বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৮শে জুলাই, রবিবার, ১১ই শ্রাবণ, ১৩৮১
আফগান সীমান্তে পাকিস্তানের রণপাঁয়তারা
ক্ষুদে দ্বীপ সাইপ্রাসে উত্তেজনা এখনো প্রশমিত হয়নি। সেখানে প্রয়োজনে স্বেচ্ছাসেবক পাঠাবার কথা ভাবতে ভাবতে পাকিস্তানি নায়কদের মাথায় একটা অদ্ভুত খেয়াল চেপেছে। দূরে গিয়ে কি লাভ ‘যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’ একটা নিজ দেশের আশেপাশের কোন রাষ্ট্রের সাথে চালালেই তো হয়। পিণ্ডী থেকে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে তাইতো তাই তলোয়ার ধারী পিপলস পার্টির প্রধান ছুটেছিলেন আফগান সীমান্তে। সঙ্গে সিপাই-সান্ত্রী, সৈন্য-সাবুদ, গোলাবারুদ। সবাইকে সীমান্তে মোতায়েন রয়েছে আম জলসার আয়োজন করেছিলেন পাকিস্তানি উজিরে আজম। সেখানে গল্প-মসকরা হয়েছে। দিলটা চাঙ্গা করে পেড়েছেন সযত্নে লালিত মনের একটা বাসনা।
আফগান মুল্লুকটা একবার দখলে আনতে পারলে হতো। খায়েশ ছিল দিল্লি জয়ের। কিন্তু সে পথে মুখ পুরেছে। তাই ওমুখো হবার আর ইচ্ছে নেই। এবারকার অভিযান পরিচালিত হবে পশ্চিম সীমান্তে। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমে তাই সাজসাজ রব। দু’ডিভিশন সৈন্য আর এক ব্রিগেড সাঁজোয়া বাহিনী সেখানে ইতিমধ্যেই মোতায়েন করা হয়েছে। জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো পাক-আফগান সীমান্তে এক জনসভায় সরাসরি হুমকি দিয়েছেন কাবুল জয়ের।
আসলে পাকিস্তানি উজিরে আজমের এসব কোন বেসামাল উক্তি নয়। অত্যন্ত ঠান্ডা মাথার জিভটাকে সামাল দিয়েই তিনি বক্তব্য রেখেছেন। ইতিহাস টেনেছেন তিনি নিজের গরজে প্রভুর শিক্ষায়। ভুট্টোর আন্তর্জাতিক মুরুব্বি গণচীনও তাঁর সীমান্তের ওপারের কোন এলাকা দখলের পাঁয়তারা করেন ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েই। অমুক শতকে অমুক সম্রাট ওই ওই এলাকা আমার দেশের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তাই আজ আমি সেই সম্রাটের যোগ্য উত্তরসূরি, আমি দাবী করছি অমুক এলাকা আমাকে ছেড়ে দেয়া হোক। জনসভায় ভুট্টো আফগানিস্থান এর উপর তার অধিকারের দাবি তুলেছিলেন সেই একই কায়দায়।
এই ‘অধিকার’ প্রতিষ্ঠায় তিনি কতটুকু অগ্রসর হবেন? পাকিস্তানি পতাকা কি উড়বে কাবুলের সরকারি-বেসরকারি ভবনসমূহে? না তেমন কোনো অভিলাষ হয়তো জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর আদৌ নেই। নিজে ঘর সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে, পরের ঘরে পতাকা উড়াবার সাধ্য এবং সম্ভাবনার কথাই এখানে উঠতে পারে না। আর এটাই যখন সত্য তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর হুমকি-ধামকির পেছনে তাহলে কোন উদ্দেশ্য কাজ করছে?
একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, যেমন করেই হোক জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। সত্তুরের নির্বাচনে একমাত্র বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ ছাড়া বাকি সম্পূর্ণ এলাকার লোকেরা তার স্বপক্ষে রায় দিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিচক্ষণতা অথবা প্রজ্ঞা কোনটাই তেমন ছিলনা। ছিলনা সংগঠিত কর্মীবাহিনী। নতুন দল গড়ে যাদের তিনি এক ইমামের পেছনে শরিক করাতে পেরেছিলেন তাদের রাজনৈতিক আদর্শ এবং চরিত্র ছিল সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী। এতকিছুর পরও নির্বাচনে জিতে যদি তিনি তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের পাকে জড়িয়ে না পড়তেন তবুও হয়তো পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছুদিন তেষ্টানো তার পক্ষে সম্ভব হতো। পারতেন হয়তো সত্তুরের তার সমর্থকদের অন্তত একটা অংশের সহানুভূতি অক্ষুন্ন রাখতে। কিন্তু রাজনীতির সেই সোজা পথে তিনি অগ্রসর হন নি।
ক্ষমতায় যাবার থেকে তিনি তাই দিনের-পর-দিন বিচ্ছিন্ন হতে থাকলেন স্বদেশবাসী থেকে। যারা একদিন ‘শরাব পান’ করা সত্বেও ‘গরিবের খুন পান’ করেন না বলে নাঙ্গা তলোয়ার ধারী ভুট্টোর উপর আস্থা এনেছিলেন তারা ধীরে ধীরে হতাশ হয়ে পড়ছেন। আজ এ এলাকায় কাল ও এলাকায় দেখা গেল বিক্ষোভ। যেসকল গণপ্রতিনিধি শিয়া রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ভুট্টোর আশেপাশের জড়ো হয়েছিল তারা সরে পরল। দলের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও ভুট্টোর কোপদৃষ্টি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেন না।
ভুট্টো শরীক হলেন পাকিস্তানের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের সঙ্গে। আমলা আর সব নায়কদের পুরনো আঁতাতে হাবুডুবু খেতে থাকলেন। সারাদেশে অধিকার সচেতন মানুষের উপর আবার চালানো হলো অত্যাচারের স্টিমরোলার। ক্ষুধার্ত মানুষের দল বিদ্রোহ করল । সংঘর্ষ শুরু হল বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ।
এভাবেই পূর্বসূরিদের পথে এগিয়ে চলেছেন ভুট্টো। সেই সন্ত্রাস অত্যাচার-নির্যাতন আর তুণের সব শর যখন শেষ তখন সারাদেশে একটা যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টি করা। হয় ভারত না হয় আফগানিস্তান যে কোন প্রতিবেশী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জনগণের মন বিষিয়ে তোলে একটা চরম উত্তেজনা সৃষ্টি করা। আর তার মাধ্যমে সহজ সরল মানুষদের চোখকে তাদের সমস্যা থেকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া।
এ বড় পুরনো কৌশল। পাকিস্তানি প্রাসাদ চক্রীদের এই পুরোনো কৌশলে বন্দি হয়েছে সেখানকার মানুষ বহুবার। এবারও ভুট্টোর চটক ধরানো বক্তৃতায় পাকিস্তানের জনগণ কতটুক আকৃষ্ট হবে তা ভবিষ্যতেই বলতে পারে। এসব নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার কোন কারণ নেই। কিন্তু এ হাওয়ার আজ আমাদের গায়ে লাগে তখনই যখন এই উত্তেজনা; যুদ্ধ উন্মাদনা সারা উপমহাদেশে শান্তি ও প্রগতির ধারাকে আঘাত করে।
পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর মনোভাব এবং পদক্ষেপ স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশের স্পর্শকাতর পরিস্থিতির উপর প্রভাব বিস্তার করে। উপমহাদেশের তিনটি দেশ বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে জনগণের অগ্রগতি ও কল্যাণ সাধনে বাস্তবতা খুঁজে বের করবার প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল এতদিন। এ ব্যাপারে যে কিছুটা অগ্রগতি হয়নি তাও নয়। কিন্তু পাকিস্তানি শাসক শ্রেণীর নুতন করে উত্তেজনা সৃষ্টির অপপ্রয়াস এবং এ অঞ্চলের যুদ্ধাশঙ্কা গড়ে তোলায় তা বিনষ্ট হতে পারে বলে অনেকেই অনুমান করছেন। আমরা শুধু এ বিষয়টির প্রতিই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তার দেশের অভ্যন্তরে তিনি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন সেটা তাঁর এবং তাঁর দেশবাসীর ব্যাপার। কিন্তু তাদের কোনো পদক্ষেপ যদি গোটা উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতাবস্থা ফিরিয়ে আনতে বাধার সৃষ্টি করে তবে এ এলাকার শান্তিকামী মানুষেরা তার বিরুদ্ধে স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক