জন্ম ও বংশ পরিচয়
ভৌগােলিক আয়তনের বিচারে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম এবং বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য সুপরিচিত। ঐতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা এই অঞ্চলেই গড়ে উঠেছিল। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে এখানে স্থাপিত হয়েছিল বিশালাকার একাধিক সাম্রাজ্য। নানা ইতিহাস-প্রসিদ্ধ বাণিজ্যপথ এই অঞ্চলের সঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য সভ্যতার বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রক্ষা করত। হাজার বছর ধরে চীন, মঙ্গোলিয়া, মধ্য এশিয়া, ইরান, আরব, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে পরিব্রাজক, বণিক, রণকৌশলী যােদ্ধা, ধর্মপ্রচারক, সুফি প্রভৃতি দল ভারত উপমহাদেশে আসে। তাজউদ্দীন আহমদের পূর্বপুরুষরাও সুদূর মঙ্গোলিয়া থেকে এই ভারতদেশে এসেছিলেন। তাজউদ্দীনের নিকটতম পরিবার ও বংশের অনেকেরই শারীরিক গঠন, রঙ ও চেহারার মধ্যে মঙ্গোলীয় মধ্য এশীয় ছাপ স্পষ্ট ছিল। মঙ্গোলিয়া থেকে তার বংশধরদের একজন, যার নাম ফকরুদ্দীন শাহ, আনুমানিক ১৭শ শতকের প্রথমার্ধে মােঘল শাসনামলে দিল্লিতে আসেন। পরবর্তীকালে তিনি দিল্লির মুসলিম শাসকদের কাছে প্রশাসনিক ‘খান’ উপাধি লাভ করেন। এক পর্যায়ে তিনি আধ্যাত্মিক জগতে চলে যান। এই জগতে পদার্পণ করার পর দিল্লির উচ্চপদ ত্যাগ করে দেশ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন। ঘুরতে ঘুরতে চলে আসেন বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী বাংলাদেশে নদীমাতৃক এই দেশের সবুজ শ্যামল প্রকৃতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে। যান এবং তৎকালীন মােমেনশাহী বর্তমান ময়মনসিংহ জেলার নিগুয়ারী গ্রামে বসতি পত্তন করেন। আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের জন্য তিনি ‘ফকির সাহেব’ ও “ফকির খা’ নামেও পরিচিতি লাভ করেন। তার বসতবাড়ি ‘খানবাড়ি’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
এই ফকির সাহেবেরই উত্তরপুরুষ তাজউদ্দীন আহমদ। তার দাদার নাম ইব্রাহীম খান। তিনি বিয়ে করে ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেন। ঢাকা থেকে কাপাসিয়ার দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলােমিটার। দরদরিয়া থেকে নিগুয়ারীর দূরত্ব মাত্র ছয় মাইল। কাপাসিয়া ও গফরগাঁও পাশাপাশি থানা, মাঝখানে শুধু একটা নদী। ইব্রাহিম খাঁ ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ, বলিষ্ঠ ছিল তার শরীরের গড়ন, টকটকে ফরসা ছিল গায়ের রঙ। পিতার একমাত্র পুত্র ইব্রাহিম পৈতৃকসূত্রে অনেক ধনসম্পত্তির মালিক ছিলেন। একদিন ইব্রাহিম খাঁকে নিয়ে তার বাবা ইউসুফ খাঁ তাদের পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের নিগুয়ারী থেকে তরগার খা বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। তারা যাচ্ছিলেন দরদরিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে সৈয়দ জিকির মােহাম্মদের বাড়ির কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে। জিকির মােহাম্মদ ছিলেন সাহেব আলী বেপারির বাবা। নৌকার ব্যবসা ছিল বলে লােকে ‘বেপারি’ বলত। জিকির মােহাম্মদ প্রচণ্ড ডাকসাইটে ও রাগী একজন মানুষ। তিনি যখন ইব্রাহিম খাঁকে দেখলেন তখন তাদের থামিয়ে তার বাবাকে প্রস্তাব দিলেন যে, এই ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’ প্রস্তাব শুনে পিতা-পুত্র দুজনেই অবাক। খাঁ পরিবার ছিল অত্যন্ত ভদ্র, মিতভাষী তারা ভাবতেও পারেননি এমনভাবে অচেনা লােককে এক কথায় কেউ বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে! ইব্রাহিমের বাবা বুদ্ধি করে বললেন যে তরগা থেকে ফেরার পথে দেখা যাবে। তরগার খা বাড়িতে বেড়িয়ে তারা দরদরিয়া রাস্তা বদলে তরগা থেকে সরাসরি। কাপাসিয়ার পথ ধরে বর্মির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। জিকির মােহাম্মদ সে সময় সেই নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে তাদের দেখে ফেললেন।
পিতা-পুত্র নদীর ওপার দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন নদী সাতরে তাদের থামালেন জিকির মােহাম্মদ। ইব্রাহিম খাঁ-ই তার মেয়ের জন্য উপযুক্ত এবং তার মেয়ের বিয়ে এই ছেলের সাথেই হবে—এই সিদ্ধান্তে অটল জিকির মােহাম্মদ। তার মনের আশা শেষপর্যন্ত পূরণ হলাে। ইব্রাহিম খার বিয়ে হলাে জিকির মােহাম্মদের আদরের কন্যার সঙ্গে। ইব্রাহিম খাঁর বাবা ইউসুফ খাঁ ছেলেকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে নিগুয়ারীতে ফিরে গেলেন। শ্বশুর দরদরিয়া ও শ্রীপুরের সব তালুকদারি লিখে দিলেন ইব্রাহিম খাঁর নামে। নিগুয়ারীর অগাধ ধনসম্পত্তি যা খাঁ বাড়ির ছিল এবং একমাত্র পুত্র ইব্রাহিম খার জন্য রক্ষিত ছিল তা পেছনেই রয়ে গেল। গ্রামের নাম দরদরিয়া কেন? এ বিষয়ে নানাজনের নানা মত। কেউ কেউ মনে করেন ‘দরদরিয়া’ অর্থ হলাে দরিয়ার দ্বার বা সমুদ্রের দরজা। গ্রামটি নদীর কূলে গড়ে উঠেছে বলেই এই নামকরণ। দরদরিয়ার স্থানীয় পল্লি চিকিৎসক শাহাবুদ্দীনের মতে, সাহারা দরদরিয়াসহ অত্র এলাকা শাসন করতেন বলে মৌজার নামকরণ হয় ‘সাহাবিদ্যার কোর্ট। রানি তার এলাকাকে প্রতিরক্ষা করার জন্য খাল কেটে, শীতলক্ষ্যা নদীর পাশ দিয়ে পরিখা খনন করেন। রানির দুর্গ ছিল নদীর ওপারে রানি বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মােগল সৈন্যদের হটিয়ে দিয়েছিলেন। তার মৃত্যুর বহু পরে তার বাড়ির অনেক নিশানা পাওয়া যায়। প্রবাদ আছে, নদীর কিনারে রানির যে টাকার কুঠি বা কোষাগার ছিল, সেটা ভেঙে একজন জেলের নৌকায় পড়ে। সেই জেলে টাকা গুলাে নিয়ে ঘরে ফেরে। স্বপ্নে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় সে যেন এই অর্থ মানুষের কল্যাণে ব্যয় করে। স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশ না মানায় জেলের আকস্মিক মৃত্যু হয়। সে যাহােক, ইব্রাহিম খাঁর পুত্র মােহাম্মদ ইয়াসিন খান। তার জন্ম কাপাসিয়াতেই ইয়াসিন খান শৈশবেই পিতৃহারা হন।
সেকালে গহীন গজারি, শালবন ও গড় এলাকায় বাঘের উপদ্রব ছিল। পাকা বাঘশিকারি ইব্রাহিম খাঁ একদিন রানিবাড়ির দিকে বাঘ শিকারে গেলেন। বাঘকে গুলিবিদ্ধও করলেন। গুলি খেয়ে বাঘ পালিয়ে গেল। পরদিন তিনি সে স্থানে গেলেন বাঘটাকে খুঁজতে। গুলিবিদ্ধ বাঘটি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল । অতর্কিতে ইব্রাহিম খাঁর ওপর ঝাপিয়ে পড়ল । ইব্রাহিম খাঁর হাতের গাদা বন্দুক হঠাৎ জ্যাম হয়ে যাওয়ায় গুলি বের হলাে না। বাঘ এই সুযােগে তার শরীরে সতেরটি মরণকামড় বসাল। ইব্রাহিম খার রক্তাক্ত টুপি ছিটকে পড়ল একপাশে বাঘের বিষাক্ত কামড়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে সাতদিন পর তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। বিত্তশালী ভূস্বামী ইয়াসিন খান তিনটি বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে দুই কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিল। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে এক পুত্র ও এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম পুত্রসন্তানের নাম। ওয়াজিউদ্দীন আহমদ খান এবং কন্যার নাম সফরন নেসা। দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর বৈমাত্রেয় বােন (এক পিতার ঔরসজাত) পরান জাহির কন্যা মেহেরুননেসা খানমকে বিয়ে করেন। মেহেরুননেসা খানমের গর্ভে সাত সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রথম সন্তান সুফিয়া খাতুন। মাঝে এক মৃত পুত্র প্রসব করেন মেহেরুননেসা। দ্বিতীয় সন্তান তাজউদ্দীন। আহমদ খান, তারপর মফিজউদ্দীন আহমদ খান, সাহারা খাতুন, মরিয়ম খাতুন, বদরুন নেসা খানম, আফসারউদ্দীন আহমদ খান। সর্বকনিষ্ঠ কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করার পর আঁতুড়ঘরেই মারা যায়।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ইয়াসিন খান ও মেহেরুননেসা খানমের দ্বিতীয় সন্তান তাজউদ্দীন আহমদ খান। এখানে বলে রাখি, তাজউদ্দীন আহমদ খান। পরবর্তীকালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময় নামের ‘খান’ অংশটি বাদ দেন। তার কন্যা শারমিন আহমদের মন্তব্য : পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ‘খান’ উপাধিটি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত “খান বাহাদুর’ উপাধির সাথে সম্পৃক্ত না হলেও ধারণা করা যায় যে, তিনি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত উপাধির সাথে মিল থাকায় ‘খান’ উপাধি ত্যাগ করেন। তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ২৩ জুলাই ১৯২৫ সালে। তিনি যে কোঠাঘরে জন্মগ্রহণ করেন সেই আদি বসতবাড়িটি ‘৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পুড়িয়ে দেয়। তার জন্মের আড়াই বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন তার বড় বােন সুফিয়া খাতুন, বাংলা মাঘ মাসের কোনাে এক শুক্রবারে, ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে। তাজউদ্দীনের জন্মের দু-বছর পর ভাই মফিজউদ্দীন আহমদের জন্ম, তখন বাংলা ভাদ্র মাস এবং খ্রিস্টাব্দ ১৯২৭ সাল। এর সঙ্গে তাজউদ্দীনের চেহারার খুব মিল ছিল। তারপর জন্মগ্রহণ করেন বােন সাহারা খাতুন, বাংলা চৈত্র মাস এবং খ্রিস্টাব্দ ১৯৩০ সালে। তারপর মরিয়ম খাতুনের জন্ম, বাংলা ভাদ্র মাসে, খ্রিস্টাব্দ ১৯৩২ সালে। এরপর জন্মগ্রহণ করেন বদরুন নেসা খানম, ১৯৩৪ সালে সর্বকনিষ্ঠ আফসারউদ্দীন আহমদ। তার জন্ম বাংলা পৌষ মাসের ১ তারিখে এবং ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ – স্বকৃত নোমান – উৎস প্রকাশন, ৩ নভেস্বর ২০১৫