You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.22 | দা স্যাটারডে রিভিউ, মে ২২, ১৯৭১ পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা - সংগ্রামের নোটবুক

দা স্যাটারডে রিভিউ, মে ২২, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা

মানুষের সকল অধিকারের মাঝে সবচেয়ে মৌলিক যে অধিকার, একজন মানুষের বিপদের সময় সাহায্যের জন্যে অন্য একজন মানুষের এগিয়ে আসার অধিকারকে এখন এমন এক মাত্রার আনুষ্ঠানিক ঔদ্ধত্যের মাধ্যমে অস্বীকার করা হচ্ছে যা কিনা সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিরল এক দৃষ্টান্ত।

পূর্ব পাকিস্তানের যে মানুষগুলো গত বছরের বন্যার কারণে এখনো গৃহহীন এবং ক্ষুধাপীড়িত, তারাই এখন আবার মনুষ্যসৃষ্ট এক দুর্যোগের শিকার। তাদের দেশ পরিণত হয়েছে এক অনুমোদিত বধ্যভুমিতে। বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ আজ প্রায় শুন্যের কোঠায়। যারা জরুরী চিকিৎসা বা অন্যান্য সাহায্যে এগিয়ে আসতে চেয়েছিল তাদেরকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।

বর্তমান সময়ের এই অবস্থার শেকড় রয়েছে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় উপমহাদেশকে দ্বি-জাতিতত্বের ভিত্তিতে ভেঙে দুটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তের মধ্যে। ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা আদায়ের সংগ্রাম ছিল জটিল এবং হিন্দু ও মুসলিম জোটের পৃথক অস্তিত্বের কারণে সংকটময়। ইংরেজরা এমনি এক দ্বিধাবিভক্ত উপমহাদেশের ধারনা প্রতিপালন করেছে যে ভারত হবে হিন্দু অধ্যুষিত এবং পাকিস্তান হবে মুসলিম অধ্যুষিত। দীর্ঘদিন ধরে গান্ধী এবং নেহরু এইধরণের দেশবিভাগের বিরোধিতা করে এসেছেন এই বিশ্বাস থেকে যে দুই ধর্মের মানুষগুলোকে একটি বিশাল জাতিতে একীভূত করা অপরিহার্য। গান্ধী এবং নেহরু অবশ্য তাদের দেশবিভাগ সংক্রান্ত এই আপত্তি উঠিয়ে নেন, যখন তারা নিশ্চিত বুঝতে পারেন যে নাহলে জাতীয় স্বাধীনতাই অনির্দিষ্টকালের জন্যে বিলম্বিত হবে।

দেশবিভাগের নকশাতে মূলত দুটি রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ছিল। বাস্তবে, উদ্ভব হয় তিনটি রাষ্ট্রের। কেননা পাকিস্তানকে তার নিজের মাঝেই দুইভাগে বিভক্ত করা হয়, পূর্বে ও পশ্চিমে। পশ্চিম অংশটি ছিল ভৌগলিকভাবে আকারে বড় এবং সেখানেই রাজধানী স্থাপিত হয়। পূর্বের অংশটি ছিল জনবহুল এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ। একই দেশের দুই অংশের মাঝে রয়ে যায় হাজার মাইলের ব্যবধান।

ভৌগলিক এই বৈসাদৃশ্য বুঝতে হলে, শুধু কল্পনা করতে হবে যদি মেইন এবং জর্জিয়া অঙ্গরাজ্য সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পৃথক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে তাহলে কি ঘটতো। জর্জিয়া নামের এক রাষ্ট্র তৈরি হতো, যার দুই অংশের মধ্যিখানে বাস্তবে পুরো যুক্তরাষ্ট্র অবস্থিত। আমরা আরো ধরে নিই যে এই নতুন রাষ্ট্রের রাজধানী হতো অগাস্টা, উত্তর জর্জিয়াতে। পক্ষান্তরে বেশিরভাগ মানুষ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ রয়ে গেছে দক্ষিন জর্জিয়াতে। ফলাফলে সৃষ্টি হতো এক প্রশাসনিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার। পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা এই বর্ণনার সাথে মোটামুটিভাবে মিলে যায়। পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে পাঞ্জাবি (পশ্চিমের) এবং বাঙালি (পূর্বের) সমাজের মধ্যকার সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রবল ব্যবধান।
শুরুর দিকে কিছুটা সময়ের জন্য পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষেরা নতুন জাতীয়তাবাদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক প্রফুল্লতায় একীভূত ছিল। কিন্তু মৌলিক সমস্যাগুলো আরো প্রকট হতে লাগলো যখন পূর্ব পাকিস্তান উপলব্ধি করতে শুরু করলো যে তারা আসলে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে যা কিনা ইংরেজ ঔপনিবেশিকতারই নামান্তর। তারা দাবি করেছিল যে সরকারের নীতিনির্ধারণী উচ্চপদে তাদের জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে প্রতিনিধিত্ব নেই। তাদের অভিযোগ ছিল যে শিল্প-উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাদের শ্রম ও সম্পদের ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও লভ্যাংশের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা হচ্ছে। তারা পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যকার মজুরি ও জীবনযাত্রার মানের সুতীক্ষ্ণ বৈষম্যকে তুলে ধরেছিল।

এই বিদ্রোহের উদ্গিরন অবধারিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে শুরু হওয়া রাজনৈতিক আন্দোলনের পিছনের প্রকৃত খুঁটিনাটি এখানে তুলে ধরার কোন মানে নেই। এখানে এইটুকুই বলা যথেষ্ট যে ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তানের সংসদে উপস্থাপনে নারাজ ছিল। যদিও সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষেই রায় এসেছিল। ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার জনতার এই রায়কে সম্মান দিতে শুধু ব্যর্থই হয়নি, বরং সামরিক বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় এর বাস্তবায়নকে বানচাল করতে। ২৬ শে মার্চে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক হত্যাযজ্ঞ।

(১) ২৬ শে মার্চ ভোরে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও গ্রেনেড সজ্জিত সৈনিকরা সাঁজোয়া যান (ট্যাঙ্ক) নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে। ইকবাল হল এবং তার ডরমেটরিতে অবস্থানরত সকল ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ট্যাঙ্কের গোলায় ধসিয়ে দেয়া হয় পুরো ভবনটি।

(২) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে অবস্থানরত একশত তিন জন হিন্দু ছাত্রকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ছয়জন হিন্দু ছাত্রকে অস্ত্রের মুখে বাধ্য করা হয় তাদের কবর খুঁড়তে এবং তারপর তাদেরকেও গুলি করে হত্যা করা হয়।

(৩) দর্শন বিভাগের প্রধান বরেণ্য অধ্যাপক জি. সি. দেবকে তার বাসা থেকে বের করে পার্শ্ববর্তী মাঠে নিয়ে যাওয়া হয় এবং গুলি করা হয়।

(৪) একই বিভাগের অন্য শিক্ষক যাদেরকে হত্যা বা গুরুতরভাবে জখম করা হয় তাদের নামঃ মনিরুজ্জামান, গুহঠাকুরতা, মুনিম, নাকী, হুদা, ইন্নাস আলি।

(৫) সৈনিকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৪ নং দালানের ‘ডি’ ফ্ল্যাটে জোর করে ঢুকে অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, তার ছেলে, তার ভাই (যিনি পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টে চাকরী করতেন) ও তার ভাইপোকে আটক করে এবং তাদেরকে দলবেঁধে দোতলার বারান্দায় নামিয়ে আনে, যেখানে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের গুলিতে তাদের হত্যা করা হয়।

(৬) পুরানঢাকার সদরঘাট টার্মিনালের ছাদে একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র (মেশিনগান) স্থাপন করা হয়। মার্চের ২৮ তারিখে, এই অস্ত্রের আওতার মধ্যে থাকা সকল বেসামরিক নাগরিকদের গুলি করা হয়। এই হত্যাযজ্ঞের পর, মৃতদেহগুলোকে টেনেহিঁচড়ে কতগুলো বাসে তোলা হয়। কিছু মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। কিছু মৃতদেহ টার্মিনালের পাশের বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
(৭) ২৮ শে মার্চ সকালে, শাঁখারী বাজার, পুরানঢাকার একটি হিন্দু অধ্যুষিত শিল্প-এলাকা, এর দুপাশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র (মেশিনগান) বসানো হয়। সৈনিকেরা আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে ভিতরে আটকে পড়া বেসামরিক নাগরিকদের ওপর। মৃতদেহগুলো ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে থাকে রাস্তার ওপর।

(৮) ২৮ শে মার্চ সন্ধ্যায়, সৈন্যরা রমনা কালীবাড়ি, পুরানঢাকার এক প্রাচীন হিন্দু বসতি, তে ঢুকে পড়ে, সবাইকে (আনুমানিক ২০০ জনকে) হত্যা করে। পরেরদিন ২৯ শে মার্চে, একশোর মতো মৃতদেহ পাওয়া যায় ঐ এলাকায়।

(৯) বেসামরিক নাগরিকদের ঢাকা থেকে পালানোর সকল পথ অস্ত্রের মুখে বন্ধ হয়ে যায়।

(১০) ২রা এপ্রিল সকালে, চল্লিশজন সৈনিক বাড্ডা নামক গ্রামে ঢুকে সব (আনুমানিক ৬০০ জন) পুরুষদেরকে একত্রিত করে এবং অস্ত্রের মুখে দলবেঁধে গুলশান পার্কে নিয়ে আসে, সেখানে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ঐ দল থেকে দশ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়, তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা আজো অজ্ঞাত।

এখানে বর্ণিত এই সত্যিকার ঘটনাগুলো যুবকবয়সী এবং শিক্ষিতদের উপর চালানো ব্যাপক গণহত্যার এক অতিক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এক্ষেত্রে নিহত বা আহতদের সঠিক সংখ্যা অনুমানের চেষ্টা নিছক বাতুলতা। প্রত্যেক শহর এবং গ্রামেরই রয়েছে এমন ভয়ঙ্কর ইতিকথা। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ইসলামাবাদ সরকার মাত্র গত সপ্তাহ পর্যন্ত, শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে সাংবাদিকদেরকে এর বাইরে রেখেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগের কাছে শুধু উপরে বর্ণিত ঘটনাগুলেো ছাড়াও আরও অসংখ্য ঘটনার প্রামাণ্য বিবরণ রয়েছে। ঢাকাস্থ আমেরিকান রাষ্ট্রদূত এবং এপিপি-এর সাথে সম্পৃক্ত আমেরিকান চিকিৎসকরা এই বিস্তারিত বিবরণগুলো ওয়াশিংটনে প্রেরন করেন। কোন অজানা কারণবশত, স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাদের কাছে থাকা কোন বিবরণই প্রকাশ করেনি।

পাকিস্তানে পাঠানো আমেরিকান বন্দুক গোলাবারুদ ও অন্যান্য অস্ত্রই ব্যবহার করা হয়েছে বাঙালীদের উপর আক্রমণের সময়। একই ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন থেকে পাঠানো অস্ত্রও ব্যবহৃত হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ কোন সহায়ক হতে পারেনি। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার দাবী করছে যে এটা তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়, যা কিনা জাতিসংঘের এখতিয়ারের বাইরে।

এথেকে হয়ত বুঝতে সুবিধা হতে পারে যে জাতিসংঘ এখনো পর্যন্ত আপাতদৃষ্টিতে প্রমানযোগ্য এই গণহত্যার বিরুদ্ধে কোন কার্যকর ভূমিকা নেয়নি কেন কিন্তু এর কোন ব্যাখ্যা নেই যে কেন বিবেকবান মানুষেরা জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে আকাশ বিদীর্ণ করে এই ঘৃণিত অপরাধের প্রতিবাদ করছেনা।

উপদ্রুত এলাকায় খাদ্য, ঔষধ, এবং চিকিৎসক প্রেরণের সকল প্রচেষ্টা ইসলামাবাদের কেন্দ্রীয় সরকার বানচাল করতে সক্ষম হয়েছে। এটা বোঝা খুবই দুষ্কর যে এই ধরনের একটি সিদ্ধান্তকে কিভাবে টিকে থাকতে দেয়া যায়। বাঙালীরা হয়ত তাদের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্য জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার অধীনে কোনদিনই পাবেনা।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাদের জাতীয় স্বার্থে অত্যন্ত জোরের সাথে এবং সাফল্যের সাথে কথা বলতে কখনই দ্বিধাবোধ করেনি। প্রত্যেক আমেরিকান নাগরিক এই প্রত্যাশা করতেই পারে যে যেখানে মানবাধিকারের প্রশ্ন জড়িত সেখানে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত জোরের সাথে কথা বলবে। যুক্তরাষ্ট্র যদি পাকিস্তানে অস্ত্র পাঠানোর নৈতিক উপায় বের করতে পেরে থাকে তাহলে সেখানে খাদ্য ও জরুরী চিকিৎসা সাহায্য প্রেরণের ব্যপারেও নৈতিক উপায় বের করতে পারবে।

প্রেসিডেন্ট বলেছেন যে ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যে পৌরুষের এক পরীক্ষা। এই প্রস্তাবনাটি দ্ব্যর্থক। তবে এটুকু নিশ্চিত বলা যায় যে পাকিস্তানে যে ঘটনাগুলো ঘটছে তা যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতিশীল বিবেকের কাছে এক বিশেষ পরীক্ষাসরূপ।