রাজনীতির উন্মেষকালে
বলা যায়, কাপাসিয়া মাইনর স্কুলে পড়ার সময় রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয় তাজউদ্দীন আহমদের। ১৯৩৭ সালের কথা তখন তিনি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছেন। সেই সময় তিনজন শিক্ষক রাজবন্দিকে কাপাসিয়া থানার কর্তৃত্বে রাখা হয়। একদিন তাদের একজন তাজউদ্দীনকে দেখে কাছে ডেকে নিলেন কিছু প্রশ্ন করলেন। সঠিকভাবে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিলেন তাজউদ্দীন। তার মেধা দেখে রাজবন্দিরা অবাক হলাে। তারপর সেই তিন রাজবন্দি তাজউদ্দীনকে ইতিহাস, ভূগােল, যুদ্ধ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মনীষীদের জীবনী সম্পর্কিত প্রায় ৫০-৬০টি বই দিলেন পড়তে। তাজউদ্দীন পড়লেন সবকটি তারপর শুরু হলাে পরীক্ষা সব বিষয়ে তিনি পাস করলেন। কিন্তু রাজনীতি বিষয়ে পেলেন সবচেয়ে বেশি নম্বর। তিন রাজবন্দি তাকে বললেন ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে এই তিন রাজবন্দির সংস্পর্শে এসেই তাজউদ্দীনের হাতেখড়ি হয় রাজনীতিতে। তাদের পরামর্শেই তিনি কালিগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। কয়েক মাস পর কারা অন্তরীণ অবস্থার অবসান হলে সেই তিন রাজবন্দি কোথায় চলে গেলেন তা জানলেন না তাজউদ্দীন। তার সঙ্গে তাদের শেষ সাক্ষাটুকুও হয়নি। যেদিন তারা চলে যাচ্ছিলেন সেদিন তাজউদ্দীন অন্য গ্রামে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন তারা যাওয়ার সময় তাজউদ্দীনের ঘরে রেখে গিয়েছিলেন একজোড়া গােলাপ। ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি ঢাকা উত্তর মহকুমা বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সদস্য হন। লীগের ইউনিয়ন ও শাখা কমিটির নির্বাচন সম্পন্ন করে মহকুমা কমিটি গঠন করণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একইসঙ্গে তিনি কামরুদ্দিন আহমদের দক্ষিণহস্ত হিসেবে সব মহকুমার অগ্রগতি সমন্বয় করতেন। গফরগাঁওয়ের সংঘাতময় পরিস্থিতিকে ত্বরিতগতিতে তিনি মােকাবেলা করেছেন দেখে কামরুদ্দিন আহমদ বিস্মিত হয়েছিলেন।
তিনি মাওলানা শামসুল হুদার পার্টির দাবির প্রতিধ্বনি দিয়ে। তার দলের লােকদের শান্ত করেছিলেন। তিনি উপস্থিত না হলে মাওলানার লােকদের হাতে তাদের লাঞ্ছিত হতে হতাে। সেখানে কামরুদ্দিন ও তাজউদ্দীনের আগে শামসুল হক ও বাহাউদ্দিন চৌধুরী এসেছিলেন এবং দুজনই লাঞ্ছিত হন। ‘৪৪ সালে ঢাকা থেকে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। তাজউদ্দীন এবছরই তিনি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম ও শেখ মুজিবুর রহমানের সংস্পর্শে আসেন এবং তাদের প্রেরণাতেই তিনি মুসলিম লীগে যােগ দেন। ‘৪৬ সালের ১৯-২২ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ঢাকা জেলার সব আসনে মুসলিম লীগ জয়ী হয়। ফরিদপুরে শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইউসুফ হােসেন চৌধুরী মােহন মিয়াকে স্বেচ্ছাসেবক ও অর্থ দিয়ে সাহায্য না করে তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন ফলে মােহন মিয়া পরাজিত হলেন এবং নির্বাচিত হলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী শামসুদ্দিন চৌধুরী। এ কে ফজলুল হক এককভাবে তিন আসনে অপরাজিত থেকে তার ব্যক্তিগত জয় টিকিয়ে রাখতে সমর্থ হন। তার দলীয় প্রার্থী সৈয়দ মােহাম্মদ আফজাল পিরােজপুর থেকে এবং খান সাহেব হাতেম আলী জমাদ্দার মঠবাড়িয়া থেকে নির্বাচিত হন। ১১৯টি আসনের মধ্যে শেরেবাংলা মাত্র ৫টি আসন লাভ করেন। মুসলিম লীগ ১১৪টি আসনে বিজয়ী হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকা জেলার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করেন। কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ ঢাকা জেলার মুসলিম লীগের নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন এবং সবকটি আসনে মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়। তাজউদ্দীন আহমদের নির্বাচনী এলাকা ঢাকা উত্তর-কাপাসিয়া থেকে এমএলএ নির্বাচিত হলেন ফকির আব্দুল মান্নান পরবর্তীকালে ‘৫৪ সালের নির্বাচনে তাকে হারিয়েই তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত হন। ‘৪৭ সালের ৫ জুন দিল্লিতে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার কাউন্সিলরদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ দিল্লির অধিবেশনে যােগ দেন।
এ সময় তিনি দিল্লিতে হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার মাজার জেয়ারত করেন। ব্রিটিশ-বিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে তিনি বাংলা ও ভারতের কোনাে কোনাে স্থানে দলীয় প্রচারাভিযানে যান। ‘৪৭ সালের ৩ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান সৃষ্টির ঘােষণা দেয়। ভারত ও বাংলা বিভাগ তাজউদ্দীন আহমদ মেনে নিতে পারেননি। কামরুদ্দিন আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন, তােয়াহা, তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকদিন আলােচনার পর ‘পিপলস ফ্রিডম লীগ’ বা গণআজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং কামরুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে গণআজাদী লীগ নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করা হয়। কিন্তু গণআজাদী লীগ গণসংগঠনে পরিণত হতে পারেনি। আহ্বায়ক কামরুদ্দিন আহমদের কর্মবিমুখ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, কারাভীতি ও ত্যাগী মনােভাবের অভাবই ছিল এর কারণ। এছাড়া তখন ছিল সারা দেশে উৎকট সাম্প্রদায়িক বিষাক্ত আবহাওয়া। তার উপর তদানীন্তন মুসলিম লীগ সরকারের কাঠের দমননীতি। পাকিস্তান সৃষ্টির পর একদিন শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে যান। সােহরাওয়ার্দী তাকে চিনতেন না, তাই শেখ মুজিবকে প্রশ্ন করলেন, “হু ইজ হি?’ এই কথা শুনে তাজউদ্দীন বেরিয়ে যান। পরে শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে তাজউদ্দীন সম্পর্কে জানতে পারেন সােহরাওয়ার্দী। আস্তে আস্তে তিনি সােহরাওয়ার্দীর প্রিয় হয়ে ওঠেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ‘৪৭ সাল থেকে ঢাকাকেন্দ্রিক পাকিস্তানবাদ-বিরােধী পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনবাদী গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে তাজউদ্দীন সক্রিয় ছিলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ঢাকা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় অনেক সমস্যা দেখা দেয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল আবাসন। অফিস ও কর্মকর্তাদের বাসস্থানের তীব্র সঙ্কট শুরু হয়। নাজিমউদ্দিন সরকার সমর্থক শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত বঙ্গীয় মুসলিম ছাত্রলীগ নিজেদের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। এ কারণে ছাত্রসমাজে অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। ‘৪৭ সালের নভেম্বর মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ বর্তমান স্থান থেকে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ঢাকা মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে কনডেঞ্জ এমবিবিএস কোর্স এবং ঢাকা আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে ডিগ্রি কোর্স চালুর দাবিতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্রমিছিল ইডেন বিল্ডিংয়ে প্রবেশ করে। সচিবালয়ের কর্মচারীরাও ছাত্রদের সঙ্গে যােগ দেয়। কর্মচারীরা পানি ও আবাসন সঙ্কটে ভুগছে। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের দাবি শােনেন। ছাত্রদের প্রাথমিক বিজয় সূচিত হলাে। সােহরাওয়ার্দী গ্রুপের ছাত্রনেতা পিরােজপুরের নুরুদ্দিন আহমদ কলকাতা থেকে আসতে পারেননি। কিন্তু তার দলের আবদুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং মুসলিম ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবদুল মতিন চৌধুরী, মুহাম্মদ তােয়াহা, ঢাকা কলেজের ছাত্র তাজউদ্দীন আহমদ, অলি আহাদ প্রমুখের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন এগিয়ে চলে। ৫ জনের ছাত্র প্রতিনিধি দল জিন্নার সঙ্গে দেখা করেন।
তিনি ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তাজউদ্দীন। ‘৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার কাজে তিনি নিযুক্ত ছিলেন। সে বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের সমর্থনে পরিচালিত ছাত্রদের আন্দোলনে নেতৃস্থানীয়দের একজন ছিলেন তাজউদ্দীন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি অনার্সের ছাত্র এবং ফজলুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। ‘৫০ সালে দাঙ্গা প্রতিরােধ ও ‘৫১ সালে যুবলীগ প্রগতিশীল ছাত্রদের গঠন প্রক্রিয়ায় তাজউদ্দীন একজন উদ্যোক্তা ছিলেন। গণতান্ত্রিক যুবলীগের নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন তিনি। শেখ মুজিবুর রহমান যুবলীগে ছিলেন না। পরবর্তীকালে সেখান থেকেই অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টিতে চলে যান। যাদের অনেকের সঙ্গেই আজীবন তাজউদ্দীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। উদার গণতান্ত্রিক মতাদর্শ এবং সমাজতান্ত্রিক সমতাবাদী ভাবধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাজউদ্দীন আহমদের সাবসিডিয়ারি ছিল ইতিহাস এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ‘৫১ সালে বিএ অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার কথা তার কিন্তু শ্রীপুর বন বিভাগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় তার বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা দায়ের করা হলে পরীক্ষা না দিয়ে তিনি স্থানীয় জনগণের অনুরােধে কাপাসিয়া হাইস্কুলের শিক্ষকের পদ গ্রহণ করেন। প্রায় এক বছর এই স্কুলের শিক্ষকতা করেন। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ ও দক্ষ শিক্ষক। ঢাকায় তার যাতায়াত ছিল নিয়মিত এবং রাজনৈতিক ও অন্যান্য কাজও তিনি সমান গুরুত্বের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনকালে তাজউদ্দীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনিও এই সময় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে যােগ দেন। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৪৮ সালের সূচনাকাল থেকেই তিনি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন।
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ছিলেন। তার ডায়েরি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের তথ্যের অন্যতম উৎস। তমদুন মজলিশের সঙ্গে তার ছিল সুসম্পর্ক। ১৯৫৪-৫৭ সালে তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ‘৫৪ সালে নির্বাচনের হাওয়া বইতে লাগল। মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ সরকারকে পরাজিত করতে হলে দরকার জাতীয় ঐক্যের। ছাত্র-জনতার দাবি ‘হক-ভাসানী-সােহরাওয়ার্দী এক হও’। ছাত্র-যুবকদের চাপে অনেক আলােচনার পরে ‘৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। ‘৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কয়েকজন ছাত্রনেতাকে যুক্তফ্রন্ট থেকে মনােনয়ন দেন। তাদের মধ্য ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ একজন। ‘৫৪ সালের ৯-১০ মার্চ ইস্ট বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলির নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া এলাকা থেকে তিনি বিপুল ভােটে এমএলএ নির্বাচিত হন। তার কাছে পরাজিত হন মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক ফকির আবদুল মান্নান। এই সময় নির্বাচনী প্রচারে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও আতাউর রহমান খান তাজউদ্দীনের নির্বাচনী এলাকা কাপাসিয়ায় যান। ভাসানী কাপাসিয়া সফরে যাওয়ার বর্ণনা তাজউদ্দীন কন্যাকে খুব মজা করে বলেন, কাপাসিয়ায় তিনি মস্ত হাতির পিঠে চড়ে গিয়েছিলেন। সেই হাতিটা ছিল তাজউদ্দীনের ছােটবােনের শ্বশুরবাড়ির হাতির পিঠে চড়ে গহীন গজারি বনের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে তার মনে হয়েছিল কি জানি আবার বাঘে ধরে কিনা! ১৮ মার্চ নির্বাচনী এলাকার ভােট গণনা করা হয়। তাজউদ্দীন পেলেন ১৯০৩৯টি ভােট এবং ফকির আবদুল মান্নান পেলন ৫৯৭২টি। মাত্র আটাশ বছর বয়সে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হলেন তাজউদ্দীন। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হলে তাকে শােভাযাত্রাসহকারে যুক্তফ্রন্ট অফিস থেকে নবাবপুর আওয়ামী লীগ অফিস, এফএইচ হল ও সলিমুল্লাহ হল পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করে। বিজয়ের দিনেও তাজউদ্দীন আইনের ক্লাস করেছেন।
‘৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকার ও অবাঙালিরা যুক্তফ্রন্টের বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা যুক্তফ্রন্টকে হেয় করার জন্য চন্দ্রঘােনা পেপার মিল ও নারায়ণগঞ্জ আদমজী জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা বাধায় ১৫ মে আদমজী জুট মিলে দাঙ্গায় ১৫ শ’ নিরপরাধ শ্রমিক নিহত হয়। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ২১ দফা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২৩ এপ্রিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, আবু হােসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক, আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী, মােহন মিয়া, তফাজ্জল হােসেন করাচি যান। কেন্দ্রীয় সরকারে সঙ্গে তারা পূর্ববাংলার পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন। কেন্দ্রের মুসলিম লীগ সরকার শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হককে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সংবাদদাতা কালাহান এক নিবন্ধে লেখেন, ফজলুল হক বলেছেন, পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা হবে তার প্রথম কাজ। কেন্দ্রীয় সরকার ফজলুল হককে বিচ্ছিন্নতাবাদী, দেশদ্রোহী বলে ‘৫৪ সালের ৩১ মে গভর্নর জেনারেল গােলাম মুহাম্মদ ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং ৯২(ক) ধারা জারি করে পূর্ব বাংলার গভর্নর শাসন প্রবর্তন করে। গভর্নর চৌধুরী খালেকুজ্জামানের স্থলে কেন্দ্রের প্রতিরক্ষা সচিব মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করে। চিফ সেক্রেটারি মুহাম্মদ ইসহাকের বদলে এনএম খানকে পূর্ব বাংলার চিফ সেক্রেটারি নিয়ােগ করা হয়। ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর হয়ে যুক্তফ্রন্টের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। প্রায় ৩ হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩০ জন এমএলএকে গ্রেফতার করা হয়। মওলানা ভাসানী এই সময় ইউরােপ সফরে ছিলেন। ইস্কান্দার মির্জা ঘােষণা করলেন ভাসানী দেশে এলে তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে। ৫ জুন তাজউদ্দীন আহমদ ও ইয়ার মােহাম্মদ খান মিন্টো রােড থেকে ঢাকা। কেন্দ্রীয় কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে যান। জেলগেট থেকে পুলিশ ইয়ার মােহাম্মদকে গ্রেফতার করে।
তাজউদ্দীন কৌশলে জেলগেট ত্যাগ করতে সক্ষম হন। জার্মানির রাজধানী বার্লিনে বিশ্বশান্তি সম্মেলনে যােগ দেওয়ার জন্য মওলানা ভাসানী ‘৫৪ সালের ২৫ মে ত্যাগ করেন। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে অত্যধিক। পরিশ্রমের ফলে শরীর ভেঙে পড়া হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ‘৫৪-এর ৭ জুন ইউরােপের জুরিখ যান। জাতীয় দু-নেতা ইউরােপে, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক প্রায় গৃহবন্দি। এই অবস্থায় বাঙালি নেতাশূন্য হয়ে পড়ে একযােগে চলছে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জার স্বৈরশাসন ও নির্যাতন।
দু’টি চিঠি
তখন মওলানা ভাসানী তাজউদ্দীন আহমদ ও অলি আহাদের কাছে একটি চিঠি লেখেন। প্রাসঙ্গিক বলে চিঠিটি উল্লেখ করছি প্রিয় অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ ও ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্য সাহেবান, অদ্য আমি ময়মনসিংহ হইতে নালিতাবাড়ি মিটিংয়ে খােদা করেন রওনা হইব। তথা হইতে আগামীকল্য ফিরিব। পরশু জ্বর উঠিয়াছিল গতকল্য জ্বর আসে নাই। আল্লা ভরসা তােমারা আগামী ওয়ার্কিং কমিটিতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পাটিকে নির্দেশ দিবে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করিয়া কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট সুপারিশ করতঃ প্রস্তাব আনয়ন করে বিশেষ জরুরি কাজ জানিবে। অপজিশন হইতে প্রস্তাব আসিবে। আমাদের পক্ষ হইতে প্রস্তাবের নােটিস না দিলে বা আনয়ন না করিলে জনসাধারণের নিকট মুখ দেখানাে যাইবে না। অপজিশনের প্রস্তাবে বাধ্য হইয়া ভােট দিতে হইবে, বিশেষ জরুরি কাজ মনে করিতে প্রত্যেক মেম্বারকে আমার পক্ষ হইতে অনুরােধ করিবে। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে নাজিমউদ্দিন সাহেব প্রস্তাব আনিয়া পূর্ব-পাক এসেম্বলিতে নির্বাচনের পূর্বে জরুরি প্রস্তাব পাস না করাইলে আওয়ামী লীগের পক্ষে নেহায়েত ভুল হইবে। কেন্দ্রীয় সরকারের লিডারের নিকটও অনুরােধ জানাইবে, উভয় পাকিস্তানের সংহতি কায়েম করিবার জন্য পার্টি মিটিংয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি পেশ করিতে। কাগমারী মাওলানা মােহাম্মদ আলী কলেজ খােলার পারমিশন চাহিয়া সত্ত্বর দরখাস্ত ইউনিভার্সিটি বরাবর দিবে এবং অল্প দিনের মধ্যে যাহাতে অনুমতি পাওয়া যায় তাহার ব্যবস্থা অব্যশই করিবে। কলেজের জন্য বিভিন্ন সাবজেক্ট পড়াইতে উপযুক্ত ও আদর্শবাদী ৬ জন প্রফেসর সংগ্রহ করিতে তােমারা সকলে চেষ্টা করিবে। ভুলিয়া যাইও না। আমার দোয়া ও সালাম জানিও। আমার শরীর খুব দুর্বল। তাই মিটিংয়ে উপস্থিত হইতে পারিব না।।
আবদুল হামিদ খান
অলি আহাদ, তাজউদ্দীন
৫৬ নং সিম্পসন রোড, আওয়ামী লীগ অফিস গভর্নর শাসন প্রবর্তনের পর আত্মগােপনে থাকাকালে তাজউদ্দীন আহমদ ছদ্মনামে অলি আহাদের কাছে পত্র লেখেন। এই পত্রে অলি আহাদকে তিনি রহমত নামে সম্মােধন করেন এবং নিজের পরিচয় দেন তারেক নামে। পত্রটি নিচে প্রিয় রহমত, সকালে তােমার পত্র পেলাম।
আমি খুবই দুঃখিত। তােমার পূর্বের পত্রের উত্তর না দিতে পেরে আমি অপরাধ স্বীকার করছি। কিন্তু তুমি নিশ্চিত থাকতে পার যে, তােমার চিন্তাভাবনার সাথে আমরা সচেতন। আমরা তােমার ব্যাপারে বাস্তবে কিছু করতে পারিনি। আমার অনুরােধ মি. এ আর খান (আতাউর রহমান খান) তােমার মামলার বিষয়ে চিফ সেক্রেটারীর সাথে কথা বলেছেন। মি. খান নিজেই অনেকবার চিফ সেক্রেটারীর সাথে কথা বলেছেন। তিনি রাজবন্দি, বিশেষ করে আওয়ামী লীগারদের মুক্তি নিয়ে আলােচনা করেছেন। তিনি তােমার ও তােয়াহার ব্যাপারে খুবই উদ্যোগী। কামরুদ্দিন সাব তােমার লেখা একখানি পত্র দেখিয়েছেন। নেজামে ইসলাম ও কৃষক শ্রমিক পার্টির সাধারণ সম্পাদক আওয়ামী লীগের মতামত সম্পর্কে তােমার সুপারিশ এ আর খানকে অবহিত করা হয়েছে। বাস্তবতার নিরীক্ষে তিনি তােমার মতামতের প্রশংসা করেছেন। তুমি হয়ত বন্যা ত্রাণ কমিটির গঠন দেখেছ। আমরা চেষ্টা করছি যাতে অনাকাক্সিক্ষত ব্যক্তিরা প্রাধান্য না পায়। একই সাথে যুক্তফ্রন্ট যাতে ধ্বংস না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে যুক্তফ্রন্টে যে বিভেদ আছে তা যেন স্বার্থান্বেষী মহল আমাদের নির্দোষ শুভাকাক্ষীবৃন্দের অথবা ঈর্ষাপরায়ণ শত্রুরা জানতে না পারে। এমনকি তােমার খারাপ বন্ধুরা (শত্রু ব্যবহার করলাম না) আজকের দুর্যোগময় মুহূর্তে তােমার উপস্থিতির প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করে।
পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও এ আর খানের আলােচনা থেকে মনে হয় সরকার। আওয়ামী লীগারদের ব্যাপারে সদয় হবে। কিন্তু অন্য দলগুলাে PsvyI এবং জি দলের ব্যাপারে কঠোর হবে। সত্য হােক আর মিথ্যা হােক সরকার তাদের কমিউনিস্ট পার্টির অনুসারী বলে মনে করে। তুমি জেনে নিশ্চিত হবে যে, সরকার মনে করে পিএসইউ (ছাত্র ইউনিয়ন) হলাে তাদের রিক্রুটিং সংগঠন। ওয়াইএল যুবলীগ হলাে প্রশাসনিক প্রশিক্ষণ পর্ব এবং ডিএল গণতন্ত্র হলাে কমিউনিস্ট পার্টির সংসদীয় শাখা—এ হলাে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিশ্লেষণ তােহা আওয়ামী লীগ কিন্তু যুবলীগের সদস্য। ইয়ার মােহাম্মদ খান একই দলের। সুতরাং আমাদের সকলের মত হলাে, তােমাকে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে যে পর্যন্ত না সরকারের বিশেষ কর্মকর্তা উপলব্ধি করতে পারেন যে, তাদের অপদার্থ পদোন্নতি লােভ আইবির প্রতিবেদনকারীরা যে তথ্য দেয় তারচেয়ে বেশি তথ্য পৃথিবী ও স্বর্গে আছে। আমরা আশা করি যে, সরকারের বােধাদয় হবে। আমি তােমার অসুবিধা বুঝতে পারছি। কিন্তু ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত আমরা আমাদের কণ্টকাকীর্ণ পথে চলতে হচ্ছে। দেশপ্রেমিকদের দুঃখ-কষ্ট বৃথা যায় না। তাদের দুঃসাহসী প্রেরণা এবং অকৃত্রিম দেশপ্রেম মানব প্রেমিকদের পথ প্রদর্শন করে যেমন তেমন সঠিক গন্তব্যে পৌছার জন্য দিকনির্দেশ করে। সত্যের পথ থেকে কোনাে নির্যাতন তাদের বাধা দিতে পারে না। মৌলানা সাব তােমার মতাে ফলাফল চিন্তা না করে প্রকাশ্যে বলতে চায়। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী নিষেধ করেন। তিনি পাকিস্তানে ফিরে না আসা পর্যন্ত প্রকাশ্যে আসবে না। আমরা তােমার বিষয় আলােচনা করছি এবং সিদ্ধান্ত। হয়েছে যে, সােহরাওয়ার্দী না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এক পক্ষকাল। পূর্বে তার অপারেশন হয়েছে। তিনি দ্রুত আরােগ্য লাভ করছেন। সম্প্রতি তিনি এ আর খান ও কামরুদ্দিনের নিকট পত্র লিখেছেন। অনুগ্রহ করে বিশ্রাম নেও এবং অপেক্ষা কর। তুমি সব সময় অত্যন্ত সাহসী ছিলা। আমরা পূর্ণ বিশ্বাসী। যে তুমি সকল কষ্ট সহ্য করতে পারবে এবং হতাশার নিকট আত্মসমর্পণ করবে।
তােমার বিশ্বস্ত
তারেক
পুনশ্চ : এ মুহূর্তে আত্মসমর্পণের প্রশ্ন ওঠে না।
আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে ঢাকায় আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ।
এই সম্মেলনের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের নাম পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগ করা। ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে দলকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করে ধর্মনিরপেক্ষ দল করা হয়। আওয়ামী লীগকে সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত করতে তাজউদ্দীন আহমদ ছাত্র-যুব সমাজকে নিয়ে জোর প্রচেষ্টা চালান। তিনি ছাত্র জীবন থেকে সাম্প্রদায়িকতাবিরােধী ছিলেন। তার কর্মতৎপরতায় মুগ্ধ হয়ে মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান তাকে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করেন। ঢাকা জেলা থেকে ‘৫৫ সালে তিনি। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। এসময় তার বয়স মাত্র তিরিশ বছর। তার রাজনৈতিক জীবন জেলা থেকে প্রদেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। এভাবেই তার কর্মক্ষেত্র প্রসারিত হলাে, উন্মুক্ত হলাে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পথ। তার মেধা, সততা ও কর্মসাধনা যৌবনের প্রথম পর্বে বিকশিত ‘৫৮ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিনি যুক্তরাজ্যেও যান। এসময় তিনি পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও প্রশাসন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেরেন। যুক্তফ্রন্ট ভাঙায় তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা কী ছিল সেই সম্পর্কে তার কোনাে মন্তব্য জানা যায় না। তবে সঙ্গত কারণেই বলা যায় যে, তিনি মূল দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিলেন। বিশেষ করে শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীনকে নিয়ে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতেন। ‘৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খান গণতন্ত্র চায় না। তারা সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করবে। তাই তাদের অনুসারীরা পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হত্যা করে।
প্রদেশে ও কেন্দ্রে সরকার অস্থিতিশীল করে সামরিক শাসনের ক্ষেত্র তৈরি। করে। প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নূনের মন্ত্রিসভা নিয়ে ইস্কান্দার মির্জা খেলা শুরু করেন। মন্ত্রিসভার দপ্তর বণ্টন নিয়ে ফিরােজ খান নূন ওয়াদা ভঙ্গ করেন। তাই ‘৫৮-এর ৭ অক্টোবর আওয়ামী লীগ মন্ত্রী জহিরুদ্দিন, দেলদার আহমদ, আদেল। উদ্দিন, আবদুর রহমান খান, নুরুর রহমান খান পদত্যাগ করেন। ‘৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত সাড়ে ১০টায় ইস্কান্দার মির্জা বেতারে ভাষণ দেন এবং দেশে জারি করেন সামরিক আইন। প্রেসিডেন্ট প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানকে পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করেন। ‘৫৮-এর অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সুলতান উদ্দিন আহমদের স্থলে আইজিপি জাকির হােসেনকে গভর্নর নিয়ােগ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর আখতার হােসেনের স্থলে কালাবাগের আমির আজমকে নিযুক্ত করেন গভর্নর। সামরিক আইন জারি করে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করা না হলেও তিনি সামরিক সরকারের কঠোর পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিলেন। তিনি গােপনে দলের কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন।
সৈয়দা জোহরা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে সৈয়দা জোহরা খাতুনের বাবার নাম সৈয়দ সেরাজুল হক। তার জন্ম ১৮৯৩ সালে কুমিল্লার (বর্তমান চাঁদপুর) হাজীগঞ্জ থানার (বর্তমান শাহরাস্তি) আজাগড়া গ্রামে। তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ আরবিতে বিএ অনার্স পাস করেন। জ্ঞানের সাধক সেরাজুল হক ইংরেজি ও ফারসি ভাষা এবং সাহিত্যেও স্বর্ণপদকসহ কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। বিএ পাস করার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ক্লাসে ভর্তি হন এবং কিছুদিন ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপনাও করেন পরবর্তীকালে ঢাকা কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। | জোহরার খাতুনের মায়ের নাম সৈয়দা ফাতেমা খাতুন তিনি ছিলেন বাবামায়ের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। জন্ম ১৯০৪ সালে, দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে। ফাতেমার বাবা সৈয়দ গােলাম মােস্তফার জন্ম আনুমানিক ১৮৬২ সালে, হুগলির ইমামবাড়ার জমিদার পরিবারে। তিনি ছিলেন সেই যুগের প্রথম বাঙালি মুসলিম এমবিবিএস ডাক্তারদের একজন। কলকাতা মেডিকেল থেকে তিনি ডাক্তারি পাস করেন। সৈয়দা ফাতেমা খাতুন ও সৈয়দ সেরাজুল হকের ছিল পাঁচ সন্তান। যথাক্রমে সৈয়দ গােলাম কিবরিয়া, সৈয়দা হাসিনা খাতুন, সৈয়দ গােলাম মর্তুজা, সৈয়দ গােলাম মাওলা এবং সৈয়দা জোহরা খাতুন। সেরাজ-ফাতেমা দম্পতির সর্বকনিষ্ঠ সন্তান জোহরা খাতুনের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদের বিয়ে হয়। জোহরার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনু এবং তার স্বামী ইসলাম সাহেব। ছিলেন তাদের বিয়ের ঘটক। জোহরার সঙ্গে তাজউদ্দীনের প্রথম দেখা হয় ১৯৫৯ সালের ১৪ এপ্রিল। পহেলা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষের দিনে, ‘ঢাকার বংশালে অনু ও ইসলাম সাহেবের বাসায়। এর আগে ১১ এপ্রিল জোহারার খােপা করা সাইড থেকে তােলা ছবি তাজউদ্দীনকে দেখানাে হয়েছিল।
জোহরা যখন ঐ বাড়িতে প্রবেশ করেন তাজউদ্দীন তখন বাইরের উঠানে চেয়ারে বসে ইসলাম সাহেবের সঙ্গে টেবিলে রাখা ভাত ও ছােটমাছের চচ্চড়ি খাচ্ছিলেন। তাজউদ্দীনের পরনে ছিল হাওয়াই শার্ট। জোহরা হাতের কাজ করা একটি থ্রিকোয়ার্টার ব্লাউজের সঙ্গে সাদা সুতিশাড়ি পরে ছিলেন। দুজনের যখন বিয়ের কথাবার্তা চলছিল তখন জোহরার এক ভাই তাজউদ্দীনের গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে তাজউদ্দীন সম্বন্ধে খোঁজ করেন। সেই ব্যক্তি তাজউদ্দীনের স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করলেন। পরে জানা যায় সেই ব্যক্তি ছিলেন তাজউদ্দীনের বিরােধী দলের। তাজউদ্দীনের সঙ্গে তার সম্পর্কও ভালাে ছিল না। তা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরােধকে পাশে হঠিয়ে তাজউদ্দীন সম্বন্ধে সত্য বলতে দ্বিধা করেননি। ২৬ এপ্রিল রােববার রাত ৮টায় দুজনের বিয়ে পড়ানাে হয়। স্ত্রীর ইচ্ছা অনুযায়ী তাজউদ্দীন একরাশ বেলিফুলের গয়না এনেছিলেন বিয়ের দিন। সেই বেলিফুলের গয়না পরেই তার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে তাজউদ্দীনকে জোহরা বলেছিলেন, ‘আমার সােনা-গয়নার দরকার নেই। আমি বেলিফুল ভালােবাসি। তা দিয়েই আমার বিয়ে হােক।’ সমাজের কিছু আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রীতি ও সংস্কারকে তারা সেদিন চূর্ণ করে দেন হৃদয়ের মিলনকে প্রাধান্য দিয়ে তাদের বিয়ে হয়েছিল মগবাজার ‘কাজিবাড়ি’ নামের বাবার বাড়িতে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে প্রায় ৬০ জন উপস্থিত ছিলেন। খাসির বিরিয়ানি, মুরগির রােস্ট, কাবাব ও মিষ্টি ছিল বিয়ের খাবার। বিয়ের পর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি ১৮ নম্বর কারকুনবাড়ি লেনে বসবাস করতেন। ‘৬২ সালে ধানমন্ডির বাসভবনে স্থায়ীভাবে বাস করতে লাগলেন। তাজউদ্দীন-জোহরা দম্পতির চার সন্তান। বড় মেয়ে শারমিন আহমদ রিতি, মেজো। মেয়ে সিমিন হােসেন রিমি এবং কনিষ্ঠা মেয়ে মাহজাবিন আহমদ মিমি। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান তানজিম আহমদ সােহেল।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫