You dont have javascript enabled! Please enable it! প্রতিরােধ যুদ্ধে বগুড়া - সংগ্রামের নোটবুক

প্রতিরােধ যুদ্ধে বগুড়া

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ, পাকিস্তান দিবস। কিন্তুস্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে দিনটি প্রতিরােধ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। শুধু ছাত্রলীগের কর্মীরা ঐ দিন সকাল ৬টায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন এবং ছাত্রলীগের বগুড়া জেলা শাখার নেতৃত্বে সকাল ৮টায় আলতাফুন্নেছা মাঠে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক মকবুল হােসেন, ছাত্রনেতা আব্দুস সামাদ, খাদেমুল ইসলাম, সাজিরুল ইসলাম ও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহমুদুল হাসান খান ও বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ কে মজিবর রহমান ও আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। অন্য সদস্যরা এ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বগুড়া আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মােস্তাফিজার রহমান পটল কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। মাসব্যাপী মিছিলের পর মিছিল চলছিল। রাস্তায় ছাত্র, শ্রমিক, চাকরিজীবী, ডাক্তার, মহিলা, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মিছিলের ঢল নামে। আপামর জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে রাজপথ পূর্ণ হয়।

বগুড়ার আকাশ-বাতাস মিছিলের জয়ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এত দিন চক্রান্তের ফাদ পেতে কুচক্রী ইয়াহিয়াগােষ্ঠী প্রকাশ্য রঙ্গমঞ্চে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা চালিয়ে আসছিল। তারা তাদের হিংস্র নখরগুলােকে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলােচনার নরম দস্তানার আবরণের নিচে ঢেকে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রহসনমূলক আলােচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। অবশ্য আগেই একটা খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, তারা বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা এখানকার সত্যিকারের। প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দেবে না। সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে তারা সশস্ত্র অভিযানের জন্য প্রস্ততি চালিয়ে যাচ্ছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় পথে ছাত্রদের মিছিল বের হয়। তার পর পরই লাল ঝান্ডাসহ শ্রমিকদের মিছিল চলে আসে। ছাত্র আর শ্রমিকদের শ্লোগানে বগুড়া শহরের রাজপথ আর অলিগলি প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। আসন্ন ঝড়ের আভাস পেয়ে তাদের মনে আশঙ্কামিশ্রিত উত্তেজনা। খবর এসেছে, ইয়াহিয়ার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। এবার এক নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। ২৫ মার্চের কিছু পূর্বে বৃন্দাবন

পাড়া রেস্ট হাউজ ও মহাস্থানে কিছুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনা রংপুর সেনানিবাস থেকে এসে ছাউনি ফেলে। ফলে বগুড়ার জনসাধারণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ মােস্তাফিজার রহমান (পটল) ও মতিয়ার রহমান ঢাকা থেকে ফোনে ছাত্রনেতা আবদুস সামাদকে জানান যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। আগামীকাল থেকে দেশের প্রতিরােধ যুদ্ধে বগুড়া পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে এ খবর পৌছার সঙ্গে সঙ্গে ডিআইবি ইন্সপেক্টর শাহ মকবুল হােসেন সাহেব ও থানা অফিসার নিজামুল হককে জ্ঞাত করেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, মকবুল হােসেন ও নিজামুল হক পুলিশ লাইনে গিয়ে আরআই হাতেম আলী খানের সাথে গোপনে পরামর্শ করে সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলােচনা করেন এবং এ আলােচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, কোনােক্রমেই অস্ত্রাদি পাকিস্তানি সেনার হাতে সমর্পণ করা হবে। যথাযথভাবে আক্রমণ প্রতিহত করা হবে, ওয়্যারলেস অপারেটরদের নির্দেশ দেওয়া হয় যে, সব সময় তারা যেন ঢাকার সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে। সাবইন্সপেক্টর আফতাব উদ্দীনকে যােগাযােগ রক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি যেন সর্বক্ষণ ওয়্যারলেস অপারেটরদের খবর উপরি-উক্ত অফিসারদের কাছে গােপনে সরবরাহ করে যােগাযােগ রক্ষা করেন। পুলিশের আরআই হাতেম আলী খানকে সর্বাবস্থায় পুলিশ বাহিনী নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় এবং বগুড়া থানার শক্তি বৃদ্ধির জন্য সেখানে ৫০জন পুলিশ মােতায়েন করতে বলা হয়।

২৫ মার্চ রাত ১টার সময় পুরাে শহর যখন ঘুমন্ত অবস্থায়, সে সময় ঢাকা থেকে পুলিশ ওয়্যারলেসে সংবাদ আসে যে, রাত ১১টার সময় ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআর পিলখানা সদর দপ্তর পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করেছে এবং উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলছে। আরও জানা যায় যে, বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার পুলিশ লাইন আক্রমণ করা হয়েছে। এমতাবস্থায় বগুড়া থানা থেকে ময়মনসিংহে টেলিফোনযােগে খবর আসছে। রংপুরে ফোন করে লাইন পাওয়া যায় নি। পরে গােবিন্দগঞ্জ থানায় ফোন করলে থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার সংবাদ দেন যে, সৈন্যভর্তি ৩২টি ট্রাক এইমাত্র গােলাপবাগের উপর দিয়ে বগুড়ার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয়েছে। টেলিফোনে এ সংবাদ সংগ্রহের সময় বগুড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপারেটররা থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার নিজামুল হককে অভূতপূর্ব সহযােগিতা করেন। হাতে সময় নেই, আরআই হাতেম আলী খানকে তৈরি থাকার পরামর্শ দিয়ে নিজামুল হক এবং জেলার স্পেশাল ব্রাঞ্চের ইন্সপেক্টর শাহ মকবুল হােসেনের বাসভবনে তাড়াতাড়ি আলােচনায় বসেন। পরে সাব-ইন্সপেক্টর দলিলুর রহমান এ আলােচনায় অংশ নেন। আলােচনা বৈঠক মাত্র ১০ মিনিটকাল স্থায়ী হয়। এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই কতকগুলাে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যথা: যে-কোনাে ক্ষতির বিনিময়ে হলেও পাকিস্তানি হানাদারদের বগুড়ায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।

আধ ঘণ্টার মধ্যে বগুড়া শহরের সমস্ত ছাত্র, যুবক ও নাগরিকেরা ঘুম থেকে জেগে ওয়াপদা থেকে পুলিশ লাইন পর্যন্ত সমস্ত রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে পাকিস্তানি সৈন্যের আক্রমণ প্রতিহত করে। নিজামুল হককে এ কাজের ভার দেওয়া হয়। নিজামুল হক সাহেবের কর্মদক্ষতার ফলে ছাত্র-শ্রমিক ও নাগরিকদের সহযােগিতায় এ কাজ মাত্র আধ ঘণ্টার মধ্যে সমাপ্ত হয়। অপর এক সিদ্ধান্তে নিজামুল হকের নেতৃত্বে থানার সব পুলিশের মধ্যে রাইফেল ও গুলি বিতরণ করে থানার চারপাশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পজিশন নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং জেলার বিভিন্ন থানায় অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। সাব-ইন্সপেক্টর রসিম উদ্দীন প্রায় সারারাত প্রচ্ছন্ন বিপদের সম্মুখীন হয়েও এ কাজ সমাধান করেন। শত্রুদের প্রতিরােধ করতেই হবে। কিন্তু প্রতিরােধ করার মতাে অস্ত্র কোথায়? শহরে যাদের ঘরে বন্দুক ছিল, ছাত্ররা সেগুলাে বের করে নিয়ে আসে। সে অবস্থায় কারাে কাছ থেকে তারা। বাধা বা আপত্তি পায় নি। ছাত্ররা সে সমস্ত বন্দুক নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। সারা শহরের পথে পথে বহু ব্যারিকেড গড়ে ওঠে। এমনকি রেলগেটে মালগাড়ি টেনে এনে ব্যারিকেড গড়ে তােলা হয়। এ ব্যারিকেড গড়ে তােলার ব্যাপারে হাজার হাজার মানুষ, ছাত্র, শ্রমিক সবার আগে তাদের সাথে যােগদান করে। ব্যারিকেডের পর ব্যারিকেড করে চলার পথকে আটকে দিতেই হবে। বড়াে বড়াে গাছ কেটে শহরে প্রবেশমুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর স্টাফ অফিসার লুৎফর রহমান জনগণকে পাকিস্তানি সেনার আক্রমণ থেকে হুঁশিয়ার করার জন্য সাইরেন বাজানাের ব্যবস্থা করেন এবং ছাত্রদের মধ্যে হেলমেট বিতরণ করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড