বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩০শে জুলাই, মঙ্গলবার, ১৩ই শ্রাবণ, ১৩৮১
জেনেভায় ত্রিপক্ষীয় বৈঠক
তুরস্ক তার কথা জানিয়ে দিয়েছে; গ্রীস এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। জেনেভায় শান্তি আলোচনা এক অচলাবস্থার সম্মুখীন। আনুষ্ঠানিকভাবে যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। তুর্কিদের সাফকথা সাইপ্রাসে তাদের যে ১৫ হাজার সৈন্য রয়েছে তাদের সরিয়ে নেয়া অথবা প্রত্যাহার করার কোন কথাই উঠেনা। এছাড়া সাইপ্রাসের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক কাঠামো সম্পর্কেও তাদের দেয়া প্রস্তাব মেনে নিতে হবে। দেশের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কে হবেন তাও তারা বলে দিয়েছেন। শুধু বলেননি ক্ষমতায় কে বসবেন। ম্যাকারিয়স? না সে সম্পর্কে কোন উচ্চবাচ্য জেনেভা শান্তি আলোচনায় তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী করেননি। তবে ক্লারিডেস ক্ষমতায় থাকুক এটা তারা চান না।
তারা কি চান আর কি চান না সে পরের কথা। তাদের মুরুব্বীরা কিন্তু অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় তাদের চাওয়া না চাওয়া সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো বক্তব্য রাখছেন না। ব্রিটেনের আলোচনার প্রথম দিকে বলেছিল তুর্কি বাহিনীর অভিযান আগে রোধ করতে হবে। কিন্তু তারপর কি? সেইখানে ব্রিটেনও নিরব। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। জেনেভা আলোচনায় তারা শুধু তদারকি করছেন। অথচ কে না জানে ন্যাটোর সদস্য ভুক্ত তুরস্ক অথবা গ্রিস কোন সমাধানই মেনে নেবে না যতক্ষণ না তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সবুজসংকেত পাচ্ছে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আর্যবিশপ ম্যাকারিয়স অভিযোগ তুলেছিলেন তুরস্ক এবং গ্রিস সাইপ্রাস ভাগ বাটোয়ারা করে নেবার ষড়যন্ত্র এঁটেছে। এ অভিযোগ শুধু ম্যাকারিয়াসের নয়, বিশ্বের সচেতন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও দিনের-পর-দিন এই সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছিল। জেনেভার শান্তি আলোচনা যে দিকে অগ্রসর হচ্ছে তা থেকে ম্যাকারিয়সের সেই অভিযোগই আজ বাস্তবে রূপায়িত হতে চলেছে বলে অনুমান করা যায়।
আমরা সাইপ্রাসের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা কথা বারবার উল্লেখ করেছি। বাংলাদেশ সরকারও ম্যাকারিয়স সরকারের সঙ্গে তাদের সংহতির কথা ঘোষণা করেছেন। সাইপ্রাসে বিদেশি যে সকল বাহিনী রয়েছে সে তুর্কিই হোক আর গ্ৰীকই হোক তাদের অবশ্যই দ্বীপ ছেড়ে চলে আসতে হবে। গ্রিক সাইপ্রিয়ট অথবা তুর্কি সাইপ্রাইয়টদের ‘স্বার্থ রক্ষার’ নামে সেখানে বিদেশি সৈন্যের অবস্থান কোন মতেই মেনে নেয়া যায়না।
পূর্বেও বলেছি এবং আজকেও আমরা সেই বক্তব্যের পুনরুল্লেখ করে বলছি সাইপ্রাসের সাম্প্রতিক ঘটনাবলী কোন অবস্থায়ই বিচ্ছিন্ন অথবা আকস্মিকভাবে সংঘটিত কোন ব্যাপার নয়। অতন্ত পরিকল্পিতভাবেই ন্যাটোর সদস্য ভুক্ত দেশ এবং তুরস্ক পূর্ব ভূমধ্যসাগরে সামরিক গুরুত্বের কথা স্মরণে রেখে ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ ‘আলোচনা আলোচনা’ খেলায় বসেছে। মূল উদ্দেশ্য তাদের ওই এলাকায় সাইপ্রাসের এতদিনকার অনুসরিত জোট নিরপেক্ষ নীতির অবসান ঘটানো। সেটা সাইপ্রাসের তথাকথিত স্বাধীনতা মেনে নিয়ে হোক অথবা দ্বীপটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে হোক।
সাইপ্রাসের ঘটনাবলী তাই আর সেই ক্ষুদ্র দ্বীপটির ঘটনা হয়ে নেই। সারা দুনিয়ার শান্তিকামী এবং জোট নিরপেক্ষ নীতির অনুসারী মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সতর্ক করে দিয়েছে জেনেভা বৈঠকে অংশগ্রহণকারী দেশ তুরস্ক, গ্ৰীস এবং ব্রিটেনকে। সাইপ্রাসের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো সিদ্ধান্ত সে বৈঠকে নেয়া চলবে না। আর আর যদি তেমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে আমরা বিশ্বাস করি সাইপ্রাসের শান্তি ও স্বাধীনতাকামী মানুষ আজ হোক কাল হোক ঐক্যবদ্ধভাবে তার প্রতিরোধে অগ্রসর হবে।
সময়োচিত সিদ্ধান্ত
গত শুক্রবার এক সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, বন্যার পর মহামারীর আশঙ্কা করে সরকার পূর্ব হতেই প্রতিরোধক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন। যে কোনো রকমের অসুখ মহামারী আকারে দেখা দিলে তা যাতে সহজেই নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা যায় সেজন্য সরকার সম্ভাব্য সর্ব প্রকার পদক্ষেপই নিয়েছেন। স্থানীয় সব অফিসেই প্রতিষেধকমূলক প্রয়োজনীয় ঔষধ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মহামারী উপদ্রুত এলাকায় সমাজসেবীর কর্মীরা মহাকুমা চিকিৎসা অফিসারের নেতৃত্বে ও ১০০০ স্যানিটারী ইন্সপেক্টর এর তত্ত্বাবধানে মহামারী প্রতিরোধ মূলক কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। সিভিল সার্জন (স্বাস্থ্য) ও প্রধান চিকিৎসক অফিসারগণ স্ব-স্ব জেলায় কর্মীদের সাথে সহযোগিতা ও সমন্বয় রেখে মহামারী প্রতিরোধের কাজ তদারকি করছেন। তাছাড়া স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় পানীয় জলের অভাব দূর করার জন্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে প্রচুর পরিমাণে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট পাঠানো হয়েছে। কোন কোন বন্যা উপদ্রুত এলাকা থেকে বিক্ষিপ্তভাবে কলেরা ও অন্যান্য অসুখের খবর আসছে। সাথে সাথে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে পরিস্থিতি পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। সরকার যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা বাস্তবায়িত করতে জনগণের পূর্ণ সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। জনগণকে বন্যা ও পানীয় জল সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।
সরকারি প্রেসবিজ্ঞপ্তি মোতাবেক এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বন্যা জনিত পরবর্তী অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, দেশের বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশঃ অবনতির দিকে যাচ্ছে। অবিরাম বৃষ্টিপাতের ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কে নিয়ন্ত্রন করার মানুষের সাধ্যাতীত। তবে একথা সত্য যে, সময় মতো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে অনেক সময় অনেক বিপর্যয়ের হাত থেকে পরিত্রান পাওয়া যায়। কথায় বলে সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।
সরকার যে সমালোচিত পদক্ষেপ নিয়েছেন তার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রেখেই বলবো যে, অনেক সময় দেখা যায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অব্যবস্থার দরুন প্রয়োজনীয় ওষুধ-পত্তর যথা সময়ে পৌঁছে না। এ যেন ঠিক ওই ‘চন্দননগরে আগুন’ লাগার মতই একটা অবস্থা। যদি এরকম হয় তাহলে সরকারের পরিপূর্ণ সদিচ্ছা থাকা সত্বেও বন্যা পরবর্তী অবস্থাকে মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। এটা সকলেরই জানা আছে যে, বন্যার পানি সরে যাবার পর ব্যাপক আকারে কলেরা, বসন্ত, উদারাময় রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ইতিমধ্যেই কলেরা রোগে আক্রান্ত হয় বেশ কিছু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। সুতরাং এহেন পরিস্থিতিতে মোকাবিলা করতে হলে সর্বাত্মক প্রস্তুতি চাই বৈকি! শুধুমাত্র ঔষধ পাঠালেই চলবে না–ঔষধ যাতে ঠিকমত পৌঁছে সেদিকেও সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাছাড়া বন্যা পরবর্তী অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আগেভাগেই প্রচার অভিযান জোরদার করতে হবে অর্থাৎ কলেরা, বসন্ত উৎসব ইত্যাদি রোগকে কিভাবে প্রতিরোধ করা যায় সে সম্পর্কে জনসাধারণকে আগেভাগেই অবহিত করা প্রয়োজন। এ প্রচার অভিযান কে গ্রামাঞ্চলেই চালাতে হবে ব্যাপকভাবে।
প্রসঙ্গতঃ আরও বলা প্রয়োজন যে, দেশের সকল দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোরও এ সম্পর্কে একটা বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। একা সরকারের পক্ষে বন্যা পরবর্তী অবস্থাকে মোকাবিলা করা যে সম্ভব নয় তা বুঝিয়ে বলার জন্য বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণ করার অপেক্ষা রাখে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক