বিকল্প চিন্তা
নিউজউইক, মে ১৯, ১৯৭১
সাত সপ্তাহ আগে যখন পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়, তখন দ্বিধাবিভক্ত জাতির পশ্চিম ভাগের বেশির ভাগ মানুষ তাদের সরকারের বিছিন্নতাবিরোধী কঠোর মনোভাবকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলতে থাকলে, পশ্চিম পাকিস্তানের আরও বেশি মানুষ বিকল্প চিন্তা করা শুরু করে। করাচী থেকে গত সপ্তাহে, নিউজউইকের মিলান জে. কুবিচ তারবার্তার মাধ্যমে এই সংবাদ প্রেরণ করেছেনঃ
যুদ্ধের শুরুতে, কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত করাচীর সংবাদমাধ্যম এই বিদ্রোহ এবং জাতির উপর এর প্রভাবকে অতিরঞ্জিত সরকারী মতামতের পর্দার আড়ালে ঢেকে দিতে পেরেছিল। এই ধুম্রজাল এতই কার্যকর ছিল যে মাঝে মাঝে এটা তাদেরকেও হতভম্ব করে দিত যারা এটা ছড়িয়েছে। এখন, সরকার এই পর্দার এক পাশ তুলেছে, এবং এর নিচে তারা দেখতে পাচ্ছে যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা দ্বিধা ও বিষণ্ণতায় ভুগছে।
তাদের বিহ্বলতা আরো প্ররোচনা পায় যখন গত সপ্তাহে ঘোষণা আসে যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মেদ ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা পাকিস্তানের ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বৈদেশিক ঋণ শোধ করার জন্য আরও ছয় মাসের সময় চাইছে, এবং জ্বালানী তেলের মূল্য ৮ থেকে ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হবে। সরকারী হুকুমে ৪৬ ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধকরণ এবং অন্যান্য পণ্যের উপর দিগুন-ত্রিগুন আমদানি শুল্ক আরোপের পরপরই এই ঘোষণা আসায়, মনে হচ্ছে এটা ভবিষ্যৎ ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস। এবং এই সম্ভাবনা, পক্ষান্তরে, অনেক পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদের সেই আশঙ্কাই প্রমান করে যে যুদ্ধের ময়দানে সরকারের জয় হলেও, পূর্ব পাকিস্তানে যে তিক্ত সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করছে।
এই উপসংহারে আসার পক্ষে যুক্তি খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন নয়। একদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পগুলো বড় একটি আঘাত পেয়েছে দেশের পূর্ব অংশে তাদের পণ্যের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়াতে, যেখানে তারা তাদের উৎপাদিত পণ্যের একতৃতীয়াংশ বিক্রি করতো। অন্যদিকে, অসংখ্য বাঙালি শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়াতে আসন্ন চা-পাতা উত্তোলন হুমকির মুখে পরেছে, যা বিকল্প হিসেবে চা পাতা আমদানির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সবচেয়ে ক্ষতিকর, অবশ্য, পূর্ব পাকিস্তানের পাট রপ্তানি ব্যাহত হওয়া, যা কিনা জাতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার সবচেয়ে বড় উৎস; মাত্র গত সপ্তাহে রপ্তানি পুনরায় শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে, এই যুদ্ধের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রতিদিন ২০ লাখ মার্কিন ডলার যা কিনা এক বিশাল বোঝা এই জাতির জন্য যার বৈদেশিক মুদ্রার মজুত এই সংকটের শুরুতে ছিল মাত্র ৮ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার।
আরও বলতে গেলে, অদূর ভবিষ্যতে পরিস্থিতির লক্ষণীয় মাত্রায় উন্নতি হবার সম্ভাবনও খুবই ক্ষীণ। যদিও কতিপয় সরকারী কর্মকর্তা বলতে চান যে আস্তে আস্তে পূর্ব পাকিস্তানের জীবনযাত্রা “স্বাভাবিক” হয়ে আসছে, অন্যরা স্বীকার করেন যে সশস্ত্র বিদ্রোহের মাত্রা ক্রমশঃ বাড়ছে। রয়েছে ব্যাপক হারে কর ফাঁকির খবর (যা কিনা পুরো জাতির কর আদায়ের ৪০ শতাংশ)। এবং রাজনৈতিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত করার সরকারী চেষ্টাও একইভাবে বিফল হচ্ছে। তাই, গেরিলা যোদ্ধাদের জন্য সাধারন ক্ষমা এবং সরকারি কর্মচারীরা যার যার চাকরিতে ফিরে এলে তাদের বকেয়া বেতন পরিশোধের ঘোষণা থাকলেও, শুধুমাত্র গুটিকয়েক পূর্ব পাকিস্তানিই এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। বাস্তবে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচিত ১৬৭ জন সংসদ সদস্যর মধ্যে মাত্র দুই জনই তাদের অঞ্চলের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অস্বীকার করেছে।
অবধারিতভাবে, ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট এবং পূর্ব পাকিস্তানের চলমান প্রতিরোধ পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও নাড়া দিয়েছে। কিছুদিন আগেই উত্তর-পশ্চিমের সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধ-এ বেশকিছু নাগরিককে গ্রেফতার করা হয় প্রাদেশিক বিভাজনের পক্ষে আন্দোলন করার অপরাধে। এবং জুলফিকার আলি ভুট্টো, পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চাকাঙ্ক্ষী নেতা যে কিনা তার অনুসারীদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসনের অবসান হবে, নিন্দিত হয়েছে সামরিক শাসন এখনো বলবত থাকায়। কিন্তু সর্বোপরি মাথার উপর মূল্যস্ফীতির শঙ্কা এবং পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের সম্ভাবনা ইয়াহিয়া খানের জন্যেও হুমকিস্বরূপ। কেননা গত সপ্তাহে করাচীর একজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আমাকে বলেছেনঃ “অতীতের অন্য সরকারগুলো এর চেয়ে অনেক অল্পতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে। আমি বলবো ইয়াহিয়ার হাতে আর ছয় মাস সময় আছে সবকিছু ঠিকঠাক করার জন্য। এরপর, সামরিক বাহিনী ধরে নেবে যে তাদের প্রেসিডেন্ট যে কাজ পারবেনা সেটাতেই হাত দিয়েছে, এবং তারা হয়তো একজন নতুন নেতা খোঁজা শুরু করবে।” যদি সঠিক হয়, তাহলে এই ধারণা থেকে বলা যায় যে ইয়াহিয়ার হাতে সামান্য হলেও সময় আছে। কিন্তু পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে, সময় খুব দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে।