বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আবেদন
বাঙলাদেশের সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বেতার ভাষণে পশ্চিমী বৃহৎ শক্তিবর্গকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের আরব ও মুসলিম দেশগুলির ভ্রাতৃবর্গের প্রতি বিশেষ আবেদন করেছেন। উভয়ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবেই বলেছেন যে বাঙলাদেশের মানুষের যুদ্ধ ন্যায় যুদ্ধ, স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তি যুদ্ধ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের জনগণ বা কোন ভাষাগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। বরং বাঙলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং সিন্ধী, বেলুচ, পাঠান প্রভৃতি জাতি গােষ্ঠীর স্বাধীন বিকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য পথপ্রদর্শক।
এই মুক্তিসগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য পশ্চিমী বৃহৎশক্তিবর্গ যাতে পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক চক্রকে কোন প্রকার সাহায্য না করেন তার জন্য প্রধানমন্ত্রী তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। কারণ পশ্চিমী বৃহৎ শক্তিদের সাহায্য পুষ্ট হয়ে পাক শাসকচক্র নিজেদের ভেঙে পড়া অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে ঠেকা দেবার চেষ্টা করবে এবং সেই অর্থনীতিকে বাঙলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণকে জোরদার করার জন্য ব্যবহার করবে।
পশ্চিমী বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আবেদন সময়ােপযােগী। কিন্তু এই আবেদন তারা কর্ণপাত করবেন কিনা সন্দেহ। যারা পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে সমর সম্ভারে সমৃদ্ধ করে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্ররােচিত করেছে, তারা বাঙলাদেশের নবজাগরণে যে স্বস্তিবােধ করতে পারেন না এটাই স্বাভাবিক। তথাপি এই আবেদনের মূল্য আছে। সমগ্র পাকিস্তানে এখনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য সম্পর্কে যারা মােহগ্রস্ত তারা মােহমুক্তির সুযােগ পাবেন এবং নির্মম অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষালাভ করবেন।
তিনি আরব দুনিয়ার প্রতিও আবেদন করেছেন। কারণ আরব দুনিয়ার দূর থেকে এখনও বাঙলাদেশের যুদ্ধ যে ন্যায় যুদ্ধ এটার সম্যক উপলব্ধি হয় নি। আরব দুনিয়া মনে করছে যে বাঙলাদেশের মানুষের সংগ্রাম মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভাঙার সংগ্রাম। তারা এখনও মনে করতে পারছে না যে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের সংগ্রাম হল বাঙলাদেশের ৭ কোটি মানুষেরই সগ্রাম। সংখ্যালঘু পাক জঙ্গী শাসকচক্র পাকিস্তান থেকে গণতন্ত্রকে নির্মূল করার জন্য যুদ্ধ ঘােষণা করেছে বলেই বাঙলার সাধারণ মানুষকে গণতন্ত্রের পক্ষে অস্ত্রধারণ করতে হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে আরব দুনিয়ার মানুষের অভিজ্ঞত কম নয়। তারা যদি স্বদেশে নিজেদের অভিজ্ঞার আলােকে বাঙলাদেশের মানুষের ন্যায়যুদ্ধকে বিচার করে দেখেন তাহলে মুসলিম আরবের মনােভাবকে নয়া উপনিবেশবাদীরা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করার কোন সুযােগ পাবে না। প্রধানমন্ত্রীর আবেদনের এটাই হল রাজনৈতিক তাৎপর্য।
সূত্র: কালান্তর, ১৫.৬.১৯৭১