মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রাপ্ত তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ)-এর অকুতােভয় সৈনিক নম্বর ৯৪৫৯, শহিদ ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ তিনি ১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন যশাের জেলা তথা বর্তমান নড়াইল জেলার মহিষখােলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আমানত শেখ এবং মাতার নাম জেন্নাতুন্নেসা। তিনি স্থানীয় বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। শৈশবে অভিভাবকহীন অবস্থায় পৈতৃক জমিজমা বিক্রি করে তিনি জীবন যাপন করতে থাকেন পরে স্থানীয় মুজাহিদ বাহিনীতে যােগ দেন। ১৯৫৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ২৩ বছর বয়সে তৎকালীন ইপিআর-এ যােগ দেন প্রশিক্ষণ শেষে তার পােস্টিং হয় দিনাজপুর সেক্টরে ১৯৭০ সালের আগস্ট মাসে তিনি যশাের সেক্টর সদর দপ্তরে বদলি হন। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে এসে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। ১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যশাের জেলার ঝিকরগাছা থানার গােয়ালহাটি গ্রামের এক প্রান্তে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করতে গিয়ে শহিদ হন। এর আগে ৮ নম্বর (যশাের) সেক্টর অধিনায়ক মেজর মঞ্জুর প্রতিটি সাব-সেক্টর ঝটিকা সফর করে মুক্তিবাহিনীকে সুসংগঠিত করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরােধে সেপটেম্বর মাসেই নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ও গণবাহিনীর সদস্য দ্বারা সম্মিলিতভাবে গােয়ালহাটি গ্রামে একটি ক্যাম্প স্থাপন করা হয় এবং এ ক্যাম্পের নিরাপত্তার জন্য গােয়ালহাটি গ্রামে একটি প্যাট্রল পার্টি নিয়ােজিত। করে নূর মােহাম্মদকে এ ক্যাম্পের অধিনায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দায়িত্ব পাওয়ার পরই তিনি ক্যাম্পের নিরাপত্তার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেন। ৫ সেপটেম্বর তিনি তাঁর ৩জন সঙ্গীকে নিয়ে গােয়ালহাটি এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর উপর নজর রাখছিলেন। তখন সকাল সাড়ে ৯টা দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানি বাহিনী তার উপস্থিতি টের পেয়ে যায় এবং উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে নূর মােহাম্মদ এবং তার ২ সঙ্গী মােস্তফা কামাল ও নানু মিয়াকে ঘিরে ফেলে গোলাগুলির শব্দে ৮ নম্বর সেক্টরের বয়রা সাব-সেক্টরের গােয়ালহাটিতে জড়াে হতে থাকে মুক্তিযােদ্ধাসহ সাধারণ মানুষ। সাব-সেক্টর অধিনায়ক ক্যাপটেন খন্দকার নাজমুল হুদা সেখানে কী হচ্ছে জেনে আসার জন্য নির্দেশ দেন মক্কেল আলীসহ আরও কয়েকজনকে তারা ফিরে এসে জানান যে, নূর মােহাম্মদের নেতৃত্বাধীন টহল দল পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে অবিলম্বে পালটা আক্রমণ করা হয় নূর মােহাম্মদের নেতৃত্বাধীন টহলটিকে রক্ষা করার জন্য কিন্তু কিছুতেই তাদের উদ্ধার করা যাচ্ছিল না। ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদও চেষ্টা করেছিলেন তাঁর টহল দলকে পিছু হটিয়ে নিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে ফিরে যেতে টহল দলের একমাত্র প্রধান অস্ত্র হালকা মেশিনগানটি ছিল সিপাহি নান্ন মিয়ার হাতে টহল দলকে পিছু হটিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার সময় ঘটে যায় অঘটন। শত্রুর গুলি আঘাত করে নানু মিয়াকে। মারাত্মক আহত অবস্থায় নানু মিয়া এলএমজি চালাতে পারছিলেন না। এ সময় অধিনায়ক নূর মােহাম্মদ নিজের হাতে তুলে নিলেন লাইট মেশিনগানটি। আহত সিপাহি নাননু মিয়াকে কাঁধে তুলে নিলেন। ঘন ঘন অবস্থান পালটে গুলি করছিলেন।
উদ্দেশ্য শত্রুকে বিভ্রান্ত করা, শত্রু যেন তাদের সঠিক অবস্থান। বুঝতে না পারে। কোন পথ দিয়ে পশ্চাদপসরণ তাও যেন ধরতে না পারে। এভাবে ডানে-বাঁয়ে গুলি চালাতে চালাতে পিছু হটছেন, এমন সময় ২ ইঞ্চি মর্টারের এক গােলা এসে পড়ল নূর মােহাম্মদের ঠিক ডান পাশে। গােলার। আঘাতে তার ডান হাটু ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, আঘাত পেলেন ডান কাধেও। বুঝতে পারলেন মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু তখন পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্বের কথা মনে রয়েছে। টহল বাহিনীর বাকিদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পৌছে দেওয়ার শেষ চেষ্টাটুকু করতেই হবে তাকে সহযােগীযুদ্ধা সিপাহি মােস্তফার দিকে এলএমজিটা বাড়িয়ে ধরে আদেশ করলেন ওটা নিয়ে কভারে পশ্চাদপসরণ করতে সঙ্গে নিতে বললেন আহত নান্নু মিয়াকে। আর মােস্তফার সেলফলােডেড রাইফেলটি তাকে দিতে বললেন। হালকা এ অস্ত্রটি দিয়ে তিনি শত্রুকে ঠেকিয়ে রেখে সঙ্গীদের নিরাপদে ঘাঁটিতে পৌছার পথ প্রশস্ত করবেন অধিনায়কের নির্দেশে সিপাহি মােস্তফা নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে এলএমজি হাতে নিয়ে ফায়ার করতে করতে পিছু হটলেন নূর মােহাম্মদ অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করলেন জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত। সিপাহি মােস্তফা পিছু হটতে শুরু করলে তিনি এসএলআর নিয়ে শত্রুর উপর গুলি করতে শুরু করেন। এদিকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাঁর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসছিল। তবু তিনি গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে গুলি করেই চলেছেন, যাতে শত্রুরা তাঁর গুলিতে ব্যতিব্যস্ত থেকে মােস্তফা ও নান্নুর দিকে মনােযােগ দিতে না পারে। নূর মােহাম্মদের এ অসাধারণ আত্মত্যাগ সার্থক হয়েছিল নান্নু মিয়াকে বহন করে নিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজস্ব প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পৌছতে পেরেছিলেন মােস্তফা এক পর্যায়ে তার গুলি শেষ হয়ে গেলে পাকিস্ত নি সেনারা তাঁকে ঘিরে ফেলে এবং মিমভাবে হত্যা করে। ঘন্টা খানেক পর। মুক্তিযােদ্ধারা আরও শক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ব্যুহের উপর পালটা আক্রমণ চালান, অবস্থা বেগতিক দেখে শত্রু সৈন্যরা পিছু হটে নিজেদের ডেরায় সরে যায়।
সিপাহি মােস্তফা কামাল এবং আরও অনেকে ছুটে যান ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদের খোঁজে সেই গাছপালা ঘেরা জায়গাটিতে অনেক খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে নূর মােহাম্মদের প্রাণহীন দেহটি আবিষ্কার করেন পাশের এক ঝােপে সেখান থেকে শহিদের লাশ তুলে এনে মাটিতে শােয়ানাের পর স্তম্ভিত বাকহারা মুক্তিযােদ্ধারা দেখতে পান যে, বর্বর পাকিস্তানি সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রের নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে আহত এ মুক্তিযােদ্ধার চোখ দুটি উপড়ে ফেলেছে, বর্বররা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে নূর মােহাম্মদের এ অসাধারণ আত্মত্যাগ সেদিন তার সহযােদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করেছিল ভীষণভাবে। মুক্তিযােদ্ধারা শপথ নিয়েছিলেন, নূর মােহাম্মদের আত্মত্যাগ বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। দেশ স্বাধীন না করে তারা ঘরে ফিরবে অবশেষে একদিন দেশ পাকিস্তানি দস্যুদের কবল থেকে মুক্ত হলাে দেশ স্বাধীন হলাে কিন্তু নূর মােহাম্মদ জেনে যেতে পারেন নি। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মােহাম্মদকে সমাহিত করা হয় যশাের জেলার মুক্তাঞ্চল নামে। পরিচিত শার্শা থানার কাশীপুর গ্রামের এক প্রান্তে নূর মােহাম্মদের ক্যাম্প গােয়ালহাটি থেকে কাশীপুরের দূরত্ব ৭ কিলােমিটার স্বাধীনতাকামী মানুষের। কাছে স্মরণীয় স্থান গােয়ালহাটি ও কাশীপুর। ল্যান্স নায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ নিজের জীবন বিপন্ন করে সহযােদ্ধা ও যুদ্ধাস্ত্র রক্ষা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে অগাধ দেশপ্রেম, অসীম সাহসিকতা, বিরল কর্তব্যপরায়ণতা এবং সহযােদ্ধাদের প্রতি দৃষ্টান্তমূলক সহমর্মিতার এক অনন্য। নজির স্থাপন করেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার তার অসাধারণ কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে তাকে সর্বোচ্চ বীরত্বসূচক ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড