You dont have javascript enabled! Please enable it! 1961 | বঙ্গবন্ধু ১৯৬১ সালে স্বাধীনতার জন্য দিল্লীর সাহায্য চান। নেহেরুর অস্বীকৃতি। গােলাম মােরশেদের পদত্যাগপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট পাঠানাে
মাে: গােলাম মােরশেদের পদত্যাগপত্র
শ্রদ্ধেয় নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা,
২৫/৬/৭৩
আমার সশ্রদ্ধ সালাম নেবেন। ১৯৪৫ এর শেষে রশীদ আলী দিবসে গােরা সৈন্যের গাড়িতে আগুন লাগানাে থেকে শুরু করে এই সুদীর্ঘকাল দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা রাজনীতির উদ্দেশ্য বলে মনে করেছি। দোয়া করবেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত যেন এই শিক্ষা থেকে বিচ্যুত না হই। ১৯৬১ তে আপনার নির্দেশে আমি তৈরি ছিলাম। স্ত্রী ও সন্তানদের শাশুড়ির হেফাজতে রেখে আমি অপেক্ষা করছিলাম কখন ডাক আসবে। জানি না মহম্মদ আলী কীভাবে সংবাদ আদান প্রদান করেছিল, পরে জানতে পারলাম। আমি নাকি তৈরি ছিলাম না। বুক আমার ভেঙে গেল। রাজনীতির আবাল্য জড়িত ক্ষেত্র পরিত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসলাম হয়তাে ইচ্ছা করলে ২/১ বার এম.এন.এ হতে পারতাম। কিন্তু যে আঘাত তাতে সব উৎসাহ নষ্ট হয়ে গেল। নিজেকে নির্বাসিত করে ঢাকায় চলে আসলাম। আগরতলা মামলার সময়ই আবার নিয়তি আমাকে সামনের দিকে ঠেলে দিল।
১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ রাত্রে অন্তর থেকে বুঝলাম পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা আমাকে ১৯৬১ তে প্রযুক্ত মিথ্যা স্বলনের সুযােগ আমাকে দিয়েছেন তাই আপনার নির্দেশ না মেনে আপনার পাশে থাকবার সৌভাগ্য অর্জন করলাম। এই স্বল্পকালের মধ্যে আপনার স্নেহ ও ভালােবাসা আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকবে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ। আমি আশা করি এবং পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার নিকট প্রার্থনা করি যে, বাংলার প্রধানমন্ত্রী, জাতির পিতা বঙ্গ বন্ধুর সহকর্মী, উপদেষ্টা এবং কর্মচারীরা সকলেই সৎ, সত্যবাদী, দৃঢ় চরিত্র এবং নির্ভীক হন এবং তার নির্দেশ এবং ইচ্ছা ও ধারণাকে বাস্তবে পরিণত করবে প্রধানমন্ত্রীর সহায়ক হিসাবে গত পনরাে মাসে তার উপরােক্ত কর্মী ও কর্মচারীদের মধ্যে ঐ সমস্ত গুণরাজির বিপরীত অনেক সময় লক্ষ্য করেছি। আশা করেছিলাম স্বভাবের পরিবর্তন হবে এবং নেতার সম্মান ও সুনাম দেশে ও বিদেশে উদ্ভাসিত হতে থাকবে কিন্তু গভীর পরিতাপের বিষয় তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতার সম্মান সম্পর্কে একেবারেই উদাসীন।
পরিশেষে আমার তিনটা নিবেদন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহায়কের পদত্যাগ করিতেছি এবং আমার এই প্রার্থনা মঞ্জুর করিবার আবেদন জানাইতেছি।
১. সকল সরকারি দফতর থেকে আর্দালি ও বেয়ারা প্রত্যাহার করে সামন্ততান্ত্রিক নিয়মের অবসানে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হােক।
২.জাতির এই দুর্দিনে সকল অসৎ, দুর্বল চরিত্র ব্যক্তিদের প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে অপসারিত করা হােক।
৩. মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১৯৭২ সালের ২৪শে মে প্রদত্ত ১১৪ নির্দেশ কার্যকরী করিবার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে জাতির সময় ও শ্রমের অপচয় বন্ধ করা হােক। আপনার নির্দেশে যে কোনাে সময় যে কোন কাজ করবার জন্য সর্বদা আমি প্রস্তুত আছি।
আপনার বিশ্বস্ত ও অনুগত
( মাে: গােলাম মােরশেদ)
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া পদত্যাগ পত্রে (২৫জুন, ১৯৭৩) উল্লেখিত ‘১৯৬১ তে আপনার নির্দেশে আমি তৈরি ছিলাম’ অংশটির ব্যাখ্যা করলেন হাজী গােলাম মােরশেদ। ১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময় আমাকে জানান হলাে যে মুজিব ভাই ভারত সীমান্তে যাবেন এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রচেষ্টা শুরু করবেন। পূর্ব পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তের কোনাে জায়গায় ক্যাম্প করে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীনের আন্দোলন শুরু করব এবং ভারত সরকার আমাদের সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছে। মুজিব ভাই (বঙ্গবন্ধু), সি.এসপি রুহুল কুন্দুস, সি,এস,পি আহমেদ ফজলুর রহমান, মহম্মদ মােহসীন (আওয়ামী লীগের ট্রেজারার খুলনা) ও আমি এই প্ল্যানে ছিলাম। পাকিস্তান আমলের একমাত্র হিন্দু সি,এস পি, নামটা মনে নেই, উনি আশ্বাস দিয়েছিলেন যে আমরা যদি স্বাধীনতার মুভমেন্ট করতে চাই, ভারত সরকার সাহায্য করবে। He was a link between Ahmed Fazlur Rahman and ours. উনি এক সময় বরিশালের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। আইউব খান মার্শাল ল জারি করার পর উনি পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে ট্রান্সপােট কমিশনার হন। ১৯৬১ সাল থেকে আমরা স্বাধীনতা মুভমেন্টের প্রস্তুতি নিতে থাকি। তারপর নাইনটিন সিক্সটি টু’র ফেব্রুয়ারির সেকেন্ড অর থার্ড উইকে মুজিব ভাইয়ের শ্যালক, হাসুর মামা (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) মহম্মদ আলী যশােরে আমার কাছে চিঠি নিয়ে আসলেন। ওখানে এয়ারফোর্সের রিটায়াড অফিসার মিজানুর রহমানের একটি দোকান ছিল। সেই দোকানে তিনি মিজানুর রহমানকে বললেন যে উনি টুঙ্গিপাড়া থেকে এসেছেন এবং গােলাম মােরশেদের বাসা খুঁজছেন। মিজানুর রহমানকে বাসা দেখিয়ে দেওয়ার পর মহম্মদ আলী আমার বাসায় গেলেন।
আমি তখন বাসার বাইরে আমি বাসায় ঢােকার মুখে মিজানুর রহমান বললেন যে টুঙ্গিপাড়া থেকে এক ভদ্রলােক আপনার সাথে দেখা করতে এসেছেন। তারপর বাসায় ঢােকার পর মহম্মদ আলী একটা স্লিপ দিলেন ঐ স্লিপে মুজিব ভাই লিখেছিলেন ‘আমি কয়েক দিনের ভেতর আসছি তুমি তৈরি থেকো।’ অর্থ হলাে যে আমি গাড়ি নিয়ে রেডি থাকব। উনি সােজা সাদিপুর বেনাপােলের বর্ডার দিয়ে আমাকে নিয়ে ভারতে ঢুকবেন। That was the original plan. আমি তথন মহম্মদ আলীকে বললাম যে মুজিব ভাইয়ের সাথে কথা বলব, তারপর জানাব। কারণ ব্যাপারটা ছিল হাইলি সেনসেটিভ। আমি মহম্মদ আলীকে আগে দেখিনি, আবার মুজিব ভাইয়ের হাতের লেখাও চিনতাম না। যার জন্যে বিশ্বাস করাও মুশকিল ছিল। যে জন্যে আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তারপর তখন ফোনও ছিল না। এবং যােগাযােগ ব্যবস্থাও তখন এত উন্নত ছিল না যে, তাড়াতাড়ি যােগাযােগ করব। যাই হােক এদিকে আমাকে না পেয়ে, মুজিব ভাই around third week of February, কুমিল্লা দিয়ে।
—————–
মুক্তিযােদ্ধা কাশেম আলী আমাকে জানান যে (৮ নভেম্বর, ২০১৪) উল্লেখিত হিন্দু সি, এস, পির নাম ছিল অজিত কুমার দত্ত চৌধুরী। এই বইটি প্রকাশিত হবার পর লেখক মঈদুল হাসানের একটি সাক্ষাৎকার (২৩.৪.২০১৪) নেই। তখন তিনি জানান যে, ১৯৬২ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে মুজিব কাকু, আব্বু ও মানিক মিয়া প্রমুখের সাথে তিনি কারাগারে বন্দী ছিলেন। সুতরাং হাজী গােলাম মােরশেদের কাছে মুজিব কাকুর চিঠিটি পৌছায় খুব সম্ভবত জানুয়ারি মাসেই। এ প্রসঙ্গে হাজী গোলাম মােরশেদকে অবহিত করলে তিনি সায় দিয়ে বলেন যে, বয়স এবং এত কাল আগের ঘটনা হবার কারণে হয়তাে তিনি জানুয়ারির বদলে ফেব্রুয়ারি বলেছেন। ইন্ডিয়ায় কসবাতে পৌছে গেলেন। আগরতলায় উনি যাননি। কসবা থেকে উনি দিল্লির সাথে যােগাযােগ করলেন। তখন দিল্লি থেকে উত্তর আসল ‘Sorry we can’t help you.’ তখন উনি ঢাকায় ফিরে আসলেন। এসে শুনলেন পুলিশের ডি.আই.জি ওনাকে খুঁজছেন। উনি বললেন, “আপনারা নাকি আমাকে খুঁজছেন ? ওনারা বললেন, ‘আপনার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে।’ তারপর পুলিশ ওনাকে অ্যারেস্ট করল। মুজিব ভাই অ্যারেস্ট হবার পর আমার মামা যশােরের শহীদ মশিউর রহমানের কাছে আমি ব্যাপারটা ডিসক্লোজ করি। আমার তখন চিন্তা হলাে যে শেখ সাহেব যে অ্যারেস্ট হলেন তাহলে কি আমাদের মুভমেন্ট ফেল হলাে ? তখন দু-এক মাস পরেই কোলকাতায় গেলাম খোজ নিতে। ওখানে হােম মিনিস্টার কালীপদ মুখার্জির সাথে দেখা করি। জেল মিনিস্টার ড. জীবন রতন ধরের মাধ্যমে ওনার সাথে আমার যােগাযোেগ হয়। ইস্ট পাকিস্তানি ত্যাগের আগে ড. জীবন রতন ধর, যশোের ডিস্ট্রিক্ট কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন তখন ওনার সাথে জানা শােনা হয়।
যাই হােক, হােম মিনিস্টার কালীপদ মুখার্জি আমাকে তিন চার দিন অপেক্ষা করতে বললেন। আমি অপেক্ষা করলাম। উনি দিল্লি থেকে সংবাদ নিয়ে আমাকে বললেন ‘Nehru has refused to help’. শেখ সাহেব বাষট্টির অগাস্ট বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ছাড়া পেলেন। আমি যশাের থেকে ঢাকায় গেলাম ওনার সাথে দেখা করতে। তখন উনি কসবাতে যাওয়ার ঘটনা বললেন। উনি বললেন কসবাতে আমি দু-তিন দিন ছিলাম প্রধানমন্ত্রী নেহরুর জবাবের অপেক্ষায়, কিন্তু আমাকে জানানাে হলাে যে দিল্লি থেকে বলেছে ‘Sorry we can’t help you’. শেখ সাহেব জেল থেকে ছাড়া পাবার পর শিক্ষা দিবস শুরু হয়। ছাত্ররা হামদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সময় ছাত্ররা সভা ত্যাগ করে। পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২)। গুলিতে কয়েকজন ছাত্র মৃত্যবরণ করে এবং অনেকে আহত হয়। মুজিব ভাই, আমায় নিয়ে বের হলেন মেডিক্যাল কলেজে আহত ছাত্রদের দেখতে। যাবার সময় ফর্মার চিফ মিনিস্টার আতাউর রহমান খান ও শেরে বাংলার সময়ের ফর্মার চিফ মিনিস্টার আবু হােসেন সরকারকে সাথে নিয়ে মুজিব ভাইসহ আমরা যখন নীলক্ষেতের রেলক্রসিং ক্রস করছি, তখন ডেপুটি সেক্রেটারি সি.এস.পি মনিরুজ্জামান সামনের দিক দিয়ে হেঁটে আসলেন। শুনেছিলাম, ছাত্ররা ওনার গাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। উনি আমাদেরকে দেখে হুঃ শব্দ করে চলে গেলেন।
(টেলিফোন সাক্ষাৎকার, ১৮ ও ২২ অক্টোবর, ২০১২। কোস্তারিকা ক্যানাডা।)
——————————
মুজিব কাকু আগরতলায় গিয়ে দিল্লীর সাথে যােগাযােগের চেষ্টা করেছিলেন, যা তিনি নিজে কারাগারে মঈদুল হাসানের কাছে ব্যক্ত করেন। এ প্রসঙ্গে হাজী গােলাম মােরশেদকে অবহিত করলে তিনি একমত হন এবং তথ্যটি সংশােধন করে আগরতলায় গিয়েছিলেন উল্লেখ করতে বলেন। তবে মূল কথা একই থাকে, তা হলাে মুজিব কাকু গোপনে বর্ডার ক্রস করে দিল্লীর সাথে যােগাযােগের চেষ্টা করেছিলেন।
 

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ

Photo: Shekh mujib, Rashed Suharawardy & Golam Morshed before 1971