শ্যামনগরের যুদ্ধ
ভৌগােলিক অবস্থান সাতক্ষীরা জেলার ৫৫ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত শ্যামনগর একটি ছােটো শহর। ১৯৭১ সালে এটি ছিল একটি সাধারণ শহর। এর পশ্চিমে বাদঘাটা, আটালিয়া, উত্তরে কাটালবাড়িয়া এবং দক্ষিণে কাশীপুর। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে শ্যামনগর ২০ কিলােমিটার পশ্চিমে অবস্থিত ছিল। তা ছাড়া শ্যামনগর থেকে ১৬ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে কালিগঞ্জ শহর অবস্থিত। এ শহর পাকা রাস্তা দিয়ে সাতক্ষীরা ও যশাের শহরকে সংযুক্ত করেছে। যুদ্ধের সংগঠন ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১টি প্লাটুন। খ. মুক্তিবাহিনী: ১৫০-২০০জন। যুদ্ধের অবস্থান। শ্যামনগর ওয়াপদা কলােনিতে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি প্লাটুন অত্যন্ত সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে অবস্থান গ্রহণ করে। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা ক্যাপটেন নুরুল হুদা শ্যামনগর মুক্ত করার পরিকল্পনা করেন। তিনি ২০ আগস্ট ১৫০-২০০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল নিয়ে শ্যামনগর আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে উকসা থেকে রওনা হয়ে রাত ২টায় শ্যামনগর শক্ত অবস্থানের কাছাকাছি পেীছেন। ক্যাপটেন হুদা মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি কলামে বিভক্ত করে ১ট গ্রুপের নেতৃত্বে তিনি নিজে এবং অন্য ২টি গ্রুপের মধ্যে ১টি গ্রুপের নেতৃত্ব লেফটেন্যান্ট বেগ এবং অন্যটির নেতৃত্ব নায়েব সুবেদার আব্দুল গফুরের উপর অর্পণ করেন। যুদ্ধের বিবরণ ক্যাপটেন হুদা প্রতিটি গ্রুপ অধিনায়ককে তাদের করণীয় বিষয়াদি বুঝিয়ে দেন। পরে তারা পরিকল্পনা মােতাবেক নির্দিষ্ট অবস্থানে পৌছার পর সমন্বিতভাবে প্রথমে নায়েব সুবেদার গফুর মর্টার দিয়ে শত্রুর অবস্থানে আঘাত হানতে শুরু করেন। সঙ্গে সঙ্গে অপর ২টি কলামের মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল ৮টি এলএমজি, ১২টি এসএমজি, ৩টি ২ ইঞ্চি মর্টার এবং কয়েকটি এসএলআর।
এভাবে উভয় পক্ষের তুমুল সংঘর্ষ হয়। এমতাবস্থায় মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে কিছুতেই অগ্রসর হওয়া সম্ভব ছিল না। এরূপ পরিস্থিতিতে গােলাগুলির শব্দে ভাের প্রায় ৪টার দিকে কালিগঞ্জ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি প্লাটুন শ্যামনগরে তাদের সহযােগীদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের ফায়ার পাওয়ার বেড়ে যায়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সুবেদার ইলিয়াস ক্রলিং করে ওয়াপদা কলােনির ভিতরে প্রবেশ করে অবস্থান গ্রহণ করেন। তাকে অনুসরণ করে আরও কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা কলােনির ভিতরে প্রবেশ করেন। প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করার দরুন পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ক্যাপটেন হুদার। গ্রুপটিও অগ্রসর হতে থাকে। কলােনির ভিতর ও বাইরে যুগপৎ আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পালাতে শুরু করে। ফলে সকাল ৯টার মধ্যে শ্যামনগর মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে অবশ্য এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের চরম মূল্য দিতে হয়। সুবেদার ইলিয়াসসহ ৮জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং পালানাের সময় পাকিস্তানি সেনারা ৯জন মুক্তিযােদ্ধাকে ধরে নিয়ে যায়। অন্যদিকে, যুদ্ধের পর ৪জন পাকিস্তানি সেনার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় এবং আহতাবস্থায় ৪জন পাকিস্তানি সেনাকে বন্দি করা হয় ২১ জুলাই ২৫জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ক্যাপটেন হুদা শ্যামনগর থানায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। অন্যদিকে, ক্যাপটেন জিয়া, ক্যাপটেন মেহেদী, ক্যাপটেন শাহজাহান এবং স্টুয়ার্ড মুজিবুর ও তাদের সহকর্মীদের আক্রমণাত্মক তৎপরতা অব্যাহত থাকে শিক্ষণীয় বিষয় ক. আকস্মিকতা: সঠিক পরিকল্পনা প্রতিটি যুদ্ধে সফলতার জন্য অপরিহার্য। শ্যামনগরের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সুপরিকল্পিত আক্রমণের ফলে শত্রুকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সময়ােচিত ও আকস্মিক আক্রমণ পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের প্রধান কারণ।
উচ্চ মনােবল: দেশমাতৃকার স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ছিল দৃঢ় ও অত্যুচ্চ অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনী জানত যে, তারা কোনাে আদর্শের জন্য যুদ্ধ করছে না। তাই তাদের মনােবল ছিল নিচু। দৃঢ় মনােবলের কারণেই মুক্তিযােদ্ধারা শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিকল্পনা করতে সমর্থ হয়েছে। তাই দেখা যায় যে, সব যুদ্ধে জয়ের জন্য দৃঢ় মনােবল বজায় রাখা অনস্বীকার্য। গ, সঠিক রেকি: সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে রেকি সম্পাদন যে-কোনাে যুদ্ধজয়ের পূর্বশর্ত। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এলাকাটি ছিল পরিচিত। অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট এলাকাটি ছিল অপরিচিত। তাই মুক্তিযােদ্ধারা এলাকা সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে আক্রমণ পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছে। সঠিক নেতৃত্বদান: সঠিক নেতৃত্ব প্রদান যুদ্ধজয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। শ্যামনগরের যুদ্ধে ক্যাপটেন হুদা সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিয়ে সফল আক্রমণ পরিচালনা করেন। তার উপস্থিতবুদ্ধি ও সাহসিকতাপূর্ণ মনােভাব মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করেছে।
উপসংহার
শ্যামনগরের যুদ্ধ কোনাে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত যুদ্ধ ছিল না। এটি ছিল। একটি প্রতিরােধ যুদ্ধ মাত্র প্রাথমিক প্রতিরােধ পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা স্বতঃস্ফূর্ত ছিল এবং তা ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিকভাবেই জনযুদ্ধের রূপ নিয়েছে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড