মেহেরপুর অঞ্চলের অন্যান্য যুদ্ধ
মানিকনগর যুদ্ধ মানিকনগর গ্রামটি মুজিবনগর এলাকা থেকে ৩ কিলােমিটার উত্তরে এবং মেহেরপুর সদর উপজেলা থেকে ১৩ কিলােমিটার দক্ষিণে মেহেরপুর-মুজিবনগর রাস্তার উভয় পার্শ্বে বিস্তৃত। মানিকনগরের পশ্চিম দিকে রয়েছে বিশাল খােলা মাঠ ও নিচু জমি। পাকিস্তানি সেনারা মুজিবনগর ক্যাম্প স্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল মানিকনগরে একটি ক্যাম্প স্থাপন করে। ১৯৭১ সালের মে, জুন ও জুলাই মাসের বিভিন্ন সময় এ অবস্থানের উপর মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ করেও শত্রুমুক্ত করতে পারে নি। পরবর্তী সময় ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণের মাধ্যমে শত্রুমুক্ত করা হয়। এ যুদ্ধে প্রায় ১৮-২০জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। বাগুয়ানের যুদ্ধ বাগুয়ান মেহেরপুর সদর থেকে ১৩ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে নাটুদা স্থান থেকে ৭ কিলােমিটার পূর্বে মানিকনগর-নাটুদা সড়কের উভয় পার্শ্বে বিস্তৃত। বাগুয়াননাটুদা রাস্তা থেকে একটি পায়ে চলার পথ দক্ষিণ দিক দিয়ে বিভিন্ন গ্রামকে যুক্ত করেছে। তখন এ রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি চলাচল করত। গােপন সংবাদের ভিত্তিতে মুজিবনগর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি ১টি দল নিয়ে ১৯৭১ সালের ২০ মে বাগুয়ানে ফাদ (অ্যামবুশ) পেতে প্রায় ১৫১৭জন পাকিস্তানি সেনা হত্যা করেন। তা ছাড়া পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া ১টি জিপ, ৪টি রাইফেল, ১টি এলএমজি এবং বিপুল পরিমাণ গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। উল্লেখ্য, মানিকনগর এবং অপর কয়েকটি অবস্থান থেকে প্রায়ই পাকিস্তানি সেনারা নাটুদাতে রসদ আনার উদ্দেশ্যে বাগুয়ানের। রাস্তাটি ব্যবহার করত।
আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে মাছপাড়া এলাকায় ঠাণ্ডু মিয়ার বাড়ি সংলগ্ন অবস্থান থেকে পাকিস্তানি সেনারা রসদ নিয়ে নাটুদার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে বলে মুক্তিযােদ্ধা বশির আহমেদকে (বর্তমানে জেলা অধিনায়ক) জানানাে হয়। অতঃপর মুক্তিযােদ্ধা বশির আহমেদ ইপিআর-এর ৪জন সৈনিক এবং ১৬জন অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে বাগুয়ান এলাকার রাস্তার দক্ষিণ পার্শ্বে বড়াে ঘাস ও গাছের আড়ালে ফাদ (অ্যামবুশ) পেতে অবস্থান। গ্রহণ করেন। যথারীতি শত্ৰু ঐ এলাকায় আগমন করলে ফাদের মাধ্যমে পাকিস্তানি সেনাদের ১৬-১৭জনকে হত্যা করা হয়। এ অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনীর। ৮জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন।
১৯৭১ সালের ৩ জুন মুজিবনগরের যুদ্ধটি ছিল একটি উল্লেখযােগ্য আক্রমণ। পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে এবং প্রথম দিকে মুক্তিবাহিনী প্রতিরক্ষা অবস্থান ত্যাগ করে পশ্চাদপসরণ করে। পরবর্তী সময় পুনর্গঠিত মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে পাকিস্তানি। বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা করে প্রতিরক্ষা ঘাটি পুনরুদ্ধার করে। যুদ্ধের সংগঠন ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ১ ব্যাটালিয়ন খ, মুক্তিবাহিনী: ১ কোম্পানি (তাদের মধ্যে ৪৫জন ইপিআর-এর সৈন্য এবং অন্যরা মুক্তিযােদ্ধা)। যুদ্ধের অবস্থান ক. মুক্তিবাহিনী: নায়েব সুবেদার আব্দুল মতিন পাটোয়ারির নেতৃত্বে ৪৫জন ইপিআর সৈনিকসহ ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে। মুজিবনগরের আম্রকাননে (বর্তমানে স্মৃতিসৌধ এলাকা) প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী: পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল মেহেরপুর সদরে। মানিকনগর ও বাগুয়ান এলাকায় কিছু সংখ্যক সৈন্য রেখে ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে ১৯৭১ সালের ৩ জুন মুজিবনগরের উদ্দেশ্যে অগ্রাভিযান শুরু করে।
যুদ্ধের বিবরণ
মুক্তিযুদ্ধকালীন ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল আনুমানিক ৯টায় সর্বপ্রথম পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় ১০০জনের ১টি দল মুজিবনগরের আম্রকাননে প্রবেশ করে এবং সেখানকার ইপিআর ক্যাম্পের কাছে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করতে চেষ্টা করে। পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিতি জানতে পেরে বেতাই সাব-সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে দীর্ঘক্ষণ গােলাগুলির পর পাকিস্তানি সেনারা ঐ স্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। তারপর বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি সেনারা মুজিবনগরে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করতে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র প্রতিরােধের। সম্মুখীন হয়। এসব যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরবর্তী সময় ১৯৭১ সালের ৩ জুন নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি সংবাদদাতার মারফত পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের সংবাদ পেয়ে তার প্রতিরক্ষায় অবস্থিত সৈনিকদের ২টি ভাগে ভাগ করে ১টিতে নিজে এবং অপরটি নায়েব সুবেদার তােফাজ্জেল হােসেনের নেতৃত্বে প্রতিরক্ষায় অবস্থান নেন। যখন পাকিস্তানি। সেনারা অগ্রসর হয়ে ঐতিহাসিক আমবাগানের নিকট আসে, তখন পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রগুলাে পাকিস্তানি সেনাদের উপর একসঙ্গে গর্জে ওঠে। পাকিস্তানি সেনারা ছিল খােলা মাঠে আর মুক্তিযােদ্ধারা আমগাছের আড় নিয়ে সহজেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে গুলি বর্ষণ করতে সক্ষম হয়। কিন্তু মুজিবনগর সম্পর্কে পাকিস্তানি বাহিনীর অজানা রহস্য ঘনীভূত হয় এবং ক্ষিপ্রতার সাথে তীব্র গতিতে অগ্রসর হতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনীর নিজ অবস্থানে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি তৎক্ষণাৎ পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেন।
ফলে তারা পিছু হটে পূর্ব পার্শ্বে অবস্থিত বিস্তীর্ণ আখক্ষেতের মধ্যে অবস্থান গ্রহণ করেন। ইতােমধ্যে। পাকিস্তানি সেনারা শেষ পর্যন্ত মুজিবনগরের মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটি দখল করে পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত নিরীহ মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। নায়েব সুবেদার পাটোয়ারি এমন দুর্যোগেও মনােবল হারান নি। বরং ঐ পরিস্থিতিকে কাজে লাগানাের চেষ্টা করেন। এমন সময় আমবাগানসংলগ্ন আখক্ষেতে অবস্থিত। স্বল্পসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে দৃঢ়তার সাথে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে দিয়ে সামরিক কায়দায় পাকিস্তানি সেনাদের উপর পালটা আক্রমণের আদেশ দেন। এবং মুহূর্তের মধ্যে আখক্ষেতের ভিতর থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র গর্জে ওঠে । গুলি বর্ষণ এবং কমান্ডের দৃঢ়তা শুনে পাকিস্তানি সেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে শেষ পর্যন্ত পিছু হটে চলে যায়। এভাবে মুক্তিবাহিনী পুনরায় তাদের মুজিবনগর প্রধান ঘাটি পুনরুদ্ধার করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের ২৮জন নিহত এবং ২০জনেরও বেশি আহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ২জন শহিদ হন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. আদর্শগতঃ এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য স্বাধীনতার যুদ্ধ। নিজের জীবন বাজি রেখে দৃঢ়তার সাথে যুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযােদ্ধারা। অন্যদিকে, পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধ ছিল কেবলমাত্র জায়গা দখল করা। নির্দিষ্ট লক্ষ্য তাদের ছিল না। খ, সঠিক রেকি: সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে রেকি সম্পাদন যে-কোনাে যুদ্ধের। পূর্বশর্ত। বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর রাখায় প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানি সেনারা মুজিবনগর চিনতে অপ্রত্যাশিত দেরি হওয়ায় মুজিবনগরে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনাে অভিযান পরিচালনা। করতে পারে নি। গ, তথ্যসংগ্রহ: তথ্যসংগ্রহের ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধারা সর্বদা এগিয়ে ছিলেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – সপ্তম খন্ড