগুলাে নিম্নরূপঃ
ক, লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ।
খ, গােপনীয়তা বজায় রেখে লক্ষ্যবস্তুতে গমন করা।
গ, আকস্মিকতা অর্জনপূর্বক গুলিবর্ষণ করায় উল্লেখযােগ্যসংখ্যক রাজাকার নিহত হয়।
ঘ. সাহসিকতা ও দৃঢ় মনােবল। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যর্থতার কারণ মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর হয়রানিমূলক ফায়ার করে ক্ষতিসাধনে। সক্ষম হলেও প্রয়ােজনীয় জনবল ও অস্ত্রবলের অভাবে তা একটি পূর্ণাঙ্গ । আক্রমণে পরিণত করতে পারেনি। এ ছাড়া একটি নিয়মিত বাহিনীর উপর । আক্রমণ করে সফল হওয়ার মতাে প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্ব তাদের মধ্যে। ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
বর্ণিত যুদ্ধ থেকে নিমলিখিত শিক্ষণীয় বিষয়গুলাে স্মরণ করা যেতে পারে: ক. জনগণের সহায়তা গেরিলাযুদ্ধে সাফল্যের মূলমন্ত্র । খ. প্রশিক্ষিত জনবল ও উন্নত অস্ত্র ব্যতিরেকে একটি নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ বা অন্য যে-কোনাে যুদ্ধে সার্বিক জয়লাভ কষ্টসাধ্য। উপসংহার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কেউ কখনাে ভুলতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও পারবে ইতিহাস থেকেই আমরা অনেক কিছু শিক্ষালাভ করি। স্বল্প অস্ত্রে সজ্জিত গুটিকয়েক মুক্তিযােদ্ধার সাজাপুরের এ খণ্ডযুদ্ধটিও আমাদের শিক্ষার পাথেয় হয়ে থাকবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড