ডঃ হেনরী কিসিঞ্জার ওয়াশিংটন থেকে পিকিংয়ের উদ্দেশে। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নিক্সন-মাও সেতুং বৈঠকের জমিন তৈরির জন্যে। পথে ইসলামাবাদে একদিনের যাত্রা বিরতি। রাত্রিযাপন। উদ্দেশ্য-ইয়াহিয়া খানের সাথে সলা পরামর্শ, আমােদফুর্তির ফাঁকে কূটনীতির ডালপালা বিস্তার। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে কাজে লাগানাের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনার প্রস্তুতি এগিয়ে নেয়ার মিশন। কিসিঞ্জারের পাকিস্তান চ্যানেলে পিকিং মিশনকে মার্কিন মিডিয়া ‘কু অব দি সেঞ্চুরী’ বা ‘শতাব্দীর সার্থক অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছে। পাকিস্তানের প্রেসিছে ইয়াহিয়া খানের সাথে ড হেনরী কিসিঞ্জাৱেৱ গলায় গলায় ভাব। ইয়াহিয়াকে খুব পছন্দ করেন কিসিঞ্জাৱ। সদা চঞ্চল, কৌতুকময় হাসি-খুশি ইয়াহিয়া খানকে কিসিঞ্জারের দারুণ পচ্ছন্দ। কিসিঞ্জারের প্রকাশ্য মন্তব্য; অতিথি সেবায় ইয়াহিয়ার জুড়ি নেই। সৈনিক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের জীবনে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কৃতিত্ব নেই। স্বাভাবিকভাবে তার বড় জোর বর্ডার পুলিশ ফোর্সের একজন সার্জেন্টের বেশি কিছু হওয়ার কথা ছিল না। দেখতে শুনতেও ইয়াহিয়াকে তেমন মানায় না। পাট্টাগােট্টা, বেঁটেখাটো চেহারা। ছােট কালে সাদা এক গােছা চুল নিম্নমুখী। মাখার অধিকাংশ চুল ধূসর রঙ ধারণ করেছে। সৈনিক জীবনে তার ক্রমান্বয়ে প্রমােশন প্রাপ্তি ধারাবাহিক দুর্ঘটনারই ফসল। ঘটনাচক্রে দেশের সর্বোচ্চ আসনটিও শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়াকে সৌভাগ্যবান করেছে। না, কেউ তাকে ভোট দিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে নি। ইয়াহিয়ার পিছনে কখনাে কোনাে জনসমর্থন ছিল না। ফৌজি একনায়ক আইয়ুব খানের দশ বছরের দুঃশাসন উনসত্তরে প্রচণ্ড গণবিদ্রোহের সৃষ্টি করলে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভাগ্য খুলে যায়। আইয়ুবের পর সেনাবাহিনীর মধ্যে সিনিয়রিটির বিবেচনায় ইয়াহিয়া খান ক্ষমতার শীর্ষ স্থানটিতে গিয়ে বসেন। মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব কিসিঞ্জার ইসলামাবাদে হর অল্পকালীন অবস্থানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে মিলিত হন। এশীয় পরিস্থিতি বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। কিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইয়াহিয়া বলেন ; এখানে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ শান্ত, আমাদের নিয়ন্ত্রণে। বাকি সব ইণ্ডিয়ার প্রচার। ওসব ভিত্তিহীন প্রচারণায় মােটেই কান দেবেন না। ইয়াহিয়া বলে চললেন : ভারতীয় তথ্য মিথ্যাচারে ভরা। শরণার্থী সংখ্যা কয়েক হাজারের বেশি হবে না। আমাকে বিশ্বাস করুন, আমরা পাকিস্তানীরা কদাচ মিথ্যার আশ্রয় নিই না। ড কিসিঞ্জারের চোখে সহানুভূতিসূচক এক ঝিলিক হাসি খেলে গেল। ইয়াহিয়া ; এই যুক্তিটাকে আমি কখনাে পরােয়া করি না। আমরা সৈনিক। আমরা জানি কিভাবে সেই মহিলা (ইন্দিরা গান্ধী) ও তার সশন্ত্র বাহিনীকে শায়েস্তা করতে হয়। আমার একটা অর্ডারই কাশ্মীর দখলের জন্য যথেষ্ট। আরেকটা অর্ডারে পাকিস্তানি জওয়ানরা নির্ঘাত দিল্লী বিজয়ে রওয়ানা হবে। আমরা ইচ্ছা করলে বিচ্ছাটাকে খাঁচায় করে পিণ্ডি পর্যন্ত নিয়ে আসতে পারি। বলতে বলতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া উত্তেজিত হয়ে পড়েন। যেন এক ঘন্টা সময়ের মধ্যে গােটা ভারত দখল করে ইন্ধিরা গান্ধীকে গ্রেফতার করে নিয়ে আসবেন।
হুইস্কির গ্লাস থেকে ঠোট নামিয়ে কিসিঞ্জার কূটনীতিকের মতােই নিঃশব্দে হাসলেন। ইয়াহিয়া বললেন ; আমারও এক কথা, বেশি পরিমাণে পানীয় খাবাে, বেশি করে চিন্তা করবাে। আর হ্যা যা বলছিলাম-মিসেস গান্ধীকে কখনাে আস্থায় আনা যায় না। অথচ আপনি আর আমি-আমরা কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একে অপরকে কত ভালাে করে জানি। কিসিঞ্জার : মিঃ প্রেসিডেন্ট, বন্ধুত্বই বড় কথা। ইয়াহিয়া : বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে সম্পর্ক খােলামেলা হওয়াই সমীচীন। কোনাে ঢাক ঢাক গুড় গুড় নেই। কোনাে প্রকার গােপনীয়তারও প্রশ্ন ওঠে না। ভােজসভায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পঁচিশ মিনিট বক্তৃতা করেন। সমগ্র বক্তৃতা জড়েই প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও ডঃ কিসিঞ্জারের প্রশংসাসূচক অসংখ্য বিশ্লেষণের ব্যবহার। সাথে সাথে ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বিষােদগার। অপরপক্ষে ডঃ কিসিঞ্জারের বক্তব্য ছিল সংক্ষিপ্ত। বাছা বাছা শব্দ ও বাক্য চয়নে দশ মিনিটেই ভাষণের সমাপ্তি। তাতে উত্তেজনা উচ্ছ্বাস আবেগ কিছুই ছিল না। কিসিঞ্জারকে পাকা কূটনীতিকই বলতে হবে। প্রেসিডেন্ট ভবনের বিরাট ডাইনিং রুমে অভ্যাগতদের মধ্যে প্রায় সবাই মিলিটারির অফিসার, কিসিঞ্জার লক্ষ করলেন বয়স্ক জেনারেলদের সাথে ওদের যুবতী সুন্দরী স্ত্রীরাও এসেছেন। পরক্ষণে তিনি ভাবলেন স্ত্রীদের ঘরে ফেলে বয়সী জেনারেলরা মিসট্রেস নিয়েই ভােজসভায় এসেছেন। ডিনার শেষে হলরুমে বড় মেহমানের সম্মানে মেজবান জিয়াউল হকের উদ্যোগে নাচগানের সামান্য আয়ােজন। ইয়াহিয়া ও কিসিঞ্জার পাশাপাশি বসে বেলে নৃত্য উপভােগ করেন। এর মধ্যে মঞ্চের দিকে এগিয়ে এল প্রেসিডেন্টের সবচেয়ে প্রিয় ও পাকিস্তানের নামকরা বেলে নর্তকী লীলা। ইয়াহিয়া মেহমানের দিকে চেয়ে বললেন : কী বন্ধু আমাদের লীলা চমৎকার নয় কী? কিসিঞ্জার বললেন : আমি জীবনে কত বেলে ড্যান্সার দেখেছি তন্মধ্যে নাচে ও সৌন্দর্যে সত্যি লীলার জুড়ি নেই। ইয়াহিয়া সরব হাসিতে ফেটে পড়লেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আপ্যায়ন, অতিথেয়তায় ডঃ কিসিঞ্জার সন্তুষ্ট। রাতের মতাে অপার শান্তিতে তিনি ঢলে পড়লেন ঘুমের কোলে। পরের দিন সকালে পিকিং যাত্রা। এয়ারপাের্টের উদ্দেশে লিমুজিনে চড়বার আগে ইয়াহিয়ার সাথে উষ্ণ করমর্দন করে বললেন : প্রয়ােজনীয় সব কিছুই করা হবে। খােলাখুলি কিছু না বললেও কিসিঞ্জার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিলেন : আমেরিকান অস্ত্রের চালানটা শিগগিরই এসে যাবে।
Source: পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু -রবার্ট পেইন