You dont have javascript enabled! Please enable it! তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বংশাবলি ও পারিবারিক ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বংশাবলি ও পারিবারিক ইতিহাস
 
১৯৮৩ সালে ছােট কাকু আফসারউদ্দীন আহমদ হাতে লেখা আমাদের পরিবারের একটি বংশাবলি আম’কে দেন। আমি সেখান থেকে কপি করে মূল কপি ছােট কাকুকে ফেরত দিই। ছােট বােন রিমিও আমাদের প্রপিতামহ ইব্রাহীম খাঁর আদি বাসস্থান ময়মনসিংহের নিগুয়ারী হতে আমাদের আত্মীয় মুজিবুর রহমান খানের (বুলবুল) সূত্র থেকে আমাদের পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে আরও কিছু তথ্য যােগ করে, যা আমার কপি করা বংশাবলির সাথে যােগ দিয়ে উল্লেখ করলাম। মূল বংশাবলিতে কন্যা-সন্তানদের নাম ছিল না। অব্দুির পরিবারের নিকটতম কন্যা বা মহিলাদের নাম, যা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে এবং চাচাতাে ভাই (প্রয়াত বড় কাকা ওয়াজিউদ্দীন আহমদ  খানের পুত্র দলিলউদ্দীন আহমদ) দলিল ভাই যে নামগুলাে দিয়েছেন তা ওনার সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করা হলাে নিগুয়ারীর মূল বংশাবলি বিশাল সেখান থেকে এই লেখার জন্য যতটুকু প্রয়ােজন ততটুকুই উল্লেখ করা হলাে। 
আব্বু আমাদের কাছে স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন যে তাঁর পূর্বপুরুষ সুদূর মঙ্গোলিয়া থেকে আমাদের দেশে আসেন। হাজার বছর ধরেই চীন, মঙ্গোলিয়া, মধ্য এশিয়া, ইরান, আরব, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ থেকে পরিব্রাজক, বণিক, রণকৌশলী যােদ্ধা, ধর্মপ্রচারক, সুফি প্রভৃতি বিভিন্ন দল ভারত উপমহাদেশে প্রবেশ করে। সেই হিসেবে আব্দুর বংশধরদের মধ্যে মঙ্গোলীয় থাকা অস্বাভাবিক নয়। আলু, তার নিকটতম পরিবার ও বংশের অনেকেরই শারীরিক গঠন, রং ও চেহারার মধ্যে মঙ্গোলীয় মধ্য এশীয় ছাপ স্পষ্ট। মঙ্গোলিয়া থেকে আব্দুর বংশধরদের  একজন, ফকরুদ্দীন শাহ, দিল্লিতে আসেন। (আনুমানিক ১৭০০ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মােঘল শাসনামলে) তিনি দিল্পির মুসলিম শাসকদের কাছ থেকে প্রশাসনিক খান’ উপাধি লাভ করেন। একপর্যায়ে তিনি আধ্যাত্মিক লাইনে চলে আসেন। আধ্যাত্মিক জীবনে পদার্পণ করার পর তিনি | দিল্লির উচ্চপদ ত্যাগ করে দেশভ্রমণে বের হন। বাংলাদেশ ভ্রমণে এসে নদীমাতৃক এই দেশ ও সবুজ শ্যামল প্রকৃতি দেখে তিনি মুগ্ধ হয়ে যান এবং মােমেনশাহী (ময়মনসিংহ) জেলার নিগুয়ারী গ্রামে বসতি করেন। তার আধ্যাত্মিক জীবনযাপনের জন্য তিনি ফকির সাহেব এবং ফকির খাঁ নামেও পরিচিত হন।
১৯৮৭ সালের গ্রীষ্মকালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় গিয়ে আমি আমার মাস্টার্সের থিসিস লেখার জন্য ফিল্ড ওয়ার্ক শুরু করি; সেই সাথে জেল হত্যাকাণ্ডের ওপর তথ্য সংগ্রহ ও সাক্ষাৎকার গ্রহণ। আব্দুর জনস্থান, আমার শৈশব ও কৈশােরের মধুর স্মৃতির সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত, গজারি ও শালবনে ঘেরা, শীতলক্ষ্যা নদীর কুলঘেষা দরদরিয়া গ্রাম (ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৫০ মাইল/৮২ কিলােমিটার দূরবর্তী গাজীপুর জেলায় অবস্থিত) ভ্রমণের সময়, পূর্বোক্ত কাজের পাশাপাশি, আন্ধুর জন্মস্থান, পারিবারিক ইতিহাস, তার বাল্যকাল ও ছাত্রজীবন সম্বন্ধে তথ্য জোগাড়ের কাজও শুরু করি। গ্রামের নাম দরদরিয়া কেন, সে বিষয়ে নানা জনের নুনা মত। কেউ কেউ মনে করেন যে দরদরিয়ার অর্থ হলাে দরিয়ার দ্বার। গ্রামটি নদীর কূলে গড়ে উঠেছে বলে এই নামকরণ। পল্লি চিকিৎসক শাহাবুদ্দীন জানালেন যে সাহারা রানী দরদরিয়াসহ এই এলাকা শাসন করতেন বলে মৌজার নামকরণ হয় সাহাবিদ্যার কোর্ট। রানি তার এলাকাকে প্রতিরক্ষা করার জন্য খাল কেটে, শীতলক্ষ্যার পাশ দিয়ে পরিখা গঠন করেন। পরিখাটি আমাদের দরবেশ ফুফুর কবরের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছিল।
রানির দুর্গ ছিল নদীর ওপারে। রানি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে মােগল সৈন্যদের হটিয়ে দিয়েছিলেন। ওনার মৃত্যুর বহু পরে, ওনার বাড়ির অনেক নিশানা, যেমন স্বর্ণ, আসবাব ও কাগজপত্র পাওয়া যায়। প্রবাদ আছে যে নদীর কিনারে রানির যে টাকার কুঠি বা কোষাগার ছিল, সেটা ভেঙে একজন জেলের নৌকায় পড়ে। সেই জেলে টাকা ভরে ঘরে ফেরে। স্বপ্নে তাকে নির্দেশ দেওয়া হয় যে সে যেন এই অর্থ মানুষের কল্যাণে খরচ করে। স্বপ্নে প্রাপ্ত নির্দেশ না মানায় জেলে আকস্মিক মৃত্যুবরণ করে।  বর্ষায় ফুলে ওঠা ভরা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি স্মরণ করি এক বীর নারীকে। এক ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে। আমার গ্রামে যাবার খবর পেয়ে আমাকে দেখতে দুই বর্ষীয়ান ফুফু, সুফিয়া খাতুন ও সাহারা খাতুন, দুই-তিন মাইল পথ হেঁটে পার্শ্ববর্তী দিগধা ও বাঘিয়া গ্রাম থেকে দরদরিয়ায় এসেছিলেন। দাদার হাতে গড়া দক্ষিণমুখী বাংলাে-স্টাইলের দোতলা কাঠের বাড়ির নিচতলার খাটের ওপর জড়াে হয়ে আমরা স্মরণ করি এক অসাধারণ পিতা ও তার পরিবারের ইতিহাসকে।
সেকালে জন্মতারিখ-সন লিপিবদ্ধ করার রেওয়াজ না থাকায় সবার জন্মতারিখ একদম সঠিকভাবে জানা সম্ভবপর হয়নি। যদিও জন্ম বছর প্রায় সবারই কাছাকাছি অনুমান করা গিয়েছে। আলু ও মফিজ কাকুর মতােই প্রখর স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন বড় ফুফু সুফিয়া খাতুন, দাদা ও দাদির মারফত, প্রায় প্রতিটি ভাই ও বােনের জন্মের দিন, মাস, বছরের ব্যবধান স্মৃতিতে ধরে রেখেছিলেন, যা উল্লেখ করা হলাে।  বিত্তশালী ভূস্বামী দাদ’ ইয়াসিন খানের ঔরসজাত ও দাদি মেহেরুননেসা খানমের গর্ভে সাত সন্তান জন্মগ্রহণ করে। সবার জন্মসাল ইংরেজি সালে ধরা হয়েছে। আব্বুর প্রায় আড়াই বছরের বড় বােন সুফিয়া খাতুনের জন্ম বাংলা মাঘ মাসের কোনাে এক শুক্রবার। ইংরেজি ১৯২৩ সাল। (বড় ফুফুর বিয়ে হয় সােমবার ২০ চৈত্র। বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর।) আব্দুর জন্ম বাংলা শ্রাবণ মাসের বুধবার দিবাগত রাত, বৃহস্পতিবার ১৯২৫ সালে। (তাজউদ্দিন আহমদ খান পরবর্তী সময়ে পরিবারের মধ্যে সর্ব প্রথম খান উপাধি ত্যাগ করেন।) পশ্চিমের যে কোঠাঘরে আব্দু জন্মগ্রহণ করেন সেই আদি বসতবাড়িটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভস্মীভূত করে। দু’বছর পর মেজ কাকু, মফিজউদ্দীন আহমদের, জন্ম বাংলা ভাদ্র মাস। ১৯২৭ সাল। মফিজ কাকু বেশিদূর লেখাপড়া না করতে পারলেও উনার মেধা ও স্মরণশক্তি ছিল তীক্ষ্ণ। আব্দুর সাথে উনার চেহারার খুব সাদৃশ্য ছিল। মেজ ফুফু সাহারা খাতুনের জন্ম বাংলা চৈত্র মাস। ১৯৩০ সাল। সেজ ফুফু মরিয়ম খাতুনের জন্ম বাংলা ভাদ্র মাস। ১৯৩২ সাল। ছােট ফুফু বদরুন নেসা খানমের জন্ম (মাস জানা যায়নি) ১৯৩৪ সাল। সর্বকনিষ্ঠ, ছােট কাকু আফসারউদ্দীন আহমদ, জন্ম ১ পৌষ। ১৯৩৭ সাল।
(আরবি ১ শওয়াল, ঈদুল ফিতরের দিন, ঈদুল ফিতরের নামাজের সময় ছােট কাকু জন্মগ্রহণ করেন।) ছােট কাকু পেশায় সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভােকেট। প্রাক্তন সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রী। বড় ফুফু সুফিয়া খাতুনের স্মৃতিচারণা ১০ জুলাই, ১৯৮৭ বড়ফুফু আন্ধুকে বড় হয়ে উঠতে দেখেন দায়িত্বশীল, শান্ত, সংযমী, মিতভাষী ও স্নেহপরায়ণ মানুষ রূপে। তার মধুর স্বভাব ও চারিত্রিক গুণাবলির কারণে তিনি ছিলেন সকলের নয়নের মণি’। তিনি বাল্যকাল থেকেই গাছপালার পরিচর্যা খুব পছন্দ করতেন। গরু বাছুরেরও দেখাশােনা করতেন দায়িত্ব সহকারে। আব্দুর প্রিয় মিষ্টি ছিল গুড়। ব্রিটিশ আমলে হিন্দু-মুসলিম সকলের মধ্যেই ধুতি পরার রেওয়াজ ছিল। আব্দুও বাল্য বয়সে ঘরে ধুতি পরতেন। দাদা জেনারেল শিক্ষা অপছন্দ করতেন। ওনার ইচ্ছা ছিল আব্দুকে কুরআনে হাফেজ করা। দাদার তত্ত্বাবধানে নিজ গৃহে প্রতিষ্ঠিত মক্তবে আব্দু বালাবয়সেই ১১ পারা পর্যন্ত কুরআন হেফজ করেন। পরে পুরাে কুরআন। শুক্রবার লুঙ্গি ও শার্ট পরে জুম্মার নামাজে যেতেন। ছেলে ধর্মীয় ও সাধারণ সব শিক্ষায় সমান পারদর্শিতা লাভ করুক, এই ছিল দাদির মনােভাব। দাদির প্রচণ্ড ইচ্ছা ও আগ্রহের কারণে আল্লু স্কুলে ভর্তি হন বাড়ি থেকে দেড়মাইল দূরে (হাফিজ ব্যাপারির বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত স্কুল) ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে। ভূলেশ্বরে পড়াকালীন প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন প্রথম স্থান লাভ করে। পুরস্কার হিসেবে পান ৯ পয়সার কলম ও দেড় পয়সার দোয়াত। দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রথম হন। এবারে প্রথম পুরস্কার পান আল্লাহর ৯৯ নামের বই এবং আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের বই। তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন কাপাসিয়া মাইনর ইংলিশ প্রাইমারি স্কুলে। হেডমাস্টার মফিজউদ্দীন। আব্দুর সব চেয়ে বড় বােন আমাদের দরবেশ ফুফুর শ্বশুর আহমদ ফকিরের বাড়ি তরগাঁওয়ে দু’বছর থেকে কাপাসিয়া প্রাইমারি স্কুলে আব্দু লেখাপড়া করেন। ষষ্ঠ শ্রেণীতে বৃত্তি পরীক্ষায় আন্ধু ঢাকা জেলায় প্রথম স্থান লাভ করেন। ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের তিনজন জ্যৈষ্ঠ বিপ্লবী যারা নজরবন্দী হয়ে কাপাসিয়ায় ছিলেন তাঁদের সাথে আব্দুর পরিচয় হয় বই পড়ার মাধ্যমে। আব্দুর মেধা ও জ্ঞান পিপাসা দেখে তারা মুগ্ধ হন।
তারা আব্বুর  শিক্ষককে অনুরােধ করেন তাকে আরও ভালাে স্কুলে পাঠানাের জন্য। সেই অনুযায়ী সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় আব্বু ভীত হন কালীগঞ্জের নাগরীর সেন্ট নিকোলাস ইন্সটিটিউশনে। ক্লাস এইটের মাঝামাঝিতে এসে ভর্তি হন ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাই স্কুলে এবং ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরিক্ষার আগে সেন্ট গ্রেগরী স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৭৫ সালে ধানমণ্ডির বাড়ির দোতলায় নাশতার টেবিলে আন্ধু স্মৃতিচারণার সময় বলেছিলেন যে ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগের দিন তিনি শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বক্তৃতা শুনতে যান। পরীক্ষায় কোলকাতা বাের্ডে (সে সময় বাংলা প্রদেশে মাত্র একটাই বাের্ড ছিল) ১২তম স্থান লাভ করেন। ম্যাট্রিক পাশের পর এক বছর আব্বু লেখাপড়া করেননি ব্রিটিশ শিক্ষা বিরােধী আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে। আন্ধুর এই সিদ্ধান্তে দাদি খুব মর্মাহত হয়ে আল্লুকে বকাঝকা করেছিলেন। বড় ফুফুর স্মৃতিচারণার এই জায়গায় ছােট কাকু যােগ করেন যে, আব্দুর লেখাপড়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তে দাদি এতই মর্মাহত হয়েছিলেন যে আল্লুকে বলেছিলেন তাজউদ্দীন, তুই পড়বি নাকি আমি দা’। দিয়ে কোপ দিয়ে নিজে মরে যাব!’ আবু তার প্রতিজ্ঞা রেখেছিলেন। আবার দাদির মনও রক্ষা করেছিলেন। একসময় তিনি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় ঢাকা বাের্ডে চতুর্থ স্থান লাভ করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। 
১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দাদা পরলােকগমন করেন। টেলিগ্রাম যখন করা হয় আব্বু তখন কোলকাতায় পার্টির মিটিঙের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। টেলিগ্রাম পেয়ে দরদরিয়ায় পৌছতে পৌছতে রাত। হয়ে যায়। ইতােমধ্যে দাদাকে দুপুরেই দাফন করা হয়। দাদার মৃত্যুর পর আন্ধু পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। জ্যৈষ্ঠভ্রাতা (প্রয়াত ১৯৪৪) ওয়াজিউদ্দীন আহমদ খানের পুত্র দলিলউদ্দীন আহমদ, সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আফসারউদ্দীন আহমদ ও ভাগ্নি আনােয়ারা খাতুন আনারকে পরবর্তী সময়ে লেখাপড়ার জন্য ঢাকা শহরে তার কাছে নিয়ে আসেন।  বড়ফুফু আন্ধুর সাথে তার একটি মধুর স্মৃতি স্মরণ করে স্মৃতিচারণা শেষ করলেন। কিশােরী বধু বড়ফুফু শ্বশুরবাড়ি থেকে পিত্রালয়ে যখন বেড়াতে আসতেন, আন্ধু তাঁর পাঠ্যপুস্তক থেকে ছড়া, গল্প ইত্যাদি আগ্রহভরে ওনাকে পড়ে শােনাতেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আন্ধু পড়তেন সচিত্র শিশুপাঠ। সেই বইটির একটি কবিতা আব্বুর সাথে পড়ে ফুফুও মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। আন্ধু যখন সুর করে কবিতাটি পড়তেন, বড়ফুফুও যােগ দিতেন উৎসাহভরে। আমার শরীরে স্নেহের স্পর্শ বুলিয়ে, তন্ময় হয়ে, ফুফু, আব্বুর মতােই অসাধারণ স্মৃতিশক্তি দিয়ে আবৃত্তি করলেন কবিতাটি :
পথের ধারে পুকুর পাড়ে ভিখারিদের মেয়ে
সারাটি দিন থাকত বসে পথের দিকে চেয়ে।
কেউ বা দিত পয়সা কড়ি
কেউ বা দিত চাল।
কেউ বা কেবল দেখে যেত
কেউ বা দিত গাল।
ধুলাে দিয়ে পালিয়ে যেত দুটু ছেলের দল।
নীরবে তার গালটি দিয়ে পড়ত চোখের জল।
রাজার ছেলে সেই পথেতে যেতেন ঘােড়ায় চড়ে
একদিন তার ছুটল ঘােড়া তিনি গেলেন পড়ে।
হাঁ করে সব লােকগুলাে দেখল শুধু চেয়ে।
আহা বলে দৌড়ে এল ভিখারিদের মেয়ে।
কেঁদে বলে হায় কী হবে কপাল গেছে কেটে
নিজের কাপড় ছিড়ে মাথায় পট্টি দিল এঁটে।
আজলা ভরে পুকুর হতে জল দিল সে ঢেলে
রাজার ছেলে সুস্থ হলেন বসলেন আঁখি মেলে।
জিজ্ঞাসিলেন অবাক হয়ে চেয়ে মুখের পানে।
কি নাম তােমার কাজের মেয়ে থাক বা কোনখানে।
ভয়ে ভয়ে ভিখারিণী, ভয়ে বা লাজে
বলে আমার কেউ নেই, ভিখারিদের মেয়ে।
বাবা আমার অন্ধ হলেন মা পড়েছেন বাতে
ভিক্ষা করে যেটুকু পাই, বেঁচে আছেন তাতে।
রাজার ছেলে দিলেন খুলে রত্ন হীরার হার
ভিখারিণী বলে ঠাকুর চাই না অলঙ্কার।
গরিব আমি সােনারুপার কাজ কি বড় মাের ?
মিথ্যা ললাকে বলবে মােরে চোর
রাজার ছেলে গেলেন চলে দেখলেন সবাই চেয়ে
সবাই বলে আচ্ছা বােকা ভিখারিদের মেয়ে।
এখন দেখ রাজবাড়িতে রানির মত সুখে।
এমন করে বেড়ায় কে গাে এমন হাসি মুখে।
কাহার গুণে, প্রশংসাতে দেশ গিয়েছে ছেয়ে।
আহা বলে এই কি মােদের ভিখারিদের মেয়ে !
১০ জুলাই, ১৯৮৭ | ছােট কাকু সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভােকেট (প্রাক্তন সাংসদ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী) আফসারউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎকার ছােট কাকু, দাদা ও দাদির কাছ থেকে শােনা, আমাদের বংশের ইতিহাস স্মরণ করেন। ছােট কাকুর দাদা, আমার প্রপিতামহ ইব্রাহীম খাঁ (বংশাবলি ও রেওয়াজ অনুযায়ী একই ব্যক্তি কখনাে  খ বা ধান হিসেবে উল্লেখ্য) ছিলেন অত্যন্ত সুপুরুষ। বলিষ্ঠ শরীরের গড়ন। টকটকে ফরসা গায়ের রং। পিতার একমাত্র পুত্র ইব্রাহীম খাঁ পৈতৃক সূত্রে অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক ছিলেন। ইব্রাহীম খাঁকে নিয়ে তার বাবা ইউসুফ খাঁ তাদের পৈতৃক নিবাস ময়মনসিংহের নিগুয়ারী থেকে তরগার বা বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। তাঁরা দরদরিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে সৈয়দ জিকির মােহাম্মদের (সাহেব আলী ব্যাপারির বাবা। নৌকার ব্যবসা ছিল বলে লােকে ব্যাপারি বলত) বাড়ির কাছাকাছি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। জিকির মােহাম্মদ ছিলেন প্রচণ্ড ডাকসাইটে ও রাগী। তিনি যখন ইব্রাহীম খাঁকে দেখলেন তখন তাদের থামিয়ে তার বাবাকে প্রস্তাব দিলেন যে এই ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দেব।’ প্রস্তাব শুনে পিতা ও পুত্র হতভম্ব। খাঁ পরিবার ছিল অত্যন্ত দ্র ও মিতভাষী। তারা ভাবতেও পারেনি এমনভাবে অচেনা লােককে এক কথায় কেউ  বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারে ইব্রাহীমের বাবা বুদ্ধি করে বললেন যে তরগা থেকে ফেরার পথে দেখা যাবে।
তরগার বা বাড়ি বেড়িয়ে তারা দরদরিয়া রাস্তা বদলে তরগা থেকে সরাসরি এই লাইনটি স্পষ্ট নয়। এত বছর পরও ফুফু সুদীর্ঘ কবিতাটি প্রায় নিখুঁতভাবে মনে যে রেখেছিলেন, সেটিই বড় পাওয়া।কাপাসিয়ার পথ দিয়ে বর্মির পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। কিন্তু জিকির মােহাম্মদ সে সময় সেই নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে তাদের দেখে ফেলেন। পিতা ও পুত্র নদীর ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। তখন তিনি নদী সাঁতরিয়ে তাদের থামালেন। ইব্রাহীম খাঁ-ই তার মেয়ের জন্য উপযুক্ত, এবং তার মেয়ের বিয়ে এই ছেলের সাথেই হবে, এই সিদ্ধান্তে অটল জিকির মােহাম্মদের মনের আশা শেষ পর্যন্ত পূর্ণ হলাে। ইব্রাহীম খাঁর বিয়ে হলাে জিকির মােহাম্মদের আদরের কন্যার সাথে। ইব্রাহীম। ঘর বাবা ইউসুফ খাঁ ছেলেকে তার শ্বশুরবাড়িতে রেখে নিগুয়ারীতে ফিরে গেলেন। শ্বশুর এই দরদরিয়া ও শ্রীপুরের সব তালুকদারি লিখে দিলেন ইব্রাহীম খাঁর নামে। নিগুয়ারীর অগাধ ধনসম্পত্তি যা খা বাড়ির ছিল এবং একমাত্র পুত্র ইব্রাহীম খাঁর জন্য রক্ষিত ছিল তা পেছনেই রয়ে গেল। ইব্রাহীম খার একমাত্র পুত্র আমার দাদা ইয়াসিন খাঁর (খান) জনু দক্ষিণের ঘরের সামনের উঠানে যে ঘর আগে ছিল, সেখানে।
ইয়াসিন খাঁ শৈশবেই পিতৃহারা হন। সে কালে এই গহীন গজারি, শালবন ও গড় এলাকায় বাঘের উপদ্রব হতাে। পাকা বাঘশিকারি ইব্রাহীম খাঁ একদিন রানি বাড়ির দিকে বাঘ শিকারে গেলেন। বাঘকে গুলিবিদ্ধও করলেন। গুলি খেয়ে বাঘ লুকিয়ে পড়ল। পরদিন তিনি সে স্থানে। গেলেন বাঘকে খুঁজতে। গুলিবিদ্ধ বাঘটি ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল। অতর্কিতে ইব্রাহীম খাঁর ওপরে সে হামলা চালাল। ইব্রাহীম খার হাতের গাদা বন্দুক হঠাৎ জ্যাম হয়ে যাওয়াতে গুলি বের হলাে না। বাঘ এই সুযােগে তাঁর শরীরে ১৭টি মরণকামড় বসাল। ইব্রাহীম খাঁর রক্তাক্ত টুপি ছিটকে পড়ল এক পাশে। বাঘের বিষাক্ত কামড়ে গ্যাংগ্রিন হয়ে সাত দিন পর আমার বড় দাদা ইব্রাহীম খাঁ ইন্তেকাল করেন। বাঘের প্রসঙ্গ উঠতে মেজ ফুফু সাহারা খাতুন ও বড়কাকার মেয়ে রমিযা আপা আরও কিছু তথ্যের জোগান দিলেন। দাদি খুব সাহসী ছিলেন। একবার গভীর রাতে ছাগলের ঘরের দরজার নিচের মাটি খুঁড়ে এক খুদে বাঘ ছাগলের চামড়া টেনে বাইরে বের করার চেষ্টা করেছিল। বড় কাকিকে (রমিযা আপা ও দলিল ভাইয়ের আম্মা) সাথে নিয়ে দাদি ছাগলের ঘরে ঢুকে দেখেন যে, বাঘ ছাগলকে টানছে। ছাগলের পেট ছিড়ে ফালা ফালা। দাদির উপস্থিতি দেখে বাঘ ছাগল ছেড়ে দূরে সরে যায়। বাঘের খোজে দাদি বাইরে এসে দেখেন যে বাঘের নীল চোখ ঝােপের আড়াল থেকে জ্বলছে, গনগন করে।
আর একবার এক বাঘ ছাগল নিয়ে দেওয়াল টপকে পালাচ্ছিল। দাদি দরজা খুলে ভীষণ চিৎকার শুরু করেন। দাদির চিৎকারে বাঘ ছাগল ছেড়ে পালায়। আব্ব বলেন যে ‘মাকে আমরা বকা দিই বেশি গলা বলে। আজ ওনার গলার জন্য ছাগল ফেরত পেলাম।’ ঐ ছাগলটা তখনাে মরেনি। ওকে জবাই করে সবাই খেল। মেজ ফুফুর বয়স তখন ৮/৯ বছর। আন্ধু সে সময় দরদরিয়ার বাইরে থেকে লেখাপড়া করছেন। ভরা আষাঢ়ের রাতে দরজা ভেঙে ডাকাত ঘরে ঢুকল। তারা ট্রাঙ্ক ভেঙে দাদির ও বড় কাকির গয়না নিল। দাদার মাথায় কুড়ালের কোপ দেওয়ার সময় দাদি ডাকাতের সামনে এসে কুড়াল ধরলেন। ওই কোপে দাদির হাতের মাঝখানের আঙুলের মাথা কেটে পড়ে গেল। দাদা। প্রাণে রক্ষা পেলেন। প্রতিবেশী মফিজউদ্দীন মুনশীর স্মৃতিচারণা মফিজউদ্দীন মুনশীর বয়স ওনার হিসেবে আনুমানিক ৬৮ বছর। ওনার বাবা ফজলুর রহমান মুনশীর কাছে আমার দাদা ইয়াসিন খান আরবি ও ফারসি শিক্ষা লাভ করেন। পল্লিচিকিৎসক ডাক্তার শাহাবুদ্দীনের দুদা, সাহেব আলী ব্যাপারির বােনের সাথে ইব্রাহীম খাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর তারা দক্ষিণ ও পশ্চিমের দিকে ভিটা করে বসবাস শুরু করে। বাঘ শিকারে যাবার পর।
ইব্রাহীম খকে বাঘ ১৭টি কামড় দেয়। সাত দিন পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। পিতৃহারা বালক ইয়াসিন খাঁর গ্রামে তখন কোনাে মাদ্রাসা বা স্কুল ছিল না। ইয়াসিন খাঁ দুই মাইল দূরে বাঘিয়া গ্রামে হেঁটে যেতেন ওস্তাদের কাছে পড়তে। সেই ওস্তাদের নাম ছিল আব্দুল করিম মুনশী । প্রথম দুই স্ত্রীর মৃত্যুর পর দাদা বিয়ে করলেন একই গ্রামের ভূস্বামী পরান হাজির কন্যা ও নজিমুদ্দীনের বােন, আমার দাদি মেহেরুননেসাকে। আব্দুর বাল্যকালে প্রতিবেশী আবু মােড়লের বাড়িতে আব্দুর রউফ নামে একজন শিক্ষক বাংলা পড়াত। সেই ননফর্মাল স্কুলের প্রথম ছাত্র ছিল তাজউদ্দীন। এর কিছুদিন পর সে হাফিজ ব্যাপারির বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত ভুলেশ্বর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়। সেই স্কুলে তার একজন শিক্ষকের নাম ছিল ইউসুফ আলী।’ মফিজউদ্দীন মুনশী স্মৃতিচারণা শেষ করেন। ১১ জুলাই, ১৯৮৭ আব্দুর শিক্ষক, কাপাসিয়া এম. ই (মাইনর ইংলিশ) প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মফিজউদ্দীন (মফিজ মাস্টার হিসেবে পরিচিত) আহমদের স্মৃতিচারণ। ১৯৩৬ (আনুমানিক) সালে কাপাসিয়া প্রাইমারি স্কুলে তাজউদ্দীন ক্লাস থ্রিতে পড়ত। একদিন তার ক্লাসে ঢুকি। দেখি যে তাজউদ্দীন কাঁদছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম কাঁদছ কেন ?’ সে বলল, absent ছিলাম, তাই স্যার মেরেছে। সেই ক্লাসের শিক্ষক দেবেন্দ্রবাবু ছাত্রদের মারতেন। আমি কমনরুমে দেবেন্দ্রবাবুকে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেন মেরেছেন ?’ উনি উত্তর দিলেন, ‘বাধা (absent) করেছে, তাই মেরেছি।’ আমি বললাম, এই সামান্য কারণে কেন মেরেছেন ?’ এরপর আমি সব টিচারদের বললাম, আপনারা তাজউদ্দীনকে মারবেন না। সে হলাে great scholar। সে হলাে রত্ন। তার মাঝে আমি বিরাট ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। তাজউদ্দীন যখন ক্লাস নাইনে পড়ে, তখন আমি জোরপূর্বক ট্রান্সফার করিয়ে ঢাকা শহরে সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে তার আগে কিছুদিন মুসলিম বয়েজ স্কুলে পড়েছিলেন) ভর্তির ব্যবস্থা করি। কারণ তার মতাে মেধাবী ছেলেকে পড়াবার মতাে টিচার গ্রামে ছিল না। যখন তাজউদ্দীনকে সেন্ট গ্রেগরিতে পাঠালাম, তখন তােমার দাদা খুব charge করলেন ওকে একা ঢাকা শহরে পাঠাবার জন্য। আমি ওনাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম যে উনি যেন চিন্তা না করেন।
(দাদা পরে সম্মতি দেন এবং আব্দুর লেখাপড়া ও লজিং এর খরচের দায়িত্ব বহন করেন।) | ঢাকা কোর্টের কাছে যে ব্রিজ ছিল তার পূর্ব দিকে সাহেব আলী ব্যাপারির (অন্য ব্যক্তি) বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে তাজউদ্দীন থাকত। গােলাম হােসেন ছিল সাহেব আলীর ভাই, সেও তাজউদ্দীনের সাথে পড়ত। ম্যাট্রিকে তাজউদ্দীন ১২তম স্থান লাভ করে। বাংলাদেশে তখন একটাই বাের্ড ছিল। তাজউদ্দীনের মতাে brilliant ছাত্র আমার জীবনে আর পাইনি। সেন্ট গ্রেগরি স্কুলে তখনকার পাঞ্জাবি গভর্নরের ছেলে (লাস্ট নেম ছিল চৌধুরী) তার সাথে compete করে সে ফাস্ট হতাে। সেই গভর্নরের ছেলের চারজন টিউটর ছিল এবং নিজেও ঐ স্কুলের ফাস্ট বয় ছিল। তাজউদ্দীন আসার পর তার সাথে সে পারেনি। পরীক্ষার রেজাল্টে তাদের মধ্যে ৩০/৩৫ মার্কসের ডিফারেন্স থাকত। তাজউদ্দীনের বৃহৎ গুণ হলাে যে সে সব বিষয়ে সমান। ভালাে ছিল। শিক্ষকের প্রতি সম্মান মফিজ মাস্টার সাহেব স্মৃতিচারণায় আরও বলেন যে ১৯৭১-এ যুদ্ধের সময় তিনি যখন আগরতলা ক্যাম্পে, তখন আব্ব ওনার জন্য ওজুর বদনা ও জায়নামাজ নিয়ে গিয়েছিলেন। আর একবার ঐ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি কোলকাতার মুজিবনগরে আন্ধুর জন্য কুরআন শরিফ পাঠিয়েছিলেন। কুরআন পেয়ে আন্ধু ওনাকে খবর পাঠিয়েছিলেন এই বলে মফিজ স্যারের পাঠানাে কুরআন যখন হাতে পৌঁছেছে, তখন চিন্তা নেই।
দেশ স্বাধীন হবেই।’ বংশাবলির নিম্নোক্ত অংশটি দলিল ভাই (প্রকৌশলী দলিলউদ্দীন আহমদ)-এর ১৪ অক্টোবর ২০০৯, ১৭ ডিসেম্বর ২০০৯, ৭ জুলাই ২০১১-এর সাক্ষাৎকার থেকে সংগৃহীত। ইয়াসিন খানের প্রথম স্ত্রীর (নাম জানা যায়নি) গর্ভে দুই কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল। প্রথম কন্যার নাম গােলাবুন্নেসা (দরবেশ ফুফু)। দ্বিতীয় কন্যার নাম জানা যায়নি। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর ইয়াসিন খান দ্বিতীয় বিয়ে করেন। দ্বিতীয় স্ত্রীর (নাম জানা যায়নি) গর্ভে এক পুত্র ও এক কন্যা জনুগ্রহণ করে। প্রথম পুত্রসন্তানের নাম ওয়াজিউদ্দীন আহমদ খান (দলিল ভাইয়ের পি) জন্ম ১৯১৩ বা ১৯১৪ সাল, ও কন্যার নাম সফরুন নেসা।
দ্বিতীয় স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর বৈমাত্রেয় বােন (এক পিতার ঔরসজাত) পরান হাজির কন্যা মেহেরুননেসা খানমকে বিয়ে করেন। মেহেরুননেসা খানমের গর্ভে সাত সন্তান জন্মগ্রহণ করে। প্রথম সন্তান : কন্যা সুফিয়া খাতুন মাঝে এক মৃত পুত্র প্রসব করেন (রিমির তথ্য) দ্বিতীয় সন্তান : প্রথম পুত্র – তাজউদ্দীন আহমদ খান (জন্ম : ২৩ জুলাই ১৯২৫। পরবর্তী সময়ে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফরম পূরণ করার সময় তিনি নামের খান অংশটি বাদ দেন)। পৈতৃক সূত্রে। প্রাপ্ত খান উপাধিটি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘খান’ খানবাহাদুর উপাধির সাথে সম্পৃক্ত না হলেও ধারণা করা যায় যে তিনি ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত উপাধির সাথে মিল থাকায় ‘খান’ উপাধি ত্যাগ করেন। তৃতীয় সন্তান : দ্বিতীয় পুত্র – মফিজউদ্দীন আহমদ খান। চতুর্থ সন্তান : দ্বিতীয় কন্যা – সাহারা খাতুন। পঞ্চম সন্তান : তৃতীয় কন্যা – মরিয়ম খাতুন। ষষ্ঠ সন্তান। চতুর্থ কন্যা – বদরুন নেসা খানম (বুলবুল ফুফু) সপ্তম সন্তান : কনিষ্ঠ পুত্র – আফসারউদ্দীন আহমদ খান। সর্বকনিষ্ঠ কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করার পর আতুড়ঘরেই মৃত্যুবরণ করে। সে সময় দলিল ভাই ও ছােট কাকুর বয়স সাত-আট বছর। | দলিল ভাইয়ের মা, আমাদের বড় কাকির নাম জয়নাবুন্নেসা। আমাদের সবচেয়ে বড় কাকা ওয়াজিউদ্দীন আহমদ খান। ছােট কাকুর সমবয়সী দলিল ভাইয়ের জন্ম আনুমানিক ১৯৩৭ সালে, বাংলা চৈত্র মাসে। ওনার হিসাব অনুযায়ী খুব সম্ভবত ২০ মার্চের আগে। (বাংলা মাস ইংরেজি মাসের প্রায় মাঝামাঝি সময়ে শুরু হবার কারণে বাংলা মাস শেষ হয়ে থাকে পরবর্তী ইংরেজি মাসে। দলিল ভাইয়ের জন্ম চৈত্র মাসের শুরুতে হওয়ায় উনি অনুমান করেন যে ওনার জন্ম তারিখ হবে ইংরেজি ২০ মার্চের পূর্বে, খুব সম্ভব মার্চের ১৬ তারিখে। বাংলা চৈত্র মাসের ২ তারিখে।)
ভাইবােনদের মধ্যে সবচেয়ে বড় (দলিল ভাইয়ের চেয়ে ছয় বছরের বড় বােনের নাম রমি আকতার খানম। রমিযা আপার দুই বছরের ছােট ভাইয়ের নাম মােহরউদ্দীন আহমদ খান। ওনার চার বছর পর দলিল ভাইয়ের জন্ম। দলিল ভাইয়ের এক বছরের ছােট বােনের নাম সাঈদা আকতার খানম। দলিল ভাই খুব অল্পবয়সেই পিতৃহারা হন। ওনার বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন ওনার বাবা ১৯৪৬ সালের বাংলা ভাদ্র মাসের (অগাস্ট বা সেপ্টেম্বর) কোনাে একদিন আকস্মিকভাবে ইন্তেকাল করেন। সেকালে ওনার মৃত্যুর কারণ নির্ণয় না করা গেলেও ধারণা করা যায়, হয়তাে ‘food poisoning বা খাদ্যে বিষক্রিয়ার ফলে উনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর আগের দিন তিনি। চাষিদের (মৌসুমের ফসল কাটার জন্য সাময়িকভাবে নিয়ােগপ্রাপ্ত) বানানাে নানা রকম পিঠা ও খাবার খান। রাতে প্রচণ্ড পেটব্যথা শুরু হয় কিন্তু বমি বা বাথরুম কিছুই হয় না। পরদিন তিনি। মৃত্যুবরণ করেন। দাদা মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। দলিল ভাইয়ের বড়। ভাই ক্লাস এইটের ছাত্র, মােহরউদ্দীন টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৮ সালে। পিতৃহারা দলিল ভাই গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে প্রথম আসেন মফিজ কাকুর সাথে ১৯৫০ সালে। বনবিভাগের দুনীতির বিরুদ্ধে আল্লু অভিযােগ করায় বনবিভাগ আব্দুর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে। সেই মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারেই দলিল ভাইকে সাথে নিয়ে মফিজ কাকু ঢাকায় আসেন। সাক্ষাৎকারের এই অংশে দলিল ভাই ওনার ঢাকা শহরে প্রথম আগমনকে কেন্দ্র করে একটি মজার ঘটনা বললেন। ঢাকা শহরে উনি মফিজ কাকুর সাথে সদরঘাট ঘুরলেন, ঘােড়ার গাড়িতে করে যাত্রীদের যাতায়াত দেখলেন (মােটরগাড়ি ওনার চোখে পড়েনি) এবং রাতে মজা করে মফিজ কাকুর সাথে সিনেমা দেখলেন। হল থেকে বেরুতে বেরুতে অনেক রাত। উনি বললেন ‘ভয়ে আমরা বাসায় ঢুকি না। অনেক রাত, যদি বড় কাকু বকা দেয়। আমরা তখন একটি মসজিদে ঢুকলাম। মফিজ কাকু নামাজ পড়লেন। আমরা সেই মসজিদেই ঘুমালাম।
রাতে ভূমিকম্প হলাে। সকালে রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে দেখি সুইপাররা রাস্তা ঝাড় দিচ্ছে। একটু পরে দেখি পানি দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করা হচ্ছে। গ্রামে ফেরত যাবার পর সকলে জিজ্ঞেস করল ‘ঢাকা। শহরে কী দেখলে ? আমি বললাম যে, রাতে ঝাঁকুনি দিয়ে ঢাকা শহরের বিল্ডিংয়ের সব ময়লা মাটিতে ফেলা হয়। তারপর সেই ময়লা ঝাড় দিয়ে পরিষ্কার করা হয়। ভূমিকম্পকে তিনি ভেবেছিলেন ঢাকা শহরের ময়লা পরিষ্কারের অভিনব এক পন্থা। ১৯৫১ ও ‘৫২ সাল থেকে দলিল ভাই অনেকবার ঢাকা শহরে আসেন।  ছােট কাকু আফসারউদ্দীন আহমদসহ আন্ধুর সাথে পুরাতন ঢাকার ১৭ কারকুন বাড়ি লেনে বসবাস শুরু করেন ১৯৫৬ সাল থেকে। পিতৃহারা বালিকা ফুফাতাে বােন আনার আপা (আনােয়ারা খাতুন) ওনাদের সাথে বড় মামার গৃহে বসবাস শুরু করেন ১৯৫৭ সাল থেকে। রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকার কারণে ঢাকা কলেজের ক্লাসগুলােতে আবু নিয়মিত উপস্থিত থাকতে পারেননি। ঢাকা কলেজ যেহেতু সরকারি কলেজ ছিল এবং অন্যান্য সরকারি কলেজের মতােই, উপস্থিতির ব্যাপারে এই কলেজের নিয়মকানুন ছিল কড়া, সেহেতু এই কলেজ থেকে আব্ব ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিতে পারেননি। তিনি বেসরকারি সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়ে ঢাকা বাের্ডে চতুর্থ স্থান লাভ করেন। মাঝে আব্বু কিছুদিন জগন্নাথ কলেজে পড়েছিলেন। ১৯৫৪ সালে আল্লু অর্থনীতিতে অনার্স সহকারে বিএ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। যুক্তফ্রন্ট ইলেকশন ঐ বছরেই ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। আব্দু শুনেছিলেন যে বিএ পাস ব্যতীত ইলেকশনে হয়তাে নমিনেশন দেওয়া হবে না। এ কারণেই তাড়াহুড়া করে বিএ পরীক্ষা দেন ও বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। যুক্তফ্রন্টের ইলেকশনে জেতার পর ফজলুল হক হলের ছাত্ররা ওনাকে বিশাল সংবর্ধনা দেয়। হলের ভেতরের দিকে এক সুন্দর বাগান ছিল, সেখানেই তারা তাকে মাথায় তুলে আনন্দ প্রকাশ করে। 
বিএ পাস করার পর আলু এলএলবি (ব্যাচেলার অব ল’) পড়ার জন্য আইন বিভাগে ভর্তি হন। আব্দুর নির্দেশ অনুসারে দলিল ভাই আব্দুর একটা চিঠি ফজলুল হক হলের প্রভােস্টের কাছে পৌছান। ঐ চিঠি পেয়ে প্রভােস্ট দলিল ভাইয়ের কাছে ল’ কলেজে ভর্তির জন্য রেফারেন্স ও রেসিডেন্স সার্টিফিকেট দেন। আব্ব পূর্ণ উদ্যমে আইন অধ্যয়ন শুরু করেন। দলিল ভাইয়ের ভাষায়, ঢাকা মেডিক্যাল হাসপাতালের সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ল’ ফ্যাকাল্টি ছিল। সেখানে বড় কাকা ক্লাসে যেতেন। আমি একদিন ‘৫৬ সালে ওনার সাথে ক্লাসে যাই। জেল থেকে উনি ল’ পরীক্ষা দেন। কাকি (আম্মা) বই জোগাড় করেন। আমি বইগুলাে নিয়ে লালবাগ এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) অফিস থেকে সেন্সর পাস করিয়ে আনি। সিএসপি হাফিজউদ্দীন সাহেবের ছােট ভাই মহিউদ্দীন সাহেবও সিএসপি ছিলেন এবং লালবাগ এসবি অফিসে পােস্টিং পেয়ে সেখানে কর্মরত ছিলেন। উনিই সেন্সর পাসের ব্যবস্থা করেন। বইগুলাে যে নিতান্তই আইনের বই এবং আপত্তিকর নয় সে জন্যই জেলের ভেতর পাঠাবার আগে সেন্সর পাসের নিয়ম ছিল। ১৯৬২ সালে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ডেপুটি জেলার ছিলেন খুব সম্ভবত শাহাবুদ্দীন সাহেব। সে সময় আজম খান ছিলেন ঢাকার গভর্নর। অবাঙালি হলেও বাঙালিদের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। কাকা জেল থেকে ল’ পরীক্ষা দেন ১৯৬৪ সালে। জেল থেকে বের হবার পর ল’র রেজাল্ট বের হয়। বড় কাকাকে প্রায়ই জেলে যেতে হতাে। ১৯৬২ সালে হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য বড় কাকাকে আইয়ুব খান সরকার জেলে ঢােকায়।
এই শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে আইয়ুব খান বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আঘাত হানতে চেয়েছিল। প্রায় ১০ হাজার লােকের সাথে এই শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আমি তেজগা থেকে প্রসেশনে যােগ দিই। ঐ বছরেই ১ রমজানে আন্দোলনরত কয়েক হাজার লােকের সাথে বন্দী হই। আমাদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখা হয়। এই শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন আসলে ছিল স্বৈরাচারী (ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আন্দোলন। বড় কাকা ও অন্য নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন। অর্গানাইজ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক আন্দোলন যখন দানা বাঁধল তখন সরকারের লেজুড় মুসলিম লীগের মাধ্যমে অবাঙালি বিহারি সম্প্রদায়কে ব্যবহার করে আইয়ুব খান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবেই পাকিস্তান সরকার বিহারিদের পূর্ব পাকিস্তানে ঠাই দেয়। উদ্দেশ্য ছিল বিহারিদের ব্যবহার করে হিন্দু ও মুসলিম বিদ্বেষকে জিইয়ে রাখা এবং বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনকে দমিয়ে রাখা। তাদের উসকিয়ে দেওয়া হয় বাঙালির সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্তিমিত ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য। ১৯৬৪ সালের ১৪ জানুয়ারি বিশিষ্ট সমাজকর্মী ড. আমির হােসেন চৌধুরীকে সকাল ১০টার দিকে বিহারিরা নবাবপুর রেল লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। উনি মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য ও হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য তাকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়া লাল হেডিংয়ে ইত্তেফাক পত্রিকায় লিখলেন বাঙালি রুখিয়া দাঁড়াও’। বাঙালিরা যখন বুঝতে পারল এবং বিহারিদের পাল্টা আক্রমণ করল তখন সাথে সাথেই কারফিউ জারি হয়ে যায়।
১৪ জানুয়ারি ড. আমির হােসেনকে হত্যার দিনে তেজগাঁ পলিটেকনিকে আমার ফাইনাল পরীক্ষার শেষ দিন ছিল। আমাদের পরীক্ষা শুরু হয় ২ জানুয়ারি থেকে। আমরা যখন পরীক্ষা দিচ্ছি তখন শেখ সাহেব কাছাকাছি কোথাও ছিলেন। শেখ সাহেব পরীক্ষার হলে একজনের মারফত চিরকুট পাঠালেন। ওনার চিরকুটে আমাদের জন্য নারায়ণগঞ্জে যাবার নির্দেশ ছিল। দাঙ্গা দমন করে শান্তি রক্ষার নির্দেশ দিয়ে তিনি মুন্সিগঞ্জের এমপি বাদশা মিয়াকে একটি চিঠি ও আমাদের জন্য কারফিউ পাস পাঠিয়েছিলেন। আমাদের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইস্ট্রেনিকস শাখার ফার্স্ট বয় আনিস ও আমি তাড়াহুড়া করে কোনােমতে পরীক্ষা দিয়ে শেখ সাহেবের চিঠি নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বাদশা মিয়ার কাছে পৌছে দিই। শেখ সাহেব, বড় কাকু ও নেতৃবৃন্দ দাঙ্গা। প্রতিরােধ ও শান্তি-সম্প্রীতি রক্ষার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখার পরও পাকিস্তান সরকার মিথ্যা অভিযােগ (Press and Publication Ordinance এবং পাকিস্তানের দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় তথাকথিত অপরাধ সংঘটনের অভিযােগে সরকার মামলা দায়ের করে) এনে ওনাদের গ্রেপ্তার করে। ওনারা পরে জামিনে মুক্তি পান। কাকু রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে। ওতপ্রােতভাবে জড়িত থাকার পরও লেখাপড়ার দিকটা ঠিক রেখেছিলেন। মনে আছে, কাকুর সাথে একদিন হেঁটে হেঁটে কারকুন বাড়ি থেকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দক্ষিণ দিকে ল’ কলেজে যাই ওনার ফজলুল হক হলের রেসিডেন্স সার্টিফিকেট তুলতে। কারকুন বাড়ি থেকে ল’ কলেজ ৩ মাইলের পথ ।
রিকশায় গেলে ভাড়া তিন বা চার আনা, কিন্তু কাকু সেটিও খরচ করবেন না। বলতেন, হাঁটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালাে। উনি অপচয় করতেন না। আবার গরিবদুঃখীদের জন্য অকাতরে খরচ করাতেও ওনার কোনাে কার্পণ্য ছিল না। | কাকুর বিয়ের আগে আমি একই সঙ্গে সংসার চালাতাম ও কলেজেও পড়তাম। উনি MLA (Member of Legislative Assernbly – প্রাদেশিক সদস্য) হিসেবে ২০০ টাকা ভাতা পেতেন। তার থেকে ৬০ টাকা চলে যেত বাসা ভাড়াতে। উনি নিজের জন্য ১০/২০ টাকা রেখে বাকি টাকা আমার হাতে তুলে দিতেন। আমি হাটবাজার ও গােটা সংসারের তদারক করতাম। রান্নাবান্না করত গােসিঙ্গার আবুল হাশেম। কাকু চ্যাপা শুটকি দারুণ পছন্দ করতেন। শুটকি যেদিন রাঁধা হতাে সেদিন ভাত short পড়ত। কাকু মাছও খুব পছন্দ করতেন। মেহমান এলে আবুল হাশেম দই আনত বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে। সেখান থেকে দই কেনার আগে। আরও অনেক দোকানে দই চেখে যখন তার পেট ভরত তখন সে যেত বিক্রমপুর মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। এ নিয়ে আমরা খুব হাসতাম। এভাবেই আমাদের সংসার জীবনের দিনগুলাে কেটে যাচ্ছিল। কাকু যখন বিয়ে করলেন তখন কাকির হাতে সংসার তুলে দিয়ে আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কাকি দারুণ মজার রান্না করতেন। পুরান ঢাকার লালবাগে কাকি আমাকে মাঝে মাঝে পাঠাতেন। বাকরখানি নিয়ে আসতে।
সেই দিনগুলাের স্মৃতি কখনােই ভুলতে পারিনি।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ