বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের রচয়িতা বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটের সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত তাজউদ্দীন আহমদ ট্রাস্ট ফান্ডের প্রথম স্মারক বক্তৃতা, সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদান (৩ জুলাই, ২০১২) অনুষ্ঠানে যােগ দেবার জন্য যখন মধ্য আমেরিকার কোস্তারিকা রাষ্ট্র হতে ঢাকা আসি, তথন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের টেলিফোন সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি। আমীর কাকু, ২৫ মার্চের ঘটনা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই। সে সময়ের পরিবেশ কেমন ছিল? আপনি কী করছিলেন ? ২৫ মার্চ সারাদিন ধরেই নানারকমের আশংকাপূর্ণ খবর আসছিল। ইয়াহিয়া খানের সাথে সমঝােতাপূর্ণ সমাধানের সম্ভাবনা আর নেই। ৬ দফা ভিত্তিক সাংবিধানিক সমাধানের জন্য যে আলােচনা চলছিল তা কতটুকু সদিচ্ছাপূর্ণ ছিল সেটা নিয়েই সন্দেহ। ইয়াহিয়া খান ও তার সঙ্গীদের উদ্দেশ্য ছিল তাদের অপারেশন সার্চ লাইট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে সামরিক সরকার যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এবং তারা যে হার্ড লাইন বেছে নিতে যাচ্ছে, তা বােঝা যাচ্ছিল। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নং রােডের বাড়ির নিচতলার লাইব্রেরিতে টাস্ক ফোর্সের অফিস করা হয়েছিল। টাস্ক ফোর্স ২৪ ঘণ্টা কাজ করত। আমি ও কামাল হােসেন (ডঃ কামাল হােসেন) টাস্ক ফোর্সের সদস্য হিসেবে অসহযােগ আন্দোলনের দিনগুলােতে (১ মার্চ২৫ মার্চ ১৯৭১ সারা বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় সংগঠনের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করতাম, বঙ্গবন্ধুকে ব্রিফিং দিতাম, প্রেসে খবর পাঠাতাম ইত্যাদি কাজ করতাম। তাজউদ্দীন ভাই, এই টাস্কফোর্সের নেতৃত্ব দিতেন। দিনের শেষে আমি সারা দেশের অসহযােগ আন্দোলনের সর্বশেষ পরিস্থিতি ও অবস্থা জানাতাম। টাস্ক ফোর্সের সাথে বৈঠক হতাে ব্যাংকারদের, কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সরকারি কর্মকর্তা, ওয়্যারলেস কর্মকর্তা, যােগাযােগ ও পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে। অফিস-আদালত ইত্যাদির জন্য প্রতিদিন কী নির্দেশ যাবে, তার পরিকল্পনা করা হতাে এবং সেই অনুযায়ী নির্দেশ পাঠানাে হতাে।
বঙ্গবন্ধুর সাথে আলাপ করে আমরা প্রতিদিনের নির্দেশনা তৈরি করতাম। আমাদের একটা সিক্রেট প্ল্যান ছিল যে, যখনই মিলিটারি টেক ওভার হবে, তাজউদ্দীন ভাই, কামাল হােসেন ও আমি একত্রিত হব এবং নেক্সট কী করব সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। কনটিনজেনসি প্ল্যান নিয়ে আমরা আলােচনা করতাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে আমাদের এ পরিকল্পনার বিষয়টি নিয়ে কথা বলা জরুরি মনে করি। তাজউদ্দীন ভাই দুদিন আমাকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে গেলেন আমাদের কনটিনজেনসি প্ল্যানের জন্য। বঙ্গবন্ধু ডাইরেকটিভ দিলেন না। বললেন, এখন দেশ স্বাধীন হবে। তােমরা নিশ্চিন্তে থাক। আমরা বললাম, আপনাকে নেতৃত্ব দিতে হবে’। উনি বললেন, ‘আমাকে নিয়ে কোথায় যাবি, আমাকে খুঁজতে যেয়ে গ্রাম-গঞ্জ পােড়াবে’ এইসব কথা বললেন। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা কী করব সে সম্বন্ধে কোনাে নির্দেশ দিলেন না। এদিকে আমরা বুঝতে পারছিলাম যে নন কো অপারেশন মুভমেন্ট আর্মস স্ট্রাগলে পরিণত হতে যাচ্ছে। ২৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন হতে বিভিন্ন খবর আসছিল, যাতে বােঝা যাচ্ছিল যে মারাত্মক কিছু হতে যাচ্ছে। যশাের আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট মশিউর রহমানকেও জানিয়েছিলাম যে বাসায় থাকবেন। উনি আমাকে বলেছিলেন যে যশাের ক্যান্টনমেন্টের জিওসি (পাকিস্তানি জেনারেল] ওনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু উনি আমন্ত্রণে যাননি। পরে শুনেছি উনি বাড়ি থেকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাইরে হোঁচট খেয়ে আবার বাড়িতেই ফিরে আসেন। তারপর পাকিস্তানি আর্মি ওনাকে বন্দী করে এবং যশাের ক্যান্টনমেন্টে নির্মমভাবে হত্যা করে।
আব্বুর কাছে ওনার কথা শুনেছি। উনি একজন নিবেদিত দেশপ্রেমিক ছিলেন। ওনার মতাে হাজার হাজার নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক তাে এভাবেই পাকিস্তান আর্মির হাতে প্রাণ হারায়। তাে, ২৫ মার্চে আপনারা বিভিন্ন খবর থেকে বুঝতে পারছিলেন যে পাকিস্তান আর্মি হার্ড লাইন নিতে যাচ্ছে ? হ্যা। ওইদিন দুপুর আড়াইটার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে যখন আমি সার্কিট হাউসে আমার বাসায় খেতে এসেছি, তখন দেখি যে ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক সাহেব ইিস্টার্ন ওয়্যারলেস ডিভিশনের, ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। আমার মতােই ওনার দেশের বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। ওনাকে আমি থােকা ভাই বলে ডাকতাম। কিছুটা বামপন্থী রাজনীতির সাথে ওনার যােগাযােগ ছিল। ওনার স্ত্রীও [নাসরিন বানু ব্রিটিশ বিরােধী বিপ্লবী আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। থােকা ভাই ছিলেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হতে পাস করা ব্রিটিশ সময়ের একজন প্রতিভাবান ইঞ্জিনিয়ার। ১৯৬১ সালে রানি এলিজাবেথ যখন পূর্ব পাকিস্ত নি সফরে আসেন, তখন মিন্টো রােডের পুরাতন গণভবনে ছিলেন থােকা ভাই, সেখানে wirless set up করে, বাকিংহাম প্যালেসের সাথে রানি এলিজাবেথের ডাইরেক্ট যােগাযােগের ব্যবস্থা করেছিলেন। পাকিস্তান সরকার ওনাকে নেপালেও পাঠিয়েছিল টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা set up করার জন্য। পাকিস্তানের ইসলামাবাদের মিলিটারি বেইসেও উনি Wireless set up করেন। তিনি ট্রান্সমিটার বানাতে পারতেন। তার কাজের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে বড় খেতাবও দেয়। তাে, সেদিন দুপুরে যখন লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় যাই, থােকা ভাই এলেন আমার সাথে দেখা করতে। উনি ছিলেন খুব স্মার্ট, চমৎকার ইংরেজি বলতেন এবং সব সময় well dressed থাকতেন। সেদিনও উনি একটি মভ কালারের শার্ক স্কিন স্যুট পরে এসেছিলেন। উনি বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেছিলেন একটি ট্রান্সমিটার যােগাড় করতে। আমি খুলনা থেকে এটা। নিয়ে এসেছি। আমি এখন এটা কোথায় পৌছে দেব?’ আমি বললাম, ট্রান্সমিটার কাজ করে?’
উনি বললেন, ‘হ্যা এটা কাজ করে।’ আমি তখন বললাম, ‘আমাকে তাে বঙ্গবন্ধু এ সম্বন্ধে কোনাে নির্দেশ দেননি। বলেননি ট্রান্সমিটার সম্বন্ধে। তবে ওনার একটা কথা সবাই জানে, সেটা হলােযার কাছে যা আছে, তা নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে। আপনার কাছে ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার আছে, তা দিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করবেন। আমার কাছে আছে সাংগঠনিক শক্তি, তা দিয়ে আমি করব।’ তারপর আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি ওয়্যারলেসে কী বলবেন তা কি আমি বলে দেব এবং ওটা লিখে দেব ? উনি বললেন, ‘আমি জানি কী বলতে হবে। It will cost my life, but I will do it. It’s worth doing.’ উনি নিদ্বিধায় এবং জোর দিয়ে
——–
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে এই গ্রন্থটির প্রকাশনা অনুষ্ঠানের ভিডিও রেকর্ডকৃত বক্তব্যে (১৮ এপ্রিল, ২০১৪) এবং লেখকের সাথে পরবর্তী আলাপে (২৫ এপ্রিল ২০১৪) নূরুল হকের শেষ বাক্যটি যােগ করেন। কথাটি বললেন। আমার ধারণা he was the one who sent out the wireless message. থােকা ভাই চলে যাবার পর আমি আবার ৩২ নম্বর রােডে ফিরে আসলাম। এক অবাঙালি ভদ্রলােক, ইউ.পিতে বাড়ি, নাম দিলদার রিজভী United Bank Limited-এর ভাইস চেয়ারম্যান, উনি আমার কাছে আসলেন বিকেল চারটা-সাড়ে চারটার দিকে। ওনার কিছু লিগাল কাজ করে দিয়েছিলাম। সেই সূত্রে পরিচয়। উনি আমাকে ৩২ নম্বর রােডের কাছেই ওনার বাসায় নিয়ে বললেন, ‘Things are very bad. আজ রাতেই ঘটনা ঘটতে পারে। আমি আমার ফ্যামিলিকে অন্য জায়গায় শিফট করেছি। আমার এই খালি বাড়ি আপনি ব্যবহার করতে পারেন। আমাদের Secret plan অনুসারে গত সাতদিন ধরে কামাল হােসেন ও আমি নিজ বাড়ির বাইরে থাকা প্র্যাকটিস করছিলাম। এ ক্ষেত্রে আমরা সাত মসজিদ রােডের ওপর মুসা সাহেবের বাসা বেছে নিয়েছিলাম। ওনার পরিচয় ?
উনি ব্যবসায়ী ছিলেন। বাড়ি কুষ্টিয়ায়। প্রতিদিনের মতােই ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন ভাই, কামাল হােসেন ও আমার রিভিউ কমিটির মিটিং করার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসার লাইব্রেরি কক্ষে রেগুলার আমাদের এই মিটিং হতাে। কিন্তু সেই সন্ধ্যায় মিটিং হলাে না। তাজউদ্দীন ভাই ও কামাল হােসেনকে খুঁজে পেলাম না। চারদিক থেকে তখন নানারকমের আতঙ্কপূর্ণ খবর আসছিল। সন্ধ্যায় বের হবার আগে বঙ্গবন্ধুর Speech draft করে, ফাইনাল করে, ওনার প্রেস। সেক্রেটারি আমিনুল হক বাদশাকে দিই সাইক্লোস্টাইলে প্রিন্ট করতে। তারপর সেই বিবৃতির প্রিন্ট বঙ্গবন্ধুকে দেখাই। সাইক্লোস্টাইলে প্রিন্ট করা এই বিবৃতিতে তিনি ২৬ ও ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বাসা থেকে রাত ন’টা-সাড়ে ন’টার সময় তােমাদের বাসায় যাই। দেখি যে বেগম নূরজাহান মুরশিদ বাইরের ঘরে বসা। ভেতরের ঘর থেকে। তাজউদ্দীন ভাইয়ের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। উনি জোরে জোরে ভাবির সাথে কথা বলছিলেন। একটা ব্যাগ খুঁজে না পাওয়াতে উনি খুব Upset ছিলেন বলে শুনেছি। আব্বুর সাথে তখন দেখা হয়েছিল ? কিন্তু ভেতরের ঘর থেকে ওনার গলা শুনে বুঝলাম যে He is disoriented. ওনাকে। Reinforce করা দরকার। কিন্তু তার জন্যে ওনাকে একা দরকার। আমি তখন নূরজাহান মুরশিদকে ওনার ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে নামিয়ে দিতে চলে গেলাম। আপনার গাড়িতে ? গাড়ি কী আপনি চালাচ্ছিলেন ? হ্যা আমার নিজস্ব গাড়ি। আমিই চালাচ্ছিলাম। কী গাড়ি? রং কী ? মরিস ১১০০। বটল গ্রিন কালার। গাড়ির কথাটি জিজ্ঞেস করলাম কারণ, এ ধরনের খুঁটিনাটি তথ্যও একদিন ইতিহাসের উপাদান হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। ভবিষ্যতে হয়তাে এই ঘটনা নিয়ে একটি মুভিও হয়ে যেতে পারে। That’s ight, ঐতিহাসিক কনটেক্সটে ছােটবড় সব তথ্যেরই গুরুত্ব রয়েছে।
সেদিন ওই গাড়িতেই নূরজাহান মুরশিদকে নামিয়ে নিয়ে বাসায় যাবার পথে দেখি যে, হােটেল শেরাটনের [পূর্বে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল) দক্ষিণ দিকে রেডিও পাকিস্তানের অফিস আর্মিরা টেক ওভার করছে। তারা দলে দলে ট্রাক থেকে নামছে। আমি বুঝলাম যে ভয়ংকর কিছু হতে যাচ্ছে। তখন পাশেই ৩ নম্বর সার্কিট হাউসে কামাল হােসেনের বাসায় ঢুকলাম। দেখি উনি বাড়ির বাইরে ন্যাপের বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি লিডার আহমদুল কবির ও লায়লা কবিরকে বিদায় দিচ্ছেন। আমি ওনাকে তাড়া দিলাম। বললাম, “রেডি হন। আমি বাসা থেকে রেডি হয়ে আসছি।’ আমার বাড়ি পাশেই ৪ নম্বর সার্কিট হাউসে। সেখানে ল্যান্ডলেডি গেটের তালা বন্ধ করে দেওয়ায় দেওয়াল টপকে বাসায় প্রবেশ করি। মেয়ে শম্পা তখন নারায়ণগঞ্জে, নানা বাড়িতে আছে। ছােট ছেলে আদিল স্ত্রীর সাথে বাসায়। আমি স্ত্রীকে বললাম, লীলা বাচ্চাদের নিয়ে সাবধানে থেকো। তারপর আমি চলে গেলাম। যাবার পথে কামাল সাহেবকে তুলে নিলাম। তখন দেখি রাস্তায় ব্যারিকেড পড়েছে। শাহবাগ দিয়ে যেতে পারলাম না, ব্যারিকেডের জন্যে। তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভেতর দিয়ে গেলাম। সেখানেও স্টুডেন্টরা রাস্তায় গাছ ফেলে ব্যারিকেড করেছে। ছাত্ররা, আমাদের চিনে ব্যারিকেড একটু ফাক করে দিল। তার ভেতর দিয়েই গাড়ি চালিয়ে আবার ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসায় ফিরলাম। তখন রাত কটা বাজে? তখন রাত সাড়ে দশটা বেজে গিয়েছে। যেয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু ও ওনার পার্সনাল এইড হাজী গােলাম মােরশেদ নিচতলার ডাইনিংরুমে বসা। বঙ্গবন্ধু খুব Calm ও Relaxed ছিলেন। ওনার পরনে গেপ্তি। আমরা বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।’ উনি বললেন, না, আমি কোথাও যাব না। এখানেই থাকব। Whatever happens I will face it.’
উনি ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে কথাটি বললেন। আমরা বললাম, তাহলে আমরা যাব না। আপনার সাথেই থাকব।’ উনি এবার বেশ দৃঢ় স্বরে ইংরেজিতে বললেন, ‘Both of you are oath bound to obey my order. You must leave my house. God bless you’. 661 বলে he walked with us. উনি আমাদের দুই কাঁধে ধরে গ্রাউন্ড ফ্লোরের লাস্ট স্টেপ-এ এসে বিদায় দিলেন। যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন সামনের গেটের ভেতর দিয়ে ছাত্র নেতা তােফায়েল আহমেদ ঢুকছেন। তােফায়েলকে বললাম, ওনাকে বের করতে চেষ্টা করলাম, উনি বের হলেন না। Now you try.’ এরপর গাড়ি চালিয়ে আবার তােমাদের বাসায় গেলাম। তখন রাত ক’টা? রাত এগারােটার কাছাকাছি। যেয়ে দেখি তােমার বাবা তােমাদের বাড়ির সামনের লনের বাগানে খুব অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। আমি ওনাকে বললাম, ‘Military has taken over, আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হবে।’ উনি বললেন, কী করব ? কোথায় যাব ? ওনার মুখে প্রচণ্ড অভিমান ও Confusion লক্ষ করলাম। পরে বুঝলাম যে উনি নেতার কাছ থেকে কোনাে নির্দেশ পাননি। উনি নেতার নির্দেশ পুংখানুপুংখভাবে পালন করতেন। সে কারণেই নির্দেশহীন অবস্থায় উনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিলেন। তখন ওনাকে বললাম, “আর্মি রাজারবাগ ও ইপিআর টেক ওভার করছে। আজ রাতের অবস্থা কিন্তু অন্যরকম হতে যাচ্ছে।’ ঠিক তক্ষুনি ইপিআর এলাকা থেকে আমাদের সাতমসজিদ রােডের বাড়ির দক্ষিণে ইপিআর বর্তমান বিডিআর-এর হেড কোয়ার্টার।- লেখক আওয়ামী লীগের সমর্থক এক ব্যক্তি বাসার সামনে প্রায় দৌড়ে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন যে আর্মিরা ইপিআরকে ডিসআর্ম করছে। একথা শােনার পরেই তাজউদ্দীন ভাই মাইন্ড চেঞ্জ করলেন। ওনার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ করলাম ।
ইতােমধ্যে পথের সমস্ত আলাে নিভে গিয়েছে। তাজউদ্দীন ভাই আমাদের অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভেতরে গেলেন। সেই সময়ই কামাল হােসেন insist করলেন ধানমণ্ডির ১৩ নম্বর রােডে। ওনার এক আত্মীয়র বাসায় নামিয়ে দিতে। তখন আমি বললাম, না, আগে উনি আসুক, তারপর ডিসাইড করব কোথায় যাব না-যাব। ওনাকে ফেলে চলে যেতে পারি না।’ তাজউদ্দীন ভাই যখন আসলেন, দেখলাম ওনার ভেতরে একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গিয়েছে। তখন ওনার কাধে রাইফেল, একটা থলি ও কোমরে ম্যাগাজিন ভরা পিস্তল। তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল যে, আমরা সশস্ত্র বিপ্লবে যাচ্ছি। ইতােমধ্যে উনি অস্ত্র চালানাের ট্রেনিং নিয়েছেন এবং রাইফেলও যােগাড় করেছেন ওনার বন্ধু ও সহকর্মী আরহাম সিদ্দিকীর মারফত। পরে ওনার পিস্তল আমি নাড়াচাড়া করে, কীভাবে লােড ও আনলােড করতে হয় তা রপ্ত করে ফেলেছিলাম। আব্বু ও আপনি কী ধরনের পােশাক পরে বের হয়েছিলেন?
তাজউদ্দীন ভাইয়ের পরনে ছিল সাদা ফতুয়ার মতাে হাফ শার্ট ও চেক লুঙ্গি। আমার পরনে ছিল পায়জামা, পাঞ্জাবি ও স্যান্ডেল। বের হয়ে আপনারা তিনজন কোথায় গেলেন? কামাল হােসেন আমাদের সাথে থাকতে চাইলেন না। উনি জোরাজুরি করায় ওনাকে ধানমণ্ডি ১৩ নম্বর রােডে ওনার এক আত্মীয়র বাড়িতে নামিয়ে দিই। তারপর আমরা সাত মসজিদ রােডের ওপরে মুসা সাহেবের বাসায় যাই। গত সাতদিন ধরে আমি ও কামাল হােসেন রাতে বাসায় না থেকে বাইরে থাকার প্র্যাকটিস করছিলাম। আমি ও কামাল হােসেন মুসা সাহেবের বাসার চিলেকোঠার ঘরে রাত কাটাতাম। কিন্তু সে রাতে তাে আপনারা অন্য জায়গায় আশ্রয় নিলেন। হ্যা। তার কারণ হলাে যে মুসা সাহেবের বাসা ইপিআরের কাছে ছিল। আমি ও কামাল হােসেন চিলেকোঠার যে ঘরে থাকতাম সেই ঘরেই মুসা সাহেবের এক ড্রাইভার Stray bulletএ মারা যায়। আমি মুসা সাহেবের বাসায় আমার গাড়িটা রাখলাম এবং ওনাকে অনুরােধ করলাম ওনার গাড়ি ও ওনার ড্রাইভার দিতে। এই ড্রাইভার লালমাটিয়ায় রেলওয়ের রিটায়ার্ড চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাসা চিনত। ওনার বাসায় আশ্রয় নেব, এই সিদ্ধান্ত নিলাম। গফুর সাহেবের সাথে কীভাবে পরিচয় হয় ? গফুর সাহেব আমার ক্লায়েন্ট ছিলেন। দুদিন আগেই উনি আমার টেবিলে একটা চিঠি লিখে রেখে গিয়েছিলেন। চিঠিতে লিখেছিলেন, আমার বাড়িতে পরিবার নেই। বাড়ি খালি। কোনাে জরুরি কাজে আপনি আমার বাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন।’ গফুর সাহেব একজন বিশ্বস্ত ও সৎ মানুষ ছিলেন।
রাজনৈতিক মহলে পরিচিত ছিলেন না। সে জন্য ওনার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। উনি আমাদের অতি সমাদরে গ্রহণ করেন। ওখানেই আমরা ছদ্মনাম ধারণ করি। তাজউদ্দীন ভাই হলেন মুহম্মদ আলী ও আমি রহমত আলী। লালমাটিয়া ঐ রাতেই অবরুদ্ধ হয়ে গেল। সাত মসজিদ রােডে অবস্থিত ফিজিকাল ইনস্টিটিউটে আর্মি ক্যাম্প বসানাে হলাে। পরে যেখানে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কারফিউ তােলার পর ২৭ তারিখে চলে যাবার সময় গফুর সাহেবের বাসায় রাইফেল ফেলে যেতে হয়। ওই বড় রাইফেল নিয়ে চলা তখন বিপজ্জনক। গফুর সাহেব রাইফেলটি প্ল্যাস্টিকে জড়িয়ে মাটির নিচে পুঁতে রাখেন। স্বাধীনতার পর তিনি সেটা তােমার আন্ধুকে ফেরত দেন। সেই ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক সাহেবের তারপর কী হলাে ? সেটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। উনি ওয়্যারলেসে যেসব সংকেত সেট-আপ করে। রেখেছিলেন, তা পাকবাহিনী ইন্টার সেপট করে। তারা ট্রান্সমিটার খুঁজতে ওনার ওয়্যারলেস কলােনির বাসা ঘেরাও করে এবং ২৯ মার্চ ওনাকে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। উনি আর ফিরে আসেননি। ওনার স্ত্রী এখনাে বেঁচে আছেন। তুমি ওনার সাথে কথা বলতে পারাে। আরও একজন।
সেই ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোন কল রিসিভ করেছিলেন, সেই হাজী গোলাম মােরশেদ সাহেবের সাথেও কথা বলতে পারাে। বয়স হলেও উনি মেনটালি খুব শার্প এবং তােমাকে বিস্তারিত বলতে পারবেন। সেই রাতে ওনাকেও কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাথেই বন্দী করা হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ওনার ওপর অনেক অত্যাচার চালানাে হয়। তার একটি পা এখনাে অকেজো। ক্রাচে ভর করে হাঁটেন। বঙ্গবন্ধুর একজন নিঃস্বার্থ, নির্লোভ নিবেদিত প্রাণ সর্ব সময়ের সঙ্গী।
ওনার সাথে আপনার কবে থেকে পরিচয় ? বহু যুগের পরিচয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময় মােরশেদ ভাই এবং আমি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নির্বাচনী প্রচারে বিভিন্ন জায়গায় সফরসঙ্গী হই। নির্বাচনের বিজয়ের পর যখন পাকিস্তান সরকার গণরায়কে বাতিল করে যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছিল, তখন হাজী গােলাম মােরশেদ ও আমি একই সাথে রাজশাহী জেলে। ছিলাম। আশ্চর্য ! এ ধরনের ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কোনাে উল্লেখই নেই ইতিহাসে। কী অকৃতজ্ঞ জাতি আমরা। থ্যাংকস কাকু ওনাদের ইনফরমেশন দেবার জন্য। আমি চলে যাবার আগে অবশ্যই ওনাদের সাথে যােগাযােগ করব। (১১ জুলাই কোস্তারিকার পথে রওয়ানা দেবার আগে হাজী গােলাম মােরশেদ ও নূরুল হক পরিবারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি)। তারপর ওই ফোন কলটি কে করেছিলেন, কী ব্যাপারে ? এক ব্যক্তি, মধ্য রাতে ফোন করে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলতে চাইলেন। হাজী সাহেব বললেন, ‘আপনি কে?’ উনি পরিচয় না দিয়ে বললেন যে বঙ্গবন্ধুকে বলেন যে মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি, এখন মেশিন কোথায় রাখব, কী করব ? তখন বঙ্গবন্ধু হাজী গােলাম মােরশেদকে বললেন যে, ওই ব্যক্তিকে বল মেশিন ভেঙে সে যেন পালিয়ে যায়।
আমার ধারণা ওই ব্যক্তি। ছিলেন নুরুল হক বা তার বিশ্বস্ত কোনাে লােক যাকে দিয়ে তিনি খুলনা থেকে আনা ট্রান্সমিটারে। মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। ওয়্যারলেসে ইংরেজিতে স্বাধীনতার যে ডিক্লেয়ারেশনটা দেওয়া হয় সেই কণ্ঠটি হয়তাে নূরুল হকের ছিল এবং তা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেওয়া হয়। লিন্ডনের দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক ও দক্ষিণ এশিয়া করেসপন্ডেট ডেভিড লােশাক, যিনি সর্বপ্রথম বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ভাষণটি উল্লেখ করেন, তিনি লিখেছিলেন যে গলার আওয়াজ খুব ক্ষীণ ছিল এবং যাতে মনে হচ্ছিল খুব সম্ভবত ওটা আগেই রেকর্ড করা ছিল।
বঙ্গবন্ধু, আব্বুর লিখে আনা স্বাধীনতার ঘােষণায় সাইন করলেন না, আপনাদের অনুরােধ সত্ত্বেও টেপ রেকর্ডারেও কোনাে নির্দেশ দিলেন না। অথচ আপনাদের অজান্তে নির্দেশ পাঠালেন। ভিন্ন মাধ্যমে। এর যুক্তি কী? আমার মনে হয় উনি স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে সরাসরি কোনাে লিঙ্ক রাখতে চাননি। বঙ্গবন্ধু হয়তাে কোনাে নেগশিয়েটেড সেটেলমেন্ট চাচ্ছিলেন। আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে যেয়ে স্বাধীনতা। যুদ্ধের যে পথটা বেছে নিচ্ছিলাম তার ফলাফল নিশ্চিত ছিল না। উনি হয়তাে ভাবছিলেন যে উনি বন্দী হবার পরেও স্বাধীনতার জন্য নেগশিয়েটেড সেটেলমেন্ট করা সম্ভব। উনি জানতেন যে GAICP RUJT 2516 RT I He actually made a decision to surrender to the arrest. He knew that his life would be saved. But if he leaves home, he would be termed as a traitor-a fugitive. He could have been killed in that situation and the blame could be shifted as if he was killed by the extremists in his own party. I can understand his position. It was communicated to him that Bangladesh is not on the map of either the state Department or the C.I.A. Later, the same thing was communicated to me by one Mr. Brut of the U. S Consulate in Dhaka. মিস্টার ব্রুট ? পুরাে নাম কী ? কবে দেখা হয় ? পুরাে নামটা মনে পড়ছে না। ১৯ বা ২০ মার্চে ওনার সাথে দেখা হয়। He was the number three in Dhaka U.S Consulate in 1971. He invited me to a lunch and conveyed to me the same message. He said that although he has personal empathy for our struggle, but there is no Bangladesh as an independent country in the map of C.I.A or the State Department. It was most likely that the same message was conveyed to Bangabandhu at a higher level. তারপরও তাে দেশ স্বাধীন হলাে।
জাতি যেখানে প্রস্তুত, নেতৃত্ব যেখানে সবল সেখানে স্বাধীনতাকে কোনাে শক্তি যত বড়ই প্রতাপশালী হােক না কেন তা ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। তিনি বাইরের চাপে সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে যদি নাও জড়াতে চান কিন্তু এ সম্পর্কে আপনাদের সাথে আলােচনা তাে করতে পারতেন, একটা দিক নির্দেশনা তাে দিতে পারতেন। ‘ যেহেতু তিনি তার জীবন বাজি রেখে শত্রুর শিবিরে বন্দী হবার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন, স্বাধীনতার জন্য তাই আমাদের উপর সবটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। ওনার কাছ থেকে কোনাে নির্দেশনা না পাওয়াতে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালানাের সময় আমাদের অনেক রকমের সমস্যা হয়েছে এবং সব সময়ই আমরা তার অভাব অনুভব করেছি। তবে পাকিস্ত নি কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু এত শক্তিশালী অনুপ্রেরণা হয়ে সকল ছাত্র, যুবক, তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য দিক নির্দেশনা ছিলেন। তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে যখন বর্ডার ক্রস করলাম তখন বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স] বলল যে, তারা টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মেসেজ পেয়েছে এবং তারা সেটা প্রিন্টও করেছে। স্বাধীনতা ঘােষণা? হা। ওই মেসেজ বিভিন্নভাবে গিয়েছিল। ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে, টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার ও টেলিগ্রাফের টরেটক্কা সংকেত হিসেবে। আমরা যখন স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র রচনা। করলাম তখন আমরা বললাম যে, অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন। অতএব ওই দিন থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা কার্যকরী হবে। আমরা স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার গঠন করলেও শেখ মনি ওই সরকার কখনােই মেনে নেয়নি।
১০ এপ্রিল রাতে তােমার আব্বুর বক্তৃতা প্রচারের সময় শেখ মনি আমার সামনে তােমার আব্দুকে বলেছিল যে, তার কাছে বঙ্গবন্ধুর লিখিত নির্দেশ আছে যে সে-ই বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তার পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করবে- টু অ্যাক্ট অন হিজ বিহাফ । শুনেছি ওই চিঠি ভারত সরকারের উচ্চ কর্মকর্তাদের দেখিয়েছিলেন। আপনাদেরকে কি দেখিয়েছিল ? না। যদিও তাকে ও তার অনুগত ছাত্র ও তরুণদের নিয়ে আমরা কাজ করতে চেয়েছিলাম এবং সেই সুযোেগও তাদের দেওয়া হয়েছিল। তােমার আব্দুর ১০ এপ্রিলের বক্তৃতা যাতে প্রচার। করা না হয় সেই চেষ্টাও সে করেছিল। শেখ মনির অনুরােধে তাজউদ্দীন ভাই বক্তৃতাটা বন্ধ করার জন্য আমাকে নির্দেশ দেন। গােলােক মজুমদার যখন আমাকে বললেন যে, বক্তৃতার ক্যাসেট শিলিগুড়ির গােপন স্থানে পৌঁছে গিয়েছে এবং তিনি বন্ধ করার চেষ্টা করতে পারেন কিন্তু তা কি ঠিক হবে? তখন আমি বলেছিলাম যে, ক্যাসেটটি যদি গন্তব্য স্থানে পৌছে যেয়ে থাকে তবে বক্তৃতাটা নির্ধারিত সময় অনুসারে প্রচার হােক। তাজউদ্দীন ভাইয়ের ওই একটা নির্দেশ আমি অমান্য করেছিলাম। সেটা ভুল কি সঠিক ছিল তা ইতিহাসই বলবে। আর একটা কথা, বর্ডার। ক্রস করার পর কোলকাতায় যখন পৌছলাম, তখন তােমার আন্ধু বলেছিলেন যে, মার্চ মাসে উনি। একদিন মুজিব ভাইয়ের ঘরে ঢােকার সময়ে শােনেন যে মুজিব ভাই, শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ ছাত্র নেতাদের বলছেন যে, ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ অ্যাভিনিউতে গেলে খোঁজ পাবে।
সে সময় তিনি চিত্ত সুতারের নাম শােনেন। পরে কোলকাতায় শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়কে ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার নিয়ে আমরা হন্যে হয়ে রাজেন্দ্র প্রসাদ অ্যাভিনিউতে ওই বাসা খুঁজি। শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়ের সাথে ‘৮৭ সালে কোলকাতায় যখন দেখা হয় তখন উনি আমাকে ওই বাসা খোঁজার কথা উল্লেখ করেছিলেন। হ্যা। আমরা পরে ঠিকই ১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ অ্যাভিনিউয়ের বাসা খুঁজে পেয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের বলা হলাে যে ওই নামে ওই বাসায় কেউ থাকেন না। পরে আমরা জানতে পারি যে চিত্ত সুতার ছদ্ম নামে ওই বাসায় থাকতেন। উনি সেখানে থেকে ‘র’-এর চ্যানেল হিসেবে কাজ করতেন। ওনার মাধ্যমেই শেখ মনি গ্রুপটি ‘র’-এর সাথে যােগাযােগ করে এবং মুজিব বাহিনী গড়ে তােলে। এটা খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার যে স্বাধীনতার এই বিশাল আয়ােজনে দলের সুযােগ্য নেতৃবৃন্দকে কোনাে নির্দেশ দেওয়া হলাে না কিন্তু গােপনে নির্দেশ দেওয়া হলাে শেখ মনি গ্রুপটিকে! বঙ্গবন্ধু হয়তাে চেয়েছিলেন একটা সাে কলড স্ট্রাগল হবে এবং তার ভিত্তিতে নেগশিয়েশন হবে। এবার একটা ভিন্ন প্রশ্ন করি। ১৯৭৪-এর মে মাসে আপনাকেসহ সাতজনকে মন্ত্রিসভা থেকে কেন বাদ দেওয়া হলাে? প্রসিডিয়ারটি কী ছিল? বঙ্গবন্ধু একটা রেজিগনেশন লেটার ড্রাফট করে সব ক্যাবিনেট মিনিস্টারদের স্বাক্ষরসহ কপি নিজের কাছে রাখেন। পরে সেই রেজিগনেশন লেটার ব্যবহার করলেন আমাদের বাদ দেওয়ার জন্য। ওনার ধারণা ছিল যে আমরা তাজউদ্দীন সাহেবের অনুসারী। সে জন্য আমাদের অনেকেই বাদ পড়ে যান। অথচ তাজউদ্দীন সাহেব আমাদেরকে কী বলতেন? উনি বলতেন, আসুন আমরা এমনভাবে দেশের জন্য কাজ করি, যাতে আমাদেরকে খুঁজে পেতে কষ্ট হয়।’ আব্বু তাে কখনােই লােক দেখানাে কাজ করতেন না।
ওনার ভিশনটাকে যদি কাজে লাগানাে যেত তাহলে নতুন সৎ নেতৃত্বর সৃষ্টি হতাে। বাংলাদেশ এগিয়ে যেত বহু দূর। তাজউদ্দীন ভাইয়ের একটা বড় স্বপ্ন ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে। উনি পরিকল্পনাও করেছিলেন যে ওদেরকে শুধু সাটিফিকেট দিয়ে ঘরে না পাঠিয়ে ওদেরকে জাতির পুনর্গঠনে কাজে লাগানাে হবে। ওদের জন্য বিশাল ক্যাম্প তৈরি হবে, সেখানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে উনি থাকবেন, বঙ্গবন্ধু থাকবেন, আমরা থাকব। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ হতে শিক্ষা, অর্থনীতি সব কিছুর ওপর তাদেরকে উপযুক্ত ট্রেনিং দেওয়া হবে। কর্মক্ষেত্রের জন্যও তারা দক্ষতা অর্জন করবে। ওই ট্রেনিং নিয়ে তারা বাংলাদেশ গড়বে। দেশ স্বাধীন হয়ে গেলেই তাে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যায় না। এই চিন্তাটা উনি করতেন।
আব্বু তাে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের জন্য জাতীয় মিলিশিয়া গড়ার পরিকল্পনা। করেছিলেন। ওনার সেই স্বপ্ন বাস্তব হতাে যদি মুজিব কাকু আন্ধুর কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, নয় মাসের ইতিহাস শুনতে চাইতেন। বুঝতে চাইতেন সেই সময়কে। রাষ্ট্র গঠনে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ওই নয় মাসের ইতিহাস জানা জরুরি ছিল। সেটা যে হতে পারেনি, তা আমাদের দেশের জন্য একটা বড় ট্র্যাজেডি। তাজউদ্দীন ভাই বঙ্গবন্ধুকে ভীষণ ভালােবাসতেন। ‘৭১-এ বঙ্গবন্ধুর কথা ভেবে ওনাকে কাঁদতে দেখেছি। উনি। নিজেকে আড়াল করে সব কাজের কৃতিত্ব বঙ্গবন্ধুকে দিতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রতি ওনার বিশ্বস্ততা ছিল। একশাে ভাগ। ১৫ আগস্ট সকালে যখন তােমাদের বাসায় ফোন করি, তাজউদ্দীন ভাই বললেন, ‘আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ মুজিব ভাই জেনে গেলেন না কে তার বন্ধু, কে তার শত্রু। উনি হয়তাে ভেবেছেন, তাজউদ্দীনের লােকই তাকে মেরেছে।’ আমি সেদিন ওনাকে বলেছিলাম, আপনি বাড়িতে থেকেন না। অন্য কোথাও চলে যান।’ উনি বললেন, ‘আমি তাে ক্যাবিনেটে নেই আমাকে কী করবে ? ওনার গলা শুনে মনে হলাে, উনি যেন ডেস্টিনির হাতে নিজেকে ছেড়ে দিলেন। আমি তখন তােমাদের বাসার কাছেই ধানমণ্ডির ২২ নম্বর রােডে থাকতাম। সেখান থেকে দ্রুত বেরিয়ে আমি ড. মনিরুজ্জামানের বাসায় শেল্টার নিই এবং ওখান থেকে আবার তাজউদ্দীন ভাইকে ফোন করি। কিন্তু ফোনে আর পেলাম না। বুঝলাম লাইন কাটা।
আপনার সাথে কথা বলার একটু পরেই আর্মি আমাদের বাসা ঘিরে ফেলে আর ফোন লাইন কেটে দেয়। আব্বু কিন্তু জানতেন যে মুজিব কাকুকে যারা হত্যা করেছে তারা আব্বুদেরকেও বাঁচিয়ে রাখবে না। তােমার বাবাকে শেষ বিদায় দিতে যখন তােমাদের বাসায় যাই, ভাবি কেঁদে কেঁদে আমাকে বলছিলেন, সেদিন আপনি তাজউদ্দীনকে বাসা থেকে বের করে নেওয়ায় উনি বেঁচে ছিলেন। ১৫ আগস্টে যদি আপনি আবার এসে নিয়ে যেতেন উনি আজ বেঁচে থাকতেন। কিন্তু সেই ‘৭১-এর ২৫ মার্চ আর ‘৭৫-এর ১৫ আগস্টের মধ্যে ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর তাজউদ্দীন ভাই নিজের জীবনকে ডেস্টিনির হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন। সাক্ষাৎক্তার ৫ ও ৬ জুলাই, ২০১২।
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ