You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.02.03 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | নদীপথে হিংস্র জলদস্যুতা রোধ করুন | ভোজ্য তেল নিয়ে ভোগান্তি | বল মা তারা দাঁড়াই কোথা! | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩রা ফেব্রুয়ারী, রোববার, ২০শে মাঘ, ১৩৮০

নদীপথে হিংস্র জলদস্যুতা রোধ করুন

মাত্র কয়েকদিন আগে আমরা নদীবক্ষে জলদস্যুদের উৎপাতের কথা লিখেছি। কলমের কালি শুকোতে না শুকোতেই গত শুক্রবার প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে দশ এগারোটি লঞ্চে প্রকাশ্য দিবালোকে স্মরণাতীতকালের ভয়াবহ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে এবং এসব যাত্রীবাহী লঞ্চ গুলো থেকে প্রায় বারো লক্ষ টাকার মালামাল জলদস্যুরা ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। মুন্সিগঞ্জ থেকে মাদারীপুরের সীমানায় অবস্থিত পদ্মা নদীর কাচিকাটা চরের নিকট সশস্ত্র ডাকাত ভোর থেকে বেলা দশটা-বারোটা পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে একে একে দশ-এগারোটি লঞ্চে হানা দিয়ে যাত্রীদের কাছ থেকে নগদ অর্থ এবং স্বর্ণালংকার ছিনতাই করে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুযায়ী জানা গেছে, ডাকাতদল একটি জেলে নৌকা করে সর্বপ্রথম এম,এল নাসিরুদ্দিন লঞ্চটিকে দখল করে নেয়। পরে লাঞ্চ আরোহন করে এই পথে যাতায়াতকারী অন্যান্য যাত্রীবাহী লঞ্চকে গুলি বর্ষণ করে যাত্রাবিরতি ঘটায়, অবশ্য দু-একটি লঞ্চ ডাকাতদলের হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দ্রুত পিছুটান দিতে বাধ্য হয়। কিন্তু তবুও প্রায় দশ-এগারোটি লঞ্চ ডাকাতদলের কবলে আটকা পড়ে এবং প্রায় প্রতিটি লঞ্চযাত্রীকেই তাদের পথের সম্বল ডাকাত দলের হাতে তুলে দিতে বাধ্য করা হয়। জলদস্যুরা এল, এম, জি রাইফেল ও স্টেনগান উঁচিয়ে প্রতিটি যাত্রীকে তল্লাশি করে, এমনকি মহিলা যাত্রীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয়। কাচিকাটা চরে ডাকাতরা লঞ্চযাত্রীদের সমবেত করে লুণ্ঠন কার্য চালায় এবং সর্বস্ব হরণ করার পর ডাকাতেরা চম্পট দেয়। ইতিপূর্বে একই দিনে এবং দিনে-দুপুরে এতগুলো যাত্রীবাহী লঞ্চের উপর ডাকাতির খবর আর পাওয়া যায়নি। নদীবক্ষে এই লঞ্চ ডাকাতির তাই স্বাভাবিকভাবেই যাত্রী এবং লঞ্চ কর্মীদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছে। নদী পথে যাতায়াতের ব্যাপারে যাত্রীসাধারণের মন থেকে নিরাপত্তাবোধের চিহ্ন ধুয়ে-মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। আমরা জানি, যাত্রী সাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের জন্য নদীপথে জল পুলিশী প্রহরার বন্দোবস্ত আছে। কিন্তু একই দিনে মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে একই সঙ্গে দশ-এগারোটি লঞ্চ ডাকাতির সংবাদে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছি। শুধু নদীপথেই যে ডাকাতি হয়েছে তা নয়, খোদ রাজধানী শহরেও গত শুক্রবার বাংলা একাডেমী থেকে সশস্ত্র হাইজাকাররা বাইশ হাজার টাকা নির্বিঘ্নে ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কতটা অবনতি ঘটলে এরকম হিংস্র দস্যুবৃত্তি অব্যাহত থাকতে পারে, তা আজ আর কোনো নাগরিকেরই বুঝতে বেগ পাওয়ার কথা নয়। দেশে যে আইনের শাসন পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, তার প্রতি আমাদের উদাসীনতার অর্থ হচ্ছে, দেশকে চরম অরাজকতার মুখে ঠেলে দেয়া। এ ধরনের পরিস্থিতি যত বাড়বে দেশের মানুষের মনের মধ্যে ভয়ভীতির আশঙ্কা প্রবল হবে এবং এই পরিণতি যে খুব শুভ নয় তাও আমরা আঁচ করতে পারছি। কিন্তু কথা হলো, নদীপথে জলদস্যুদে নর ঠেকবার জন্য কোন কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায়না? সশস্ত্র পুলিশ যেখানে ডাকাতের ছোরার ভয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়, সেখানে সংগত কারণেই জোর পুলিশি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। জলপথে, রেলপথে এবং সড়ক পথে, কোন পথেই সাধারণ নাগরিকরা নিরাপদ নয়। যে কোন পথেই হোক না কেন, সাধারণ নাগরিকরা আজকাল এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াতের ব্যাপারে দারুণ শংকাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। দুর্বৃত্ত দমনে গৃহীত ব্যবস্থা দিয়ে কোন ফলোদয় ঘটাতে পারছে না। সত্যি, মানুষের নিরাপত্তা আজ দুর্বৃত্তদের হাতের মুঠোয়। এ অবস্থা জনজীবনে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। নদীপথে জলদস্যুতা সম্প্রতি যে চাঞ্চল্য জাগিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, একটি শক্তিশালী সশস্ত্র দুর্বৃত্ত দল এই দুষ্কর্মে লিপ্ত। এদের বিষদাঁত ভেঙে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ একান্তই জরুরী। নদীপথে জনসাধারণ আর কতকাল দস্যুর ভয়ে ভীত থাকবে। জনসাধারণের মনে এই প্রশ্ন আজ স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারিত হবে। সশস্ত্র জলদস্যুতা রোধ করে ঠুনকো প্রতিরোধ ব্যবস্থা নয়, জোরদার প্রতিরোধব্যবস্থা যাতে অবিলম্বে গড়ে ওঠে আমরা সেই কামনা করছি।

ভোজ্য তেল নিয়ে ভোগান্তি

গত কিছুদিন ধরে রাজধানী ঢাকা নগরীতে বিভিন্ন ধরনের ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং কোথাও কোথাও বা আকাল পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভোজ্যতেল বর্তমানে দেশের অন্যান্য সমস্যার মত আরেকটি মারাত্মক সমস্যা হয়ে দেখা দেয়ার পর্যায়ে এসে উন্নীত হয়েছে। গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেল যে, রাজধানী ঢাকা নগরীর শহরতলী এলাকায় বিশেষ করে বাড্ডা, মাতুয়াইল, ডেমরা, রায়েরবাজার ও নবাবগঞ্জ এলাকায় ভোজ্যতেল দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে, দোকানের কাছে ভোজ্যতেল হিসেবে চিহ্নিত সরিষার তেল, সয়াবিন তেল, নারিকেল তেল বা বাদাম তেল কিছুই নেই। দু’একটা দোকানে যদিওবা ছিটেফোঁটা কিছু পাওয়া যায়, দাম আগের চাইতেও অনেক অনেক বেশি। কিন্তু কেবল কি ভোজ্যতেল! তার সাথে টেক্কা দিয়ে বনস্পতি ঘিও উধাও বা দুর্মূল্যের খপ্পরে পড়তে শুরু করেছে। ঘিয়ের কথা ভাবাও দুষ্কর। অবস্থা এমন হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে রসনা তৃপ্তির অন্যতম প্রধান উপকরণ ভোজ্যতেলের ব্যবহারের অভ্যাসটাই না হয় ছাড়তে হয়!
বর্তমানে বাজারে ভোজ্যতেলের দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য হয়ে ওঠার তেমন কোনো কারণই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ওয়াকিবহাল মহলও এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পাচ্ছেন না। যদিও স্বাধীনতার পর দেশের অন্যান্য জিনিসের মত ভোজ্যতেলের একটি অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে যা হোক একটা থোরবড়ি খাড়া ধরনের যুক্তি খুঁজে পাওয়া গেছিল। তাছাড়া ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা আবার বাড়ার একটা কারন ছিল ঈদুল আযহার সময়। সে ঈদতো গেছে মাসখানেক আগেই এবং সে সময় দাম কিন্তু এতটা বাড়েনি। তাহলে এখন এই বাড়বার কারণটা কী?
বর্তমানে বাজারে সরিষার তেল প্রতিসের নাকি ১৬ টাকা দরে, সয়াবিন ১২ টাকায়, নারকেল তেল ২২ টাকায়, বাদাম তেল সাড়ে ১০ থেকে ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ ঢাকা নগরীর সহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরিষার তেলের যে মিল ও ঘানিগুলো রয়েছে এবং স্বাধীনতার পরে এগুলোর মধ্যে যেগুলো চালু হয়েছে, সেগুলোর কোনটাই তো এর মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে, এমন কোন খবরতো এযাবৎ পাওয়া যায়নি। অথবা এসব চালু মিলে নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহ করা হচ্ছে না, সেসব কথা ওতো কিছু শোনা যায়নি। তবে কি সেই একই অদৃশ্য চক্রের খেল এবারও শুরু হয়েছে! কতৃপক্ষ কি একটু তদন্ত করে দেখবেন? সয়াবিনের ব্যাপারে না হয় একটা কেলেঙ্কারি ঘটেছে সে দু’বছর আগে চাটগাঁয়- যদিও এ যাবৎ কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেননি। তবে এবার তো কিছু ঘটেনি। তাহলে এক্ষেত্রেই বা কেন এমন হলো। ভাববার বিষয় বৈকি! কেবল ভাবলেই চলবে না, কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এর একটা কারণ খুঁজে পেতে হবে বৈকি! এবং দেশবাসীকে অবিলম্বে তা জানাতেও হবে। এক কথা বলবো, দেশের মানুষের এহেন অস্বাভাবিক অর্থনৈতিক নিগ্রহের দিনে যারা ভোজ্যতেলের মতো একটি অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে -কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই তাদের শাস্তি দিতে হবে।

বল মা তারা দাঁড়াই কোথা!

তিন টাকার টিকিট পয়ত্রিশ টাকা। পাঁচ টাকার টিকিট পঞ্চাশ টাকা। এ দামে গত শুক্রবার স্থানীয় একটি প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার টিকিট বিক্রি হয়েছে। খোলাবাজারে নয় -কাল বাজারে। এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে গতকালের ‘বাংলার বাণী’তে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, গত শুক্রবার থেকে স্থানীয় প্রেক্ষাগৃহটিতে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে সাহায্যার্থে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। এ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়।
কালোবাজারে সিনেমা টিকিট বিক্রির সংবাদ এমন কোন নতুন নয়। কালোবাজারে হরহামেশাই সিনেমার টিকিট বিক্রি হচ্ছে। তবে এবারে টিকিটের দাম যে অংকে গিয়ে ঠেকেছে তাতে মাথায় হাত দিয়ে বসা ছাড়া কোন উপায় নেই।
এটা কারো অজানা নয় যে, সিনেমা টিকিট কালোবাজারির পেছনে রয়েছে সঙ্ঘবদ্ধ একটি দল। তাতে প্রেক্ষাগৃহের কর্মচারী, টাউট আর পুলিশও রয়েছে। এদের কল্যাণে তিন টাকার টিকিট পয়ত্রিশ টাকায় বিক্রি হয়।
প্রেক্ষাগৃহে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, আপনার পাশেই সিনেমা টিকিটের কালোবাজারির রয়েছে ওকে ধরিয়ে দিন। বিজ্ঞাপনে অনুপ্রাণিত হয়ে দু-একজন কালোবাজারি কে হয়তো কেউ কেউ ধরিয়ে দেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অদৃশ্য হাতের ভোজবাজিতে তারা ছাড়া পায়। ছাড়া পেয়ে আবার দ্বিগুণ উদ্যোগে কালোবাজারিতে নেমে পড়ে। এই হল বাস্তব হালহকিকত।
এরা যেন রূপকথার সেই রাক্ষসের মত। যেখানে রক্তের ফোটা পড়ে সেখানেই নতুন রাক্ষস গজিয়ে ওঠে। প্রশ্ন হলো, এভাবে চলবে কতদিন? রাজধানীতে নিরীহ জনসাধারণের জন্য চিত্তবিনোদনের অন্য কোন পথ খোলা নেই। একমাত্র সিনেমাই ভরসা। অথচ সেই সিনেমাতে যদি কালোবাজারিতে গ্রাস করে বসে তখন জনসাধারণের পক্ষে বল মা তারা দাঁড়াই কোথা- বলে ত্রাহি চিৎকার করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকেনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন