১৯৭১ এর জুলাই আগষ্ট মাসের দিকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী অধিক সামরিক শক্তি সরঞ্জাম নিয়ে সারিয়াকান্দিতে তাদের ঘাঁটি ফেলে। হানাদার বাহিনী বাঁধে যাওয়ার পথে বেণীপুর চরের তমিজউদ্দিন প্রামাণিকের ভগ্নিপতিকে সাপাড়ার রাস্তায় ধরে এবং রাইফেল দ্বারা আঘাত করে হত্যা করে। তারা প্রত্যেক দিন সকালে দল বেঁধে বিভিন্ন গ্রামে রুটিন মোতাবেক হামলা করত। নারী নির্যাতন, হত্যা, মারধোর ও লুন্ঠন করে মূল্যবান জিনিসপত্রাদি নিয়ে বিকালে তাদের ঘাঁটিতে ফিরত। এমনি একদিন গণকপাড়ায় যেয়ে তারা মুক্তি বাহিনীর হাতে আটকা পড়ে। সারাদিন সারারাত দু’দলের মধ্যে যুদ্ধ হয় কিন্তু মুক্তি বাহিনীর গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানী বাহিনী রক্ষা পায়।
অতর্কিতে হানা দিয়া পাক বাহিনী দেলুয়াবাড়ী গ্রাম হতে মুক্তিযোদ্ধা নজির হোসেন, সাহায্যকারী কোরবান আলী, মন্তেজার রহমান ও বাবু খাঁকে আটক করে। বাঁধের নিকট নিয়ে হাত পাঁ বেঁধে নজির হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে এবং অপর তিনজনকে নিয়ে ঘাঁটিতে আসে। অতি কষ্টে পরে তারা মুক্তি পায়। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পর প্রায় সপ্তাহখানেক তাদের দু’জনকেই অজ্ঞান অবস্থায় দেখা গেছে। বাঙ্গালীর পশ্চিম পাড়, রামচন্দ্রপুর গ্রামে অপারেশন চালাতে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর গুলিতে ছোট দারোগা নিহত হয় এবং সামরিক বাহিনীর একজন গুরুতররূপে আহত হয়।
মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা রীতিমতো বেড়ে যায়। হানাদার বাহিনী বাইরে যাওয়া কম করে ফেলে। তাদের অত্যাচারে পলাতক বাড়িওয়ালাদের খাসী, মোরগ কুড়াতে থাকে। একদল হানাদার বাহিনী বগুড়া থেকে আসার পথে ফুলবাড়ী খেয়াঘাটে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। খেউনিরুপী মুক্তিযোদ্ধা খেয়ার নৌকা নদীর মধ্যে আসলে গুলি ছুড়তে থাকে। ঘটনাস্থলেই তিনজন কনষ্টেবল প্রাণ হারায়। তারপর শুরু হয় স্থানীয় দোকানপাঠ লুন্ঠন। তবিবর মণ্ডলের দোকানের সম্মুখে ট্রাক রেখে মালপত্র বোঝাই করে সেগুলো রংপুরের গাইবান্ধায় পাচার করে। হাবিবুর প্রামাণিকের দোকান লুট করে এবং তাকে পর পর দুই দিন দোকানের মধ্যেই বেদম প্রহার করে। নৌকাতে পাঠ উঠানোর অভিযোগে দৌলতুজ্জামান তরফদার সাহেবকে ভীষণ মারধোর করে। তখন মুক্তি বাহিনীর আর সহ্য হয় না। এদিকে সোজাসুজিও তারা মিলিটারীদের ঘাঁটিতে হানা দিতে পারে না। কারন পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্পে হানা দিলে আশেপাশের গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় এবং লোকজন মেরে সাফ করে ফেলে। তবুও সময় ঠিক করে একদিন মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা আরো বৃদ্ধি পায়। পাকিস্তানী বাহিনীর এই খবর বগুড়ায় তাদের ঘাঁটিতে পৌঁছিয়ে দেয়ার পর সামরিক বাহিনীর লোককে সারিয়াকান্দি পাঠিয়ে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। সারিয়াকান্দি বাজারের সমস্ত বাড়ী ও দোকানপাট তল্লাশী চালিয়ে মালেক মণ্ডলের দোকান হতে বাংলাদেশের পতাকা উদ্ধার করে। ফলে তার দোকানের সমস্ত মালপত্র থানাতে উঠাবার আদেশ দেয়। তারপর মন্তেজা রহমান মণ্ডলকে পাকিস্তানী পতাকা না উঠাবার অভিযোগে আটক করে তাদের সামরিক গাড়িতে উঠায়ে নেয়। মফিজ মাষ্টার সাহেবের বাড়ীতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তার বাড়ীতে পাহারারত কামলা খটটুর বাবাকে আটক করে এবং গাড়ীতে তুলে নেয়। জামাল ডাক্তারের শ্বশুর ময়েজ ডাক্তার, জামাল ডাক্তার, মালেক মণ্ডলের ছেলে এবং অন্যান্য বেশ কিছু লোককে হানাদার বাহিনীর জোয়ানরা আটক করে। সামরিক বাহিনীর উক্ত দলের নেতৃত্ব দিচ্ছিল লেফটেন্যান্ট আতিক। মালেক মণ্ডলের ছেলেকে থানায় তার বুকে পায়ের শক্ত জুতার দ্বারা বার কয়েক আঘাত করে। ফলে সে অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং তার মুখ হতে রক্ত বের হতে থাকে। সকলকে নিয়ে বাউলে আটা ঘাঁটিতে চলে যায় এবং রাতে তাদের প্রতি অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। তাদের ঘাঁটিতে রেখে জামাল ডাক্তারের বাসায় পুনরায় আসে এবং তার স্ত্রীকে খোঁজাখুঁজি করতে থাকে। তার স্ত্রীকে না পেয়ে তার শ্বাশুড়ীকে ধরে মোটরে উঠায় ও তার মেয়েকে বের করে দেয়ার জন্য ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে। রাত্রিতে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতে থানা আক্রমণ করে। তখন সারিয়াকান্দি থানায় মিলিটারী ছিল। থানা আক্রমনের পরপরই ভীষণ বৃষ্টি আরম্ভ হয়। দুই পক্ষের ভীষণ গোলাগুলি হয় কিন্তু বৃষ্টির বেগ আরো প্রবল হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। তারপর প্রায়ই খবর পাওয়া যেতে লাগল আজ এ দালাল খতম, কাল ও দালাল খতম। পাকিস্তানী বাহিনী তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে লাগল। ইতিমধ্যে থানায় পশ্চিম ও,সি কে পাঠানো হয়েছে। তার চেষ্টায় প্রায় ৭০/৮০ জন রাজাকার সংগ্রহ করা হয়েছে। এলো পশ্চিমা পুলিশ। এদের বাবা-মা মানুষ কিনা আমার জানা নেই। তবে এরা আকৃতিতে মানুষ হলেও আসলে ছিল কুকুর। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় তাদের যাতায়াত বন্ধ করে দেয়া হল। রাজাকাররূপী একজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেকে তারা টের পেয়ে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে এবং হাত-পা কেটে নদীতে ফেলে দেয়। সারিয়াকান্দি এক্সচেঞ্জ হতে পাকবাহিনীর সংখ্যা এবং তাদের গোলা বারুদের খবর জেনে ভোর পাঁচটায় সারিয়াকান্দি আক্রমণ করা হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ উক্ত যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর দুইজন যুবক প্রথমেই নিহত হওয়ায় তারা ফিরে যেতে বাধ্য হন। বগুড়া ও গাবতলী থেকে হানাদার বাহিনীদের ডাক আসে এবং তাদেরকে থানা ছেড়ে অতিসত্বর বগুড়া চলে যাবার নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু ইতিমধ্যেই মুক্তিবাহিনী কতৃক রাস্তা বন্ধ হওয়ায় তারা চলে যাবার কোন পথ পেল না।
১৯৭১ সালের ২৬ শে নভেম্বর সকাল ঠিক এগারটায় মুক্তিযোদ্ধারা সম্মিলিতভাবে সারিয়াকান্দি থানাতে অবস্থানরত হানাদার বাহিনীদেরকে আক্রমণ করে। বিকাল তিনটার সময় এক্সচেঞ্জে অবস্থানরত বাহিনীদের পতন ঘটে। সারাদিন এবং সারারাত যুদ্ধের পর ২৭ শে নভেম্বর সকালে হানাদার বাহিনীসহ থানার পতন ঘটে। শতাধিক রাজাকার ও পুলিশ মুক্তিবাহিনীর দ্বারা আটক হয়। আটককৃত পুলিশদেরকে ভারতে বিচারের জন্য পাঠিয়ে দেয়া হয়। রাজাকারদের বিচার করা হয় যমুনা নদীর পাড়ে। বিচারে কিছু রাজাকার রক্ষা পায় এবং অবশিষ্ট গুলো যমুনা নদীতে তাদের সলিল সমাধি লাভ করে। থানার পতনের পর শুরু হয় উড়োজাহাজ থেকে বোমা বিস্ফোরণ ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ । উক্ত এমনি গুলিতে নিহত হয় পাকুড়িয়া গ্রামের পুকরা মণ্ডলের ছেলে দুদু মণ্ডল। সে মুক্তিবাহিনীদেরকে নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল এবং মেশিনগানের গুলিতে নৌকা থেকে নদীতে পড়ে যায়। বর্বর পাক বাহিনীর রাইফেলের গুলিতে নিহত হয় উক্ত গ্রামের জাফর সরদারের ছেলে জহির উদ্দিন। মেশিনগানের আর একটি গুলিতে সারিয়াকান্দির আছমতের মা নিহত হয়।
দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় সারিয়াকান্দি থানা পতনের পূর্ব রাত্রিতে পাকিস্তানী বাহিনীর অধিকাংশ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় এবং তার কিছু অংশ রাস্তায় মারা পড়ে। বাকীগুলো সমন্ধে কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। ফলে অত্র থানার অনেক অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে আসে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ জালাল উদ্দিন
সারিয়াকান্দি
জেলা- বগুড়া
২২/০৯/৭৩