You dont have javascript enabled! Please enable it! বীরশ্রেষ্ঠ শহিদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান - সংগ্রামের নোটবুক

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের জন্ম ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর পুরােনাে ঢাকার ১০৯, আগা সাদেক রােডের বাড়িতে তাদের আদি। নিবাস বর্তমানে নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার রামনগর গ্রামে। চাকরির সুবিধার্থে সব নথিপত্রে তাঁর জন্ম তারিখ দেখানাে হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ সাল। তাঁর পিতা মরহুম মৌলভি আবদুস সামাদ ছিলেন জেলা সাব-রেজিস্ট্রার। মা মােবারকুন্নেছা ছিলেন রত্নগর্ভা এবং একজন আদর্শ গৃহিণী, যার উপর ন্যস্ত ছিল সংসার ও সন্তানাদির দায়িত্ব। পিতামাতার ১১ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন। অষ্টম। ঐতিহ্যবাহী ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নের পর তিনি তল্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানের সারগােদাস্থ পাকিস্তান এয়ার ফোর্স পাবলিক স্কুলে মেধা ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালে যােগদান করেন। সেখান থেকে। ১৯৬০ সালে ডিস্টিংশনসহ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। অতঃপর ১৯৬১ সালের ১৫ আগস্ট তিনি রিসালপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাডেমিতে ৩৬তম জিডি(পি) কোর্সে যােগ দেন। একজন মেধাবী ছাত্র ছাড়াও তিনি খেলাধুলায় খুবই পারদর্শী ছিলেন। সাঁতার ও ফুটবলে তিনি যথেষ্ট কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিলেন। চাকরিকালীন তিনি ভালাে Lawn Tennis, Squash, Chess ও Billiard খেলতেন। হকি, বাস্কেট বল, ভলিবল ও অ্যাথলেটিকসেও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনি স্কুলের পক্ষ থেকে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন বিভিন্ন প্রতিযােগিতায়। মতিউর ছিলেন হাসিখুশি, প্রাণচঞ্চল, উদ্দীপ্ত ও চৌকস একজন পেশাজীবী বৈমানিক। তিনি ছিলেন একজন অলরাউন্ডার ফ্লাইট ক্যাডেট । মতিউর পড়াশােনা ও উড্ডয়ন প্রশিক্ষণে খুব ভালাে ফল অর্জন করেন।
২ বছরের প্রশিক্ষণ সাফল্যের সাথে শেষ করে ১৯৬৩ সালের ২৩ জুন তিনি। পাইলট অফিসার হিসেবে ফ্লাইং ব্রাঞ্চে কমিশন লাভ করেন। কমিশনের পর তাঁকে করাচির মৌরিপুরে (বর্তমানে মাশরুর বিমানঘাঁটি) বদলি করা হয়। সেখানে তিনি ২ নম্বর স্কোয়াড্রনে টি-৩৩ বিমানে জেট করভারশন কৃতিত্বের সাথে সম্পন্ন করেন। কোর্স শেষ করে এফ-৮৬ Sabre Jet বিমানে Fighter Conversion করেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানি-ভারত যুদ্ধ শুরু হলে তিনি ঐ যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখেন। তারপর তিনি Flying Instructor’s School থেকে কোর্স সম্পন্ন করে রিসালপুর একাডেমিতে Qualified Flying Instructor হিসেবে নিয়ােগ পান। সেখানে তিনি T-6G Harvard ও T-37 বিমানে প্রশিক্ষক হিসেবে সাফল্যের পরিচয় দেন। ১৯৬৭ সালের ২৩ জুলাই তাকে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৬৭ সালের ৪ অক্টোবর তাকে ‘সিতারা-য়ে-হার্ব’ খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭০ সালে তিনি ২ নম্বর Jet Conversion স্কোয়াড্রনে ইনস্ট্রাক্টর নিযুক্ত হন এবং ১৯৭১ সালের। ২০ আগস্ট পর্যন্ত ঐ স্কোয়াড্রনেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালে ছুটিতে থাকাকালীন ছুটিতে এসে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্থানীয়ভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং ভৈরবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ছুটি শেষে মে মাসে তিনি পাকিস্তানে ফিরে যান। পাকিস্তানে ফিরে গেলে তাকে Active Flying থেকে সরিয়ে করাচিস্থ মৌরিপুর বিমানঘাঁটিতে ফ্লাইট সেফটি অফিসার হিসেবে নিয়ােগ দেওয়া হয়। এ সময় মতিউরের মন দেশ সেবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠায় তিনি পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ১টি বিমান নিয়ে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন।
তার উদ্দেশ্য ছিল সেই বিমান নিয়ে পালিয়ে এসে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা। উল্লেখ্য, তিনি ইতঃপূর্বে তার অতি ঘনিষ্ঠজন ও বিশ্বস্ত সহকর্মীদের মাতৃভূমির স্বাধীনতা অর্জনে নিজকে সম্পৃক্ত করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট সকালে মাশরুর বিমানঘাঁটি থেকে পাইলট অফিসার রশিদ মিনহাজ দুই আসন বিশিষ্ট ১টি টি-৩৩ বিমান নিয়ে Solo Flight-এ নিয়মিত প্রশিক্ষণের জন্য রওনা হন। মতিউর রহমান তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সেই সুযােগটি গ্রহণ করেন। তিনি তার নিজ গাড়ি চালিয়ে Taxi Track-এর পাশে, গাছগাছড়ার আড়ালে অবস্থান নেন, যেন। Control Tower থেকে তাকে না দেখা যায়। রশিদ মিনহাজের বিমান তার কাছাকাছি আসা মাত্রই তিনি ফ্লাইট সেফটি অফিসার হিসেবে হাত ইশারা দিয়ে তাকে থামান এবং লাফ দিয়ে বিমানের পাখার উপর উঠে রশিদ মিনহাজকে বিমানের Canopy খুলতে বলেন। Canopy খুলে রশিদ মাস্ক খােলা মাত্রই মতিউর রহমান ক্লোরােফর্মে ভেজানাে রুমাল দিয়ে তাকে সাময়িকভাবে অজ্ঞান করেন। অতঃপর তিনি ককপিটের শূন্য আসনটিতে বসে বিমান নিয়ে উড্ডয়ন করেন এবং সম্ভবত রাডারকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য খুব নিচু দিয়ে উড়ে ভারতের জামনগর বিমানঘাটি লক্ষ্য করে যেতে থাকেন।  ইতােমধ্যে রশিদ মিনহাজের জ্ঞান ফিরে আসামাত্র রেডিয়াে টেলিফোনে রাডার ঘাটিকে বিমান ছিনতাইয়ের কথা জানান। এক পর্যায়ে ভারত সীমান্তের কাছে বাদিনের মরু অঞ্চলে বিমানটি বিধ্বস্ত হলে উভয় বৈমানিক নিহত হন। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউরের মৃতদেহ দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি পাওয়া যায়। অতঃপর পাকিস্তানের মাশরুর বিমানঘাঁটিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
২০ আগস্ট মতিউরের দুঃসাহসিক অভিযান বাংলার মুক্তিকামী মানুষকে করেছিল শিহরিত, মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল উঠেছিল তুঙ্গে, অপর দিকে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নৈতিক মনােবল দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় চরম ভয় ও ভীতি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার শহিদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের অসীম সাহসিকতা, বীরত্বপূর্ণ অভিযান, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের মূল্যায়নস্বরূপ। এ বীর সন্তানকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য মরণােত্তর বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে। সুদীর্ঘ ৩৫ বছর পর ২০০৬ সালের ২৪ জুন তাঁর দেহাবশেষ দেশের মাটিতে আনা হয়। এ মহান বীরকে তার মাতৃভূমির স্বাধীন মাটি মিরপুরের শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সংরক্ষিত জায়গায় সমাহিত করা হয়েছে। বাংলাদেশের এ কৃতী সন্তানের সমাধিস্তম্ভটি দেশের প্রতিটি নাগরিককে মাতৃভূমির জন্য মহান কিছু করার প্রেরণা জোগাবে আল্লাহ রাব্বল আলামিন বলেন, “আল্লাহর রাস্তায় যারা নিহত হয়, তাদের মৃত বলাে না, তাঁদের রূপের। পরিবর্তন হয় মাত্র এবং তারা রিজিক প্রাপ্ত।” আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউরের নির্ভীক ও নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ চির জাগরূক থাকুক, এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড