ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেল। লাগােয়া চারটি রুম-১৩২২ থেকে ১৩২৫। রুমগুলােতে উঠেছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার স্টাফ। স্টাফের মধ্যে একজন প্রাইভেট সেক্রেটারি, দু’জন মহিলা সেক্রেটারি, চারজন সশস্ত্র গার্ড ও একজন খানসামা । মহিলা সেক্রেটারিদ্বয় ভুট্টোর পাশের রুমেই। সন্দেহবশত হােটেলে বাঙালিদের পরিবেশিত খাবার গ্রহণ করতেন না ভুট্টো। তার জন্য তিন বেলা তেরাে আইটেমের খাবার আসতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে। সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের নির্দেশে। সেদিন ছিল ২৫ শে মার্চ। হােটেল চত্বর ও লবি রাত দশটা থেকেই পাকিস্তানি সেনাদের দখলে। কর্তব্যরত অফিসারের কড়া নির্দেশ, বের হলেই গুলি। নির্দেশ গভীর রাতে আরাে কঠোর । অর্ডার লংঘন করে কেউ বেরােতে সাহস পান নি। এমনকি সাহসী বিদেশি সাংবাদিকরাও না। হােটেলসুদ্ধ মানুষ অঘােষিতভাবে গৃহবন্দী। সবার মনে চাপা আতঙ্ক। উৎকণ্ঠা ক্রমশ বর্ধমান। ইয়াহিয়া-মুজিব ব্যর্থ আলােচনা শেষে জুলফিকার আলী ভুট্টো হােটেলে ফিরেছেন সােয়া তিনটায়। তিনি খুব ক্লান্ত। মনও খারাপ। এদিকে ঢাকা উত্তপ্ত। পাকিস্তান বিরােধী সেন্টিমেন্ট চরমে। ভুট্টো যত শিগগির সম্ভব করাচীর ফ্লাইট ধরতে ব্যাকুল। তার বিশ্বাস ছিল-ইয়াহিয়ার কথায়ই যখন তিনি ঢাকা এসেছেন, তখন নিশ্চয় প্রেসিডেন্ট তার যাওয়ার এন্তেজাম করবেন। কিন্তু না। পিপলস পার্টির নেতার ধারণা শেষ পর্যন্ত সত্যের মুখ দেখলাে না। ভুট্টোকে কিছু না বলেই ইয়াহিয়া চলে গেলেন। সামরিক গভর্নর টিক্কা খানের সাথেও তার যােগাযােগ হচ্ছে না। টিক্কাকে টেলিফোনে অনেক চেষ্টা করেও প্রাইভেট সেক্রেটারি ইকবাল ধরতে পারেন না। পাকিস্তানি নেতার মনে তখন অজানা আশঙ্কার শিহরণ । ভুট্টোর দুশ্চিন্তা যেন সেদিনের কালাে রাতের গভীরতার মতােই গভীর। মনে মনে ভাবেন : ইয়াহিয়া বুঝি তাকে একা ফেলে চলে গেল।’ ভুট্টো জানেন ঢাকা শহরে পাকিস্তান বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরু হতে আর দেরি নেই খুব বেশি। হােটেলের রুমে নরম বিছানায় ক্লান্ত অবসন্ন শরীর এলিয়ে দিয়ে হুইস্কি টানছেন ভুট্টো। পাশে প্রাইভেট সেক্রেটারি কর্নেল ইকবাল। সেই সন্ধ্যা থেকে কেমন আবােল-তাবােল বকছেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। যখন যা খুশি তাই বলছেন।
বেখেয়ালে নিজের কত গােপন কথা উরে ফেলছেন সেক্রেটারির কাছে। কখনাে কখনাে শেক্সপীয়রের উদ্ধৃতি আওড়াচ্ছেন : ‘খ্যাতি কেবলই আমাদের এড়িয়ে চলে, ভুলে যায়’-কি ঠিক বলি নি ইকবাল? সেক্রেটারি এমন অনেক প্রশ্নেরই অভিন্ন জবাব দিয়ে যাচ্ছেন, “ইয়েস স্যার” বলে। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। চারদিকে বিস্ফোরণ, গর্জন। হােটেলের চৌদ্দতলায় জানালা দিয়ে ভুট্টোর দু’চোখে দৃশ্যমান জ্বলন্ত নগরী, রক্তাক্ত ঢাকা। তিনি ছটফট করছিলেন। গ্লাসে ঘন ঘন হুইস্কি ঢালতে হচ্ছে সেক্রেটারিকে। ভুট্টো ইকবালকে কাছে ডেকে বললেন : দেখাে, এরা কি কাণ্ড বাধিয়েছে। আজ দুপুরেও তাে আওয়ামী লীগের সাথে যথারীতি আলাপ হয়েছে। আমরা একটা শান্তিপূর্ণ সমঝােতা চেয়েছিলাম। অথচ এরা তলেতলে যে কি করতে যাচ্ছে, তা সৌজন্যের খাতিরেও একবার বলে নি আমাকে। সত্যি, ইকবাল, আমি কিছুই জানি না। ইকবাল ভাল করেই জানে, কদিন আগে লারকানায় কি হয়েছিল। জেনারেলদের সেই বৈঠকে সে নিজেও উপস্থিত ছিল, যেখানে ভুট্টো আওয়ামী লীগ বিরােধী মারাত্মক বক্তব্য রেখেছিলেন। ভুট্টোর মতে : আওয়ামী লীগ নেতাদের কৃতকর্মের জন্য তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানসহ ঐ দলকে পাকিস্তানের স্বার্থে নিষিদ্ধ করে দেয়া উচিত। এ বক্তব্য শুনে ইয়াহিয়া তার কাঁধে হাত রেখে তৃপ্তির সুরে বলেছিলেন : জুলফি” তাে বরাবরই আমাদের লােক। ইকবাল ভেবে অবাক হলেন, ভুট্টো কি করে এত নিকট অতীতের সত্যকে চাপা দিতে পারেন। বাইরে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ঢাকা। আগুনের শিখাগুলাে দিগ্বিদিক দ্রুত ধাবমান। কামানের গর্জনে গুলি-গােলায় লুটিয়ে পড়া মানুষের আর্তনাতে ধুকছে রাত। কাঁপছে দালান। ভীত সন্ত্রস্ত ভুঠোর মহিলা সেক্রেটারি হঠাৎ পাশের রুম থেকে এসে ছুটে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। উত্তেজিত, অবিন্যস্ত চেহারা। আলু থালু পােশাক যেন অপরাধটা তাদের মনিবের । ভুট্টো চিৎকার করে বলেন-এখন এখান থেকে যেতে পারাে। রাগে গজগজ করছেন ভুট্টো। টিক্কা খানকে তখনাে পাওয়া যাচ্ছে না। সহকারিরা বার বার ফোনে চেষ্টা করছেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে বার বার এলােমেলাে জবাব : টিক্কা খান ক্যান্টনমেন্টে নেই। ভুট্টোর সাথে ব্যস্ত। একটা জরুরি কনফারেন্সে আছেন। ঢাকার বাইরে আছেন। পরিদর্শনে গেছেন। রিপাের্ট পড়ছেন। ঘুমিয়ে আছেন। ইত্যাদি। ভুয়ো নিশ্চিত, টিক্কা নিজেই নানান অজুহাত তুলে তার সাথে কথা বলতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছেন।
রাতের শেষ প্রহর। ভুট্টো হুইস্কি গিলছেন আর বাইরের বিধ্বস্ত ঢাকার রূপ দেখছেন। এমন সময় হঠাৎ সেক্রেটারি ইকবাল এসে বললাে : স্যার, জেনারেল লাইনে। ভুট্টো রিসিভার হাতে নিয়ে বললেন ; জেনারেল-জেনারেল টিক্কাখান। টিক্কা ; ও, জুলফি! মাই ডিয়ার । আমি শুনেছি, তুমি প্রতি পাঁচ মিনিট পর পরই আমাকে চেয়েছে। কি হয়েছে তােমার! আমার একটা উপদেশ শুনবে। বুড়াে ছেলে, নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়াে! ভুট্টো : কিন্তু আমি যা জানতে চাইছি….। টিক্কা ; জানি, তুমি কি জানতে চাও। তুমি জানতে চাইছে, কেন আমরা এই ঘৃণ্য, জঘন্য কাজ করছি, বাঙালিদের মারছি। কেন, তুমিও তাে লারকানার বৈঠকে বলেছে, প্রয়ােজনে কয়েক মিলিয়ন মারাত্মক অপরাধীকে মেরে বাকিদের সােজা পথে আনতে হবে। কেন বলােনি? এটা তােমারই পরামর্শ, আমরা আজ সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। দেখাে জুলফি, আমরা চাই না এখানে কোনাে সিভিলিয়ান এসে হস্তক্ষেপ করুক। এটা বড়ই কঠিন কাজ। টিক্কা খান বলে চললেন : তুমি হয়তাে রাগ করেছাে, জেনারেল ইয়াহিয়া খান কেন তােমাকে একই প্লেনে নিয়ে গেলেন না। কিন্তু তাতে রাগের কি আছে। ইয়াহিয়া খান সব সময় তােমাকে প্রশংসা ও শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। ভুলে যেওনা যে, তিনি মিলিটারির লােক। এখন এখানে মিলিটারি অপারেশন চলছে। জেনারেল ইয়াহিয়া আমাকে বলেছেন : রাজনীতির দিন শেষ। আমরা এখন এ্যাকশনে যাচ্ছি। দুম করে রিসিভার রেখে দিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ভুট্টো বললেন ; নােংরা বাস্টার্ড। ইকবাল পর্দা টেনে বাতি নিভিয়ে দিল। শুয়ে শুয়ে ভুঠো ভাবলেন : একুল ওকুল দু’কূলই বুঝি গেল। বাইরে ট্যাংকের দপ দপ ঘর ঘর শব্দ।
- পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু -রবার্ট পেইন