সাংবাদিক জহিরুল হকের সাক্ষাৎকার
সাবেক রিপাের্টার মার্নিং নিউজ
আদি নিবাস খুলনা, বাংলাদেশ
১৯৭৩ অথবা ‘৭৪ সালে বাজারে ২ টাকা স্ট্যাম্পের তীব্র সংকট দেখা দেয়। কালােবাজারিরা স্ট্যাম্পের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ২ টাকার স্ট্যাম্প ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করত। এরকম সময়ে তাজউদ্দীন সাহেবের পিআরও (পাবলিক রিলেশনস অফিসার) আব্দুল আউয়াল সাহেব আমাকে মর্নিং নিউজ অফিসে ফোন করে বলেন যে মন্ত্রী সাহেব এক জায়গায় যাবে। উনি আপনাকে সঙ্গে নিতে চান। আমি রিপাের্টার হিসেবে তাজউদ্দীন সাহেবের অনেক অনুষ্ঠান কভার করতাম। সেজন্য আউয়াল সাহেব আমাকে ভালাে জানতেন। তাজউদ্দীন সাহেবও আমাকে পছন্দ করতেন। আমি নিউজ এডিটরকে জানালাম যে মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে। উনি সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব, ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব, এসপি ও ডিসিসহ আমরা ঢাকা কেটে গেলাম। প্রথমে আমরা সচিবালয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে বাসস ও বিসিআই-এর সাংবাদিকরাও ছিলেন। সচিবালয় থেকে তাজউদ্দীন সাহেবসহ ঢাকা কোর্টের চত্বরে। সেখানে মহুরিরা বসে দলিল লেখে ও স্ট্যাম্প বিক্রি করে। তাজউদ্দীন সাহেব সরেজমিনে দেখতে এসেছিলেন যে সত্যি স্ট্যাম্পের সংকট রয়েছে কিনা। উনি আড়ালে দাড়িয়ে আমাকে বললেন যে আপনি বিক্রেতার কাছে যেয়ে ২ টাকার স্ট্যাম্প চান। আমি ওনার কথা অনুযায়ী বিক্রেতার কাছে ২ টাকার স্ট্যাম্প ঢাইতেই সে বলল যে স্ট্যাম্প নেই। সেই মুহূর্তেই তাজউদ্দীন সাহেব সেখানে উপস্থিত হয়ে বিক্রেতাকে বললেন, ‘স্ট্যাম্পের বাক্স খুলুন দেখি।’ বিক্রেতা ঘাবড়িয়ে বাক্স খুলতেই দেখা গেল যে বাক্স ভর্তি ২ টাকার স্ট্যাম্প। তাজউদ্দীন সাহেব তখন আমাকে বাদী করে বিক্রেতার বিরুদ্ধে কেইস করলেন। কিন্তু পরে জানতে পারি যে তৎকালীন পাট প্রতিমন্ত্রী মানিকগঞ্জের মােসলেহউদ্দীন সাহেবের হস্তক্ষেপে তার আত্মীয় বিক্রেতা রেহাই পেয়ে যায়।
(ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৪ এপ্রিল, ২০১০। ১লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ Polo India Club Restaurant, Dupont Cincle Washington DC, U.S.A)
মনে হয় ‘৭৩ সাল সেটি। কালিয়াকৈরে, তাজউদ্দীন সাহেব কৃষি ব্যাংকের শাখা উদ্বােধন করলেন। শামসুল হক সাহেবও সেখানে ছিলেন। উনি তখন প্রথম সারির একজন নেতা। যতদূর মনে পড়ে তিনি সমবায় মন্ত্রীও ছিলেন। শাখা উদ্বোধনের পর খবর এল যে কে বা কারা দুইজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করেছে। তাজউদ্দীন সাহেব তৎক্ষণাৎ আমাকে, প্রেস ইনফর্মেশন ডিপার্টমেন্টের একজন ফটোগ্রাফার ও কয়েকজন সাংবাদিকসহ ঢাকায় ফিরে আসার পথে নিহতদের দেখতে যান। গুলিবিদ্ধ লােক দুটি তখনাে গাছের সঙ্গেই বাঁধা। তাদের ফটোসহ হত্যাকাণ্ডের খবর মর্নিং নিউজে ছাপা হয়েছিল। শ্রমিক লীগের অন্তদ্বন্দ্বের কারণেই ওই দুটি নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন সাহেব রিজাইন করেন। ওইদিন দুপুরে, আমি কাজ থেকে বাসায় এসে বিশ্রাম করে প্রেসক্লাবের দিকে রওয়ানা হই। আমি শান্তিবাগ থেকে প্রেসক্লাবে যাওয়ার পথে তাজউদ্দীন সাহেবের পিয়নের সঙ্গে দেখা হয়। পিয়ন বলে যে আমার স্যার আজকে রিজাইন করেছেন। কথাটি শুনে আমি প্রেসক্লাবে না গিয়ে বিকেল চারটার দিকে, ওনার হেয়ার রােডের সরকারি বাসায় পেীছি। সেখানে যেয়ে দেখি তাজউদ্দীন সাহেব খুব ভালাে মুডে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। ওনার পাশে রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত, কালিয়াকৈরের শামসুল হক সাহেব, ড. কামাল হােসেন ও আরও ক’জন বসা। কিছুক্ষণ পর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও বাসস-এর এক সাংবাদিক আসলেন। মওদুদ আহমেদ হেসে বললেন তাজউদ্দীন সাহেব, চলেন আমরা একসঙ্গে ল ফার্মে ল প্র্যাকটিস করি। সেদিন তাজউদ্দীন সাহেবের খুশিভরা চেহারা দেখে মনে হয়নি যে উনি এতবড় পদ থেকে সদ্য রিজাইন করেছেন।
(১৪ এপ্রিল, ২০১০।ওয়াশিংটন ডিসি)
কুখ্যাত চারাচালানদার ম্যানসেরু মিয়া (কোড নাম] সম্পর্কে সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য তাজউদ্দীন সাহেব চিটাগাং এ যান। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে সঙ্গে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু আমি যেতে পারিনি, কারণ আমাকে গণপূর্তায়ন মন্ত্রী মতিউর রহমানের দুটি মিটিং কাভার করতে হয়েছিল। একই হেলিকপ্টারে তাজউদ্দীন সাহেব ও মতিউর রহমানসহ আমরা প্রথমে নােয়াখালীর রায়পুরায় যাই। আমাদেরকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব চিটাগাং-এ চলে যান।
(১৩ জুলাই, ২০১০)
—————
* কাস্টমসের সহকারী কালেক্টর আব্দুল লতিফ সিকদার তার নথিপত্র যুক্ত রিপাের্টে উল্লেখ করেন যে তাজউদ্দীন আহমদের সরেজমিনে পরিদর্শনের ফলে চোরাচালানীর বিরুদ্ধে কেসটা গুরুত্ব পায় এবং বিশেষ তদন্তের মাধ্যমে অসাধারণ কেসের প্রেক্ষিত তৈরি করে ও পরিণতি লাভ করে। ঐ কেসে নেপথ্য ব্যক্তিবর্গ জড়িত থাকার সত্য উদঘাটিত হয়। উল্লেখিত বিষয়ে ওনার বিস্তারিত বিবরণ হতে পৃ. ৪০-৪৩ সিমিন হােসেন রিমির লেখা ‘আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ’ গ্রন্থে (প্রতিভাস, ২০০১, ছয় পরিশিষ্ট) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ