You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.12 | টাইম ম্যাগাজিন- ১২ই জুলাই, ১৯৭১ ভারত - সংগ্রামের নোটবুক

টাইম ম্যাগাজিন- ১২ই জুলাই, ১৯৭১
ভারত

গত মার্চে যখন প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর নতুন কংগ্রেস পার্টি নিয়ে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসেন তখন তিনি উচ্চাভিলাষী উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যাতে ভারতের প্রায় ৬০০ মিলিয়ন জনতার জীবন-গতি বদলে যাবে। যাই হোক, গত সপ্তাহে এইটা পরিষ্কার হয়েছিল যে দেশের অর্থনীতি কিছুতেই শক্তিশালী হচ্ছিল না এবং এই বাঁধার কারণগুলো কিছুতেই শ্রীমতি গান্ধীর দ্বারা তৈরী হয়নি। গত মার্চ মাস হতেই পশ্চিম পাকিস্তানস্থ পাকিস্থান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উপর তাদের নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের বর্বর আগ্রাসন শুরু করার পর ৬০,০০,০০০ এরও অধিক শরণার্থী ভারতে পালিয়ে এসেছিল। শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্যের যোগান এবং হাজারো কলেরায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় প্রথম ছয়মাসেই কমপক্ষে ৪০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।

মুসলিম প্রধান পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের প্রায় ৮০% হিন্দু যারা পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলে যেখানে তাদের সহ-সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে সেখানে তাদের আশ্রয়স্থল খুঁজছিল। মূলত ভারতকে যা দুশ্চিন্তায় ফেলছিল তা হচ্ছে তাদের নিজেদের ভিটে-বাড়িতে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কমে আসছিল। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লী হতে বলা হয়েছিল যে পাকিস্তানীরা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের ভিটে-বাড়ী ও সহায় সম্পত্তি ধ্বংস করে ফেলছিল। আর তাই ভারতকে পাকিস্তানী শরণার্থীদের যা ক্রমাণ্বয়ে ১০ লক্ষাধিক হতে পারে তাদেরকে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য মেনে নিতে হতে পারে।

ক্ষুদ্র সাফল্য

পূর্ব বা পশ্চিম উভয় দিক হতেই শরণার্থী সমস্যার জন্য এতোই স্বল্প সহায়তা এসেছে যে যার জন্য ভারতীয়রা ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। দুই সপ্তাহে আগেই শ্রীমতী গান্ধী ঘোষণা করেছেন যে “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এর দায় হতে পালিয়ে যেতে পারে না।” “এর পরিণতি যাই হোক না কেন তা বিশ্বের এই অংশকেও সহ্য করতে হতে পারে।”

সবচাইতে ভয়ংকর পরিণতি হতে পারে যুদ্ধ, ফলাফল সম্পর্কে চিন্তাভাবনাহীন হয়ে দেখা যাচ্ছে যে অনেক ভারতীয়ই এই শরণার্থী সমস্যার সমাধান হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তান হতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে তর্ক করে যাচ্ছে যাতে শরণার্থীরা তাদের ঘরে ফিরে যেতে পারে। শ্রীমতি গান্ধী এই ধরণের আলোচনাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন, যদিও এই আলোচনার ক্ষেত্র বাড়ছে, এমনকি তা সংসদ সদস্যদের মাঝেও আলোচিত হচ্ছে।
জরুরী সহায়তা প্রদান ও পূর্ব পাকিস্তানে দমন প্রশমনে অন্যান্য দেশসমূহকে রাজী করানোর চেষ্টায়, ভারতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে প্রধানমন্ত্রী তাঁর বিভিন্ন সহকর্মীদেরকে বিদেশে পাঠিয়েছেন এবং এই পর্যন্ত এতে ক্ষুদ্র সাফল্য মাত্র অর্জিত হয়েছে।

ভারত যা চায় তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সমঝোতা। আর তা গত ডিসেম্বরে শেখ মুজিবর রহমান ও তাঁর দল আওয়ামী লীগের দ্বারা অপ্রতিরোধ্য বিজয়কেই মূল্যায়ন করা হবে। সাংবিধানিক কংগ্রেসের জন্য ভোটে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনেই শেখ মুজিব জয় লাভ করে। যেহেতু দেখা যাচ্ছে যে গণপরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে শেখ মুজিব নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, যা তাকে সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত করতে পারতো। যেহেতু তিনি ভারতের

সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন তাই ভারত শেখ মুজিবের এই বিজয়ে দারুণভাবে আনন্দিত হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে ভারত পাকিস্তানের সাথে সীমান্ত রক্ষা ব্যয়ের মতো মোটা দাগের ব্যয় কমিয়ে ফেলতে পারতো।

কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান কেন্দ্রীয় সরকারের ভিতরে শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষমতা অর্জনে রাজী ছিলেন না, এমনকি তিনি পূর্ব পাকিস্থানে বৃহদার্থে স্বায়ত্তশাসন প্রদানেও অতোটা আগ্রহী ছিলেন না। পরবর্তীতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দ্বারা কঠোর দমন নীতির ফলে শত হতে হাজারে হাজারে পূর্ব পাকিস্তানীদের হত্যাকে রাজনৈতিক সমঝোতা হতে অনেক দূরে ঠেলে দেয়।

আদর্শিকতার আত্মীয়তা

দীর্ঘ মেয়াদে চলতে থাকলে ভারতীয়দের ভয় যে তারা তাদের পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চাইতেও ভয়াবহ হুমকির মুখোমুখি হতে হবে। সত্যিকারের বিপদ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা আন্দোলন ভঙ্গূর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব হতে নকশালপন্থীদের হাতে চলে যেতে পারে যারা মাওবাদী চরমপন্থীদের সাথে আদর্শিকভাবে আত্মীয় এবং যারা কলকাতা ও পাকিস্তান-ভারতের অন্যান্য অঞ্চলকে আতংকিত করে তুলেছে। ভারতীয়দের যে ভয় সেটা হচ্ছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে পাকিস্তানের পূর্ববাংলার একত্রীকরণের প্রয়াস যেখানে সংস্কৃতি ও ভাষার মিল আছে যা কোন এক সময় ধর্মীয় অমিলকে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।

অস্ত্রের জোর

এক নাছোড়বান্দা পূর্ব পাকিস্তানী যে নিজেকে নকশালবাদী বলে পরিচয় দেয় সে টাইম ম্যাগাজিনের সংবাদদাতা লেমস্‌ শেফার্ডকে বলেছে যে “এই মুহূর্তে আমাদের অভিন্ন শত্রু (আওয়ামী লীগ এবং পূর্ববঙ্গের নকশালপন্থী উভয়ের) হচ্ছে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। ভারত যে অস্ত্র আওয়ামী লীগকে দিচ্ছে তাই নকশালপন্থীদের কাছে পৌঁছে যাবে এবং আমরা যে শুধুমাত্র সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবো তা নয় বরং বুর্জোয়াদের এবং সামন্ততান্ত্রিক উপাদানের সাথে এবং ঘৃণিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সাথে যুদ্ধ করবো।” নকশালবাদী ঘৃণার সাথে বলেছেঃ “ বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতারা রাজনৈতিক ক্ষমতা যে বন্দুকের নল হতে বের হয়ে আসে সেই প্রবাদের সত্যতা দেখতে পাচ্ছে।”
সমস্যা হচ্ছে, অনেক ভারতীয়রাও এই অস্ত্রের ক্ষমতার কথা ভাবছে। এমনকি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাস্তবমুখী শিখ শরণ সিং পর্যন্ত গত সপ্তাহান্তের সভায় ক্ষমতাসীন নতুন কংগ্রেস পার্টির সংসদ সদস্যদের সতর্ক থাকার কথা বলতে বাধ্য হয়েছেন “রাজনৈতিক সমঝোতা না হওয়া পর্যন্ত ভারত তার নিজের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।”