You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.01.23 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে মহিলা সমাজ | সহিষ্ণুতাই গণতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৩শে জানুয়ারী, বুধবার, ১৯৭৪, ৯ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে মহিলা সমাজ

বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল প্রকার সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত হয়ে দেশ গড়ার কাজে মহিলা সমাজকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বিগত পঁচিশ বছর ধরে আওয়ামী লীগের সংগ্রামে এবং গত স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মহিলাদের ভূমিকার ভূয়শী প্রশংসা করে তিনি এদেশের নারী সমাজের প্রতি গভীর আস্থা ও শ্রদ্ধা রাখেন।
এই সম্মেলনে ভাষণ দানকালে বঙ্গবন্ধু নারী শিক্ষার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং জাতীয় উন্নয়নমূলক কর্মসূচীতে নারীদের একটি বিরাট অংশকে সক্রিয় অংশ নেবার পক্ষে মন্তব্য রাখেন। তিনি মহিলাদের রাজনৈতিকভাবে সুসংগঠিত করার উপরও গুরুত্ব আরোপ করেন। এবং তারই প্রেক্ষিতে এখন মোট কাউন্সিলরদের মধ্যে শতকরা ১০ ভাগ মহিলা কমীর আসন সংরক্ষিত রাখার কথাও ঘোষণা করা হয়েছে।
এই অধিবেশনে সম্পাদিকার ভাষণেও কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য ও পর্যবেক্ষণমূলক তত্ত্ব পাওয়া যায়। সম্পাদিকা তার ভাষণে বলেন যে, বাংলার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের ভিতরে ও বাইরে ব্যাপক হারে ছাত্রী, গৃহিণী, কৃষাণী সকলেই নিজ নিজ পন্থায় শত্রুর মোকাবেলা করেছিল। বর্তমানে জাতীয় ইতিহাস রচনার প্রস্তুতি চলছে এবং এই সময় বাংলাদেশ মহিলাদের সৃষ্ট সেই সকল ইতিহাসকে উদ্ধার করে ভবিষ্যত বংশধরদের জন্যে তা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা একটা পবিত্র কর্তব্য।
সম্পাদিকা আরও বলেন যে, বিধ্বস্ত বাংলাদেশের নারী সমাজের কঠিন সমস্যা সমাধানকল্পে যে ‘জাতীয় নারী পুনর্বাসন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয় তার লক্ষ্য ছিল বহুমুখী। এই বোর্ডের দায়িত্বে নারী পুনর্বাসনের কাজ ছাড়াও নারীদেরকে বিভিন্ন কারিগরী শিক্ষায় শিক্ষিত করে দেশ গড়ার কাজে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এবং আত্মনির্ভরশীল নারী সমাজ গঠন করার কাজ চলছে। এই সকল পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার জন্যে বোর্ড বহু প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং মহিলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় নানা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে।
সাংগঠনিক সাফল্যের কথা উল্লেখ করতে গিয়ে সম্পাদিকা আরও বলেন যে, গত দেড় বছরে মহিলা আওয়ামী লীগের নির্দেশে বিভিন্ন জেলা কমিটি প্রচুর মহিলা সদস্য সংগ্রহ করা সহ সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন, সেলাই কেন্দ্র স্থাপন, দুর্গতদের সাহায্য বিতরণ, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিভিন্ন জাতীয় দিবস উদযাপন, আওয়ামী লীগের নির্দেশে গণ-মিছিল, জনসভার মাধ্যমে জনমত গঠন এবং গত নির্বাচনে দলীয় প্রচারকার্যে অংশ গ্রহণ করে স্ব স্ব ক্ষেত্রে নিজের সুষ্ঠু দায়িত্বজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন।
তিনি এ কথাও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের বৃহত্তর নারী সমাজ এখনো শৃঙ্খলিত। তাই সমানাধিকারের প্রশ্নেও এখন বহু বাঁধা। সেই প্রসঙ্গেই বলা যায়—বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও প্রত্যেকটি অফিসে মহিলাদের জন্যে শতকরা ১০ ভাগ আসন সংরক্ষণের ব্যাপারটি আজও বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ বাংলাদেশে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিতা হবার মতো এখন অনেক উচ্চ শিক্ষিতা অভিজ্ঞা মহিলা আছে।
আর শুধু তাই নয়—এবারের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মহিলা শাখার সংবিধানে মহিলাদের সমানাধিকারের প্রশ্নে সম্পত্তির বন্টনের দিকেও অঙ্গুলি সংকেত করে অবিলম্বে সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়নের দাবী জানানো হয়। নিঃসন্দেহে এ প্রস্তাব প্রশংসার্হ ও পালনীয় বলেই নারী সমাজের ধারণা।
প্রস্তাবে আরও বলা হয় যে, এক বিবাহ এবং সন্তানের স্বার্থরক্ষার ভিত্তিতেই আইনের মাধ্যমে বহু বিবাহ, যৌতুক প্রথা ইত্যাদি নিষিদ্ধ করে দিতে হবে। তাছাড়া বিবাহ বিচ্ছেদের ব্যাপারে মহিলাদের ও অধিকার পুরুষদের সমান থাকবে এবং আগামী নির্বাচনে মহিলাদের প্রত্যক্ষ নির্বাচন দিতে হবে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে স্বাবলম্বিতার মানসিকতা সুপরিস্ফুট।
এবারের মহিলা আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের গুরুত্ব এবং তার উপর ভিত্তি করে কুসংস্কারমুক্ত নারীসমাজ গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুর যে আহ্বান তা সামনে রেখে আজ আমাদের পথ চলতে হবে। বর্তমান সমাজের দুর্নীতি দূরকরণ প্রসঙ্গেও বঙ্গবন্ধু মহিলা সমাজের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন যে, তারা স্বামী, ভাই বা অন্য আত্মীয়-স্বজনের অসৎ উপায়ে অর্জিত অর্থকে ঘৃণা করে সে ঘৃণ্য কাজ থেকে তাদের নিবৃত্ত করতে পারেন। এর অবশ্যই একটা মহৎ প্রভাব সমাজে পড়বে বলে আমাদেরও বিশ্বাস। অধিবেশনের গুরুত্ব এবং তার উপর ভিত্তি করে কুসংস্কারমুক্ত নারীসমাজ গঠনের জন্যে বঙ্গবন্ধুর যে আহ্বান তা সামনে রেখে আজ আমাদের পথ চলতে হবে। বন্ধুর এ পথে বাঁধা যতই আসুক আত্মবিশ্বাস, কর্মনিষ্ঠা ও সংগ্রামী শপথ নিয়ে মহিলাদের এগিয়ে প্রেরণায় আজ সমগ্র বাঙালী সমাজ উদ্বুদ্ধ হোক।
পরিশেষে, বন্ধুর এ পথে বাঁধা যতই আসুক আত্মবিশ্বাস, কর্মনিষ্ঠা ও সংগ্রামী শপথ নিয়ে মহিলারা আজ সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে চলার নির্দশন রাখুক এবং জাতীয় উন্নয়নকে সামগ্রিকভাবে সহযোগিতা দিক—এই আমাদের কামনা।

সহিষ্ণুতাই গণতান্ত্রিক দর্শনের ভিত্তি

গত পরশু বাংলাদেশ দর্শন সমিতির প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে গিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদউল্লাহ বলেছেন, গণতান্ত্রিক জীবন পদ্ধতির ভিত্তি হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক দর্শন হচ্ছে অধিকার চেতনার উপর দায়িত্ববোধের প্রতিষ্ঠা এবং জনমতের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধার সাথে গঠনমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক আচার আচরণ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আরো বলেছেন, আজকের দুনিয়ার প্রকৃত দর্শনের লক্ষ্য হবে গঠনমূলক সহঅবস্থান ও পারস্পরিক শুভচিন্তা বিনিময়। জনাব মোহাম্মদউল্লাহ আজকের অশান্ত দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বমানবতাবোধের ইমারত তৈরীর জন্যে দার্শনিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রীয় মৌলনীতি চতুষ্টয়ের বাস্তব রূপায়ণের জন্যে দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের প্রতি সুনির্দিষ্ট পথ-নির্দেশিকা তৈরী করে তা জনগণের মন ও মননে প্রতিষ্ঠিত করারও আহ্বান জানান।
বাংলাদেশ দর্শন সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে দর্শন চিন্তার ব্যাপকতা সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তা বিভিন্ন বক্তব্য প্রকাশ করেছেন। দেশের একজন প্রখ্যাত দার্শনিক অভিমত দিয়েছেন যে, নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও এটাই এ যুগের দার্শনিক চিন্তা হিসেবে সমাদর লাভ করেছে।
বাংলাদেশ দর্শন সমিতির বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে প্রদত্ত এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, দার্শনিকরা সমাজতন্ত্র কায়েমের দৃঢ় মানসিকতা সৃষ্টি করে সোনার বাংলা গড়ার কাজে যেন সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধু আরো বলেছেন, কেবলমাত্র পুঁথিগত সীমিত দর্শন চিন্তা আমাদের জীবনে, সমাজ গঠনে, মানবতার সেবা ও কল্যাণ সাধনের মানসিকতা সৃষ্টি করতে পারে না।
সমাজে দার্শনিকদের একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। আমাদের দার্শনিকরা তাদের কর্তব্য ও দায়িত্ব কতোটুকু প্রতিপালন করছেন, সে বিচার আমরা করবো না। তবে দেশে যদি গণতান্ত্রিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটাতে হয়, কিংবা সমাজতান্ত্রিক দর্শনকে বাস্তবায়িত করতে হয়, তাহলে পরমতসহিষ্ণুতাকে অবশ্যই প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, গণতান্ত্রিক জীবনের মূলধারাই হচ্ছে পরমতসহিষ্ণুতা, অধিকার চেতনার উপর দায়িত্ববোধের প্রতিষ্ঠা এবং জনমতের প্রতি অবিচল শ্রদ্ধার সাথে গঠনমূলক ও নিয়মতান্ত্রিক আচার আচরণ। কাজেই গণতন্ত্রের মৌলশর্তগুলোকে অবশ্যই মান্য করতে হবে। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা কি কোনো কোনো রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দেখাচ্ছে? গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে কেউ কোনো দিন ‘সশস্ত্র বিপ্লবে’র ডাক দিতেও যে পারতো না, তাও আমরা অবগত আছি। দেশের আইন শৃঙ্খলা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব শুধু সরকারের নয়—রাজনৈতিক দলেরও। সে জন্যই গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র মুখের বলি হিসেবেই কপচালে চলবে না, গণতন্ত্রের যাবতীয় রীতিনীতিকে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। দেশে সত্যিকার গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির ব্যাপারে দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের ভূমিকাও একেবারে ফেলনা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার বিরোধিতা করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক অধিকারকে ভ্রান্তপথে পরিচালিত করলেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি লংঘিত হতে বাধ্য। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকার এবং বিরোধী দলগুলোর সম-অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছেন। এই দু’টি পক্ষের একটি পক্ষ যদি কোনো কারণে নীতিচ্যূত হয়ে যায় তাহলে গণতন্ত্রের মৃত্যু পরোয়ানা বেজে যেতে বিলম্ব হয়না। বাংলাদেশ দর্শন সমিতির প্রথম বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি গণতান্ত্রিক দর্শনকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য পরমতসহিষ্ণুতার যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা খুবই অর্থপূর্ণ। দর্শন সমিতির সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু যে বাণী দিয়েছেন, তাতেও দার্শনিকদের কর্তব্যের প্রতি অঙ্গুলি সংকেত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু জাতীয় আদর্শ বাস্তবায়নের ব্যাপারে দার্শনিকদের ভূমিকা যথাযথভাবে তাও অক্ষরে অক্ষরে পালিত হওয়া একান্ত দরকার বলে আমরা মনে করি। গণতান্ত্রিক পরিবেশকে ক্লেদাক্ত করে কোনো দিনই আমরা সুখী, সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী জাতি হিসেবে গড়ে উঠতে পারবোনা। দার্শনিকরা যদি তাঁদের ভূমিকা বিস্মৃত না হন, তাহলেই গণতন্ত্রের ভিত্তি সুদৃঢ় হওয়ার সহায়ক পরিবেশ গড়ে উঠবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন