১৯৭১ সাল জানুয়ারি থেকে ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঘটনাবলি
‘৭১ সালের প্রথম দিকের নানা ঘটনাবলির কথা ইতিহাসে সুবিস্তারিত লেখা রয়েছে। এখানে আলােচনা না করলেও চলবে। এতটুকু বলা দরকার যে, ‘৭১ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি রাজনৈতিক, আরেকটি সামরিক কমিটি গঠন করেন। ‘৭১ সালের ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসনভার সহস্তে গ্রহণ করেন। ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি প্রণয়ন করেন এবং তা অনুমােদন করেন বঙ্গবন্ধু। ১৫ মার্চ তাজউদ্দীন প্রণীত ৩৫টি বিধি ঘােষণা করেন বঙ্গবন্ধু। নির্দেশাবলি অনুসারে প্রয়ােজনীয় জনসেবামূলক অফিস চালু থাকবে। যেমন হাসপাতাল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ফায়ার সার্ভিস প্রভৃতি। সকল সরকারি, বেসরকারি দপ্তর, হাইকোর্টসহ অন্যান্য কোর্ট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। তাজউদ্দীন আহমদ ১৫ মার্চ এক বিবৃতিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সদলবলে ১৫ মার্চ ঢাকায় পৌঁছেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলােচনা করেন। ১৬ মার্চ সকাল দশটায় শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, খােন্দকার মােশতাক আহমদ ও ড. কামাল হােসেনকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে যান। তিনি এককভাবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ১৫ মিনিট আলােচনা করে সঙ্গীদের নিয়ে চলে আসেন। মাঝখানে দুদিন অতিবাহিত হলাে ইয়াহিয়া-মুজিব আলােচনা চলল।
১৯ মার্চ-এর কথা গাজীপুরের জয়দেবপুরে ভাওয়ালের রাজবাড়িতে এক ব্যাটালিয়ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট অবস্থান করছিল। বাঙালি সৈন্যদের নিরস্ত্র করার জন্য পাকসেনারা জয়দেবপুর আসে এই সংবাদ শুনে জয়দেবপুরের বাঙালি যােদ্ধারা সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়। তখন পাকবাহিনী যােদ্ধাদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। ২০ জন যােদ্ধা শহিদ এবং ১৬ জন আহত হন। ২০ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণ আলােচনা হয় দুই পক্ষের সাহায্যকারীরা উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রস্তাব ছিল প্রেসিডেন্ট অধ্যাদেশের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এবং সামরিক আইন প্রত্যাহার করবেন রাষ্ট্রপতির সাহায্যকারী বিচারপতি কর্নেলিয়াস জানান, ক্ষমতা হস্তান্তর ও সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় সংসদের অনুমতি ও শূন্যতা পূরণের জন্য আইনের প্রয়ােজন হবে। তাজউদ্দীন আহমদ এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মত পােষণ করলেন। আওয়ামী লীগের আরাে প্রস্ত বি ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যরা একটি কমিটি গঠন করে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিরা তাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। তারপর দুই কমিটির প্রস্তাব সংসদে পেশ করা হবে ২১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদের এক অনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা কেন্দ্রে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার থাকবে , প্রেসিডেন্ট তার উপদেষ্টাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করতে পারেন আওয়ামী লীগ চাচ্ছে সম্পূর্ণ ক্ষমতা প্রাদেশিক আইনসভার থাকবে। এ দিন জুলফিকার আলী ভুট্টো দল নিয়ে ঢাকা পৌছলে তাকে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরে শেরাটন, বর্তমানে রূপসী বাংলা) রাখা হয়। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ভুট্টোর আলােচনা চলে এর আগে ১৯ মার্চ ডেপুটি চিফ কমান্ডার জেনারেল আবদুল হামিদ ঢাকায় পেীছেন এবং সব জেনারেলের সঙ্গে গােপন বৈঠক করেন। তিনি ২১ মার্চ চট্টগ্রাম পরিদর্শন করেন এবং বাঙালিদের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। অন্যদিকে পিআইএ বিমানে প্রতিদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনী ঢাকায় আসছে ইয়াহিয়া খান একদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলােচনার নামে কালক্ষেপণ করছেন, অন্যদিকে বাঙালিদের হত্যার নীলনকশা অনুসারে পরিকল্পনা করছেন।
২২ মার্চ বিকেলে প্রেসিডেন্ট ও তার দল অধ্যাদেশের একটি খসড়া তাজউদ্দীন আহমদ ও ভুট্টোকে প্রদান করে। পিপলস পার্টি সংসদের অনুমােদন ছাড়া। অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিরােধিতা করে আওয়ামী লীগ ২৩ মার্চ প্রতিরােধ দিবস পালন করল। বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে। তার ধানমন্ডির বাসায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। একই দিন ইয়াহিয়ামুজিব-ভুট্টো আলােচনা চলল। প্রেসিডেন্টের দল একটি খসড়া তৈরি করেছে, আওয়ামী লীগ তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ২৬ পৃষ্ঠার খসড়া প্রণয়ন করে। ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্টের দল ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলােচনা হয়। এই সভায় আওয়ামী লীগ তাদের খসড়া সংশােধন করে পেশ করে। সংশােধনীতে ছিল সরকার হবে কনফেডারেশন পদ্ধতি, ফেডারেশন পদ্ধতি নয়। প্রেসিডেন্টের দল। আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের বিরােধিতা করে। প্রেসিডেন্টের খসড়া ছিল ফেডারেল পদ্ধতির সরকার। আওয়ামী লীগ কর্নোলিয়াসের প্রস্তাব গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ ও প্রেসিডেন্টের দল খসড়া চূড়ান্ত করার জন্য আলােচনায় বসবে কিনা সে সম্পর্কে রইল দ্বিমত ২৪ মার্চের সভার পর তাজউদ্দীন আহমদ সংবাদপত্রে বিবৃতিতে বলেছেন যে, তাদের আর কিছু বলার নেই এবং আর কোনাে আলােচনারও প্রয়ােজন নেই। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করলেন। আলােচনার আবরণে। অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার নীল নকশা তখন সম্পন্ন। দু-বছর আগে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের দিনকে বেছে নেওয়া হলাে বাঙালির ওপর মরণ আঘাত হানার জন্য। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালাে রাতে তাজউদ্দীন। আহমদ গেলেন শেখ মুজিবুর রহমানকে নিতে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন সেই ব্যাপারে তাজউদ্দীন তার সঙ্গে আলােচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু সেই ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন।
সেই অনুযায়ী আত্মগােপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল বড় কোনাে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাজউদ্দীনের পরামর্শ গ্রহণে বঙ্গবন্ধু এর আগে দ্বিধা করেননি। সেই কারণে তাজউদ্দীনের বিশ্বাস ছিল ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু তার কথা রাখবেন। অর্থাৎ তিনি তাজউদ্দীনের সঙ্গে যাবেন আত্মগােপনে। অথচ শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু তার সিদ্ধান্তে অনড় রয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুকে আত্মগােপনে যেতে রাজি করাতে না পেরে রাত নয়টার কিছু পরে। তাজউদ্দীন ঘরে ফিরলেন বিক্ষুব্ধ চিত্তে স্ত্রীকে সব ঘটনা জানালেন। সেই রাতে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনেরও ঘরে থাকার কথা ছিল না। পুত্র সােহেল ও ছােট মিমিকে সঙ্গে করে তারও বাসা ত্যাগ করার কথা ছিল। তিনি বুদ্ধি করে শারমিন ও রিমিকে তাঁতিবাজারে তাদের খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দুদিন আগেই তাজউদ্দীনের বন্ধু আওয়ামী লীগের এমএনএ ও কোষাধ্যক্ষ আবদুল হামিদ সেই সন্ধ্যায় এসেছিলেন জোহরা তাজউদ্দীনকে ফরাশগঞ্জে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে জোহরার ইচ্ছে ছিল স্বামীকে বিদায় জানিয়ে তারপর বাসা থেকে যাবেন তাজউদ্দীন ফেরার কথা ছিল অনেক আগেই কিন্তু বঙ্গবন্ধু বাসা না। ত্যাগ করার ফলে তাকে বােঝাতে তাজউদ্দীনের অনেক সময় লেগে যায়। এদিকে আবদুল হামিদ অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যান। সেই সময় রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে স্বেচ্ছাসেবক ও জনতা গাছপালা কেটে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। নেতৃবৃন্দের কাছেও খবর পৌঁছে গেছে যে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করার পরপরই সামরিক বাহিনী আক্রমণ ও ধরপাকড় শুরু করবে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও ছাত্রদের ওপর আঘাত আসবে এই ধারণাটি বদ্ধমূল থাকলেও নিরস্ত্র ও নিরীহ জনসাধারণের ওপরও যে ঢালাওভাবে আঘাত হানা হবে এই কথাটি অনেকেই ভাবতে পারেনি। শারমিন আহমদ তার বইয়ে আমাদের জানাচ্ছেন যে, সেদিন তাজউদ্দীন বাসায় ফিরে খুব রাগান্বিত হয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘মুজিব ভাই কিছুতেই বাসা থেকে যাবেন না।
আমিও কোথাও যাব না। বাইরের পােশাক বদলে তাজউদ্দীন ভগ্নচিত্তে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরই প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে উঠে পড়লেন। বাসায় তখনাে লােকজন আসা যাওয়া করছে। সবার মধ্যেই উৎকণ্ঠা ও উত্তেজনা। এরই মধ্যে বেগম নূরজাহান মুরশিদ (স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের স্ত্রী) তাজউদ্দীনের বাসায় এলেন। তিনি দেখলেন তাজউদ্দীনের মন খুব খারাপ বাসায় ক্রমাগত ফোন আসছে। তাজউদ্দীন বললেন যে দেশের কী হবে ঠিক নেই আর এখন মহিলারা ফোন করছেন মহিলাদের আসনে নমিনেশনের ব্যাপারে তদবির নিয়ে। বেগম নূরজাহান নিজেও বেশ কিছু ফোন রিসিভ করলেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও এলেন তাজউদ্দীনের খোঁজে। এসে দেখেন যে বেগম মুরশিদ বাইরের ঘরে বসা। ভেতরের ঘরে তাজউদ্দীনের গলা শুনতে পেলেন তিনি। তাজউদ্দীন জোরে জোরে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন। সেই সময় তার সঙ্গে আমীর-উল ইসলামের দেখা হলাে। তিনি বেগম মুরশিদকে তার ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে নামাতে চলে গেলেন। স্ত্রীর কাছে রাখা রাইফেলের ব্যাগটি না পাওয়ায় তাজউদ্দীন রেগেছেন। বললেন যে, রােগীকে মাত্র পনেরাে মিনিটের জন্য অজ্ঞান করা হয়েছে, অপারেশনের জন্য। ঐ পনেরাে মিনিটের বাইরে এক মিনিট অধিক সময়ও রােগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শেষ পর্যন্ত ব্যাগটি খুঁজে পেলেন সৈয়দা জোহরা । চটের ব্যাগ ও তার মধ্যে রাখা রাইফেলটি তাড়াহুড়ায় শােবার ঘরের আলমিরার মাথায় রেখে ভুলে গিয়েছিলেন। ব্যাগটি খুঁজে পাওয়ার পরও তাজউদ্দীনের অস্থিরতা কমল না।
শারমিন আহমদ তার বইয়ে জানাচ্ছেন, রাত প্রায় এগারােটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে ড. কামাল হােসেনকে সাথে করে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। আবারও ফিরে আসেন তাজউদ্দীনের বাসায়। তাজউদ্দীন তখন সামনের ফুল বাগানে ঘেরা লনে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন। তার পরনে লুঙ্গি ও হাফ হাতা গেঞ্জি। গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কথা বললেন তাজউদ্দীনের সঙ্গে। তাজউদ্দীন বললেন, ‘কী করব? কোথায় যাব?’ আমীর-উল ইসলাম যখন তাজউদ্দীনকে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য জোর তাগাদ দিচ্ছেন, তখনই বাসার দক্ষিণে ইপিআর-এর (ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস) এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত এম.এন, এ মােজাফফর সাহেব দৌড়াতে দৌড়াতে গেটের কাছে এসে বললেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইপিআরকে নিরস্ত্র করছে কথাটি শােনার পর তাজউদ্দীনের মনে পরিবর্তন এলাে। দ্রুত গতিতে ঘরের ভেতর গেলেন। যখন ফিরে এলেন কাধে তার রাইফেল ঝুলছে, কোমরে পিস্তল গোঁজা। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া স্টাইলের হাফ হাতা শার্ট। সহচরদের সঙ্গে তিনি বেরিয়ে পড়লেন অজানার পথে স্ত্রীকে তড়িঘড়ি করে বলে গেলেন, “তােমরা কী করবে কর। আমি চলে গেলাম। সৈয়দা জোহরা ঝােপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলেন গাড়িটি ঝিগাতলার দিকে ছুটে গেল এবং একটু পর আবার ঘুরে এসে লালমাটিয়ার পথে সাঁই করে মিলিয়ে গেল। এই সময় জোহরাও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন সােহেল ও মিমিকে নিয়ে বাড়ি ছাড়বেন। কিন্তু তার আগেই গুলি ও ফ্লেয়ার ছুড়তে ছুড়তে পাকিস্তানি বাহিনীর জিপ গাড়িগুলাে বাড়ির দিকে আসতে লাগল। ফ্লেয়ার ছোড়ার ফলে নিকষ কালাে রাত ভােরের মতাে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কোনাে ক্ষুদ্র প্রাণীরও লুকিয়ে রাস্তা পার হওয়ার উপায় নেই, গাড়িতে করে পালানাে তাে দূরের কথা। টেলিফোন বিদ্যুতের লাইনগুলাে ঝমঝম শব্দে খুলে পড়ল।
সৈয়দা জোহরা উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সােহেল ও মিমিকে নিয়ে চলে গেলেন দোতলায়, যেখানে মাত্র বছর খানেক আগেই নতুন ভাড়াটে হয়ে এসেছিলেন কালীগঞ্জ ছাত্রলীগের এক সময়ের সহ-সভাপতি বিলেত ফেরত তরুণ ব্যারিস্টার আবদুল আজিজ বাগমার ও তার প্রাণবন্ত, সদালাপী নবপরিণীতা স্ত্রী আতিয়া বাগমার। বুদ্ধি করে সৈয়দা জোহরা ও আতিয়া উর্দুভাষী ভাড়াটে সাজলেন। আতিয়ার পরনে সেলােয়ার কামিজ, সৈয়দা জোহরা শাড়ি বদলে সেলােয়ার-কামিজ পরার সময় পাননি। তারা দুজনেই গৌরবর্ণের, সাধারণ বাঙালি নারীর তুলনায় লম্বা চওড়া এবং উর্দুভাষায় দুজনেই পরদর্শী। পাকিস্তান বাহিনী শেল ও গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বাড়িতে উপস্থিত হলাে। তারপর দোতলার শােবার ঘরে ঢুকে সৈয়দা জোহরা ও আতিয়ার বুকের ওপর স্টেনগান ধরে রুক্ষ স্বরে উর্দুতে জিজ্ঞেস করল, ‘তাজউদ্দীন কোথায়? মিসেস তাজউদ্দীন এখানে কোন জন? তুমি না তুমি?’ আতিয়া খুব দৃঢ়স্বরে উর্দুতে প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আপনারা ভুল করছেন। এখানে মিসেস তাজউদ্দীন নেই । আমরা সবাই ভাড়াটিয়া। আমাদের বাড়িওয়ালা তাজউদ্দীন সাহেব নিচতলায় থাকেন। সৈয়দা জোহরার দারুণ আশঙ্কা হচ্ছিল যদি নিচতলায় ফ্রেমে বাঁধানাে ছবিগুলাে। দেখে তাকে তারা চিনে ফেলে! তিনি কোলে করা সােহেলকে নিয়ে নিজের মুখটা খানিক আড়াল করে কপট ধমকের সুরে আতিয়াকে উর্দুতে বললেন, ‘আমি তােমাকে প্রথমেই মানা করেছিলাম রাজনীতিবিদদের বাড়ি ভাড়া না নিতে হায় আল্লাহ! এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে এই ভােগান্তি আমার নসিবে ছিল! আমি কালই করাচির টিকিট কেটে এই দেশ ছাড়ব। আতিয়া ও জোহরার অভিনয়টি দারুণ হয়েছিল। তাদের দিকে তাক করা স্টেনগানগুলাে সরে গেল। তারা সেই যাত্রায় রক্ষা পেয়ে গেলেন। তারা রক্ষা পেলেও অন্য ঘর ও নিচতলায় যারা ছিল তাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দি করে। নিয়ে গেল। আটক থাকা অবস্থায় তাদের উপর চলল অকথ্য নির্যাতন।
সেই রাতে নিচতলার কিশাের কাজের ছেলে দিদারের ওপর আসে আক্রমণের প্রথম ঝাপটা তাকে তাজউদ্দীন ও তার স্ত্রী কোথায় জিজ্ঞেস করা হয়। তখন সেই কিশাের। উপস্থিত বুদ্ধি না হারিয়ে বলে উঠল যে, দুপুরের খাবার খেয়ে তারা কোথায় চলে গেছেন সে জানে না। দিদার সে-যাত্রায় পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে রক্ষা পেয়ে পালিয়ে যায়। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর সে চুপে চুপ আবার ফিরে আসে। বাড়িতে, তাজউদ্দীনের শ্বশুর সেরাজুল হকের কাছে। সৈন্যরা নিচতলায় ৭৮ বছরের বর্ষীয়ান সৈয়দ সেরাজুল হকের বুকেও স্টেনগান ঠেকিয়ে কর্কশ স্বরে তাজউদ্দীন ও জোহরার খবর জানতে চায়। অসুস্থ সেরাজুল হক উঠে বসে ইংরেজি ও উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করেন। দুজন অপেক্ষাকৃত ভদ্রগােছের অফিসার তাকে শুয়ে পড়তে বলল। হায়! সেরাজুল হক সেই আদেশকে মৃত্যুর সংকেত মনে করে কলমা পড়তে পড়তে আবার শুয়ে পড়লেন। সৈয়দা জোহরা ও আতিয়া সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পর সৈয়দা জোহরা আবারও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন দ্বিতীয় কোনাে বাহিনী চলে আসার আগেই বাড়ি ছাড়বেন। ২৬ মার্চ চারদিকে কারফিউ চলছে, বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর আনাগােনা। পাশের বাড়ির ছাদে নিজেকে আড়াল করে একজন (সাকিবার বাবা) ইশারায় জোহরাকে বলছেন তার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার বাড়িটি তাজউদ্দীনের বাড়ির মতােই বড় রাস্তার ওপরে হওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যদের নজর এড়িয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া কঠিন। আতিয়ার সহায়তায় জোহরা অতি সতর্কতার সঙ্গে দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে এলেন। কোলে সােহেল এবং মিমির হাত ধরা।
সঙ্গে কাজের মেয়ে আমেনা বেগম। নিচতলায় ভেতরের বারান্দায় জোহরার বাবা সৈয়দ সেরাজুল হক বসা। তার দৃষ্টিতে যেন সব হারাবার ব্যথা জোহরা তার বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া চাইলেন বললেন, তিনি পেছনের বাড়ির দেয়াল টপকিয়ে পালাতে যাচ্ছেন। সেরাজুল হক ব্যাকুল কণ্ঠে মেয়েকে রুখতে চাইলেন বললেন, “লিলি, তুই যাসনে, মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যাবি। চারদিকে তখনাে কারফিউ চলছে। ধরা পড়ার ভয় প্রতিপদে জোহরা আর পিছু ফিরে তার বাবার দিকে চাইলেন না। ভয় হলাে, কী জানি যদি মায়ার টানে দুর্বল হয়ে পড়েন! পেছনের বাড়ির ভদ্রলােক ছিলেন অতি সজ্জন এক ব্যক্তি সিলেটে তার বাড়ি, নাম আবদুল মুবিন চৌধুরী। মুক্তিযােদ্ধা বীর বিক্রম মেজর (অব.) শমসের মুবিন চৌধুরীর বাবা। তিনি ও তার স্ত্রী তাহমিদুর নাহারসহ পুরাে পরিবার ছুটে এলাে জোহরা ও তার শিশুদের দেয়াল পার করানাের জন্য সহযােগিতা করতে ভদ্রলােক জোহরাকে তার মেয়ে’ সম্বােধন করে অতি সমাদরে বরণ করলেন। অথচ নতুন এই প্রতিবেশীদের সঙ্গে জোহারার আগে কোনাে আলাপ পরিচয় হওয়ার সুযােগ হয়নি। ২৭ মার্চ সকাল আটটায় কারফিউ তুলে নেওয়া হলাে। তখন জোহরার ভাই ক্যাপ্টেন সৈয়দ গোলাম কিবরিয়া বােনকে তার আশ্রয়দাতার বাড়ি থেকে নিয়ে যান। শঙ্কা ছিল জোহরার খোজে সামরিক বাহিনী আশপাশের বাড়িতেও হামলা চালাতে পারে আতিয়া সেদিন চলে গেলেন শান্তিনগরে তার মায়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় সৈয়দ সেরাজুল হকের কাছে তিনি কিছু টাকা রেখে গেলেন। সেদিন বেলা ১১টায় ক্যাপ্টেন সৈয়দ গােলাম কিবরিয়ার ধানমন্ডির বাড়িতে মুসা সাহেব নিয়ে এলেন সেই ঐতিহাসিক চিরকুট। দোলনচাপা’ ছদ্মনামে তাজউদ্দীন এই চিঠি পাঠিয়েছেন। জোহরা রুদ্ধশ্বাসে বারবার করে পড়লেন স্বামীর পরিপাটি মুক্তার মতাে হাতে লেখা ছােট্ট ক’টি অসামান্য বাক্য লিলি আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও। আবার কবে দেখা হবে জানি না… মুক্তির পর । তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে-সাত-কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যাও।
—দোলনচাপা। শারমিন আহমদ তার বইয়ে লিখেছেন, আব্বুর চিরকুটটি পড়ার পর আম্মা তার হৃদয়ের অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে, ‘কতক্ষণ যে কাগজখানা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না। সেদিনের সেই মুহূর্তে এ কথা কয়টি শুধু কথার কথাই ছিল না। জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু করার জন্য সেই লেখাগুলাে ছিল এক পবিত্র প্রেরণার উৎস। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে নতুনরূপে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন। তারপর ফিরে পেলাম এক নতুন সত্তা। শুরু হলাে এক অবিস্মরণীয় মহান যাত্রা।
ভারতে, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন
২৭ মার্চ ভােরে কার্য তুলে নেওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঢাকা ত্যাগ করেন। পদ্মা নদী পার হয়ে মাগুরা হয়ে ২৮ মার্চ ঝিনাইদহ পৌছলেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী ও মেজর ওসমান চৌধুরীর সহায়তায় ২৮ মার্চ রাতে মেহেরপুর দিয়ে তারা সীমান্ত অতিক্রম করলেন। সীমান্ত অতিক্রমের আগে তিনি বার্তা পাঠান যথাযথ মর্যাদায় তাদেরকে গ্রহণ করা হলাে। তারা ভেতরে। ঢুকবেন। সীমান্ত অতিক্রম করার পর ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিদর্শক গােলক মজুমদার তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে যথােপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। গােলক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক। কেএফ রুস্তামজী তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। আশ্রয়স্থলে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করেন এবং পূর্ববাংলার সার্বিক পরিস্থিতি ও বাঙালির স্বাধীনতা লাভের অদম্য স্পৃহা সম্পর্কে সম্যক অবগত হন। সীমান্তে পৌছে তাজউদ্দীন আহমদ দেখলেন যে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছুই করার নেই। মুক্তিফৌজ গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন বিএসএফ-এর সাহায্য চাইলে তঙ্কালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন যে মুক্তি সেনা ট্রেনিং এবং অস্ত্র প্রদান সময়সাপেক্ষ কাজ। তিনি আরাে বলেন, ট্রেনিং বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোনাে নির্দেশ না থাকায় তিনি মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না।
কেএফ রুস্তামজী দিল্লির উর্ধ্বতন মহলের সঙ্গে যােগাযােগ করলে তাকে জানানাে হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে দিল্লি চলে আসার জন্য। উদ্দেশ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠক। দিল্লিতে যাওয়ার পর ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের আগে ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয় এবং তিনি তাদের বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার জন্য যেসব সাহায্য ও সহযােগিতার প্রয়ােজন তা বুঝিয়ে বলেন। এসময় তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যায় না। সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ওই সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোনাে দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনাে সরকার। গঠিত হয়েছে কিনা। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরবেন কারণ এতে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয়। তা কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দীনের ধারণা হয়। ৪ এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বৈঠক হয়। ঐ সাক্ষাতে কোনাে সহযােগী ছিল না। সাক্ষাৎ শেষে তিনি সহকর্মী আমীর-উল ইসলামকে জানান, মিসেস গান্ধী বারান্দায় পায়চারী করছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের গাড়ি পৌছার পর তাকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তার স্টাডি রুমে নিয়ে যান। স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে মিসেস গান্ধী প্রশ্ন করেন, হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অলরাইট?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন।
২৫ মার্চের পরে। তার সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ হয়নি।’ তাজউদ্দীন আরাে বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যে কোনাে মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ প্রয়ােজন আগত শরণার্থীদের জন্য প্রয়ােজন আশ্রয় ও খাদ্য।’ তিনি আরাে বলেন, পাকিস্তান সরকার আমাদের। পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাবে। কিন্তু তাদের এই চেষ্টা কোনােভাবেই সফল হতে দেওয়া যাবে না।’ তিনি জানান, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম, মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে। সব গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহযােগিতা আমরা চাই।’ মাতৃভূমির স্বাধীনতাযুদ্ধে তাজউদ্দীন আহমদ ভারত সরকারের সার্বিক সহযােগিতা কামনা করেন। বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন আহমদ জানান যে পাকিস্তানি আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই ২৫/২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘােষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকে যােগদানকারী সকল প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রিসভার সদস্য। শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতাকর্মীর খবর অজানা থাকায় সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে দিল্লির ওই সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে তুলে ধরেন। ওই বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরােধ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৫ এপ্রিল আবার তিনি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলােচনা করেন। আলােচনায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়—এক. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হয়, দুই. সরকার পরিচালনায় সহায়তা প্রদান, তিন, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের ব্যবস্থা, চার, বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়, পাঁচ, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা, ছয়, আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্যদের সাথে যােগাযােগের জন্য একটি বিমান প্রদান, সাত, মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ প্রচারের জন্য একটি বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, আট, মুক্তিযােদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ। এই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রেহমান সােবহান ও ড. আমিনুর রহমান, অ্যাডভােকেট সিরাজুল হক দিল্লিতে ছিলেন। তারা ২৫ মার্চের পর ঢাকা ত্যাগ করে ভারতে চলে আসেন। ৭ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ ও আমীর-উল ইসলাম ফিরে আসেন কলকাতায়। সেখানে তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম একই স্থানে থাকতেন। আমীর-উল ইসলাম আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণার আলােকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন এবং তাজউদ্দীন খসড়া দেখে অনুমােদন করেন।
১০ এপ্রিলের ঐতিহাসিক বেতার ভাষণ
দিল্লিতে অবস্থানকালে তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করেন। ভাষণটির খসড়া তাজউদ্দীন আহমদ, আমীর-উল ইসলাম ও রেহমান সােবহান মিলে তৈরি করেছিলেন। পরে দিল্লিতে রেকর্ড করা নতুন আত্মপ্রকাশিতব্য নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বক্তৃতাটি শিলিগুড়ির কোনাে এক জঙ্গলের গােপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছিল। ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশ সময় রাত দশটায় বেতারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনসহ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অকুতােভয় সংগ্রামের খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই দিনটি বাঙালি জাতির জন্য একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অনুভূতির ও আকাক্ষিত। এদিন আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে বারবারই প্রচার করা হচ্ছিল যে রাত দশটার পর একটি বিশেষ সংবাদ প্রচারিত হবে। এদিন বাংলাদেশের মানুষ ওই বিশেষ খবরটি শােনার জন্য উদগ্রীব হয়ে রেডিওর সামনে বসে দল বেঁধে অপেক্ষা করছিল। রাত দশটায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতেজ ও মসৃণ কণ্ঠে। উচ্চারিত হলাে শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবাদটি। তিনি বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নামের নতুন এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এখন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারিত হবে। এরপরই ইথার তরঙ্গের মধ্য দিয়ে ভেসে এলাে তাজউদ্দীন আহমদের কণ্ঠস্বর “স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাই-বােনেরা, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে।
২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলােলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নরহত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা। প্রতিরােধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের। স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরােধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছে যে পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেকদিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে। আপনাদের অদম্য সাহস ও মনােবল যা দিয়ে আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে, তার মধ্যে দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্ৰাস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্য দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালি জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম এক শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধু-বাৎসল্যে, মায়া ও হাসি-কান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লি-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম যুদ্ধ ও রণডংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে কিন্তু আজ? আমাদের মানবিক মূল্যবােধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা, আবার প্রমাণ করেছি যে আমরা তিতুমির-সূর্যসেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রুসেনাদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনােবলের কাছে শত্রু যত প্রবল পরাক্রম হােক না কেন, পরাজয়।
বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে। নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়ত কিছুদিনের জন্যে হলেও পিছিয়ে যেত আপনারা শত্রু-সেনাদের ট্যাঙ্ক ও বােমারু বিমানের মােকাবিলা করেছেন এবং আপনাদের যা হাতে যে অস্ত্র ছিল তাই নিয়েই রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোনাে জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তারা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন। আজ প্রতিরােধ। আন্দোলনের কথা গ্রামবাংলার প্রতিটি ঘরে পৌছে গেছে হাজার হাজার মানুষ। আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর-এর বীর বাঙালি যােদ্ধারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরােভাগে। রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মােজাহিদ, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যােগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শক্রদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র ও গােলা-বারুদ দিয়ে বাংলার এ মুক্তিবাহিনীকে শক্র মােকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। সাগরপারের বাঙালি ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন। সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে আমাদের। মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শক্রর সঙ্গে মােকাবেলা করেছেন এবং শত্রুসেনাদের সিলেট এবং কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শীঘ্রই শত্রুকে নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে।
চট্টগ্রাম ও নােয়াখালী অঞ্চলের সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের উপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরােধব্যুহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলের ভাই-বােনেরা যে সাহসিকতার সাথে শত্রুর মােকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরােধ স্ট্যালিনগ্রাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরােধের জন্য চট্টগ্রাম আজও শক্রর কবলমুক্ত রয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নােয়াখালী জেলাকে মুক্ত এলাকা’ বলে ঘােষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেজর সফিউল্লার উপর ময়মসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতিমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযােগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছােট ছােট শিবিরগুলােকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ইপিআর-এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশােহর জেলার। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিজয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শক্রসেনা এখন যশােহর ক্যান্টনমেন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের উপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশালপটুয়াখালীর।
উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হকের নেতৃত্বে সৈয়দপুরে ও মেজর নােয়াজেশের নেতৃত্বে রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া বাকি অংশ এখন মুক্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিষ্যতে আরও নতুন সাফল্যের দিশারী। প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিচ্ছে তেমনি শত্রুর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আসছে শত্রুর কেড়ে নেওয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি পরিচালনা কেন্দ্র গড়ে তােলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কণ্ঠস্বর এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়। আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায় পূর্বাঞ্চলের সরকারি কাজ পরিচালনার জন্যে সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তাঁরা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামাবাদ শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উচিয়ে দাড়িয়েছে তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেন।
আমরা যদিও বিদেশ থেকে পাঠানাে ত্রাণ-সামগ্রীর জন্য কৃতজ্ঞ কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে আজকের দিনে বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে বড় ত্রাণের বাণী বয়ে আনতে পারে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত হাতিয়ার, যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে তার ও তার প্রিয় পরিজনের জান, মান আর সম্রম। বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারের আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালির কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার পৈশাচিক উন্মত্ততায় মত্ত আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। এ সমস্ত অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল বিদেশি শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, বাংলার নিষ্পাপ শিশুদেরকে ও নিরপরাধ নরনারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্যে নিশ্চয়ই এ অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে অস্ত্র কেনা হয়েছে এবং যাদের টাকায় ইয়াহিয়া খানের এই দস্যুবাহিনী পুষ্ট, আজ তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে আমরা অস্ত্র সরবরাহকারী শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, শুধু অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলেই চলবে না, যে অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সে অস্ত্র দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে। পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
তাই আমরা সমস্ত দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যারা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবেন না, এ বিশ্বাস আমরা রাখি। বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চেয়েছি তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে—একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে—হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোনাে বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হবার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন ও সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্রপরিবারগােষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার। আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা, আপনারা পৃথিবীর যে কোনাে প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থসংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা অতিসত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতৃভূমিকে রক্ষা করবার কাজে ইতিমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি। তাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি, যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন। আমাদের স্থিরবিশ্বাস যে, শীঘ্রই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতিমধ্যে প্রত্যেকে আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারে ট্রেনিং নেবার জন্য নিকটবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সংগে যােগাযােগ করুন।
যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাঁদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। শত্রুর ছত্রী ও গুপ্ত বাহিনীকে অকেজো করে দেবার কাজে আপনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরে কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরাে নানাভাবে আপনার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রান ও কাবু করতে পারেন। নদীপথে শত্রু যাতে না আসতে পারে তার সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই গ্রহণ করতে হবে ও সবদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। নদীপথে সমস্ত ফেরি, লঞ্চ ও ফ্লাট অকেজো করে দিতে হবে। এ সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্যে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদে নেতৃত্বে ছােট ছােট দলে সংগঠিত হতে হবে। এর জন্যে আপনার এলাকার সমর পরিচালকের সাথে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যােগাযােগ করতে হবে এবং তার আদেশ ও নির্দেশাবলি মেনে চলতে হবে। যুদ্ধে অংশ নেওয়া ছাড়াও বাংলাদেশকে সব দিক দিয়ে বাচিয়ে রাখবার দায়িত্বকেও অবহেলা করলে চলবে না। শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙালি অফিসারদের মধ্যে যারা এখনও আমাদের সাথে যােগ দিতে পারেননি, তারা যে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা তাদের মুক্ত এলাকায় চলে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি। অনুরূপভাবে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকনিশিয়ান, ইঞ্জিনিয়ার, সংবাদসেবী, বেতারশিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের—তারা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমাদের সামনে বহুবিধ কাজ, তার জন্যে বহু পারদর্শীর প্রয়ােজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়ােগ করবার সুযােগ পাবেন। আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে সামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক প্রতিরােধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরাচরিত রাজনৈতিক গণ্ডির ঊর্ধ্বে রাখবার জন্যে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোনাে প্রকার সহযােগিতা করা বা সংশ্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোনাে মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রুসৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গাের থেকে গাত্রোত্থান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেছে তারা যদি এই সুযােগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বাংলাদেশের। স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয় তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রােষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। হয়ত কোথাও নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। আমাদের উচিত হবে যতদূর সম্ভব ব্যয়সংকোচ করা এবং জিনিসপত্র কম ব্যবহার করা। দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ অনুরােধ তারা যেন মজুতদারী ও কালােবাজারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জিনিসপত্রের দাম যাতে সাধারণ লােকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে না যায় তার দিকে দৃষ্টি রাখেন। এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতিমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমরসজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নিচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালির ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে তারা বুটের নিচে নিষ্পেষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। আমরা তাদের মারমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাদের যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে তাদের সমস্ত ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ, ঢাকার সাথে আজ তাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন উড়ােজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর। বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বালানি সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়ােজাহাজ আর বেশিদিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতাে। ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমগ্র মানুষের প্রাকুটি ও ঘৃণা। ওরা ভীত, ওরা সন্ত্রস্ত—মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরােয়ানা নিয়ে হাজির। তাই ওরা উন্মাদের মতাে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে।
পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ, যেখানে ওরা এ ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার করে নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে এ সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করেছেন তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তাণ্ডবলীলার চাক্ষুষ প্রমাণ। ইতােমধ্যে সােভিয়েত রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচারে গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সােভিয়েত রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনও বাংলাদেশের এই অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানি বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা। আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল তাদের জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি। জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ। যদিও কোনাে কোনাে দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ । ব্যাপার বলে অভিহিত করছে, তবু একথা এখন দিবালােকের মতাে সত্য হয়ে গেছে যে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ।
পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরােধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের প্রতিনিধি পাঠাচ্ছি এবং বিদেশে সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে কূটনৈতিক স্বীকৃতি ও আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি। আমাদের যে সমস্ত ভাইবােন শক্রকবলিত শহরগুলােতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাদেরকে আমরা এক মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারি না। যারা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাদের জন্যে রইল আমাদের আমন্ত্রণ যাদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবােনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত।
আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থিরবিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেওয়ার আগে শক্ররা আরও অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং এর সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হােক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শােষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত হােক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি ভাইবােনের সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণমানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের। ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হােক ‘জয় বাংলা’, ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’। তাজউদ্দীনের দীর্ঘ এই ভাষণটি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছিল। তার ভাষণের প্রতিটি ছত্রেই রয়েছে সুচিন্তিত দিক-নির্দেশনা স্বাধীনতার লক্ষ্যে ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের জন্য ।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫