ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিকথা১
শেখ আব্দুল আজিজ
(শেখ আবদুল আজিজ ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান | মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম সাংগঠনিক কমিটির সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের দুই পর্বেই তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৪৮ সালের | ১১ই মার্চ তিনি খুলনায় ভাষা-আন্দোলন গড়ে তােলেন এবং গ্রেপ্তার হন। কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকায় ভাষা আন্দোলনে সংঘটনে ভূমিকা রাখেন।)
কুমিল্লার শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সরকারের ১৯৫৬ সালে স্বাস্থ্যবিষয়ক। মন্ত্রী ছিলেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ১৯৪৮ সালে সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত গণপরিষদ সভায় প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম উর্দু ভাষার সাথে রাষ্ট্রভাষা দাবি করেন। তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল ছিলেন পাকিস্তানের গণপরিষদের সভাপতি। ধীরেন বাবুর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবির অনুকূলে ছাত্র ও সুধী মহলে অনুপ্রেরণা জাগে। এই সূত্র ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা দাবি করে সভা
———————
১. লেখাটি ২০০২ সালে ‘অমর একুশে/আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও মহান ভাষা আন্দোলনের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত ভালােবাসি মাতৃভাষা গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
———————-
সমিতি ও আন্দোলন শুরু করেন। এই সময় পূর্ববঙ্গে নঈমুদ্দীনকে। আহ্বায়ক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। তখন দুটি ছাত্র সংগঠন ছিল। একটি হল নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। অপরটি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ। তৎকালীন নিখিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠন হিসাবে কাজ করতাে। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান। তারপর তৎকালীন আবদুস সামাদ সাহেব (বর্তমানে আবদুস সামাদ আজাদ) এই সরকারি ছাত্রসংগঠনের সম্পাদক ছিলেন।
১৯৫২ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশ বিভাগের পর কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন স্টুডেন্ট প্রকাশ্যে সংগঠনের নাম দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারতাে না। কারণ কমিউনিস্ট পার্টি তখন মুসলিম লীগ সরকারের দ্বারা বেআইনী ঘােষিত হয়েছিল। আজকের বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন করেন। আমি শেখ আব্দুল আজিজ, বরিশালের আবদুর রহমান চৌধুরী, ময়মনসিংহের খালেক নওয়াজ খান যিনি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল। আমীনকে প্রাদেশিক পরিষদে পরাজিত করেছিলেন, ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, বরিশালের কাজী গােলাম মাহবুবসহ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আমরা তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম।
নব প্রতিষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহায়ক হিসাবে বিলুপ্ত ছাত্র ফেডারেশনের ছাত্ররাও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মুনীর চৌধুরী, তার বােন নাদের চৌধুরী ও অন্যরাও ছাত্র ফেডারেশনে অদৃশ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য আন্দোলন করেছেন। তখনও আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব যিনি পরবর্তী সময়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তারা দুজনই দক্ষিণ টাঙ্গাইল থেকে বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হকও তখন রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ও নেতৃত্ব দেন। তাদের সাথেও ছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) রংপুরের খয়রাত হােসেন, ঢাকার আনােয়ারা খাতুন এমএলএ এবং নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমান আলী এমএলএ।
১৯৪৮ সালে গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব ঢাকা আগমন করেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হলে ছাত্রদের এক সমাবেশে বক্তৃতায় ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ বলে ঘােষণা করেন। তখন কার্জন হলের ভিতরে নােয়াখালীর তােয়াহার নেতৃত্বে ছাত্ররা বারবার নাে নাে ধ্বনি দেন। যেহেতু ফজলুল হক হলের কাছে কার্জন হল তাই ফজলুল হক হলের ছাত্ররাই কার্জন হলের সীমাবদ্ধ সিট দখল করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা হলের বাইরে থেকেই স্লোগান দেই। এই সমাবেশে জিন্নাহ সাহেব বিব্রত বােধ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ একা আন্দোলন চালাতে পারেনি। যদিও এ আন্দোলনে ছাত্ররা নেতৃত্ব দিয়েছিলাে। এ কারণে তৎকালীন মুসলিম লীগবিরােধী জননেতারাও এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব দেন। তখন অলি আহাদও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্র নেতাদের সহযােগিতায় ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চ সারা পূর্ব-বাংলায় রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি দিবস পালন করেন। এই আন্দোলনের সময় আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটির অন্যতম সদস্য। বৃহত্তর খুলনায় ১১ই মার্চ যাতে পালন হয়, সেজন্য আমি সেখানে যাই। খুলনাতে সবুর খান ও সরকারের দাপটে ছাত্ররা কোনক্রমেই ১১ই মার্চ দিবস পালন করতে পারেনি। আমি অনেক চেষ্টা করেও খুলনাতে এই দিবস পালন করতে ব্যর্থ হই। কারণ সবুর সাহেব তখন তার নিজস্ব বাহিনী দিয়ে যখন-তখন বিরােধী ছাত্রদের মারধর করার হুমকি দিতেন। খুলনার সাথে সাতক্ষীরার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন ছিল। আমরা ট্রেনে চড়ে ৯০ মাইল কলকাতা কিন্তু সাতক্ষীরা ছিল খুলনা থেকে ১২০ মাইল। যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় সেখানে যেতে পারতাম না। ১১ই মার্চ পালনের জন্য সাতক্ষীরাও যেতে পারলাম না। তাই আমার হােম সাবডিভিশন বাগেরহাটে গিয়ে ১১ই মার্চ বাংলা রাষ্ট্রভাষা দাবি দিবস জাঁকজমকের সাথে পালন করার ব্যবস্থা করেছিলাম। ঐদিন শহরে বিরাট ছাত্র জনসভা হয়েছিল। আমি প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তৃতা করতে ওঠার পূর্ব মুহূর্তে ঐ সভা থেকে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে বাগেরহাট থানায় নিয়ে আটক করে। এক ঘন্টা পরে আমাকে ছেড়ে দেয়। সন্ধ্যার একটু আগে এসে নির্ধারিত সভায় বক্তৃতা করি। পরদিন জানতে পারি ঢাকাতেও অনেক ছাত্রনেতাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানাে হয়েছে। গ্রেফতারকৃতদের সবার নাম আমার মনে নেই। বঙ্গবন্ধু ও তােয়াহার নাম শুধু স্মরণে আছে। ৫/৬ দিন জেলে রেখে তাদের মুক্তি দেয়া হয়। খাজা নাজিমুদ্দীন তখন মুখ্যমন্ত্রী। আটককৃত ছাত্রনেতাদের সঙ্গে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে তাদের জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। ছাত্রনেতাদের মুক্তির পর মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি মেনে নেন। আবার তিনি পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবির বিরােধিতাও করেন। হাতে গােনা কয়েকজন পূর্ব বাংলার মুসলমান এমএলএ রাষ্ট্রভাষা বাংলার সমর্থন করেন। মুসলমানদের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে হিন্দু এমএলরাও নির্বাক ছিলেন। যেহেতু তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্বপাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরােধিতা করেছে এই কারণে তাদেরকে দালাল ছাত্রলীগ বলা হতাে। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৮ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরাই পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ফজলুল হক হলে। মুসলিম ছাত্রলীগের অবস্থা প্রথম দিকে স্বনির্ভর না থাকায় মুসলিম লীগবিরােধী নেতারা বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে প্রচুর সহায়তা করেছেন। তাদের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব, নােয়াখালীর আজিজ আহমদ সাহেব।
১৯৪৮ সালের পর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ব্যাহত হয়। ধীর গতিতে আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৫১ সালের শেষের দিক থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলনের অনুকূলে ছাত্রজনতার মধ্যে মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠিত করার দাবি তীব্রতর হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগে জাতীয় পর্যায়ে পূর্ব থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারকে রাজনৈতিকভাবে ধাক্কা দেয়ার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। এভাবে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ছাত্রদের ভিতরে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ফলে ব্যাপক গণজাগরণ সৃষ্টি হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারির পূর্বে ছাত্র, শিক্ষক এবং মুসলিম লীগবিরােধী নেতা-কর্মীদের মধ্যে মতবিনিময়ের মাধ্যমে তৎকালীন সরকারকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবি মেনে নেয়ার জন্য রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে সক্রিয় একটি মাত্র রাজনৈতিক দল ছিলাে পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ দলমত নির্বিশেষে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতাদের বুদ্ধি-পরামর্শে আলােচনা করতাে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সম্পাদক শামসুল হক সাহেব, সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান, এলএমএ আনােয়ারা খাতুন প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সহযােগিতা নেয়া হয়েছিলাে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করার জন্য।
১৯৫০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নিম্ন বেতনভােগী কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার কারণে ২ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়েছিলাে। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা দাবির কর্মসূচি পালনের পূর্বে বঙ্গবন্ধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বন্দি হিসেবে চিকিৎসাধীন। ছিলেন। তখন বঙ্গবন্ধু এই হাসপাতালে থাকা অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র নেতা ও অন্যান্যদের ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য তাদের সংগঠিত করেন এবং যােগাযােগ অব্যাহত রাখেন। সরকারের গােয়েন্দারা এ খবর পেয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারির কিছুদিন আগেই বঙ্গবন্ধুকে ফরিদপুর। জেলে স্থানান্তরিত করে যাতে তিনি ছাত্রদের সাথে ২১শে ফেব্রুয়ারির ব্যাপারে আর কোনাে যােগাযােগ রাখতে না পারেন।
১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির কিছুদিন পূর্বে বাংলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। তখন ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ থেকে বরিশালের কাজী গােলাম মাহবুবকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত করা। হয়। কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক নির্বাচিত করার পূর্বে তৎকালীন ইকবাল হলে যে বৈঠক হয় তাতে আমি উপস্থিত ছিলাম এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন সম্পাদক শামসুল হক সাহেবও উপস্থিত ছিলেন। আমি এবং শামসুল হক পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কমিটির সদস্য। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনের সময় নূরুল। আমীন সাহেব তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মুখ্য মন্ত্রী ছিলেন। পূর্ববঙ্গের নাম আমি ব্যবহার করছি এই কারণে যে, ১৯৫৬ সালে পূর্ববঙ্গ নাম বদল করে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বকার কলাভবন থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মিছিল বের করার কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঢাকার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় কলাভবনে মিছিলে অংশগ্রহণের জন্য আহ্বান জানানাে হয়। এই সংবাদ পেয়ে সরকার মিছিল নিষিদ্ধ করার জন্য ১৪৪ ধারা জারী করে। তখন সংগ্রাম পরিষদ অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানাের জন্য ৫-এর অনধিক বা ৫-এর অধিক লােক একসাথে জড়াে না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গে গ্রেফতার এড়ানাের জন্য সিদ্ধান্ত হয়। যে, ৫-এর কম সংখ্যক ছাত্র বা ছাত্রী একত্রে গ্রুপ করে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদ এসেম্বলী হল জগন্নাথ হলের দিকে আসার প্রস্তুতি নেয়। আমি তখন এই মিছিলে যােগদানের জন্য কার্জন হলের দিক থেকে তখনকার মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের বর্তমান শহীদ মিনারের দিকে আসতে থাকি। আমি এমএ পাশ করে ল-এর ছাত্র তখন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠের পশ্চিম পাশে ইলেকট্রিক জেনারেটরের কোনায় যখন পৌছি তখন দেখি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহ আল বাকী সাহেব গাড়ীতে করে এসেম্বলী হলের দিকে যাচ্ছেন। তখন কয়েকজন ছাত্র রাস্তার মাঝখানে তার গাড়ি থামিয়ে গাড়ির চাকার পাম্প ছেড়ে দেয়ে। বর্তমান শহীদ মিনারের উল্টো দিকে রাস্তার মাঝখানে এই ঘটনা ঘটে। আমি রাস্তা পার হয়ে বর্তমান শহীদ মিনার তখনকার মেডিকেল ছাত্র হােস্টেলের দিকে যাচ্ছিলাম। তখন ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলি করে। এ সময় মেডিকেল হােস্টেলের তার ঘেরার মধ্যে আমি প্রবেশ করি এবং সেখানে বহু ছাত্রের জমায়েত ছিল। আমি ঢুকেই দেখি মস্তকবিহীন একটা লাশ পড়ে আছে। তার মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে মগজঘিলু সব বের হয়ে গেছে। তার গায়ের রং ছিলাে কালাে, সুঠাম দেহ। ২৫/২৬ বৎসর বয়স। আমি বুঝতে পারিনি যে এটা গুলির শব্দ। পটকার শব্দ ধারণা করে রাস্তা পার হয়ে দৌড়ে গিয়ে মেডিকেল কলেজ ছাত্র হােস্টেলে তার ঘেরা স্থানে ঢুকলাম। এই ঘটনার কিছু পরে হােস্টেলের পাশে বটগাছে মাইক বাধার ব্যবস্থা করা হলাে। ঐ মাইক থেকে ছাত্ররা যে যা পারে ২১শে ফেব্রুয়ারির শহীদদের হত্যার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করতে শুরু করে। ছাত্রদের ওপর গুলির প্রতিবাদে সেদিন আমিও কিছু বক্তব্য রেখেছিলাম। এই সময় মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এমএলএ। এসেম্বলী থেকে ছাত্রদের গুলির প্রতিবাদে বের হয়ে আসেন। তিনি বটগাছে বাঁধা মাইক থেকে ছাত্র হত্যার বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা করতে শুরু করেন।
তখন পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের অধিবেশন চলছিল। মুসলমান ৩/৪ জন এমএলএ বাদে সবাই আইন পরিষদে বসে ছিলেন। কংগ্রেস-এর সব হিন্দু সদস্য ছাত্রদের ওপর গুলির প্রতিবাদে এসেম্বলী বর্জন করেন। ৪ জনের লাশ দেখতে পাই। তাদের কাউকে চেনার মতাে চিহ্ন ছিল না। দেহ ছিল রক্তে রঞ্জিত। আমি এবং আমার বন্ধু ছাত্রলীগ নেতা আহসান উল্লাহ। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্রনেতা নূরুল হুদাসহ আরও কয়েকজনের চেষ্টায় তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাদের উপর মাইক বেঁধে ছাত্রদের ওপর গুলির প্রতিবাদে বক্তৃতা করতে থাকি। তখন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আইন পরিষদের এসেম্বলী হলের উল্টা দিকে ছিলাে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্ররা হলে মাইক ফিট করে পাল্টা সরকারের মতাে কার্যকলাপ চালাতে থাকে ২২শে ফেব্রুয়ারি দিনগত রাত পর্যন্ত। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরে এক ঐতিহাসিক মিছিল বের হয়। সমগ্র ঢাকার মানুষ ঘর ছেড়ে মিছিলে যােগ দেয়। ঢাকার রাস্তা-ঘাট, বাড়ি-ঘর কালাে পতাকায় ছেয়ে যায়।
২২শে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক প্রতিবাদ মিছিলে নেতৃত্ব দেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হক সাহেবসহ অনেকে। একজন নগণ্য রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে আমারও এই মিছিলে যােগদান করার সৌভাগ্য হয়েছিল। ২২শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার একটু আগে শহীদদের লাশ পুলিশ নিয়ে গেলাে। ছাত্ররা লাশ নিয়ে মিছিল করতে পারলাে না। ২২শে ফেব্রুয়ারি [২৩ শে ফেব্রুয়ারি) রাতে যেখানে এখন শহীদ মিনার এর কাছাকাছি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভাষা সৈনিকসহ অন্যান্যরা সম্মিলিতভাবে রাতের ভিতরেই শহীদদের স্মৃতিতে একটি শহীদ মিনার গড়ে তােলেন। মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের ভিতরে ইট, বালি, সিমেন্ট ছিলাে, তা দিয়েই শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। আমরাও রাজমিস্ত্রী-শ্রমিকের মত ভূমিকা পালন করছিলাম। নওগাঁ বা রাজশাহীর অধিবাসী ঢাকা মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত ছাত্র ডাঃ মঞ্জু এই শহীদ মিনার গড়ায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদান অনেক অনেক বেশি। তিনি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। অনেক ভাষাসৈনিকের নাম শুনি কিন্তু ডাঃ মঞ্জুর নাম তেমন শুনি না। ২২শে ফেব্রুয়ারি [২৩শে ফেব্রুয়ারি) রাতে নির্মিত শহীদ মিনার ২৩শে ফেব্রুয়ারি (২৫ শে ফেব্রুয়ারি) রাতে শাবল দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়। মিনার যখন তারা ভাঙ্গতে পারছিল না তখন মিনারের চূড়ায় মােটা শিকল বেঁধে টেনে শাবল দিয়ে ভেঙ্গে ফেলা হয়। ছাত্র নেতা-কর্মী অনেকেই গ্রেফতার হলেন। আমি গ্রেফতার এড়িয়ে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বরিশালের শামসুল হক চৌধুরীকে সাথে নিয়ে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাই। নারায়ণগঞ্জ থেকে নৌকায় শরিয়তপুরের ডামুড্যায় যাই। ডামুড্যা থেকে স্টিমারে উঠে মাদারীপুর শহরে যাই। মাদারীপুর থেকে আমরা গােপালগঞ্জ যাত্রা করি। আমি পথে জলির পাড়ে নামি। নেমে দেখি রাস্তায় রাস্তায় মিছিল চলছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সমগ্র দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়লাে। শামসুল হক নৌ-পথে পিরােজপুর যাবার পথে। টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে যান। আমি অন্য পথে খুলনার দিকে যাই। ২১শে ফেব্রুয়ারি সমগ্র বাঙালি জাতি এই আন্দোলন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সমগ্র বাঙালি জাতিকে আমি ভাষাসৈনিক মনে করি।’
সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম