রাজনীতিতে অগ্রপশ্চাৎ জ্ঞান
সেদিন একজন বৈদেশিক রাষ্ট্রদূত ভদ্রলােককে অভিযােগ করেছিলাম, তােমাদের সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও দেশগুলাে বাংলাদেশের উপরে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড চলেছে, সে সম্বন্ধে তােমাদের রাষ্ট্র, তােমাদের জনমত এমন নীরব কেন? যেখানে লক্ষ লক্ষ নিরীহ লােকের প্রাণ নেওয়া হয়েছে, সেখানে কী তােমরা এখনও অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে আবিষ্কার করতে চেষ্টা করছে, কারা দোষী? ভদ্রলােক কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত একটা পাল্টা অভিযোেগ আমাদের বিরুদ্ধেই উপস্থিত করলেন! খবরের কাগজটা সামনে ধরে দেখালেন পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা এখন কী করছেন! শিক্ষাব্যবস্থার অদলবদলের এক দাবি নিয়ে রাইটারস্ বিল্ডিং-এ গৃহযুদ্ধ লাগাতে ব্যস্ত! ঐ দিনের কাগজেই দশটি খুনের খবর ছিল। ভদ্রলােক এগুলাে লাল পেন্সিল দিয়ে দাগিয়ে রেখেছিলেন। বললেন, আজ কী এপার বাংলার কাছে ওপার বাংলার সংগ্রামটাই সবচেয়ে বড় ইস্যু নয়? এপার বাংলার বাঙালিদের যেন কোনাে মাত্রাজ্ঞান নেই, সমস্যাবলী সম্বন্ধে অগ্রপশ্চাৎ জ্ঞান নেই, কোটা আসল ও আশু আর কোন্টা গৌণ এবং দুদিন বাদেও ধরা চলতে পারে সে সম্বন্ধে কোনাে জ্ঞান নেই।
বৈদেশিকদের কর্তব্য সম্বন্ধে তাদের নিজেদের গাফিলতির জবাব তাতে হয় না। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মাথা নিচু করতেই হলাে। বস্তৃত আজ পশ্চিম বাংলার রাজনীতিকরা কোন বিষয় নিয়ে সবচেয়ে বেশি সচেতন ও উত্তপ্ত? বাংলাদেশ নিয়ে? না, না। যদি তাই হতাে তবে আজ নিজেদের দলীয় ঝগড়া বন্ধ করে সবাই একযােগে এক জোটে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের দিকেই মনােনিবিষ্ট হতেন। ত্রাণ কার্য করতে হবে, মুক্তিসগ্রামে সাহায্য করতে হবে, বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে, এ জাতীয় কয়েকটি সদিচ্ছা প্রকাশ করেই তারা খালাস। ধীরে ধীরে এসব দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তারা এখানকার মন্ত্রীত্ব নিয়ে যে সংগ্রাম উপস্থিত, তাতেই নজর সীমাবদ্ধ করে ফেলছেন। অথবা সশস্ত্র সগ্রাম পরস্পরের কর্মীদের খুন করে চরিতার্থ করছেন!
কী আমাদের রাজনৈতিক জ্ঞান, যদি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামটাকেই আজ প্রধান ও একমাত্র বিষয় হিসেবে গ্রহণ না করি? এতাে কেবল একটি দেশের স্বাধীনতার কথাই নয়, এ যে আমাদের নিজেদেরই স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন। সাত কোটি এই বাঙালিদের দায়টা তাে আজ আমাদের বােঝা নয় আমাদের শক্তি, আমাদের অগ্রগতিরই সহায়ক। এমন সুযোেগ তাে আমাদের কাছে একশ বছরেও আর আসবে না, গত একশ বছরেও আসেনি। ক্ষুদ্রবুদ্ধি ক্ষুদ্রস্বার্থ চেতনা জাত তথাকথিত বিপ্লবীরা আসল বিপ্লবকে চোখবুজে না দেখে অন্ধসংগ্রামে লিপ্ত। আমাদের কূপমণ্ডুকতা কবে দূর হবে? বিধান সভার স্পিকার নির্বাচন নিয়ে হয়তাে বাংলার রাজনীতি আবার অথৈ জলে পড়ে যাবে। দল উপদলগুলাে মন্ত্রীত্ব নিয়ে জঘন্য কেনাকাটার মেছােবাজার সৃষ্টি করবে। আমরা এই চরিত্র নিয়ে কী করে দোষ দেবাে ইয়ােরােপ, আমেরিকা বা আফ্রো-এশিয় দেশসমূহের বাংলাদেশ সম্বন্ধে তাদের নীরবতা নিয়ে?
সূত্র: কম্পাস, ৮ই মে ১৯৭১