নিউইয়র্ক টাইমস, রবিবার, আগস্ট ১, ১৯৭১
পুর্ব পাকিস্তানঃ ভিয়েতনাম যুদ্ধের মত
ম্যালকম ডাব্লিউ ব্রাউনি
ঢাকা, পাকিস্তান – সরকারী সেনাবাহিনী মূলত শহর এবং রাস্তাগুলিতে সীমাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলে গেরিলা বিদ্রোহীরা সীমান্তের ওপাশ থেকে সাহায্য পাচ্ছে। একটা গোপন রেডিও বার্তায় মুক্তি বাহিনীর সাফল্য এবং ভবিষ্যৎ বিজয় সম্পর্কে বলা হয়।
একজন পরিদর্শক কোন অস্বাভাবিকতা ছাড়াই পুর্ব পাকিস্তানের বেশীরভাগ এলাকার মধ্য দিয়ে চলতে পারেন। তবুও অনেক বিদেশী কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক বাঙালীদের অবস্থাকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায় এবং এরকম কিছু ঘটনার সাথে তুলনা করতে প্রলুব্ধ হয়েছেন যেগুলোর নির্ভুল তালিকা উপরে দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারত শুরু থেকেই বাঙালি বিদ্রোহীদের আশ্রয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহযোগীতা করছে, যেমনটা উত্তর ভিয়েতনাম ভিয়েতকংদের জন্য করেছিল। এমনকি ঘন, ধান জন্মানো গঙ্গা নদীর বদ্বীপ ভূখণ্ড নিয়ে পুর্ব পাকিস্তানের অনেকাংশ গঠিত যেটা ভিয়েতনামের মেকং নদীর বদ্বীপের অনুরূপ। মুক্তি বাহিনীরা নিষ্ঠুর আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার আগে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে সংক্ষিপ্ত পোস্টার ছড়িয়ে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার জন্য সতর্ক করেছে।
কিন্তু পুর্ব পাকিস্তানে যদি একটা গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়, এটাকে পুর্ব এশিয়ায় কয়েক দশকে দেখা কার্যকারী ধাপে পৌছানোর পূর্বে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। সব পক্ষের অপপ্রচারের পরিমাণে, খুব বেশি কিছু ঘটছে বলে মনে হয় না।
পুর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্ততপক্ষে কিছু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেকেই কষ্টে ভুগছে। কিন্তু এই আবেগ-তাড়িত দেশে এর সত্যতা নিরুপণ করা, চলমান বর্ষার মৌসুমে দাঁড়ানোর মত শুষ্ক জায়গা খুঁজে পাওয়ার মতই কঠিন।
পুর্ব পাকিস্তানের পুর্বাঞ্চলীয় সীমান্ত জুড়ে, পাকিস্তান ও ভারতীয় কামান পরস্পরের দিকে বজ্রধ্বনিতে বেজে উঠছে, এবং গত সপ্তাহে এসব অঞ্চলে উভয়পক্ষ তাদের বাহিনী বৃদ্ধি করেছে। সামরিক লোকজন এবং সাধারণ জনগন আশা করছে আগামী কয়েক সপ্তাহে সহিংসতা বাড়বে, সম্ভবত ১৫ আগষ্ট পাকিস্তানের জাতীয় দিবসে একসাথে ঘটবে।
ঢাকা ও কুমিল্লার মধ্যবর্তী ৬০ মাইল রাস্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ কুমিল্লা সীমান্ত সৈন্যবাহিনী উন্মুক্ত আছে। এই কৌশলগত সংযোগ বজায় রাখতে সরকারের কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেটা দেখানোর তেমন কিছু নাই। এই রাস্তায় সম্প্রতি একটা বিস্ফোরক বসানো হয়েছে, এবং বিদ্রোহীরা রাস্তার একটা প্রধান সেতু উড়িয়ে দিয়েছে, কিন্তু যানবহন ঘুরপথে কয়েকশ গজ দুরের দুর্বল কাঠের সেতু হয়ে যাচ্ছে।
গত দু সপ্তাহে ঢাকায় গেরিলারা তাদের উপস্থিতি জানান দিতে শহরের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ ও বিদ্যুৎ সরবরাহের এমন ভাবে ক্ষতি করে যাতে ঘনঘন লোডশেডিং হয়। রাতে বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যায়। আশপাশের যেসব মার্চ মাসে জ্বলেপুড়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তা এখনো সেভাবেই আছে। কিন্তু ঢাকা আবারো মানুষ, রিকশা ও বাণিজ্যে পরিপূর্ণ এবং যেন আগের মতই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।
গ্রামাঞ্চলের অনেক জনবহুল এলাকায় ফসল ফলছে, এবং গুরুত্বর খাদ্যাভাব থাকলেও সেটা স্পষ্ট নয়।
এই শত্রুতার রাজনৈতিক পটভূমি খুঁজে পাওয়া যথেষ্ট সহজ। পরস্পর থেকে ৯০০ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড দ্বারা পৃথক পুর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মুসলিম ধর্মে বিশ্বাসী কিন্তু অন্য সবকিছুতে ভিন্ন। পুর্বাঞ্চলের বাঙালীরা পশ্চিমাঞ্চলের ভাষা উর্দু থেকে ভিন্ন ভাষায় কথা বলে, তাদের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ঐতিহ্য আলাদা, এমনকি তারা দেখতেও ভিন্ন। বাঙালীরা বহুদিন থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবীদের পুর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক শোষক হিসাবে গণ্য করে আসছে।
বাঙালীদের স্বায়ত্তশাসনের সুপ্ত বাসনা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে গত মার্চ মাসে একটা পর্যায়ে আসে এবং কিছু বাঙালী নেতৃবৃন্দ সরাসরি প্রত্যাখ্যান ও নতুন বাঙালি জাতি নিয়ে বাংলাদেশ গঠনের আহ্বান জানান। ২৫শে মার্চে, পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পুর্ব পাকিস্তানি সামরিক ইউনিট বিদ্রোহীদের সাথে একযোগ হয়ে বাংলার আক্রমণাত্মক শক্তি হয়ে ওঠে। সেই থেকেই তারা এসব অঞ্চলের প্রশাসনকে কঠোর হস্তে দমন করছে।
এর ফলে ঠিক কতজন মানুষ নিহত হয়েছে সেই বিতর্ক এখনো অমীমাংসিত। সরকারী বাহিনীরা কখনো তাদের নিজস্ব হিসাব প্রকাশ করেনি, “তারা শুধু বলেছে শত্রু মৃত্যু গণনা করা হয় না; তারা নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়েছে”। ধারণামতে দশ হাজার থেকে কয়েক শত হাজার লোক নিহত হয়। যেকোন ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের তিনটি নিয়মিত বিভাগ এখন পুর্ব পাকিস্তানে জীবনের প্রতিটা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করছে, ঝামেলায় জড়াতে চায়না এমন কিছু পশ্চাদভূমি ছাড়া।
এবং প্রচলিত ধারণায়, চ্যালেঞ্জ নয় বরং বাঙালীদের জন্য একটা হতাশা রয়ে গেলো। এখানের অনেক পর্যবেক্ষকের জন্য, সবথেকে দুঃখজনক এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে প্রায় সাত মিলিয়ন মানুষ ভারতে পালিয়েছে এবং শরনার্থী সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
ম্যালকম ডাব্লিউ ব্রাউনি