তোম লোগ কাফের হ্যায়, নামাজ কিউ পড়তা হ্যায়?
১৯৭১ সালের ১৩ই এপ্রিল পাক সৈন্যরা ৬০/৭০ খানা গাড়িযোগে সারদা আসে। এবং অবশেষে সারদার পতন ঘটে। তারা এসেছে এ খবরে এবং তাদের দেখে সারদা এলাকার লোকজন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রাণের ভয়ে আত্মরক্ষার্থে চরে আশ্রয় নেয়। পাক সৈন্যরা পিটিসিতে ঢুকে আগ্নেয়াস্ত্র দখল করে এবং বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। তারা চরে আশ্রয় নেয়া লোকদের ধরে একত্রিত করে। তাদের সংখ্যা ছিল অন্যূন ১০০০/১৫০০। এদের মধ্যে আনসার, পুলিস, সাধারণ মানুষ ছিল। একত্রিত লোকগুলিকে জমা করা হলে তারা সারি করে সকলকে গুলি করে হত্যা করে।
এক একটা দলকে ধরে এনে তারা গুলি করে হত্যা করে। ইতিমধ্যে আর একটি দল জমা হয়। তাদেরকে দিয়ে মৃত লাশগুলি জমা করে। অতঃপর তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে। অপর ধৃত লোকগুলি দিয়ে তাদের লাশ জমা করে। শেষাবধি মৃত দেহগুলিকে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
আড়াইটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত তারা এই কাজ করে। অতঃপর তারা সন্ধ্যার মধ্যেই এলাকা ত্যাগ করে চলে যায়। এসময় তারা বিরামহীনভাবে বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ করতে থাকে।
এ সময় আমি আর সকলের সাথে চরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু ব্যাপার বেগতিক দেখে চর থেকে পালিয়ে গ্রামের মধ্যে ঢুকি এবং নিজেকে মুক্ত রেখে পাক সৈন্যদের কার্যকলাপ দেখছিলাম।
সন্ধ্যার মধ্যেই এখানে থাকা নিরাপদ নয় ভেবে ছেলে-মেয়েসহ অন্য গ্রামে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেই। পরদিন অত্র থানার নন্দনগাছি নিমপাড়া ইউনিয়নে আশ্রয় নেয়। কয়েকদিন সেখানে থাকার পর বুঝতে পারলাম যে সেখানে থাকা নিরাপদ নয়। পাক মেজর এবং শান্তি কমিটির লোকেরা আমাকে খুঁজছে। তাই সেখান থেকে জামনগর গ্রামে যাই। সেখানে থাকা অবস্থায় নন্দনগাছির কতিপয় লোক খবর দেয় যে চেয়ারম্যান আমাকে ডেকেছে, আমার কোন ভয় নেই। তাদের কথামতো নন্দনগাছি পৌছালে তারা আমাকে বন্দী করে এবং পরদিন সকালে জয়েন সরকারের বাড়িতে বন্দী অবস্থায় হাজির করে। সেদিন ছিল ২৯শে মে। সেখানে পৌছার কয়েক মিনিটের মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট থেকে হাবিলদার মেজরসহ কতিপয় সামরিক লোক গিয়ে আমাকে বন্দী অবস্থায় ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে আসে। নিয়ে যাবার সময় পিছনে হাত এবং ন্যাকড়া দিয়ে চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। সেখানে মেজর শফি আহমেদের কুঠিতে বন্দী করে রেখে দেয়।
বিকেলে মেজর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা শুরু করে। সে জিজ্ঞেস করেছিল যে তুমি গোপালপুরে কতোজন মিলিটারী মেরেছো এবং কতো রাইফেল নিয়ে গিয়েছিলে? উত্তরে তারা সন্তুষ্ট হতে না পেরে আমার উপর শারীরিক অত্যাচার শুরু করে। বুটের লাথি, চড়, কিল, ঘুষি মারছিল। এ অবস্থায় অত্যাচার করার পর চোখ আবার বাঁধা হয়। হাত তো আগে থেকেই বাঁধা ছিল। এ অবস্থায় গেস্ট হাউসের উপর তলায় রাখে।
রাত আটটার দিকে আবার নতুন করে হাত কষে বাঁধে। পায়ের গিটে বেঁধে হাঁটুর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে ঘাড় এবং হাঁটু পেঁচিয়ে শক্ত করে বাঁধে। অতঃপর ঐ অবস্থায় আমাকে হৃদয়হীনভাবে প্রহার শুরু করে। হাত, লাঠি, রুলার দ্বারা প্রহার করতে থাকে। রাইফেলের বাঁট দিয়ে গর্দানে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রহার করে। এই প্রক্রিয়ায় পালাক্রমে সারারাত ধরে অত্যাচার করে। শেষ রাতের দিকে সেই পশুরা যখন অণ্ডকোষ ও মলদ্বারে লাঠি মারে সে সময় আমি চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
সকাল ৭/৮ টার দিকে যখন আমার জ্ঞান ফিরে তখন আমি ঐ বসা অবস্থায় কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে পড়ে থাকতে দেখতে পাই। এবং ঐ অবস্থায় অভুক্তভাবে সারাদিন ঐখানেই পড়ে থাকি।
বিকেল বেলা আমার হাত এবং পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থাতেই গাড়িতে তুলে নিয়ে মেজর আমাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউসে নিয়ে যায়।
সন্ধ্যার পর চোখ ও হাত পা খোলা অবস্থায় কর্নেল রেজভীর সামনে আবার পূর্বোক্ত প্রশ্নগুলি জিজ্ঞাসা করতে থাকে। আমি সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করি।
রাত ১১ টার দিকে আমাকে একটি ঘরে বন্দী করে। সেখানে আমি ১০/১২ জন লোককে বন্দী অবস্থায় দেখতে পাই।
পরদিন সকালে কয়েকজন সেপাই আমাকে দেখে প্রহার শুরু করে। পালাক্রমে তারা এই কাজ করে। তাদের রীতি ছিল যে ঐ ঘরে কোনো লোক গেলে তারা বলতো “তোম কাহাসে আয়া, কব আয়া?” আর তার সাথে প্রহার করতো। দুপুরের দিকে ২টা রুটি এবং কিছু তরকারি দেয়। পায়খানা প্রসাব অথবা গোসলাদির কোন ব্যবস্থা ছিল না।
সেখানে তের দিন বন্দী অবস্থায় ছিলাম। এবং সে সময় আমি লক্ষ্য করেছি যে সারাদিন ধরে লোক জমা হতো এবং রাতে অস্ত্রশস্ত্র সহকারে একজন হাবিলদার এবং তিনজন সেপাই আসতো। তাদের সাথে মোটা দড়ি থাকতো। কাগজে নাম লিখা থাকতো। নাম ধরে ডাকতো এবং বলতো “তোম খাড়া হো যাও।” খাড়া হয়ে গেলে পিছনে ঐ দড়ি দিয়ে কষে হাত বাধতো এবং টেনে মাঠের মধ্যে ১০০/১৫০ গজ দূরে নিয়ে যেত। তারপর শোনা যেত গুলির আওয়াজ। যতগুলি লোক ধরে নিয়ে যেত ঠিক ততটি গুলি করতো। প্রত্যেক রাতে ৭/৮/৯/১০টা করে লোক এমনি করে হত্যা করেছে। এ সময় প্রত্যেক দিন আমার উপর অমানুষিক অত্যাচার করেছে।
১৩ দিন পর বিকেলে নাকে লোহার পাত দিয়ে পিছনে হাত বেঁধে (ডাবল হ্যান্ডকাফ দিয়ে) জাহাঙ্গীর পরিবহনে (রাজশাহীর একটি বাসের নাম যা এখনো আছে) করে নাটোর এম, পি, এইচ, কিউ ফুল বাগানে পাঠায়। বাসের দরজা জানালা বন্ধ অবস্থায় ছয়জনের গার্ডে নাটোর পৌঁছায়। সেখানে প্রায় আধ ঘন্টা ছিলাম। সে সময়ই এমপিরা (MP = Military Police) পালাক্রমে প্রহার করে এবং অকথ্য ও অশ্লীল ভাষায় গালি গালাজ করে। তারপর নাটোর জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়।
জেলখানায় হাত খোলা অবস্থায় হাজত ঘরে বন্দী করে রাখে। সেখানে আরও ৫০/৬০ জন লোক ছিল। ৫/৭ দিন আমি সেখানে ছিলাম। সেখানে একজন এফআইটি প্রত্যহ আসত এবং পালাক্রমে সকলের জবানবন্দী নিত। জবানবন্দী নেবার আগে এক পশলা প্রহার করে নিতো। সকাল, বিকাল ও দুপুরে এই কাজ করতো। জবানবন্দী হয়ে গেলে ঐ সময় আমাকে জেল ঘরে পাঠায়। সেখানে আমরা ৬২ জনের মত লোক ছিলাম।
জেলখানায় থাকার সময় আমাকে একদিন বের করে মেঝের উপর হাঁটুর মধ্যে দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে কান ধরে রাখতে বলে এবং ঐ অবস্থায় ৫০/৬০টি বেত মারে। আমি পড়ে গেলে আমাকে আবার তুলে উপুড় করে শুইয়ে দেয়। এছাড়া কখনো হাত-পা ফাঁক করে দাঁড় করিয়ে রাখতো। কখনো বা টান উপর করে বুকডন দেওয়ার প্রক্রিয়ায় ঘন্টা খানেক করে রাখতো। তাছাড়াও উপুড় করে শুইয়ে রেখে দুজন সিপাই একই সঙ্গে পিঠের উপর খুচত। বেত পিটানো তো নিয়মিতই হচ্ছিল। প্রত্যেক দিন বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ১৬২ জন ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, মাস্টারসহ বিভিন্ন ধরণের লোককে অত্যাচার করতো। মাঝে মধ্যে ২০/২৫ জন লোককে ধরে ফুল বাগানে নিয়ে গিয়ে পাথর বালি বইয়ে নিত।
এ সময় নামাজ পড়তে চাইলে তারা বলত “তোম লোগ কাফের হ্যায়, নামাজ কিউ পড়তা হ্যায়?” তাছাড়া নামাজ পড়তে দেখলে তারা দাঁত বের করে হাসতো।
পরবর্তীকালে এফ,আই,ও রা আবার নাটোর রিক্রিয়েশন ক্লাবে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতো। সে সময় এক ধরনের কালো রাবারের পাইপ দিয়ে প্রহার করতো। ৫ই সেপ্টেম্বরের সপ্তাহখানেক আগে সামরিক আইনের ১৮ ধারা মতে (সামরিক বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা) চার্জশীট দাখিল করে। বিচার শুরু হবার আগেই ইয়াহিয়ার সাধারণ ক্ষমায় আমি ছাড়া পাই।
স্বাক্ষর/-
মোঃ আব্দুর রাজ্জাক
আনছার কমান্ডার
গ্রাম- গৌরশহরপুর
থানা- চরঘাট, রাজশাহী