শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১৬ই ডিসেম্বরে জাতির উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষণ |
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
যেন মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে
বাংলার অজেয় ভাইবোনেরা,
আচ্ছালামু আলায়কুম !
রক্তাক্ত একটা ইতিহাসের ক্রান্তিলগ্নে আমরা এসে পৌঁছেছি। বাঙালীর রক্তে গড়া লোহিত-সাগরের অতল তল থেকে একটা নতুন জাতি জন্ম নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। নাম তার বাংলাদেশ। শত সহস্র তরুণের বুকের রক্ত বাংলার শ্যামল মাটির বুকে অমিত ও অজেয় বিক্রমের আলপনা এঁকে দিয়েছে। এ রক্তিম আলপনার পাশাপাশি চলেছে অশ্রুভেজা কান্নার স্রোত। সারা বাংলা আজ অশ্রুসাগরে ভাসছে। কিন্তু সে অশ্রুই শেষ কথা নয়। অশ্রুসাগর পাড়ি দিয়ে এসেছে স্বাধীনতার সূর্য। পূত পবিত্র চিত্তে এ সূর্যকে বরণ করে নিতে হবে হাসিমুখে। আরা আর কাঁদব না।
আজকের কর্তব্য
স্বাধীনতার দুর্জয় সংগ্রামে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাঁরা বীরের মৃত্যু বরণ করেছেন। মরে তাঁরা অমর হয়েছেন। আমরা যারা বেঁচে আছি এবং যারা পৃথিবীর হলাহল পান করে মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি তাদের হয়তো দেয়ার মত আর বেশি কিছু নেই। আসন্ন আগামীর হাতে অনাগত ভবিষ্যতের দায় ও দায়িত্ব তুলে দেয়ার প্রতীক্ষায় সত্যনিষ্ঠ হইয়ে অপেক্ষা করাই আমার মতো মানুষের আজকের কর্তব্য।
স্বাধীনতার স্বর্ণফসল
আমাদের মুক্তি সংগ্রামের সুদীর্ঘ ন’টি মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। দুর্বিষহ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে বাংলার প্রতিটি মানুষ এ দিনগুলো কাটিয়েছেন। পরম করুণাময়ের অপার অনুগ্রহে অচিরেই সেসব নিগ্রহের দিনগুলো দূর হবে আমাদের এ বিশ্বাস আছে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ অভূতপূর্ব ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। সে স্বাধীনতাকে সুসংহত করার জন্যে চূড়ান্ত সংগ্রাম চলছে। এ সংগ্রাম সাফল্যমন্ডিত হবে সন্দেহাতীতভাবে এ ধারণা আমরা করতে পারি। কিন্তু যেদিন সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ হবে আর এক ধরনের সংগ্রাম। সে সংগ্রাম হবে সৃষ্টির সংগ্রাম। যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষতবিক্ষত একটা দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ওধর্মনিরপেক্ষতা- এ তিনটি বিঘোষিত জাতীয় মৌলনীতির উপর ভিত্তি করে দেশকে পুনগর্ঠন করতে হবে। দেশে একটা নতুন সমাজ কাঠামো ও মূল্যবোধের সৃষ্টি করতে হবে। যে জাতীয় ঐক্য ও সংগঠন আমাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের দিকে এগিয়ে দিয়েছে, সেই একই ঐক্য ও সংগঠন দিয়ে আমাদেরকে স্বাধীনতার স্বর্নফসল ফলাতে হবে এবং বাংলার ঘরে ঘরে সে ফসল পৌঁছে দিতে হবে।
পতাকার পরিবর্তন নয়
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগষ্ট আমরা একবার স্বাধীন হয়েছিলাম। কিন্তু সে স্বাধীনতা ছিল পতাকার পরিবর্তন। তাই অচিরেই সে স্বাধীনতা হতাশার বালুচরে হারিয়ে গেছে। শোষণের বেদীতে সে স্বাধীনতার অপমৃত্যু ঘটেছে। এই যে মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা সে অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের প্রমাণ করতে হবে, স্বাধীনতার মানে পতাকা পরিবর্তন নয়। রকের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে সে স্বাধীনতা সম্পূর্ণ ভিন্নতর প্রতিশ্রুতিবাহী। এ সত্যটাকে ব্যক্তি, সমষ্টি ও সামাজিক ও রাষ্ট্রিয় ব্যবস্থা এবং আচার-আচরণের মাধ্যমে সঠিকভাবে ব্যাপ্ত ও উপস্থাপিত করতে হবে।
বাংলাদেশের সংগ্রাম ভারত উপমহাদেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বের সব কটি দেশের দুয়ারে করাঘাত করেছে। মুক্তবুদ্ধি বিশ্ববিবেকগোষ্ঠী বাংলার রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের আহবানে সাড়া দিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধ, শান্তি ও সভ্যতার বিকাশে বিশ্বাসী সকল বিশ্ব নাগরিক আমাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। সমগ্র বিশ্বের সাংবাদিক সম্প্রদায়, বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্র ও জননেতাদের সাগ্রহ সমর্থনের কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পাকিস্থান ঘরোয়া বা আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চালিয়ে দিতে বা ছাই চাপা দিতে পারে নি।
গণতন্ত্র হত্যার চেষ্টা
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আজ আর কারও কাছেই অপরিচিত নয়। কিন্তু বাংলাকে আন্তর্জাতিক জগতে উপস্থাপিত করতে গিয়ে আমরা বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি যে অনেক দেশ আছে যেখানে জনমত ও গণবিবেক সে দেশের সরকারকে কার্যকরভাবে প্রভাবাম্বিত করতে পারে না। ভূমন্ডলীয় ট্র্যাটেজির স্বার্থে এসব দেশ স্থানীয় জনমতকে নিদারুণভাবে উপেক্ষা করেছে। ফলে সে ধরনের দেশের জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ কিন্তু সরকারগুলোর ব্যবহারে আমরা ক্ষুব্ধ ও দুঃখিত। গভীর ক্ষোভের সঙ্গে আমরা লক্ষ্য করেছি যে। যেসব দেশ গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থায় বিশ্বাসী এবং হরদম গণতন্ত্র ও মঙ্গলমানসী বিধিবিধানের কথা কপচাচ্ছেন তারাই পাকিস্তানী স্বৈরতন্ত্রের দোসর হিসেবে অনন্তর গণতন্ত্রকে হত্যার চেষ্টা করেছেন বাংলার মাটিতে।
ভিখারির হাত যদি—
দরিদ্র জাতি ও ক্ষুদ্রায়তন দেহের প্রতি অমর্যাদাকর ব্যবহার প্রদর্শন বা সে দেশের ছোট করে দেখার একটা প্রবণতা আমরা কোন কোন বৃহৎ শক্তির মধ্যে লক্ষ্য করেছি। ভিখিরির হাত যদি আমরা প্রসারিত না করি তাহলে দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে যে আমাদের অমর্যাদা করা যায় না, এ কথাটা স্পষ্টভাবে এদের বলে দেবার প্রয়োজন আছে বলে আমার বিশ্বাস। ক্ষমতার মোহে আর সম্পদের দস্তে মানুষের, বিশেষ, করে অনুন্নত অঞ্চলের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তিকে ছোট করে দেখাটা এদের বাতিকে পরিণত হয়েছে। ভিয়েতনাম রণাঙ্গনের অভিজ্ঞতা থেকেও যাদের এ বাতিকের অবসান হয়নি, আশা করি বাংলাদেশের উত্থানের দৃষ্টান্ত দিয়ে তারা তাদের চরিত্র শুধরে নেবেন।
মানুষের শক্তির কাছে–
বিশ্বের কোথাও যদি কোনদিন মানুষের মুক্তি সংগ্রাম বিজয়ী হইয়ে থাকে তবে বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামও বিজয়ী হবে। ইতিহাস এ শিক্ষা ও সিদ্ধান্তই ঘোষণা করেছে। বৃহৎ শক্তি, সাম্রাজ্যবাদ, নয়া সাম্রাজ্যবাদ ও শোধনবাদের অক্ট্রোপাশ ছিঁড়ে আমরা যখন বেরিয়ে এসেছি এখন বালির বাঁধ দিয়ে এ জোয়ারের গতিরোধ করা যাবে না। মুক্তিকামী মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে বৃহৎশক্তির তোয়াক্কা কোনদিন করেনি। আমরাও করি না। যে শক্তি মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হয় না সে শক্তি পাশব শক্তি। সে পাশব শক্তির বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করছি এবং করব। অতি শক্তিমান দু-এক্টা দেশ তাদের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তাদের মন ও মানসকিতা আজ দেউলিয়া হইয়ে পড়েছে। চিন্তাক্ষেত্রে যে ক্লীবত্ব তারা অর্জন করেছে তার পর এদের কাছ থেকে মুক্তিকামী মানুষের আশা করার কিছু নেই। মানুষের সংঘবদ্ধ শক্তির কাছে বল্বান ব্যক্তি বাঁ গোষ্ঠী চিরদিন হার স্বীকার করেছে।
ভোগের লিপ্সার অবসান–
নতুন জাতি হিসেবে যে গণশক্তির আমরা করেছি সে গণশক্তি দিয়ে আমরা আমাদের দেশকে গড়ে তুলব। ব্যক্তিসত্তাকে ভূলে গিয়ে গোটা জাতির জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। অসাধু প্রতিযোগিতা বা দলাদলির মাধ্যমে উচ্চাকাংক্ষার চরিতার্থ করার চিরন্তন অভ্যাস আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে। এ ধরনের আকাঙ্কার কাঙালরা অতীতে জাতির সর্বনাশ করেছে। কারণ অসাধু প্রতিযোগিতার দ্বারা তারা সৎ ও চরিত্রবান
ব্যক্তিদের কর্মপ্রেরণা ও প্রবুদ্ধিকে প্রতিহত করেছে। আমরা অবশ্যই আশা করব যে, আমরা দেশের তরুণের বুকের উষ্ণ রুধির-ধারা আকাঙ্ক্ষার কাঙালদের ভাসিয়ে নিয়ে গেছে অবলুপ্তির অতল গহবরে। সমগ্র জাতির জন্য আমরা একাত্ম হয়ে কাজ করব এবং জাতীয় সমৃদ্ধির বন্টননামায় আমাদের যা বরাদ্দ থাকবে তাই আমরা ভোগ করব ভোগের লিপ্সার হোক অবসান। ত্যাগের দীপ্তিতে হোক দীপ্তিমান বাংলাদেশের রক্তাক্ত বসুমতি।
ঋণ অপরিশোধ্য
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। বাংলার বাংলার সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষ আবেগ –আপ্লুত ও বিনয়াবনত চিত্তে ভারতের এ স্বীকৃতি গ্রহন করেছে। ভারত শুধুমাত্র আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রই নয়, এ ভারত অনন্যসুন্দর ও সমৃদ্ধিশালী একটি ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী। ভারত একটা শুধু ভূখন্ডই নয়, এটা বিবর্তনশীল মানব সভ্যতার অর্নিবাণ শিখাসম্পন্ন একটা পিলসুজও বটে। আয়তনের বিরাটত্ব, চিন্তার ব্যাপ্তি, আদর্শের দ্যুতি এবং বৈচিত্রের ঐক্যের সমাহার ভারত মুদু একটা দেশ নয়, এটা একটা উপমহাদেশ। বাংলাদেশের নির্যাতিত মানবতার পাশে ভারত যে অনাবিল বলিষ্ঠতা মানুষের জন্যে হৃদয়-নিংড়ানো প্রেম প্রীতি ভালবাসা দিয়ে ভারতবাসীদের ত্যাগ-তিতিক্ষার মর্যাদা দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবে না এ বিশ্বাস আমার আছে। মহান ভাতের সৎ প্রতিবেশী হিসেবে আমাদের উভয় রাষ্ট্রের সরকারও জনগণের মধ্যকার বন্দুত্ব দিন দিন গাঢ়তর হবে বলে আমাদের স্থিরপ্রত্যয় আছে। ভারতে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তার গতিশীল ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের দ্বারা ভারতের জীবন দর্শনকে বিশ্বদরবারে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ বলেও আমরা মনে করি।
আর এক বন্ধু
ভারতের পাশাপাশি আমাদের আর এক প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটান আমাদের সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভুটানের মহারাজা জিগমে দরজি ওয়াংচোক ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রতি যে দরদ প্রদর্শন করেছেন সে সম্পর্কে আমরা ওয়াকিফ রয়েছি। বাংলার মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর সহৃদয় সমর্থনের কথাও আমাদের অজ্ঞাত নয়। মহারাজা, তাঁর সরকার ও তাঁর জনগণের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্তুতে আমরা ব্রতী হব এ আশ্বাস আমরা তাদের দিতে পারি।
রুশ সরকার ও জনগণের প্রতি
বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে সোভিয়েট রাশিয়া আগাগোড়া যে গণমুখী ভূমিকা পালন করেছে সে ভূমিকা শুধু বাংলাদেশের নয়, মুক্তিকামী সকল মানুষের প্রশংসা অর্জন করেছে। রুশ সরকার আমাদের সমস্যা ও সংগ্রামের প্রতি যে গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন সেজন্য আমরা তাঁদের কাছে অভ্যস্ত কৃতজ্ঞ। আমরা আশা করি যে, রুশ সরকার ও জনগণ আমাদের রক্তাক্ত সংগ্রামকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন এবং তাঁর ফলশ্রুতি হিসেবে তারা আমাদের সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিও দেবেন।
স্কেন্ডিনেভীয় ও পোলান্ডসহ পূর্ব ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ আমাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রদর্শন করেছেন। আমাদের সমস্যা, সংকট ও সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁরা ও শ্রদ্ধাশীল। আমরা তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা আশা করি, যে। মুক্তিকামী মানুষের সফল সংগ্রামের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে তাঁরাও এগিয়ে আসবেন।
বৃটেন ও ফরাসী ভূমিকিয়া
বৃটেন ও ফরাসী সরকার সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ প্রশ্নে একটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। আমরা আশা করব যে, নিরপেক্ষতা এটা অর্থহীন কুটনৈতিক অনুশীলন নয়। বৃটেন ও বাংলাদেশের মধ্যকার
সম্পর্ক সুপ্রাচীন। আমরা মনে করি, বাঙালী মানসিকতা ও বাংলার ধ্যানধারনার সঙ্গে বৃটেনবাসীর সম্যক পরিচয় আছে। বৃটিশ ভারতে শাসনবর্হিভূত অঞ্চলশ গঠিত পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধবাজ গণতন্ত্রের দুশমনদের মানসকিতাও তাঁদের কাছে পরিচিত। তাই বৃটেন সরকারের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া দুরূহ নয় বলেই মনে করি।
ফরাসী দেশ সভ্যতার প্রথম গণবিপ্লবের উত্তরাধিকারী। গণসংগ্রামকে উপলব্ধি ও অনুভব করার ব্যাপারে তাঁদের একটা সুপ্রাচীন ঐতিহ্য আছে। ফরাসী বিপ্লবের উত্তরসুরী বাংলাদেশের বিপ্লবকে স্বীকৃতি জানিয়ে ফরাসী সরকার ও জনগণ তাঁদের গণমুখী ভূমিকা অব্যাহত রাখবেন বলে আশা করা অযৌক্তিক নয়।
পাষাতের রক্ষাকবচ
গণতন্ত্রের পুরোধা বলে প্রচারিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর জনগণতান্ত্রিক বিপল্বের পথিকৃৎ বলে পরিচিত চীন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের কামনা-বাসনার প্রশ্নে যে সম্পূরক নীতি গ্রহণ করেছেন সে নীতির নিন্দা না করে পারা যায় না। জাতিসংঘের ভেতরে ও বাইরে ওয়াশিংটন-পিকিং আঁতাত যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তাতে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী প্রত্যেকটা মানুষ স্তম্ভিত হয়েছে। আত্নস্বার্থ ভূমন্ডলীয় যুদ্ধনীতির খাতিরে এ দুটি পরস্পরবিরোধী শক্তির যে মিতালী হয়েছে। সে মিতালী মানুষের জন কল্যাণে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি না। সুবৃহৎ দুটি শক্তির এই ধরনের মিত্রতা বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর জন্য বড় রকমের একটা সর্বনাশ ডেকে আনার আশংকা রয়েছে বললে আত্যুক্তি করা হবে না। মার্কিন প্রশাসনের হাতে গণতন্ত্রের অপমৃত্যু আর মহান চীনে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বরূপের যৌথ অভিব্যক্তি ইয়াহিয়ার মত একটা পাষন্ডের রক্ষাকবচ হইয়ে দাঁড়িয়েছে- এর চাইতে দুঃখের ও ক্ষোভের বিষয় আর কি হতে পারে।
পররাষ্ট্রনীতির রুপরেখা
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম জোতনিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি। আমাদের মত ক্ষুদ্রায়ত্ন এবং উন্নয়য়নকামী দেশকে ভূমন্ডলীয় শক্তি – সংঘাতে জিড়য়ে পড়া থেকে অবশ্যউ বিরত থাকতে হবে। আমরা সর্বপ্রকারের সামরিক জোট বা আঁতাতের বিরুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সকল মানুষের প্রতি আমদের সমর্থন থাকবে। কারও প্রতি আমাদের বিদ্ধেষ নেই। সবার জন্যে আমাদের বন্ধুত্বের দুয়ার উন্মুক্ত।
নিষ্ঠুর গ্রহসন দুঃসহ
আওয়ামী লীগ দলের পক্ষ থেকে দলের নেতা এবং স্বাধিন বাংলার জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর নির্বাচনপূর্ব বেতার ও টেলিভিশন ভাষণে ১৯৭০ সালের ২৮ শে নভেম্বর এ পররাষ্ট্রনীতির রুপরেখা জাতির সামনে পেশ করেছিলেন। স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বাংলার আদরের দলাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ইয়াহিয়াচক্রের কারাগারে আবদ্ধ। কি নিদারুণ পারইপার্শ্বিকতায় না বংলার নয়নমণি দুঃসহ দিনগুলো কাটাচ্ছেন। আজ স্বাধীনতার নবীন ঊষাকে তাঁর অনুপস্থিতি শুধুমাত্র ম্লানই করে দেয়নি, তাঁকে ছাড়া স্বাধীনতা আমাদের কাছে নিতান্তই অপূর্ণাঙ্গ, অসম্পূর্ণ। বাংলার পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে, শহর-বন্দরে বঙ্গবন্ধুর অমোঘ বাণী বাঙময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি থেকেও আমদের মধ্যে নেই। এ মর্ম-যাতনা দুঃসহ এ নিষ্ঠুর প্রহসন আমরা স্বীকার করে নিতে পারি না।
বিশ্ব দরবারে যেসব কুটিল কূটনীতিক নিরন্তর রাজনীতির দাবার ঘুঁটি চালছেন তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলছি। শেখ মুজিবুর রহমানের মত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষকে দানবের গ্রাস থেকে উদ্ধার করে আনার দায়িত্ব বিশ্ববিবেকের। লুমুম্বা হত্যার কুৎসিৎ বিয়োগান্তক ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেজন্যে তৎপর হওয়া মানবিক মর্যাদাবোধের সকল বিশ্বাসী নাগরিকদের অবশ্য কর্তব্য। বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘের কাছে আমাদের জোর
দাবী এই যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি করে তাঁর স্বপ্নরাজ্য বাংলাদেশে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করা হোক।
আজকের বিজয়লগ্নে আমি আমাদের মুক্তিবাহিনীর অফিসার ও জোয়ানদের অভিনন্দর জানিচ্ছি। বাংলার ঘরে ঘরে অযুত-লক্ষ যেসব তরুণ স্বাধীনতার পতাককে সমুন্নত রেখেছে তাদের কর্তব্যনিষ্ঠা প্রশংসার্হ। আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেসব ভারতীয় সেনাধ্যক্ষ ও জোয়ান সংগ্রাম করেছেন তাঁদের কাছে আমরা অন্তরের অন্তস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
বাংলার ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, শ্রমজীবি আর শিল্পি-সাংবাদিক অকুতোভয় আদর্শনিষ্ঠা গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্যে যে অক্লান্ত প্রিশ্রম করছেন তা অভুতপূর্ব ও স্মরনীয়। দেশে যেসব সরকারী কর্মচারী ও বিদেশে যেসব কুটনীতিক বাংলার সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে সংরামী ঐক্য ঘোষনা করেছিলেন তাঁদের সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি।
যেন মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে
বাংলা আজ জয়ী। বিজয়ের যেমন আছে, তেমনী আছে তার দায়িত্ব। নিরহঙ্কার চিত্তে বিজয়কে আমাদের বরণ করে নিতে হবে। বিজয়ের অহঙ্কার যে আমাদের মনুষ্যত্বকে গ্রাস না করে। আমরা যে অতীত পাপ-পঙ্কিলতার আবেষ্টনী থেকে নতুন সূর্যের কিরোনে অবগাহণ করে সত্যিকারের মানুষ হতে পরি এ কামনাই করি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় আমরা শুধু মাত্র আমাদের নয় বিশ্বপাপের মার্জনা চাইব। কবিকণ্ঠের বাণী উদ্বৃত করে আমরা বলব “হে করুণাময় তুমি বিশ্বপাপ মার্জনা কর।“
-জয় বাংলা