দি ওয়াশিংটন ডেইলি নিউজ. জুন ১৫, ১৯৭১
সম্পাদকীয়
পূর্ব-পাকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, যার একটার চেয়ে অন্যটা আরো ভয়ঙ্কর, যা পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রতিদিনই বের হয়ে আসছে, এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙালী জনতার উপর চালানো হত্যাযজ্ঞের খবর ফাঁস করে দিচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা অস্বীকার করে আসছে যে তারা বেঁছে বেঁছে গণহত্যা চালাচ্ছে। কিন্তু একের পর এক তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে তারা ঠাণ্ডামাথায় হত্যা করছে সংখ্যালঘু হিন্দু, বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদী, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক, শিক্ষক, ছাত্র – মোটকথা যারাই একটি স্বতন্ত্র পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দিতে পারবে।
সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই যে ৫০ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আসার মতো ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পালিয়ে এসেছে। এই ক্ষুধাপীড়িত, কলেরা-আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতিদিন আরো ১,০০,০০০ করে আতঙ্কিত শরণার্থী যোগ হচ্ছে।
যদি পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এখন “স্বাভাবিক” হয়ে থাকে, যেমনটা ইয়াহিয়া খানের অধস্তন অত্যাচারী শাসক দাবী করছে, তাহলে কেন নতুন নতুন শরণার্থীরা ভারতকে প্লাবিত করছে এবং আগে যারা এসেছে তারা কেন বাড়ি ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে?
অন্যান্য দেশের পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রও শরণার্থীদের জন্য ঔষধ এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী পাঠাচ্ছে। এটাই ন্যায্য, যেহেতু ভারতের নিজেরই অনেক বড় বড় সমস্যা আছে এবং নিজের নাগরিকদের প্রতি ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুরতার মাশুল তাদের দেয়ার কথা নয়।
আমাদের সরকার পূর্ব পাকিস্তানের ভেতরে জাতিসঙ্ঘ পরিচালিত একটি ত্রাণ কার্যক্রম পাঠানোরও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেনাবাহিনীর কঠোর ব্যবস্থার কারণে ধানের চাষ ব্যাহত হয়েছে, এবং লাখ লাখ বাঙালী অনাহারে পড়বে যদি বাইরে থেকে খাদ্য সরবরাহ করা না হয়। জাতিসঙ্ঘেরই এটা করতে হবে, কেননা কেউই বিশ্বাস করেনা যে পশিম পাকিস্তানীরা বাঙালীদেরকে খাদ্য সরবরাহ করবে, যেখানে তারা ওদেরকে ঔপনিবেশিক প্রজা মনে করে।
সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়া খানের জান্তা সরকারকে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে “একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থান”-এ আসতে আকুল আবেদন জানিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বলতে চাইছে যে পূর্ব পাকিস্তানীদেরকে স্বায়ত্তশাসন দিতে – যার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিয়েছে।
এটা কি ওয়াশিংটনের জড়িত হওয়ার মত কোনো বিষয়? আমরা তাই মনে করি। এই দেশটি বিগত দুই দশক ধরে কোটি কোটি ডলারের অর্থনৈতিক এবং সামরিক সাহায্য পাকিস্তানে পাঠিয়েছে। (বেশিরভাগ অর্থনৈতিক সাহায্য পশ্চিম পাকিস্তান নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে এবং সামরিক সাহায্য ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালীদের নিষ্পেষিত করতে।)
দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ঠেকাতে পাকিস্তানের এখন প্রতি বছর ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার করে প্রয়োজন হবে, এবং যুক্তরাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক সঙ্ঘের প্রধান যাদেরকে অনুরোধ করা হয়েছে এই অর্থের সংস্থান করতে।
ওয়াশিংটনের কি এই রকম সাহায্য চালিয়ে যাওয়া উচিত? আমরা বলি না – যতক্ষণ পর্যন্ত না ইয়াহিয়া খান তার সামরিক খুনিদের প্রত্যাহার করে নিচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধিকারের দাবী মেনে নিচ্ছে। নইলে, তার জান্তাকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে, আমরাও বাঙালী জনতার উপর চালানো গণহত্যা এবং দাসত্বের নৈতিক অংশীদার হয়ে যাব।
এই পদক্ষেপ, আমরা স্বীকার করি, আমাদের পররাষ্ট্রনীতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে কিন্তু কোনো গণহত্যার পক্ষে মৌনসম্মতি দেয়ার চেয়ে এই মূল্য কিছুই নয়।