You dont have javascript enabled! Please enable it! মুখ খিচুনি ব্যারামের রোগী টিক্কা খান - সংগ্রামের নোটবুক

গভর্নর হাউজ, ঢাকা। ২৫ শে এপ্রিল ‘৭১। ফৌজি গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের ডেস্ক। টেবিলে রঙিন চার্টে রণাঙ্গনের অপারেশন রিপাের্ট। একমাসে ৯৮ দশমিক ২ ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণে এসে গেছে। ইমাম’ খুবই সন্তুষ্ট। সবকিছুই শান্ত স্বাভাবিক। এই মর্মে আশাবাদের রিপাের্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছেও যাচ্ছে। না কোথাও মার খাওয়ার কোনাে রিপাের্ট যায় না। রিপাের্টে পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্তমান লাশের সংখ্যা গােপন করে রাখা হয়। বাঙালি মারবার খবর আছে, নিজেদের মরবার খবর নেই। দোকানে খাবার নেই, মাঠে ফসল নেই, রফতানি নেই। তবু ইসলামাবাদে খবর যায় সবকিছু ঠিকঠাক মতাে চলছে। মিলিটারি দিয়ে ব্যাংক চালানাে হয়। রেললাইন অধিকাংশ জায়গায় চালু করা সম্ভব হয় নি। এসব খবর ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানাে রিপাের্টে থাকে না। প্রতিদিন বিমান ভর্তি লাশ যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। ওদের পিতা-মাতারা ধর্না দেয় সাহায্যের জন্যে, ইনস্যুরেন্সের টাকার জন্যে। এ খবর “ইমাম’-এর রিপাের্টে না থাকলেও ইয়াহিয়া জানেন। বিভিন্ন সেক্টরে দখলদার সৈন্যরা বাঙালি জওয়ান ও গেরিলাদের সাথে পেরে যে উঠছে না এ সংবাদও ইয়াহিয়া পেয়ে গেছেন। এপ্রিলের ৩১ তারিখ। টিক্কার টেবিলে দুটো টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন স্বয়ং ইয়াহিয়া খান। টেলিগ্রাম পড়ে ফৌজি গভর্নরের তৃপ্তির গাম্ভীর্য মেশানাে হাসি সঙ্গে সঙ্গে বিলীন। তিনি ক্ষুব্ধ ও বিষন্ন হলেন। ইয়াহিয়ার টেলিগ্রাম টিক্কা খানকে দুর্ভাবনায় ফেলে দিল। নিশ্চয় রাওয়ালপিন্ডির প্রসিডেন্ট ভবনের কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে বড়কর্তার কান ভারী করেছে। টিক্কা খানের এমনিতেই মুখ খিচুনি ব্যারাম। মানসিক চাপ বাড়লে হঠাৎ রােগটা আক্রমণ করে। যদিও এর স্থায়িত্ব পাঁচ সেকেন্ডের বেশি নয়। কেন যেন সেদিন খিচুনিটা ঘন ঘন হচ্ছিল। লম্বা টেলিগ্রামের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য এ রকম : কত বাঙালি মরেছে কিংবা কতভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণে এ জাতীয় রিপাের্টের প্রয়ােজন নেই। ইস্ট পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ শান্ত করতে আর কত সময় লাগবে সেটাই রাওয়ালপিন্ডির জানবার বিষয়। যত শিগগির সম্ভব এ মর্মে রিপাের্ট পাঠাতে হবে। এটা জরুরি। কেননা, এর ওপরই নির্ভর করছে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনার রূপরেখা। বিশ্বস্ত সহকারি কর্নেল মেহেদীর পরামর্শে গভর্নর টিক্কা খান সিনিয়র অফিসারদের জরুরি বৈঠক ডাকলেন। বৈঠকে বিশজনের মতাে বড় গােছের অফিসার আমন্ত্রিত। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠক শুরু হল। উদ্বোধনী বক্তব্যে টিক্কাখান বলেন : আপনারা জানেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার মিশনে আমরা একটা অভিযানে আছি। যদিও এটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের এ যাবত অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আর কত সময় লাগতে পারে এটা সম্ভবত গভীরভাবে ভাববার সময় এসে গেছে। আমি তাই আপনাদের মতামত নিতে চাই। এখন প্রশ্ন কিভাবে? হ্যা, আমি একটা একটা করে স্লিপ প্রত্যেকের হাতে দেব। আপনাদের লিখতে হবে শান্তি মিশনে আর কত মাস অথবা বছর সময় লাগবে এবং কেন লাগবে। প্রথমে উল্লেখ করতে হবে সময়সীমা, তারপর কারণ, সবশেষে যার যার সই। পাঁচ মিনিট সময় নির্ধারিত, এর মধ্যে চিন্তাভাবনা করতে হবে। অফিসাররা টিকা খানের বক্তব্যকে হর্ষধ্বনি দিয়ে সমর্থন করলেন। যদিও তারা তখন পর্যন্ত জানেন না তাগিদটা খােদ ইসলামাবাদ থেকে এসেছে। পাঁচ মিনিটের জায়গায় শেষ পর্যন্ত ৪৫ মিনিট সময় লেগে গেল। টিক্কা খান স্লিপ খুলে পড়ছেন। কেউ লিখেছে তিন মাস কেউ ন’মাস, একজন তাে দীর্ঘ দশ বছর। প্রায় সবার জবাবই মােটামুটি এক ধরনের শুধু সময়ের প্রশ্নে সামান্য ব্যতিক্রম। অফিসারদের উদ্দেশে উত্তেজিত গভর্নর বলেন : স্লিপগুলাে দেখে আমি নিশ্চিত আপনাদের এই গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কেউই মাথা খাটিয়ে প্রশ্নের জবাব দেন নি। আমি সত্যি হস্তশি। আপনারা এখন যেতে পারেন। জেনারেল টিক্কাখন মহা ফাপড়ে পড়ে গেলেন। কী জবাব দেবেন ইয়াহিয়া খানের কাছে। টেলিগ্রামের জবাব তাে একটা দিতেই হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাকে বড় আশা নিয়ে ঢাকায় পাঠিয়েছেন। তখন টিক্কাখান প্রেসিডেন্টকে বুঝিয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তানকে ঠাণ্ডা করতে তার সাকুল্যে ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগবে না। ইয়াহিয়া ভেবেছিলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসবাদীরা যেভাবে বেড়ে গেছেন, তাতে তাদের শায়েস্তা করবার জন্যে অভিজ্ঞ টিক্কা খানই উপযুক্ত ব্যক্তি। সফল বেলুচিস্তান অপারেশনের জন্য টিক্কাখান “দি বুচার অব বেলুচিস্তান (বেলুচিস্তানের কসাই) নামে কুখ্যাত। সহকর্মী অফিসাররা টিকাকে প্রশংসা সূচক ‘বুচার’ নামেই ডাকেন। বাঙালিদের কাছেও তিনি কসাই নামে কুখ্যাত, নিষ্ঠুরতার আরেক নাম। যৌবনে বদমেজাজের জন্যে বন্ধুবান্ধবরা তাকে ‘রেড ব্রিক’ নামে ডাকতাে। সৈনিক জীবনে মেধা কিংবা বুদ্ধিমত্তার পরিচয় তিনি কোথাও রাখেন নি। যুদ্ধের কৌশল, রণনীতির ধার তিনি ধারেন নি। বেলুচিস্তানে টিক্কার কৃতিত্বের নমুনা। কর্তার ইচ্ছায় কীর্তন। সেখানে বােমা ফেলে তিনি হাজার হাজার বেলুচ নর-নারী-শিশুকে হত্যা করেছিলেন, রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। স্বদেশের মানুষের রক্ত ঝরিয়ে টিক্কাখান বেলুচিস্তানে সাফল্য কুড়ান। বিপুল অংকের সরকারি অর্থের অপচয় করেন। বেলুচিস্তানে প্রতিরক্ষা ব্যয়ের সিংহ ভাগই চলে গিয়েছিল। জেনারেল ও সিনিয়র অফিসারদের পকেটে। পূর্ব পাকিস্তানেও সে একই খেলা চলেছে। পেলিফিকেশনের নামে ফৌ ‘কর্তাদের পকেট ভারী হচ্ছে। শান্তি মিশনের পরিবর্তে টিক্কার নেতৃত্বে দুর্নীতিবাজ পাহাড় গড়ে উঠেছে। পূর্ব রণাঙ্গনে জেনারেল টিক্কা খানের মূলমন্ত্র মানুষ নয়-মাটি চাই।’

Source:

পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু -রবার্ট পেইন