বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৪শে জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১০ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
রক্তঝরা চব্বিশে জানুয়ারী
আজ চব্বিশে জানুয়ারী। গণ-অভ্যুত্থান দিবস। রক্তলেখা এদিন সংগ্রামের ইতিহাসে চির উজ্জল, চির অম্লান। ঊনসত্তরের ২৪শে জানুয়ারী। উত্তাল এদিন। উন্মত্ত জনসমুদ্র। প্রতিবাদ প্রত্যয়ে সোচ্চার বাংলার মানুষ। ঔপনিবেশিক শাসনের স্বৈরাচারী শোষকের ভিত কেঁপে উঠেছিল সংগ্রামী ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-জনতার প্রত্যয়দীপ্ত সংগ্রামে। আর তার সাথে সাথে স্বৈরাচারী উপনিবেশবাদী শাসকরাও হয়ে পড়লো দিশেহারা। ওদের অত্যাচার আর নির্যাতনের চরম পর্যায় শুরু হলো সোনার বাংলার শ্যামল প্রান্তরে। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার আর স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে উদ্দীপ্ত হলো বাঙালী জাতি। উপনিবেশবাদের নির্যাতন তাদের ঠেলে দিল স্বাধীনতার পথে। কিন্তু স্বাধীনতা তো রক্ত দেয়া ছাড়া আসে না। তাই নবতর পর্যায়ে সেই রক্তদানের উদ্বোধন করলেন ঢাকার বুকে নবকুমার ইন্সটিটিউটের ছাত্র দারিদ্র্যপীড়িত পিতামাতার এক সন্তান শহীদ মতিউর রহমান।
বায়ান্নতে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার বীজ সত্যিকার অর্থে রোপিত হয়েছিল। বিভিন্ন প্রকার আন্দোলনের ঘটনাকে উপেক্ষা করে স্বাধীনতা সংগ্রামের সাফল্য যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি সম্ভব হয়নি অতীতের আন্দোলন ছাড়া গোটা জাতিকে সংঘবদ্ধ করা। ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক আন্দোলনই গোটা জাতিকে সংঘবদ্ধ করে প্রত্যক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামের সোপানে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন প্রতিবাদের ভাষায় গোটা দেশ মুখরিত হয়ে উঠেছিল। এদেশের সব ক’টি রাজনৈতিক দল ও ছাত্র প্রতিষ্ঠান সেদিন আইয়ুব খাঁ ও তার দলের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ডাক দিয়েছিল এ হরতালের। সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক আইয়ুব খাঁ সেদিন প্রথম বুঝতে পেরেছিল বাংলাদেশ এখন সম্পূর্ণ এক ও অভিন্নমত তার বিরুদ্ধে। ২৪শে জানুয়ারীর হরতালে সারা বাংলাদেশ বন্ধ হয়েছিল। ঢাকা সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মিছিলের উপর আইয়ুব শাহীর বর্বর সেনারা গুলি চালিয়েছিল। বাংলাদেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার এই দিনই তাই মতিউরের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে অনেকখানি বিখ্যাত। গণআন্দোলনের শুরুতেই আসাদ শহীদ হন এবং সেই থেকে আন্দোলন একটি ব্যাপক রূপ পরিগ্রহ করে। ইতিমধ্যে ছাত্র সংগঠনগুলো দলমতের উর্ধে উঠে ব্যাপক আন্দোলনের কর্মসূচী ঐতিহাসিক এগারো দফা দাবী পেশ করেন। মূলতঃ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এই এগারো দফা দাবীর উপর ভিত্তি করেই পরিচালিত হয়।
বস্তুতঃপক্ষে এগারো দফার মূল বিষয়ের মধ্যেই ছিল ছয় দফা। বাংলাদেশের বাঁচা-মরার দাবী ছিল সেদিনের ছয় দফা। গোটা জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার সুস্পষ্ট প্রতিধ্বনি ছিল ছয় দফাতে। এই ছয় দফা এগারো দফার মধ্যে সন্নিবেশিত হওয়াতেই ঊনসত্তরের আন্দোলনকে আরো বেশী ব্যাপক রূপ দেয়া সম্ভব হয়েছিল। এছাড়া এগারো দফার অন্য যে প্রধান দফা তা হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের। মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবী সেদিন গণআন্দোলনের অন্যতম প্রধান দাবী ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সময় বাংলার অসহায় মানুষের একমাত্র কণ্ঠস্বর। তাঁকে বন্দী করে রেখে এদেশের দাবী উত্থাপনের পথ রুদ্ধ করা আইয়ুবী চক্রের পক্ষে আর সম্ভব হয়নি। ঊনসত্তরের আন্দোলনই আমাদের পরবর্তীকালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সুস্পষ্ট কাঠামো তৈরী করে দিয়েছিল। গোটা জাতিকে একটি মাত্র আদর্শে উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব হয়েছিল—হয় মুক্তি, না হয় মৃত্যু। মুক্তির জন্যে মৃত্যুর শপথ নিয়ে সেদিন জাতির কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল ‘জাগো জাগো বাঙালী জাগো’ ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ’ ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ শ্লোগান। এই শ্লোগান চিরজনম বাঙালী জাতিকে উজ্জীবিত করবে। চব্বিশে জানুয়ারী তাই অমর।
স্কুলগুলোতে ভর্তি সমস্যা নিদারুণ হয়েছে
দেশের স্কুলগুলোতে নাকি ভর্তি সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। এক সংবাদে প্রকাশ, ঢাকা শহরে এই সমস্যা আরো নিদারুণ হওয়ায় অভিভাবকরা উদ্বেগাকুল হয়ে উঠেছেন। ঢাকা শহরের কয়েকটি স্কুলের উপর চাপ বেশী পড়েছে। কারণ, শহরের বেশীর ভাগ স্কুলের শিক্ষাদানের মান নিতান্তই দুঃখজনক। তা’ছাড়া শিক্ষণীয় পরিবেশের অভাবও রয়েছে। ঢাকার যে স্কুলগুলো মডেল স্কুল হিসেবে পরিচিত সে সকল স্কুলেই ভর্তির চাপ বেশী পড়েছে। অভিভাবকরা তাদের ছেলেদের যেহেতু ভালোভাবে পড়াশোনা করাতে চান সেহেতু মডেল বা ভালো স্কুলের প্রতিই তাঁদের বেশী ঝোঁক। ঢাকার একটি সহযোগী এক সংবাদ পরিবেশন করতে গিয়ে তথ্য সহ বলেছেন—মোহাম্মদপুর আবাসিক মডেল স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে তিরিশটি আসনের জন্যে ছয় শতাধিক ছাত্র ভর্তি-পরীক্ষা দিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ল্যাবরেটরী হাই স্কুলে শুধু কে-জি শ্রেণীতে ষাটটি আসনের জন্য দুইশত একত্রিশ জন ভর্তির আবেদন করেছে। সরকারী ল্যাবরেটরী হাই স্কুলে চারটি শ্রেণীতে আটষট্টিটি আসনের জন্যে এক হাজার পঁচিশ জন ছাত্র ভর্তির আবেদন করেছে। সংবাদে আরো বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর নাকি ঢাকা শহরের স্কুরের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে সেক্ষেত্রে ছাত্র সংখ্যা অত্যাধিক বৃদ্ধি পেয়েছে। এদিকে আদর্শ স্কুলগুলোর বেতনের কোনো নির্দিষ্ট হার নেই ফলে যে স্কুল যেমন পারছে বেতন বৃদ্ধি করছে। জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার উদয়ন স্কুলের অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতি মাসে পঁচিশ টাকা বেতন ধার্য করা হয়েছে। অগ্রণী বালিকা বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত মাসিক বেতন পনেরো টাকা এবং বার্ষিক ফি পঞ্চাশ টাকা। এমনিভাবে বিভিন্ন স্কুলের কর্তৃপক্ষ যেমন ইচ্ছা তেমন বেতন ধার্য করে চলেছেন। অভিভাবক ও শিক্ষকবৃন্দ মনে করছেন যে, দেশের প্রত্যেক স্কুল পরিচালনার ব্যাপারে সরকারের একটি সুস্পষ্ট নীতি অবলম্বন করা উচিত। এবং শিক্ষাকে সার্বজনীন করে তোলার জন্যে সরকারের আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া উচিত।
এদিকে অন্য একটি সংবাদে জানা গেছে যে, ঢাকার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলগুলোতে এবার ভর্তির সংখ্যা বাড়ানো হবে তাতে করে প্রায় পনেরো হাজার সিট সংখ্যাও বাড়তে পারে। সরকার এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই চিন্তা করেছেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চলেছেন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই এ ধরনের ভর্তি সমস্যা প্রকট বলে আমাদের বিশ্বাস। স্কুলের সংখ্যা কিছু হ্রাস পেয়েছে সত্য কিন্তু নতুন স্কুলের জন্মও হয়েছে অনেক। সর্বোপরি বৃদ্ধি পেয়েছে ছাত্র সংখ্যা। এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সার্বজনীন ও উন্মুক্ত করার জন্য সরকারকে অবশ্যই ভর্তি সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। এবং স্কুলগুলোর অন্যান্য আনুষঙ্গিক অসুবিধারও সমাপ্তি ঘটাতে হবে।
পাটচাষীকে ন্যায্যমূল্য দিতে হলে
গত মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে কতিপয় সদস্যের প্রশ্নোত্তরদানকালে পাটমন্ত্রী জনাব শামসুল হক বলেন, আমাদের চির শোষিত পাটচাষীরা যাতে তাদের উৎপাদিত পাটের ন্যায্যমূল্য পায়, সেজন্যে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
সরকার এ সম্পর্কে ঠিক কতটুকু তৎপর তা সদস্যদের অবহিত করার প্রসঙ্গে মন্ত্রী মহোদয় জানান যে, সরকার নির্ধারিত মূল্যের কম মূল্যে চাষীর কাছ থেকে পাট কেনার দায়ে গত ১৫ই ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৪২ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
নিঃসন্দেহে মন্ত্রী মহোদয়ের এ তথ্য প্রকাশ দেশবাসীর কাছে সর্বান্তঃকরণে গৃহীত বা সমাদৃত হবার যোগ্যতা রাখে। কারণ, এ যাবত পাটচাষীর নানান দুঃখ দুর্দশা ও টাউট ফড়িয়াদের হাতে তাদের শোষিত হবার অনেক কথা ও কাহিনী সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রতিফলিত হয়ে চাষীকূল সম্পর্কে দেশবাসীকে রীতিমতো উদ্বিগ্নই করে তুলেছিল। সেক্ষেত্রে মন্ত্রী মহোদয়ের এ ঘোষণা নিশ্চিতভাবেই চাষীকূল তথা দেশবাসীকে ভবিষ্যত সম্পর্কে এক নিশ্চিত আশ্বাস দিতে সক্ষম।
কিন্তু কথা হচ্ছে সরকারের এ সজাগতা বা উদ্যম ঠিক কতোদিন থাকবে বা আগামীতে পাটচাষীর আজন্মের দুঃখই বা কতটুকু মোচন হবে, সেটাই আজকে একটু ভেবে দেখা প্রয়োজন।
কারণ, অতীতে অনেকবার দেখা গেছে যে, দেশবাসীর অভিযোগ ও চাপের মুখে সরকার অনেক সময়ে অনেক বিষয়ে বেশ উদ্যম ও তৎপরতা দেখিয়েছেন, কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সে উদ্যম বা তৎপরতা আর প্রারম্ভের মতো পরবর্তীকালে থাকেনি।
অবশ্য, আমরা বলছিনা যে, পাটচাষীর ন্যায্যমূল্য পাবার বিষয়ে সরকারের এ বর্তমান উদ্যোগ বা তৎপরতায় কোনো আন্তরিকতার অভাব, কিম্বা সরকার আমাদের কোনো অলীক আশ্বাস দিচ্ছেন। বরং আমাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে যে, আমাদের দুঃখিত ও শোষিত পাটচাষীদের ঠকানোর চেষ্টা করলে আগামীতেও যাতে এ কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দৃষ্টান্তমূলকভাবে প্রতিপালিত হয়, সেদিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে।
আবার শুধুমাত্র পাটের ন্যায্যমূল্য বেঁধে দিলেই প্রকৃতভাবে পাটচাষীর দুঃখ মোচন করা সম্ভব হবেনা।
এ জন্যে পাট ক্ষেত বা কৃষকের ঘরের ত্রিসীমানার মধ্যে কোনো টাউট ফড়িয়া যাতে আনাগোনা করতে না পারে, কিম্বা কৃষক যাতে তাদের চক্রান্তের শিকার না হয়, সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি দিয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বিশেষ করে, পাটক্রয় কেন্দ্রগুলোকে সর্বতোভাবে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে হবে। পাটের ক্ষেত্র বা কৃষকের ঘর থেকে উৎপাদিত পাট যাতে বাঁধাবিহীনভাবে সোজা সরকারী পাটকেন্দ্রে পৌঁছুতে পারে, সেজন্যে যাবতীয় ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক