You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.14 | বাংলাদেশের যন্ত্রণা, দ্য অস্ট্রেলিয়ানে ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ এ প্রকাশিত - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের যন্ত্রণা
– মার্টিন উলাকট
– দ্য অস্ট্রেলিয়ানে ১৪ এপ্রিল ১৯৭১ এ প্রকাশিত

পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ বিদ্রোহের পরিস্থিতি দিনকে দিন হৃদয়বিদারক ও দুঃখজনক হয়ে উঠছে।
সকল শ্রেণীর মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থনে, নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে এই বিংশ শতাব্দীতে প্রায় অপ্রস্তুত ও ন্যূনতম যোগাড়যন্ত্র ছাড়া এমন ব্যাপক আন্দোলন আর কোনটি হয়নি।

পূর্ব বাংলায় প্রায় ২০০ মাইল যাত্রা শেষে ভারতীয় সীমানা থেকে ৯০ মাইল দূরে, ফরিদপুরে গঙ্গা নদীর তীরে মানুষের এখন মুল চাহিদা হচ্ছে আরও বেশি দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই আন্তর্জাতিক সহায়তা। এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বল্পস্থায়ী প্রভাব বলা যায় এটাকে।

পাঁচ ডিভিশনেরও বেশি পাকিস্তানি সেনা এখন তিন দিনের সফরে দ্রুত গতিতে বাংলাদেশের দখলে থাকা শহরগুলো কব্জা করতে এগিয়ে যাচ্ছে। এই তিন দিনের সফরে আমি শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে, প্রশাসনিক কার্যালয়গুলোতে, রাস্তার পাশের ওষুধের দোকানগুলোতে, সেনানিবাসগুলোতে শুধু একটি আকুতিই শুনেছি, “কেন সারা পৃথিবী আমাদের সহায়তা করছে না?”
যশোর ও ফরিদপুরের মাঝে মাগুরায় কর্মরত প্রধান বেসামরিক প্রশাসক, মধ্যবয়সী আইনজীবী নাসির উল ইসলাম স্বাধীনতাকামী মানবতার প্রতি লিখিতভাবে এক উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন, “সভ্যতা ধ্বংসের লীলাখেলায় মত্ত পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়া পুরো বাংলাদেশ ও জাতিকে এই ক্রান্তিকালে সাহায্যের জন্য মানবতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।” এবং কয়েকশ মানুষের সামনে আমি সেটা আমার ব্যাগে রেখে দিয়েছি।

খাদ্য, জ্বালানীসহ অন্যান্য ব্যাবহারিক পণ্যের পরিমাণে সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থাও জনস্বাস্থ্যের প্রতি আশঙ্কাজনক।

মাগুরায় একটা হাফ কোম্পানির সমতুল্য রাইফেলস আছে। নদী পার হবার সময় প্রতিরক্ষার দায়িত্বে থাকা এক প্রাক্তন পাকিস্তানি বিমানচালক অবশ্য কথা প্রসঙ্গে আমাকে জানালেন যে তাদের কাছে ৪টি লিএনফিল্ড রাইফেল ও দুটি ডামি রাইফেল আছে।

ঝিনাইদহ ও যশোরে সম্ভবত মুক্তিসেনাদের সবচেয়ে বড় দলটি অবস্থান করছে যাদের সংখ্যা কমপক্ষে ৭৫০ জন। এদের মাঝে মাত্র ২০০ জন হচ্ছে ট্রেনিংপ্রাপ্ত ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা। বাকিরা সাধারণ মুক্তিকামী।
বাংলাদেশের প্রশাসন এখনও বিভিন্ন জায়গায় কাজ করে যাচ্ছে। ছোট ছোট শহরগুলোতে এখনও দাপ্তরিক কাজ চলছে।

সন্ধ্যায় যাবতীয় অর্থ সঞ্চয় নিষিদ্ধ, সরকারি – বেসরকারি সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে নিজ নিজ কাজে ফিরে যাওয়ার আদেশ এবং সকল ছাত্রকে মিলিটারি ট্রেনিং ও অন্যান্য কাজের জন্য কমান্ড হেডকোয়ার্টারগুলোতে রিপোর্ট করতে বলা শীর্ষক নির্দেশনা এসেছে।

সদলবলে তদারকি করতে আসা ক্যাপ্টেন মাহবুবউদ্দিন আহমেদ ও তার সহযোগীরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের কথা বলেছেন, “আমাদের স্বাধীনতা অবশ্যই প্রয়োজন, এমনকি সামাজিক স্বাধীনতাও। তবে চীনাদের মত স্বাধীনতা দরকার নেই যেখানে কেউ কথা বলতে পারেনা এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রিত।”

নির্মম শারীরিক নির্যাতনের গল্প ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে যার কিছু কিছু সন্দেহাতীতভাবে সত্য। ফরিদপুর জেলা স্পোর্টস ক্লাব, যা কিনা শহরের সেনাসদর দপ্তর হয়ে উঠেছে, সেখানে খুলনা থেকে আগত এক তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে জানালেন যে শান্তিপূর্ণ এক আন্দোলনে নির্বিচারে গুলিবর্ষণের একটি ঘটনা তিনি নিজ চোখে দেখেছেন এবং কয়েকজন আর্মি অফিসারের এই ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের কথা তিনি তখনি নিজের জিপ নিয়ে সেনা দপ্তরে গিয়ে কর্নেলকে অবহিত করেছেন। তিনি আরও জানালেন, “কর্নেল আমার অভিযোগকে উড়িয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন যে এরপর গুলি করে যাদের মারা হবে তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকব আমি।”

যশোরে মৃত গণনায় ক্যাথলিক মিশনারিদের সংখ্যা মুসলিমদের চেয়ে বেশি হওয়ায় পুনরায় গণনার জন্য এক তরুণকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।

কয়েকজন স্থানীয় খ্রিস্টান সহযোগীসহ পাদ্রীকে গুলি করে হত্যার পর এক পাঞ্জাবী ব্রিগেডিয়ারের আগমন ও পুরো ঘটনাকে “দুর্ঘটনা” বলে ক্ষমা প্রার্থনার ব্যাপারটা সেই তরুণ খুব উত্তেজিতভাবে বর্ণনা করেছে। অপর আরেক পাদ্রী অবশ্য এই দুর্ঘটনার ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন এই বলে যে মিশনের ছাদে রেড ক্রসের পতাকা থাকা অবস্থাতেও কিভাবে এই ঘটনা ঘটে?

স্বাধীনতাকামী এলাকার নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতির বুনিয়াদ ভেঙ্গে দেয়ার দিকে নিজেদের বাস্তবসম্মত লক্ষ্য স্থির করেছেন।

পাটের জায়গায় ধান বপনের মাধ্যমে খ্যাতি অর্জন করা ফরিদপুরের এক তরুণ হিসাবরক্ষক আমাকে জানালেন, “ওদের অর্থনীতি এভাবে ছয় মাস অথবা এক বছরও থাকতে পারবে না। ওরা ভুলে গেছে যে ইন্দো পাকিস্তান ১৭ দিনের যুদ্ধ অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে।”

সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সাথে এক হবার নীতিগত ভুল সিদ্ধান্ত।
মাগুরায় নাসিরুল ইসলাম বলেছেন, “আমি নিজেও ভুল করেছি। আমরা সবাই ভুল করেছি এবং এখন তারই মাশুল দিচ্ছি।”