You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.11.03 | জেল হত্যাকাণ্ড এক দুঃসহ সময়ের স্মৃতিচারণ - সংগ্রামের নোটবুক

জেল হত্যাকাণ্ড এক দুঃসহ সময়ের স্মৃতিচারণ

১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায়- জেল কর্তৃপক্ষ, ৩ নভেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অভ্যন্তরে নিহত, তাজউদ্দীন আহমদের লাশ, ভাগ্নে (বড় বােন সুফিয়া খাতুনের পুত্র) মুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদের (শাহিদ) কাছে হস্তান্তর করেন। সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতি ও তথ্য যুক্তরাষ্ট্র হতে, বাংলাদেশে শাহিদ ভাইয়ের সাথে টেলিফোন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করি । নিজ পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনাে সাক্ষাৎকার, তথ্য ও বিবরণ লিপিবদ্ধ ও সংগ্রহ করা সুকঠিন কাজ। তার পরও এক রক্তঝরা ইতিহাসের বেদনাদায়ক পর্বটিকে উম্মুক্ত করতে হয়েছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। জাতীয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়, এই জেল হত্যাকাণ্ড ও আরও ঘটে যাওয়া নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য দরকার সত্য ইতিহাস জানা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মতাে শক্তি অর্জন করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সম্মিলিতভাবে সহায়তা করা। আমি শুধু একজন পিতাকেই হারায়নি, হারিয়েছি এক অনন্য মানুষকে। জাতি হারিয়েছে ভবিষ্যতের দিক-দিশারী, সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক, বিশ্ব দৃষ্টিসম্পন্ন এক বিশাল নেতাকে। ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক মহান নেতার আবির্ভাব তখনই সম্ভবপর হবে, যখন আমরা আন্তরিকভাবেই প্রচেষ্টা নেব অতীতকে জানার ও সুযােগ্য মানুষ ও নেতার জীবনাদর্শ হতে শিক্ষা নেওয়ার। আবু সাঈদ : আমি সে সময় মিরপুর ৬ নম্বরে জনতা ব্যাংকে চাকরি করি। নভেম্বরের ৪ তারিখ, দুপুর ১২টার দিকে আমার ম্যানেজার আমাকে বললেন যে জেলখানায় পাগলা ঘণ্টি বেজেছে। বড় মামার (তাজউদ্দীন আহমদ) কাছে শুনেছিলাম যে জেলে পাগলা ঘণ্টি বাজা বিপদের সংকেত।

তখন আমি ওখান থেকে সােজা ধানমণ্ডিতে মামির কাছে যাই। ওনাকে পাগলা ঘন্টি বাজার কথা বলি। মামি আমার কথা শুনে চুপ করে থাকলেন। এরপর আমি ওই ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রােডে রহমত আলী (শ্রীপুর আওয়ামী লীগের নেতা) সাহেবের বাসায় গেলাম ঘটনা জানতে। ওনাকে বাসায় পেলাম না। ওনার ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কোথায় ? উনি বললেন যে রহমত আলী সাহেব মাহবুব আলম চাষীর বাসায় গিয়েছেন। (চারতলা বাসা) নিচতলায় বন্ধু মিজানের সঙ্গে দেখা। সে-ও জানতে এসেছে। তার হােভায় চড়ে, তাকে নিয়ে গেলাম নাজিমউদ্দীন রােডে, জেলের ডাক্তার মায়েনুদ্দীন সাহেবের বাসায়। উনি আমাদের গাজীপুর এলাকার লােক। আমার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল।

উনি তখন বাজারে গিয়েছেন। আমরা ওনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। উনি বাজার থেকে ফিরে, আমরা অপেক্ষা করছি দেখা সত্ত্বেও বাজারের ব্যাগ নিয়ে সােজা ভেতরে ঢুকে গেলেন। অন্যদিন হলে উনি আপ্যায়ন করাতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। যাই হােক, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর উনি দেখা করলেন। আমি গত রাতে জেলে পাগলা ঘন্টি বাজার ব্যাপারে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন, ‘আমিও শুনেছি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি গতকাল জেলে ডিউটিতে যাননি? উনি বললেন, ‘না, যাইনি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন যাননি?’ উনি অনিচ্ছাসহকারে জবাব দিলেন, “আমি ছুটিতে ছিলাম।’ ওনার উত্তর দেওয়ার ধরন শুনে মনে হলাে উনি কিছু লুকাচ্ছেন। আমরা চলে আসার সময় উনি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘জেলে একটা কিছু ঘটেছে, পরে জানতে পারবেন। ওনার কাছ থেকে সঠিক কোনাে উত্তর না পেয়ে আমি খুব রাগান্বিত হয়ে চলে এলাম। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বড় মামার বাসায় এসে শুনি জেলহত্যার খবর জানাজানি হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে মােহাম্মদপুর থানার ওসি বড় মামার বাসায় এসে খবর দিলেন যে, জেলখানায় আত্মীয় গেলে কর্তৃপক্ষ তার কাছে লাশ হস্তান্তর করবে। তখন আমি ওসির গাড়িতেই জেলে গেলাম। আমার সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। সন্ধ্যা ৭টার দিকে জেলখানায় পৌছি। সেখানে কামরুজ্জামান সাহেবের ভাই ইতি সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। উনি জানালেন যে উনি সম্মতি দিয়ে এসেছেন যে ওনার (কামরুজ্জামান) লাশ রাজশাহীতে দাফন করা হবে। সেই অনুযায়ী হেলিকপ্টার দিয়ে লাশ রাজশাহীতে নেওয়া হয়।

মামার লাশ হস্তান্তরের আগে জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে জানাজা কোথায় হবে? আমি বললাম যে, লাশ প্রথমে বাসায় নেব, তারপর ঠিক হবে কোথায় জানাজা হবে। তারা তখন বঙ্গভবনে ফোন করে। তাদের বহুক্ষণ সময় লাগে অনুমতি পেতে। একসময় কর্তৃপক্ষ আমাকে বলে যে আপনি চলে যান। আর বলে যান কোথায় দাফন হবে, আমরা সেখানেই লাশ পাঠিয়ে দেব।’ কিন্তু আমি নাছােড়বান্দা বললাম যে, আগে লাশ হস্তান্তর করেন। তারপর কোথায় দাফন হবে সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ সন্ধ্যা ৭টা হতে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আমি জেলগেটের সামনে বসা। ওই রাতের পরিবেশ ছিল যুদ্ধের সময়ের মহড়ার মতাে জনমানবশূন্য, নীরব, নিস্তব্ধ। রাত ১১টার দিকে জেলগেটের সামনে বিডিআর-এর মেজর আতাউর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়। উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি তাজউদ্দীন সাহেবের কী হন?’ আমি বললাম, ‘ভাগ্নে হই। উনি বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি ইপির (তাজউদ্দীন আহমদের সহােদর মফিজউদ্দীন আহমদের কন্যা) মামা। আমি জেলগেটে পাহারায় আছি।’ আমি বললাম যে জেল কর্তৃপক্ষ বঙ্গভবনে ফোন করছে। লাশ হস্তান্তরের জন্য ক্লিয়ারেন্স নিচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে মাঝপথে কেউ আবার লাশ নিয়ে যায় কি না। মেজর আতা আশ্বস্ত করলেন। বললেন, ‘অসুবিধা হবে না। আপনি লাশ নিয়ে যেতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত বহু দেরি করে, গভীর রাতে আমার স্বাক্ষর নিয়ে মামার লাশ হস্তান্তর করে ঢাকার সদর নর্থের এসডিওর পক্ষের একজন ডিআইজি প্রিজনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশসহ পুলিশের ট্রাকে লাশ নিয়ে যখন বাসায় ফিরি তখন গভীর রাত। বাসায় এসে কাউকে পাইনি। সে সময় লাশ নামানাের লােক পাইনি।

হাই-এর বাবা (বারেক মিয়া) পাশের বাসায় লুকিয়ে ছিল। তাকে ডাকাডাকির পর সে আসে। লাশের পাশে আমি একা বসা। ফকির শাহাবুদ্দীনকে (এটর্নি জেনারেল) ফোন করলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসলেন। উনি বললেন, “তুমি একা এখানে? আমি বললাম, “জি। উনি লাশ সংরক্ষণের জন্য বরফ ও চা-পাতার ব্যবস্থা করলেন। একজন লােক পাঠিয়ে দিলেন বরফ ও চা-পাতাসহ। প্রতিবেশীর বাসায় মামানি ছিলেন। ওনাকে খবর দিলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গেই আসলেন। উনি যেন এক নিস্তব্ধ পাথরের মূর্তি। মামানির সেদিনের শােকাহত চেহারার বর্ণনা করা কঠিন। ৫ তারিখ সকালে ডাক্তার করিম সাহেব আমার সামনেই মামার শরীরের গুলির ক্ষত দেখেন। আমি তাকাতে পারিনি। ময়েজউদ্দীন সাহেব এসে বললেন যে আমি বাধা দিচ্ছে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারা মামা ও জেলে নিহত নেতাদের লাশ দাফন করতে দেবে না। আব্দুল মালেক উকিল মামাকে শেষ দেখা দেখতে আসেন। তারপর ওনার সঙ্গে আমিও কাছেই মনসুর আলী

সাহেবের আত্মীয়ের বাসায় যাই। সেখানে মনসুর আলী সাহেবের লাশ রাখা হয়েছিল। মালেক উকিল সাহেব ওই আত্মীয়ের বেডরুম থেকে বঙ্গভবনে ফোন করেন। আমি শুনলাম যে উনি ফোনে বলছেন যে ‘খালেদ মােশাররফের কাছে আমাদের অনুরােধ, সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা একটু মাটি চাই এমন একজন মানুষের জন্য, যিনি দেশটাকে স্বাধীন করেছেন। তাজউদ্দীন সাহেবকে দাফনের জন্য একটু মাটি চাই।’ মালেক উকিল মামার কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। বঙ্গভবন থেকে বলা হলাে ওনার ফোন নাম্বার দিতে। বলা হলাে যে ওনাকে কল ব্যাক করা হবে। মালেক উকিল বঙ্গভবন থেকে ফোনের অপেক্ষায় সেখানে রইলেন। আমি ওই সময় বড় মামার বাসায় চলে আসি। বাসায় পৌছে দেখি জানাজা বাদেই মামাকে বনানিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি তখন দৌড়ে পুলিশের আইজি ও ডিআইজিকে বললাম যে মালেক উকিল বঙ্গভবনে কথা বলছেন, যাতে ওনাকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাফন করা হয়। আমার কথা শুনে ওনারা ওয়্যারলেস হাতে করে পুলিশের জিপে উঠে আবাহনী মাঠের দিকে গেলেন। সে সময় ট্রাক থেকে মামার লাশ আমরা নিচে নামাই। আমগাছের নিচে মামাকে রাখার পর সেখানেই মেজ মামা বড় মামার জানাজা পড়ান। পুলিশের বাধায় ও ভয়ে বহু লোেকই বনানি গােরস্তানে যায়নি। আমরা বনানিতে পৌঁছার পর দেখি যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলী সাহেবদের লাশ দাফন হয়ে গিয়েছে। এত বছর পরও যখন ওই ভয়াবহ দিনগুলাের কথা মনে হয়, তখন আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে শুধু একজন মামাকেই হারায়নি, আমি হারিয়েছি একজন মহান নেতাকে। মামা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একক নায়ক। ওনার নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়। ওনার দৃঢ় মনােবল ও নেতৃত্ব না থাকলে এত সহজে দেশ স্বাধীন হতাে না। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীও আত্মসমর্পণ করত না।

অথচ ওনার কোনাে মূল্যায়ন হয়নি আওয়ামী লীগ। সরকার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেই চায় না। আওয়ামী লীগ বলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর ওদিকে বিএনপি মনে করে জিয়াউর রহমানের ঘােষণায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে যে একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য চারটি মৌলিক উপাদানের প্রয়ােজন। এক, হলাে ভূখণ্ড দুই. সার্বভৌমত্ব তিন, জনগণ ও চার, সরকার। বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করেননি। বা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করেননি। সেই কৃতিত্ব তাজউদ্দীন আহমদের। তিনি ওই চারটি মৌলিক উপাদানের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। (সাক্ষাৎকার জুন ২৮, ৩০ ও ১৩ জুলাই, ২০১০)

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ