মহাস্থানগড়ের অভিযান
ভূমিকা
মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় কম হলেও তাঁরা ছিলেন দুঃসাহসিক এবং দৃঢ় মনােবলের অধিকারী অস্ত্রের স্বল্পতা ও প্রশিক্ষণের অভাব তাদের কখনাে দুর্বল করতে পারেনি। পাকিস্তানি বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মুক্তিযােদ্ধারা প্রতি পদে শত্রুকে আঘাত করেছে পাকিস্তানি সেনারা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জন্য মহাস্থানগড়ে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। মুক্তিযােদ্ধারা এ ক্যাম্পে ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে শত্রুকে দুর্বল করে দেওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে।
যুদ্ধের পটভূমি
পাকিস্তানি সেনাদের বর্বর নির্যাতনে মহাস্থানগড়ের গ্রামবাসী অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল। তারা অন্যায়ভাবে গ্রামের নিরীহ মানুষদের ক্যাম্পে আটকিয়ে রেখে অমানুষিক অত্যাচার করতাে। যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা তখনাে ভালােভাবে সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে না পারায় পাকিস্তানি সেনাদের উপর সরাসরি আক্রমণের পরিকল্পনা করাটা ছিল তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। তাই বিভিন্ন নির্যাতনের প্রতিশােধস্বরূপ পাকিস্তানি সেনাদের হয়রানি করাই ছিল এ অভিযানগুলাের মূল উদ্দেশ্য।
ভূমির পরিচিতি
মহাস্থানগড় বগুড়া শহর থেকে আনুমানিক ১০-১১ কিলােমিটার উত্তরে অবস্থিত। মহাস্থানগড়ের উত্তরে মােকামতলা, পশ্চিমে বড়িগঞ্জ, দক্ষিণে সুফন ও পূর্বে সুখানপুকুর অবস্থিত মহাস্থানগড়ে বিস্তৃত এলাকায় খােলা ভূমি লক্ষ্য করা যায়, যা ঘন গাছপালা পরিবেষ্টিত। মহাস্থানগড়ের পূর্ব দিকে করতােয়া নদী বয়ে চলেছে, যা নৌযান চলাচলের উপযােগী।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: আনুমানিক ১ প্লাটুন।
খ. মুক্তিবাহিনী: ১৪জন মুক্তিযােদ্ধা। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে রফিকুল ইসলাম দুলালের নেতৃত্বে ১টি দল মহাস্থানগড় জাদুঘরে অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ক্যাম্পে হয়রানিমূলক ফায়ারের পরিকল্পনা করে। এ ক্যাম্পটি আক্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত করা এবং তাদের মনােবল ভেঙে দেওয়া। পরিকল্পনা মােতাবেক রফিকুল ইসলাম দুলাল ১৪জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল নিয়ে মহাস্থান জাদুঘরের পশ্চিম পার্শ্বে ক্যাম্পের কাছাকাছি অবস্থান নেন। গভীর রাতে তারা ক্যাম্পের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পরে পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রায় ১৫ মিনিট গুলিবিনিময়ের পর মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার করতে করতে পশ্চিম দিকে সরে যান এবং উত্তর দিক দিয়ে গাবতলী এলাকায় গমন করেন। এ সংঘর্ষে কোনাে পক্ষেই কোনাে হতাহত হয়। নি। যুদ্ধের বিশ্লেষণ শক্রকে হয়রানি করা, তাদের ভীতসন্ত্রস্ত করা এবং মনােবলের উপর আঘাত করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য, যা সফল হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। অল্প জনবল ও অস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পের উপর আক্রমণ করার ঐ পরিস্থিতিতে হয়ত সম্ভব ছিল না। শিক্ষণীয় বিষয় যুদ্ধে যেহেতু মনােবল একটি বড় ভূমিকা রাখে সেহেতু এ ধরনের ছােটো অভিযানও শত্রুর মনােবল ভেঙে দেওয়ায় কার্যকর অবদান রাখে।
উপসংহার
মহাস্থানগড়ের মতাে একটি ঐতিহাসিক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর পাশবিক অত্যাচারকে পদদলিত করতেই মুক্তিবাহিনী এ অভিযানটি পরিচালনা করেছিল। অতি ক্ষুদ্র জনবল নিয়েই এ যুদ্ধের দলনেতা অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে পাকিস্তানি সেনাদের উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে শুধু মহাস্থানগড় নয় সমগ্র দেশেই মুক্তিবাহিনীর এসব দুঃসাহসিক অভিযানের উদাহরণ গেরিলা যুদ্ধের শিক্ষা হিসেবে আমাদের সবার কাছেই চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড