জয় বাংলা
আবার সেই আম্রকানন। পলাশীর আম্রকাননে বাংলা দেশ হারিয়েছিল স্বাধীনতা। দু,শ চৌদ্দ বছর পরে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে জন্ম নিল স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলা দেশ। তার সাক্ষী শতাধিক দেশী বিদেশী সাংবাদিক এবং হাজার হাজার নরনারী। আকাশে উড়ছে নবরাষ্ট্রের বিজয় কেতন। তাকে সামরিক অভিবাদন জানিয়েছে মুক্তিফৌজ। ঐতিহাসিক ঘােষণা পাঠ করেছেন উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী এবং তাঁর জঙ্গী বিমান বন্ধ করতে পারে নি বাঙালীর প্রাণপ্রাচুর্যের উৎসমুগ্ধ। রাষ্ট্রপতি মুজিবুর রহমান আজ কোথায় নিশ্চয় করে বলা মুশকিল। তিনি যেখানেই থাকুক না কেন, সার্থক হতে চলেছে তার স্বপ্ন। লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তধারা মিশে গেছে বাংলা দেশের প্রতিটি ধুলিকণায়। যারা বেঁচে আছেন তাদের সামনে অগ্নিপরীক্ষা। মীরজাফরের দল ঘুরছে আনাচে কানচে। স্বাধীন বাংলা দেশের পতাকার চারদিকে শত্রুবলায়। রাহুগ্রাসের সম্ভাবনা থেকে শিশুরাষ্ট্রকে রক্ষা করার মূখ্য দায়িত্ব মুক্তিফৌজের উপর।
ইয়াহিয়া লেলিয়ে দিয়েছেন তার নেকড়ের দল। চোখে তাদের আদিম যুগের জীঘাংসা। হাতে অত্যাধুনিক মারণস্ত্র। আকাশে জঙ্গী বিমান। গ্রামের পর গ্রাম জ্বলছে। শস্যক্ষেত্র পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। রাস্তাঘাট ভরে উঠছে মানুষের শবে। লক্ষ লক্ষ নরনারী আশ্রয়ের আশায় ছুটছেন ভারত সীমান্তে। এই বিভীষিকার মধ্যে জীবনের ঘুরন্ত স্পন্দন শােনা গেছে বৈদ্যনাথতলায়। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার এই ক্ষুদ্র অঞ্চল সারা বিশ্বের মুক্তিসংগ্রামীদের তীর্থক্ষেত্র। মুজিবর তার কেন্দ্রবিন্দু। তাই বৈদ্যনাথতলার নূতন নামকরণ মুজিবনগর। ইসলামাবাদের স্বৈরাচারী ইয়াহিয়ার চোখে ঘুম নেই। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে বাংলা দেশকে শায়েস্তা করার সঙ্কল্প নিয়ে ছিলেন তিনি। কিন্তু তিন সপ্তাহ চলে গেছে। বাংলা দেশের তিন-চতুর্থাংশ মুজিব বাহিনীর দখলে। শহর, ক্যান্টনমেন্ট এবং বড় সড়ক ছাড়া পশ্চিমাদের অস্তিত্ব নেই কোনখানে। বর্ষার আগে ওরা মরণ কামড় দিতে উদ্যত্ত। সংগ্রামের এই দ্বিতীয় পর্যায়ের দিনগুলাে সাংঘাতিক। শুধুমাত্র মনােবল এবং সেকেলে অস্ত্র নিয়ে ঘাটি রক্ষা করা মুক্তিফৌজের সহজ নয়। এই অবস্থায় দরকার বাইরের সাহায্য।
নবঘঠিত একটি স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের সমস্যা অবশ্যই জটিল। কিন্তু এই জটিলতার প্রশ্ন বাংলা দেশের পক্ষে অবান্তর। যারা আজ স্বাধীন সরকার গঠন করেছের তাদের পিছনে রয়েছে কোটি কোটি বাঙালীর আনুগত্য এবং সমর্থন। গ্রামাঞ্চলে চলছে নয়া ইসলামাবাদের একটি ফ্যাসিস্ত দৃষ্টান্ত। এই ডাকাত দলের সর্দার ইয়াহিয়া খান। জনগণের ভােটে তিনি ক্ষমতা পান নি। ক্ষমতা দখল করেছিলেন গায়ের জোরে। বাংলা দেশ শাসনের নৈতিক অধিকার তার নেই। তার উপর তিনি যুদ্ধাপরাধী। বাঙালীর উপর তিনি চাপিয়েছেন সর্বাত্মক লড়াই। আর নির্বিকারে চালাচ্ছেন গণহত্যা। ধ্বংসের মধ্যে আবির্ভাব ঘটেছে সার্বভৌম বাংলা দেশের। তার গণতন্ত্রের ধ্বজা যাতে দস্যু লাঞ্ছিত না হয় তা দেখার ভার নিবে সভ্য দুনিয়াকে। তার আবশ্যিক অঙ্গ কূটনৈতিক স্বীকৃতি। ভারত তৈরী। চারদিকে তাকাচ্ছে সে সহযােগীর আশায়। মুজিবর রহমানের দূতেরা ঘুবে বেড়াচ্ছেন ইউরােপ এবং আমেরিকায়। প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন। জানিয়েছেন আকুল আবেদন। দুনিয়ার সভ্য রাষ্ট্রগুলাে যদি তাদের নিরাশ করেন তবে বহির্বিশ্বের বিবেকী সত্বার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালী এবং পঞ্চাশ কোটি ভারতীয়। এতগুলাে মানুষের অবিশ্বাসের বােঝা নিয়ে বেশী দূবে এগুতে পারবেন না বিশ্বের কোন শক্তি।
বাংলা দেশের স্বাধীন সরকারের সামনে রয়েছে পর্বত প্রমাণ সমস্যা। তাদের সামনে পশ্চিমা হুনের দল। বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলাের কূটনৈতিক স্বীকৃতি যত তাড়াতাড়ি আসবে ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী তত তাড়াতাড়ি পিছু হটবে। কারণ সবাই জানে, কূটনৈতিক স্বীকৃতির পরের পর্যায় অস্ত্র সাহায্য। সাম্প্রতিককালে মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য বাইরের অস্ত্র সাহায্যের উপর অনেকখানি নির্ভরশীল। আলজেরিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামে অকৃপণ অস্ত্র সাহায্য দিয়েছিল মিশর। মুক্তিযােদ্ধাদের কঠোর সঙ্কল্প এবং আধুনিক অস্ত্র এনেছিল তাদের সংগ্রামের সার্থকতা। সাইপ্রাসে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ে গ্রীক সিপ্রিয়টরা পেয়েছিল গ্রীসের সামরিক মদত। বাংলা দেশও নিদারুণ প্রত্যাশায় তাকিয়ে আছে দুনিয়ার প্রগতিবাদী রাষ্ট্রগুলাের দিকে। তারা এগিয়ে আসবে। ইয়াহিয়ার গণহত্যা থেকে বাঁচান সদ্যজাত শিশুরাষ্ট্রটিকে। মুক্তিপাগল বাঙালীর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলুন— জয় বাংলা।।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১