জনযুদ্ধই মূল ভিত্তি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এ যুদ্ধের ভিত্তি ছিল জনগণ, বর্তমান অধ্যায়ে সেই বিষয়ের উপর আলােকপাত করা হয়েছে। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে বাংলাদেশের সেনাসদস্যগণ পাকিস্তানের সেনা কাঠামাের আওতায় গড়ে উঠেছিল এবং তাদের মন মানসিকতা অভিজ্ঞতা ছিল সমুখ-সমরের। তারা পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার শপথ নিয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে বাতালি সেনা কর্মকর্তাদের পক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামাের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ছিল রীতিমতােভাবে মানসিক দ্বন্দ্বের। ২৫ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী অকস্মাৎ আক্রমণ শুরু করে, বন্দি ও হত্যা করে। এই অবস্থায় আক্রান্ত হয়ে বাঙালি সেনাকর্মকর্তাগণ বিদ্রোহ ঘােষণা করে। এর একমাত্র ব্যতিক্রম চট্টগ্রামে ইপিআর বাহিনীর অধিনায়ক মেজর রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথমেই পাকিস্তান সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করেন এবং সফলতা অর্জন করেন। ভারতে আগত ট্রেনিং-এর জন্য বাছাইয়ের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের উপর। মার্কিন পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঐ সময় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র পাঁচ হাজার। তার মধ্যে যুদ্ধের সক্ষমতা ছিল মাত্র সাড়ে তিন হাজারের । এর পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের জন্য ব্যাপক ট্রনিং শুরু হয় এবং শেষ পর্যন্ত ঐনিং প্রাপ্ত গেরিলাদের সংখ্যা দেড় লক্ষ থেকে পৌনে দুই লাখে দাঁড়ায় । গেরিলাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাঠানাে হয়েছিল। তারা বিভিন্ন অঞ্চলে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ও ঘাঁটি গড়ে তােলে। যখন তখন সুবিধামতাে অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের নাস্তানাবুদ করে তােলে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পূর্ব পাকিস্তানের সেনাপ্রধান লে. জে. এ এ কে নিয়াজী দেখতে পেলেন সেনাবাহিনীর যাতায়ত পথ প্রায় রুদ্ধ। ব্রিজ ভেঙে ফেলা হয়েছে। জলযানের উপরে বেপরোয়া আক্রমণ শুরু হয়েছে।
এসব পর্যবেক্ষণ করে তিনি মন্তব্য করেন, ‘গেরিলাদের দুঃসাহসিক আক্রমণে তার চোখ অন্ধ, কান বধির হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনযুদ্ধকে সামরিক যুদ্ধ হিসাবে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে শুধুমাত্র সেনা অফিসাররা নিজেদের কৃতিত্ব হিসাবে প্রচার করেছে, এমনকি তারা নিজেরাই সশস্ত্র দিবস ঘটা করে পালন করে। এতে তারা প্রমাণ করতে চায় অন্য কেউ নয়, না মুজিব বাহিনী না গেরিলা বাহিনী, না আঞ্চলিক বাহিনী কেউ যুদ্ধ করেনি এ যুদ্ধ যেন শুধুমাত্র তারাই করেছে। এই ধরনের ভ্রান্তি নিরসন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যে জনযুদ্ধ সেই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে । “বাঙালি সেনাবাহিনী হয়তাে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করত” পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নৃশংসতা ও শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ব্যাপক গণহত্যা এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশার সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও নীতি নির্ধারকদের অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নিতে হয়, ক, সামরিক খ. রাজনৈতিক গ. কূটনৈতিক ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে এই সকল ফ্রন্টেই তাদের দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত টগবগে আবেগ আচ্ছন্ন অথচ বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে দৃঢ়প্রত্যয়ী তরুণ গেরিলা ট্রেনিংয়ের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সামরিক বিজয় ব্যতীত ভারতের উপর চাপিয়ে দেয়া শরণার্থীদের বিরাট বােঝা অপসারণের অন্য কোনাে বিকল্প নেই একথা বুঝতে ভারতের বিলম্ব হয়নি। সে লক্ষ্যে ভারত তার সমর পরিকল্পনার সঙ্গে সংগতি রেখে মুক্তিযােদ্ধা গেরিলাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের নীতি গ্রহণ করে। একই সঙ্গে সিক্রেট ডিপ্লোম্যাসির উপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে।
নিয়মিত বাহিনীর সেনাসদস্যগণ পাকিস্তানি সেনা কাঠামাের আওতায় গড়ে ওঠা তাদের মন মানসিকতা ও অভিজ্ঞতা ছিল সম্মুখ সমরের। তাছাড়া গেরিলা যুদ্ধ করার জন্য যে রাজনৈতিক মটিভেশন অপরিহার্য তা ছিল অনেকাংশে অনুপস্থিত। ২৫ মার্চ অকস্মাৎ তাদের উপর পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আক্রমণ না করলে কিংবা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনা অধিনায়কগণ তাদের নিরস্ত্র ও হত্যা না করলে তাদের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতেন কিনা সন্দেহ। লক্ষণীয়, ২৫ মার্চের পূর্বে কোথাও কোনাে বাঙালি সেনা অধিনায়ক বিদ্রোহ করেনি। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত এর স্পষ্ট প্রমাণ মেলে না। সেজন্য জেনারেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর গঠন প্রসঙ্গে বিখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিংয়ের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “পাকিস্তান সেনাবাহিনী যদি শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে তাদের এ্যাকশন সীমাবদ্ধ রাখতে বাঙালি সেনাবাহিনী ও ইপিআর বাহিনী হয়তাে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করত । কিন্তু যখন সংবাদ ছড়িয়ে পড়লাে যে, পাকিস্তানিরা বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সেনা সদস্যদেরও হত্যা করছে কেবল তখনই আমরা বিদ্রোহ করি এবং এক দেহে একাত্ম হই। পাকিস্তান সেনাবাহিনী এভাবে মুক্তিবাহিনী তৈরি করেছে।” একটু পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে, পাকিস্তানি সেনা কাঠামাের আওতায় গড়ে ওঠা বাঙালি সেনাবাহিনী প্রথম দিকে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেছে। পিচ ব্যাটেলে দাড়িয়ে গেছে। যদিও তাদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, বিমান বা পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ছিল না। তারা আক্রমণমূলক ভূমিকা থেকে পিছু হটে শেষ পর্যন্ত এপ্রিল মাসের মধ্যেই ভারত সীমান্ত অতিক্রম করতে বাধ্য হয়েছে। শক্তিশালী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে টিকে থাকা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
এক্ষেত্রে ইপিআর এবং পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা কিছুটা হলেও ব্যতিক্রম ছিল । যেহেতু তারা জনগণের পাশাপাশি ছিল সেজন্য জন আকাঙ্ক্ষায় উদীপ্ত হয়ে তাদের কিছু অংশ সরাসরি নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যােগ দিয়েছে আর কিছু অংশ অনিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে থেকে তাদের প্রাথমিক ট্রেনিং দিয়েছে গেরিলা যুদ্ধে এবং শেষ পর্যায়ে সম্মুখ সমরের অগ্রভাগে থেকেছে। সেনা অফিসারদের মধ্যে যে ব্যতিক্রম ছিল না তা নয়- বরং মেজর খালেদ মােশাররফ ঢাকা-ময়মনসিংহ এলাকায় পরিকল্পিতভাবে গেরিলা যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবার পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধেও বিশেষভাবে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। বাঙালি সেনা অধিনায়কগণ পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত স্বপ্রণােদিতভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি। যখন আক্রান্ত হয়েছে তখন ‘বিদ্রোহ করেছে, করেছে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ। ব্যতিক্রম যে ছিল না তা নয়।
ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, মেজর শফিউল্লাহর মতাে ব্যতিক্রম সেনা কর্মকর্তাদের সংখ্যা নগণ্য। অনেক সেনা অফিসার প্রায় দু’মাস পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাজ করেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রথম দিকের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং বাংলাদেশ সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে অথবা তাদের পাশ কাটিয়ে অধিকাংশ নতুন ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের দেশে পাঠানাে শুরু হয়। দেশের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের উপযােগী কোনাে সম্পূরক সংগঠন ছিল না। তবে গ্রুপে গ্রুপে পারস্পরিক সমস্বয়ের মাধ্যমে গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত করার মতাে অটোমেটিক কমান্ড ব্যবস্থা তৈরি হয়ে যায় । একক কমান্ডের নির্দেশে সব গ্রুপেই কাজ করেছে এমনটি বলা যাবে না। যার, যা আছে তাই নিয়ে তারা শত্রু নিধনে জীবনবাজি রেখেছিল। একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশের অভ্যন্তরে তারা নিজেরাই সংগঠিত হয় এবং ছােট ছােট গ্রুপ তৈরি করে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করে। প্রাথমিকভাবে গেরিলা যুদ্ধে যেমনটি হয়ে থাকে।
শক্তিক্ষয় ও দখলদার সৈন্যদের হয়রানি করার জন্য গেরিলা মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাবৃদ্ধি প্রয়ােজন ছিল। কিন্তু যথােপযুক্ত রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং, পরিকল্পনা ও কমান্ড ব্যবস্থার অধীনে গেরিলা গ্রুপগুলাে জনগণের সহায়তায়, আশ্রয়ে বিভিন্নভাবে যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছিল তার ফলে পাকিস্তান বাহিনী ও তাদের সহযােগী আলবদর, রাজাকারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সমর বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন, মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাবৃদ্ধির মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যদের দুর্বল ও পরিশ্রান্ত করার কৌশল চূড়ান্ত বিজয়ের পথ। বাস্তবক্ষেত্রে প্রথম দিকে ট্রেনিংয়ের মেয়াদ ছিল চার সপ্তাহের। পরে তা কমিয়ে তিন সপ্তাহ করা হয়। ‘৭১-এর মার্চের শেষভাগে গৃহীত মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তাদানের ব্যাপারে ভারতের সিদ্ধান্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনেক পরে প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন। ২৯ জুলাই পার্লামেন্ট প্রদত্ত এক প্রতিবেদনে তিনি বলেন, সমবেদনা ও সহযােগিতার অঙ্গীকারের একটি সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে এই পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছে এবং সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়ে আমরা এটা বাস্তবায়িত করছি এবং মুক্তিযােদ্ধাদেরকে সমর্থনদানের জন্য সম্ভাব্য সব কিছু আমরা করছি।’ দীর্ঘ প্রায় চার দশক পর আজ দৃশ্যমান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। কিন্তু দেখা যাচ্ছে জনযুদ্ধের সফলতাকে সামরিক বাহিনী এককভাবে কজা করে নিয়েছে। সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন করে প্রতিবছর তা তুলে ধরা হয়। যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী ও গেরিলাদের সংখ্যানুপাত তুলে ধরা যেতে পারে। নিয়মিত বাহিনী এবং গেরিলা বাহিনী সংখ্যা কত? ১ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম ‘লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে একটি অসামান্য বই লিখেছেন, সেই বইতে সামরিক বাহিনী (নিয়মিত বাহিনী) এবং গেরিলা যােদ্ধাদের (অনিয়মিত বাহিনী) একটি হিসেব দিয়েছেন, এখানে তা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য।
১ নম্বর সেক্টর: সৈন্যসংখ্যা ছিল ২ হাজার। গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ হাজার।
২ নম্বর সেক্টর: সমগ্র সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল প্রায় ৬ হাজার এবং গেরিলা ছিল ২৯ হাজার।
৩ নম্বর সেক্টরঃ গেরিলা সদস্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার। এস ফোর্স গঠনের পর মেজর সফিউল্লাহকে এস ফোর্স কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। এটি ছিল ব্যাটিলিয়ান পর্যায়ের।
৪ নম্বর সেক্টর: সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ৪ হাজার এবং গেরিলা ছিল ৯ হাজার।
৫ নম্বর সেক্টর: নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৮শ’ এবং গেরিলা ছিল ৫ হাজার।
৬ নম্বর সেক্টর: সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় ২ হাজার এবং গেরিলা ছিল ৯ হাজার।
৭ নম্বর সেক্টর: সৈন্যসংখ্যা প্রায় ২ হাজার এবং গেরিলা সংখ্যা ছিল প্রায় ১২ হাজার ।
৮ নম্বর সেক্টর: সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩ হাজার । গেরিলা ২৫ হাজার।
৯ নম্বর সেক্টর: গেরিলা ছিল প্রায় ২০ হাজার। সৈন্য ছিল এক ব্যাটিলিয়নের মতাে।
১০ নম্বর সেক্টর: এই সেক্টরের কোনাে আঞ্চলিক সীমানা ছিল না। শুধু নৌবাহিনীর কমান্ডােদের নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের সদস্যদের শত্রুপক্ষের নৌ-যান ধ্বংস করার জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হতাে। নৌ-অভিযান শেষ হওয়ার পর কমান্ডােরা আবার তাদের মূল সেক্টর অর্থাৎ ১০ নম্বর সেক্টরে ফিরে আসত।
১১ নম্বর সেক্টর: এখানে নিয়মিত সৈন্যসংখ্যা ছিল ১২০০ এবং গেরিলার সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার ।
প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে লক্ষ্য করা যাচ্ছে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮,০০০ এবং গেরিলাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৭৪ হাজার। তাছাড়াও কাদেরিয়া বাহিনী, হেমায়েত বাহিনী এবং মীর্জা আব্দুল লতিফের নেতৃত্বে এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় অঞ্চলভিত্তিক বা স্থানীয়ভাবে গড়ে ওঠা গেরিলা বাহিনীর সংখ্যা কম করে হলেও দাঁড়াবে আরাে ৪৫ হাজার। তাছাড়া মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষিত সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। সর্বমােট গেরিলাদের সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ২৭ হাজার। তবে এই সংখ্যাটি যে একেবারেই সর্বাংশে তথ্যগতভাবে নির্ভুল এমনটি দাবি করা যায় না। কেননা জেড ফোর্স, কে ফোর্স, এস ফোর্সের ব্রিগেডগুলাে যৌথ কমান্ড ভেঙে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এদের সংখ্যা নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে অথবা গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে যােগ করা হয়েছে কিনা তার কোনাে স্পষ্ট পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। | বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। জনগণের যুদ্ধ। দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালি এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। এটা শুধু এককভাবে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে অন্য একটি সামরিক বাহিনীর যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল বাঙালির মুক্তির ও স্বাধীনতার যুদ্ধ। অস্তিত্বের যুদ্ধ। এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে এবং রাজনৈতিকভাবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে। এই যুদ্ধ ছিল বিশেষভাবে রাজনৈতিক যুদ্ধ। সামরিকবেসামরিক সকলেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদেরকে কী ধরনের কী মানসম্পন্ন সহায়তা দেয়া হয়েছিল, বিভিন্ন প্রমাণিক গ্রন্থে সেটা লিপিবদ্ধ আছে। গােয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা সিদ্দিকি সালিক। তার গ্রন্থে বলেছেন যে, ১,০০,০০০ গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দানের লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়েছিল । এদের মধ্যে ৩০,০০০ জন সাধারণ প্রথাসিদ্ধ কায়দায় যুদ্ধ করবে এবং বাকি ৭০,০০০ যুদ্ধ করবে গেরিলা কায়দায়। রবার্ট জ্যাকসন লিখেছেন যে, মে মাসের শুরু থেকে সামরিক বাহিনীর কমান্ড গঠন, প্রশিক্ষণ ও সশস্ত্রীকরণ আরম্ভ হয় এবং পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলাযুদ্ধ চালাবার জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে প্রচ্ছন্নভাবে সব ধরনের সহযােগিতা করা হয়। মুক্তিবাহিনীর অভিযানকে সিদ্দিকি সালিক সংক্ষেপে তিনটি পর্যায়ে শ্রেণীবদ্ধ করেছেন। জুন ও জুলাই মাসে মুক্তিবাহিনী লড়াই করেছে মূলত সীমান্ত অঞ্চলে, যেখানে তাদেরকে সহায়তা করার জন্য ভারতীয় বাহিনী আশেপাশেই ছিল।
সেই পর্যায়ে তাদের মূল সাফল্যের মধ্যে ছিল ছােটখাটো ব্রিজ উড়িয়ে দেয়া, পাকিস্তানিদের কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন ধরনের বিঘ্ন সৃষ্টি করা ইত্যাদি। এর পরের দুই মাসে তারা ঢাকা পর্যন্ত পাকিস্তানি সাঁজোয়া বহরের ওপরে অ্যামবুশ করা থেকে শুরু করে পুলিশ স্টেশন ঘেরাও করা, গুরুত্বপূর্ণ ফরমেশনসমূহ উড়িয়ে দেয়া, নৌযান ডুবিয়ে দেয়া, ইত্যাদি। অক্টোবর ও নভেম্বর ভারতীয় সৈন্য ও আর্টিলারির সহায়তায় সীমান্ত ফাঁড়িগুলােতে তারা প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে এবং শহরগুলােতে পাকিস্তানিদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে তােলে। তিনি বলেছেন যে, এই সময়েই ভারতীয় সৈন্যরা পাকিস্তানি অবস্থানের কাছাকাছি গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে ব্রিজহেড তৈরি করে, যা পরবর্তীতে যুদ্ধের সময়ে সুবিধাজনকভাবে তারা ব্যবহার করে। ১৯৭১ সালের মে মাস থেকে পূর্ব পাকিস্তানে গােলযােগ সৃষ্টির জন ভারত ‘বিদ্রোহীদের রিক্রুট এবং তাদের ট্রেনিং দিয়ে চলছে। লন্ডন টাইমসের একজন প্রতিনিধি ব্যক্তিগতভাবে এই ধরনের একটি রিক্রুটিং সেন্টার পরিদর্শন করেছেন। ১৯৭১ সালের ১৮ জুন তারিখে প্রেরিত এক রিপাের্টে তিনি বলেন যে, প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অফিসার ইনচার্জ দাবি করেন যে তথাকথিত বাংলাদেশ বাহিনীর সব ট্রেনিং কেন্দ্রই বাংলাদেশের কোথাও অবস্থিত রয়েছে। কিন্তু টাইমসের প্রতিনিধি যখন জানতে চান যে এগুলােকে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঠিক কোন বিশেষ জায়গায় অবস্থিত? তখন উত্তরে বলা হয় যে, এটি একটি সামরিক গােপনীয় তথ্য: লন্ডন টাইমসের প্রতিনিধি আরও জানায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অভ্যন্তরে এ রকম প্রায় শ’ খানেক ট্রেনিং কেন্দ্র রয়েছে।
তিনি আরও বলেন যে, রিক্রুটিং পয়েন্টগুলাে এমন সব জায়গায় অবস্থিত, যেগুলাে বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে যে এগুলাে উদ্বাস্তুদের রেজিস্ট্রেশন অফিস। লন্ডন টাইমসের প্রতিনিধির খবর অনুসারে যাদের রিক্রুটিং সেন্টারে যােগদানের জন্য আনা হয় তাদের শপথ নিতে হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমৃত্যু যুদ্ধ করতে হবে। লন্ডনে বৃটিশ দৈনিক গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহীর সম্প্রতি সীমান্তের ওপারে চলে গেছে, ভারতীয়রা প্রকাশ্যভাবে তাদের আশ্রয় দিচ্ছে, এসব বিদ্রোহীর মধ্যে রয়েছে, সামরিক বাহিনীর লোেক এবং অন্যান্যরা। গার্ডিয়ান প্রতিনিধি একটি বর্ডার ক্রসিং পয়েন্টে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর অবস্থানের পাশে তাঁবু খাটানাে একটি শিবিরে রাইফেলধারী সশস্ত্র ব্যক্তিদের স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। লাগােসের নাইজেরিয়ার পত্রিকায় মে মাসের সংখ্যায় বলা হয়েছে, ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত বরাবর দুটি রিলিফ কেন্দ্র স্থাপন করেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও অনুপ্রবেশকারীদের এসব কেন্দ্রর মধ্যে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানাে হয়। তিন চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণে শুধু মৌলিক বিষয়গুলােই মােটামুটিভাবে শেখানাে হয়। এছাড়াও নিম্ন ও মধ্যম পর্যায়ের অধিনায়ক তৈরির ওপরেও যথাযথ গুরুত্ব আরােপ করা হয়।
এহেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিরামহীন স্রোতের শরণার্থীর আগমন ভারতের জন্য সৃষ্টি করে জাতীয় বিপর্যয়ের মতাে এক একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। বিপর্যয় থেকে নিকৃতীর একমাত্র পথ হলাে তাদের নিরাপত্তা সহকারে স্বদেশে ফেরত পাঠানাে । বাংলাদেশ সংকটের উপযুক্ত সমাধান অন্বেষণকালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রতিরােধ সংগ্রাম যাতে সম্পূর্ণভাবে না থেমে যায়, এ মর্মে ন্যূনতম ব্যবস্থা হিসেবে ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্র ট্রেনিংদানের প্রয়ােজন ভারতের কর্তৃপক্ষ মহলে স্বীকৃত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেয়া হয় ৩০ এপ্রিল। ৯ মে তাদের হাতে ন্যস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে যােগদানেচ্ছু বাংলাদেশের তরুণদের সশস্ত্র ট্রেনিংদানের দায়িত্ব। এপ্রিল মাসে ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী (বিএসএফ) বিক্ষিপ্তভাবে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়ে যে সীমিত সাহায্য করে চলেছিল তার উন্নতি ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত চার সপ্তাহ মেয়াদি এই ট্রেনিং কার্যক্রমের মান উচু পর্যায়ের ছিল না, শেখানাে হতাে সাধারণ হালকা যন্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। ১২ মার্চ এপ্রিলের মধ্যে বাংলাদেশ সশস্ত্র প্রতিরােধ বাহিনীকে পাকিস্তান বাহিনী ধাওয়া করে সীমান্তের ওপারে পাঠিয়ে দেয়। দেশের অভ্যন্তরে সর্বত্রই সামরিক সন্ত্রাস। তাদের সহযােগী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের উদ্যোগে গঠিত ‘শান্তি কমিটির তৎপরতার ফলে স্বাধীনতা সমর্থকের নিরাপদে বসবাস করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। যে সব বিদ্রোহী সেনা পাকিস্তানি আক্রমণের মুখে স্বজন-পরিজন ফেলে ভারতে এসেছিল অস্ত্রশস্ত্রের আশায়, তারাও প্রত্যাশিত সামরিক উপকরণ না পাওয়ায় পাল্টা অভিযান শুরু দূরে থাক, তাদের অবস্থা ছিল অসহনীয়।
গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র যা পাওয়া যেত তা প্রয়ােজন ও প্রত্যাশার তুলনায় নিতান্ত কম। তদুপরি দেশের ভেতর থেকে দখলদার সেনাবাহিনীর ক্রমাগত শক্তিবৃদ্ধির সংবাদে মনােবল বজায় রাখা ছিল সত্যই কঠিন। তবু মে-জুনে এসে এই হতাশা ও বিপর্যয় অবস্থা কাটতে থাকে। ট্রেনিং কার্যক্রমের মাধ্যমে শুরু হয় গেরিলা যােদ্ধাদের প্রকৃত প্রস্তুতি। প্রথম দিকে রিক্রুটিং সীমাবদ্ধ ছিল কেবল আওয়ামী লীগ দলীয় যুবকদের মধ্যে। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে এ সিদ্ধান্ত ছিল যথার্থ। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানে আগ্রহীদের বিরাট সংখ্যার অনুপাতে ট্রেনিংয়ের সুযােগ ছিল অপ্রতুল। ট্রেনিং-পূর্ব তরুণদের একত্রিত রাখা এবং তাদের মনােবল ও দৈহিক সুস্থতা বজায় রাখার জন্য সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় যুবশিবির’ ও ‘অভ্যর্থনা শিবির সৃষ্টি হয়। এসব শিবিরে ভর্তি করার জন্য যে ক্রিনিং পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়, যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ, কেবল সে সব তরুণরাই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি দ্বারা শনাক্তকৃত হবার পর ক্যাম্পে ভর্তির অনুমতি পেত। এসব ক্যাম্পে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্দীপ্ত তরুণদের ভর্তি করা হয়। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের নির্দেশাবলী যাই থাক না কেন, সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত ছিল চূড়ান্ত। মুজিবনগর থেকে পাঠানাে ঐ সব নির্দেশাবলি কাগজে কলমেই থেকে যেত। জনপ্রতিনিধিরা তাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ছাড়াও, প্রত্যেক ক্যাম্পে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বা বিশেষজ্ঞ একজন ট্রেনার নিযুক্ত করা হয়। ট্রেনিংয়ের জন্য বাছাই করা তরুণদের রাজনৈতিক বিশ্বাস, কর্মক্ষমতা, অগ্রগতি সম্পর্কে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ রিপাের্ট পেতেন। মানসিক দুশ্চিন্তা বহুলাংশে হ্রাস পেত। অবশ্য পরে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে, সামগ্রিক সমস্যার চাপে ভারত সরকারের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে যখন পরিবর্তন ঘটে। গঠিত হয় সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের অবস্থান অপেক্ষাকৃত সবল হয়, তখন বাংলাদেশের প্রগতিশীল তরুণদের সম্পর্কে এই বিধি নিষেধ বহুলাংশে অপসারিত হয়।
আওয়ামী লীগের তুলনামূলক বিরাটত্বের দরুন গেরিলা বাহিনীতেও আওয়ামী লীগপন্থীদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। যে প্রক্রিয়ায় এবং আনুগত্যের ভিত্তিতে রিক্রুটিং করা হতাে, এর প্রয়ােজন ও আবশ্যকতা ছিল। প্রথমত, গেরিলা ট্রেনিংয়ে মনােনয়নের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের সুপারিশ করার যে বিধান ছিল সেই সুপারিশের অপব্যবহার খুব একটা ঘটেনি। এদের স্থানীয় রাজনীতির সুবিধার্থে অধিক সংখ্যায় কেবল নিজ নিজ এলাকার তরুণদের মুক্তিবাহিনীতে ঢোকাবার ঝোঁক ছিল। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীর দৈহিক যােগ্যতা, সংগ্রামী স্পৃহা এবং চারিত্রিক গুণাগুণ শিথিলভাবে বিচার করা হলেও তাদের মনােবল, আদর্শগত সহমর্মিতা বিচার করা হতাে নিবিড়ভাবেই। দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগদানেচ্ছু অপর রাজনৈতিক ছাত্র-যুবকদের রিক্রুটিং ছিল সীমাবদ্ধ। ফলে তাদের মনে ছিল প্রবল ক্ষোভ ও হতাশা। দেশের ভেতরে পাকিস্তানি নির্যাতন যতই গ্রাম-গ্রামান্তরে পৌঁছেছে এবং বিশেষভাবে তরুণ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে, ততই প্রতিদিন হাজার হাজার ছাত্র-যুবক ট্রেনিং লাভের আশায় ভারতে এসে ভিড় করেছে, মাসের পর মাস অপেক্ষা করেছে। সাধারণ শরণার্থী শিবিরে অথবা অননুমােদিত ক্যাম্পের অবর্ণনীয় দুর্দশার পরিবেশ। মার্চ-এপ্রিলের পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের মুখে বিজ্ঞি দল, মত ও শ্রেণীর মানুষের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপক্ষে ঐক্য গড়ে উঠেছিল তার প্রেক্ষিতে রিক্রুট ও ট্রেনিংয়ের ক্ষেত্রে তরুণদের একতা কখনই বিনষ্ট হয়নি। সেপ্টেম্বরে রিক্রুটিংয়ের ক্ষেত্রে দলীয় বৈষ্যমের নীতি অনেকখানি হ্রাস পেলেও সার্বিকভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের বিন্নি পর্যায়ে সময়ের ঘাটতি ছিল। গেরিলা বাহিনী নিঃশেষ হচ্ছে না এবং দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে এবং নাশকতা ও অন্যান্য কার্যক্রমের মাধ্যমে শক্তিশালী পাকিস্তান বাহিনীর কাছে তারা দৃশ্যমান। তারা দক্ষ, কর্মক্ষম এবং ছােট ছােট গ্রুপে বিভক্ত। তারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আওতাভুক্ত এলাকার মধ্যে অবস্থিত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিশ্বকে জানান দিয়েছে তারা সক্রিয়। বিদেশীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ ও নিরাপত্তার অভাবে বৃটিশ শিপিং লাইন বন্দরে আসা বন্ধ করেছে। গেরিলারা শুধু তাই নয় ১৫৭টি বড় ধরনের সড়ক ও রেলওয়ে ব্রীজ ধ্বংস করেছে।
সড়ক ও রেলপথে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। জলপথেও গেরিলাবাহিনী উপর্যুপরি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৭ অক্টোবর ‘৭১ নিউ ইয়র্ক টাইমস বাঙালি গেরিলাদের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের প্রশংসাসূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, ভিয়েতনামের যা করতে ছয়মাস লেগেছিল, সে বিবেচনায় বাংলাদেশের গেরিলা যােদ্ধাদের শুরুটা উল্লেখযােগ্যই বলতে হবে। রেল সড়ক যােগাযােগ বিপর্যস্ত হলে পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ একটি হেলিকপ্টার বাহিনী ব্যবহার এবং পেট্রোল বােট ব্যবহার করছে যেগুলাে তারা পূর্ববাংলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য পেয়েছিল। এগুলাের সাহায্যে যোেগ ব্যবস্থা রক্ষা করা দুর্বল হয়ে পড়ে। হেলিকপ্টার বাহিনী দ্বারা যােগাযােগ ব্যবস্থা রক্ষা ব্যয়বহুল। আর্থিক অনটন দেখা দেয়। যেখানে গেরিলারা সক্রিয়ভাবে শক্রসেনাদের উপর কৌশলগত যুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে সমগ্র দেশের বিন্নি অঞ্চলে, নৌ-বহরের বিরুদ্ধে চালনা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের বন্দরে গেরিলারা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিতে বাধ্য করেছে। যদিও দখলদার সরকারকে দেশের অধিকাংশ জেলা এবং থানায় প্রশাসনিক কর্তৃত্বে নাজুক হয়ে পড়ে।
স্কুল-কলেজ বন্ধ। গেরিলারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনােবল এতটা ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছে যে, বর্ধিত বেতন ও পদোন্নতির লােভ দেখিয়ে পাকিস্তান সামরিক সরকারকে এখন সৈনিকদের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বার জন্য প্ররােচিত করতে হচ্ছে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে গেরিলাদের আক্রমণে ৩ হাজার রাজাকার পাকিস্তানের পক্ষে ছেড়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ৩ হাজার পূর্ব পাঞ্জাব রেজার সীমান্তে প্রহরায় এখন আর কার্যকর ভূমিকা রাখতে প্রায় অক্ষম। সেজন্য অন্তর্ঘাত দমনের কাজ করছে পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনী। কিন্তু অন্ত ঘাত দমন প্রক্রিয়া সহজ নয়। এটি হলাে আত্মরক্ষার একটি কৌশল মাত্র। বলতে গেলে পাকিস্তান বাহিনী এখন সীমান্তের দিকে ঘাঁটি গেড়েছে এবং আক্রমণের মানসিকতা পরিত্যাগ করে নিজেদের আত্মরক্ষার কাজেই নিয়ােজিত করেছে। সে লক্ষ্যে তারা সুরক্ষিত অবস্থান নিতে বাধ্য হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা ও প্রশাসন ভেঙ্গে পড়েছে। ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর মধ্যে এসব দেখে শুনে অধিক বিষন্নতা ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। মুক্তিবাহিনী একের পর এক আঘাত হেনে চলেছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সামনে বাড়তে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছে। নৈতিকভাবে হতােদ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরাজয় অনিবার্য। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ অথবা আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রামের মতাে মুক্তিবাহিনীর গৌরববাজ্জ্বল বিজয় সুনিশ্চিত। দেশব্যাপী গেরিলা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল।
রাজধানীর চারপাশে ওঁৎ পেতে থাকত ত্রিশ হাজার গেরিলা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেরিলাদের কর্মকাণ্ডে শক্তিশালী পাকিস্তান সামরিক বাহিনী রাতের বেলায় ইদুরের মতাে গর্তে ঢুকে পড়তে বাধ্য হয়েছিল। মনােবল ভেঙ্গে পড়েছিল। চারদিকে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু আতঙ্ক। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাপ্রধান লে. জে, এ.এ.কে নিয়াজী ছিল উষান্ত। দুঃসাহসিক গেরিলাদের আক্রমণে তার চোখ অন্ধ ও কান বধির হয়ে গিয়েছিল। এটাই ছিল নিয়াজীর ভাষ্য। পাকবাহিনী গেরিলাযুদ্ধ শুরু করতে চেয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকেই পাকিস্তান সামরিক বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশের জন্য তিনটি পর্যায়ে সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করে। ২৫ মার্চ থেকে প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত পাকিস্তানি সামরিক পরিকল্পনা মূল কথা ছিল সমগ্র প্রদেশ দখল কর। স্বাধীনতাকামী মনে হলে তাকে শেষ করে দাও। নির্বিচারে নির্দ্বিধায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ শুরু হলে পাকিস্তান সামরিক পরিকল্পনার পরিবর্তন হলাে। তারা কাউন্টার ইনসারজেন্সির জন্য গঠন করল বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ ও বাহিনী। পাকিস্তান সমর্থক বাঙালিদেরকে নিয়ে গঠন করল রাজাকার বাহিনী, আলবদর, আলশামস বাহিনী। ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস ই.পি.সি.এ.এফ বাহিনী গঠিত হলাে প্রধানত অবাঙালিদেরকে নিয়ে। জেনারেল নিয়াজী তার পরিকল্পনার কথা বলেছেন এভাবে, ভারতীয় ভূখণ্ডে পাল্টা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আমি কয়েকটি নাজুক স্থান বাছাই করে নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে সে জন্য অনুমতি দেয়া হয়নি। অক্টোবর ১৯৭১ পর্যন্ত আমি ভারতীয় ভূখণ্ডে গেরিলা আক্রমণ চালানাে ও সীমিত কার্য ব্যবস্থা গ্রহণের মতাে। অবস্থায় ছিলাম। ভারত যখন পূর্ব পাকিস্তানের চারদিকে বেষ্টনী গড়ে তুলেছিল তখন আমাকে অন্তত সীমান্তের ওপারে কমান্ডাে ও গেরিলা পাঠানাের অনুমতি দেয়ার জন্য ইসলামাবাদের নিকট জানিয়েছিলাম। শক্রর উপর চাপ সৃষ্টি করা আর শত্রু সমাবেশকে বিলম্বিত করা এবং মােতায়েনকৃত সৈন্য প্রত্যাহারে তাকে বাধ্য করা আর সেতু কালভার্টগুলাে উড়িয়ে দেয়া এবং দুশমনদের যােগাযােগ ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে যথােচিত পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি বরাবর অনুমতি প্রার্থনা করেছিলাম।’
এই গেরিলা ও কমান্ডাে অপারেশন করার জন্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী ও অবাঙালিদের নিয়ে ই.পি.সি.এ.এফ বাহিনী গঠন করেছিলেন। একই সাথে তাদের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত, পূর্ণমাত্রায় সমর্থন সহযােগিতা করার জন্য কেন্দ্রীয় ও স্থানীয়ভাবে গঠিত হয়েছিল শান্তি কমিটি। এসব শান্তি কমিটি ও পাকিস্তান গেরিলাবাহিনীদের নানা দায়িত্ব দেয়া হলাে। মুক্তিবাহিনী গেরিলাদের খুঁজে বের করা, গেরিলাদের সাহায্যকারী ও আশ্রয় দাতাদের উপর অত্যাচার চালানাে। তাদের নামধাম সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করা। রেলব্রিজ, শিল্প, অফিস আদালত পাহারা দেয়। আলবদর বাহিনীর পাহারা দেবার দায়িত্ব ছিল না। তৃতীয় পর্যায়ে ছিল সরাসরি আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণ সংক্রান্ত। পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার লক্ষ্যে সেই সময় পাকিস্তান সামরিক বিশারদগণ পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডার ও শাসক জেনারেল নিয়াজীর বিবেচনার জন্য কয়েকটি সমর পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়েছিল।
গেরিলাদের সাফল্য সম্পর্কে মেজর জেনারেল ডি. কে পালিডের মূল্যায়ন অবশ্য কিছুটা ক্রিটিক্যাল। যদিও সাম্প্রতিকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ এবং সাফল্যের খবর বাংলাদেশ যুদ্ধের প্রথমাবস্থার মতাে অতিরঞ্জিত নয়, তথাপি সংবাদপত্রসমূহ অবাস্তবভাবে আশাবাদী ঐ দেশে কী ধরনের সামরিক অভিযান চলছে তার সঙ্গে এদের কারাে পরিচয় নেই। দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রায়ই মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্বাধীন মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি হবার খবর থাকে। বাংলাদেশ সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সদস্য দাবি করেছেন যে গেরিলারা প্রতিমাসে পাঁচ হাজার পাকিস্তানি সৈনিককে হত্যা করছে। পাকিস্তানকে নাকি প্রতিমাসে দেড় শ’ কোটি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এই সমস্ত আশাব্যঞ্জক খবরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় অত্যাসন্ন এবং মুক্তিবাহিনী স্বীয় শক্তিতেই বিজয় অর্জনে সক্ষম। এই সমস্ত অবাস্তব খবরের কারণ হচ্ছে, যদিও এখন আমরা মুক্তিবাহিনীর শক্তি, সংগঠন ও কৌশল সম্পর্কে কিছুটা জানি, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না। যেহেতু পাহাড়ের অন্যদিক থেকে সঠিক কোনাে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। গেরিলাদের সফলতার কাহিনী শুনে এটাই মনে হতে পারে যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দেয়ালে পিঠ। ঠেকেছে এবং তারা ভীতি ও পরাজয়ের অনিবার্যতাকে মেনে রেখে হারার জন্যেই যুদ্ধ করে যাচ্ছে। এটা সত্য নয়। ১৪ মার্চে যখন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কথা ঘােষণা করেন, পূর্ব বাংলায় তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান ছিল এরকম চৌদ্দটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ন সমন্বিত চারটি ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড নিয়ে গঠিত চৌদ্দতম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন । একটি হালকা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট। তিনটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট। অন্যভাবে বলা যায় এই পদাতিক ডিভিশনে পদাতিক সৈন্যের কিছু কমতি নেই, কিন্তু কম আছে গােলাবন্দুকের পরিমাণ। যাই হােক এই চৌদ্দটি ব্যাটেলিয়ানের পাঁচটি নিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যাতে সবাই বাঙালি। বাহিনীর এই অংশটি অনুগত থাকেনি। অবশ্য তার অর্থ এই নয় যে, এদের সবাই মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিয়েছে। উধ্বতন অফিসারদের হত্যা করার পর, অনেককে নিরস্ত্র করা হয় এবং বহুজনকে বন্দি করা। হয়। এর ফলে এই বাঙালি রেজিমেন্টের একটি অংশই যা একটি কোম্পানির বেশি হবে না- মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে সক্ষম হয়।
চৌদ্দ নম্বর ডিভিশন ছাড়া আর ছিল তিন হাজার রাজাকার (যাদের সবাই বাঙালি) এবং তিন হাজার পূর্ব পাঞ্জাব রেঞ্জার (বাঙালি ও পাকিস্তানি সমন্বয়ে গঠিত)- যাদের ভূমিকা আমাদের বিএসএফ-এর মতাে। এই অনিয়মিত বাহিনীর অধিকাংশ বাঙালিই পালিয়ে যায় এবং যেখানেই নিজেরা সংগঠিত হতে পেরেছে এরা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যােগ দিয়েছে। শেখের সাথে আলােচনার ভান করার সময়ই ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশের আদেশ দেন। এপ্রিলের শেষাশেষি তিনি বাংলাদেশে উনচল্লিশটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটেলিয়ান এবং দু’টি আর্টিলারি রেজিমেন্ট নিয়ােজিত করেন। সংখ্যার দিক দিয়ে এটা চার ডিভিশনের সমান। যদিও অন্ত্র ও গােলাবারুদ আপেক্ষিকভাবে কম। এই বিশাল শক্তির সঙ্গে মুখােমুখি সংঘর্ষে আসতে চেয়েছে মুক্তিবাহিনী। এর জন্যে মূল্যও কম দিতে হয়নি তাদেরকে। সংঘাতের প্রথম পর্যায়ে পাকিস্তানিদের লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট- ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশাের এবং উত্তরে রংপুরে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করা। এর সাথে সাথে সীমান্তবর্তী শহরগুলােকে আয়ত্তে রাখা যাতে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চিম বাংলার সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন না করতে পারে। মুক্তিবাহিনী কয়েকটি শহর যেমন- কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ দখল করে নিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দুটি শহরই পাকিস্তানি। সেনাবাহিনী পুনঃদখল করে।
সিলেট এবং ময়মনসিংহ নিয়ে তাদের কিছু সমস্যা হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গুরুত্বপূর্ণ সেতুটি উড়িয়ে দেয়ার ফলে পাকিস্তানিদের অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছিল। নিয়মিত সেনাবাহিনীর পাশাপাশি তিন হাজার পাকিস্তানি রেঞ্জারকেও নিয়ে আসা হয়েছিল। কিন্তু এরা অন্তর্ঘাত দমনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিল এমনটি ধরে নেওয়া ভুল। রেঞ্জারদের মােতায়েন করা হয়েছে সীমান্ত প্রহরায় । এ কাজের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা হয়নি। কারণ সীমান্তে নিয়মিত সেনাবাহিনীর লােকও রাখা হয়েছে। ‘অন্তর্ঘাত দমনের কাজ করছে পাকিস্তান নিয়মিত সেনাবাহিনী। এখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কৌশল হচ্ছে বাংলাদেশের সমস্ত শহরাঞ্চলে এবং ক্যান্টনমেন্টগুলিতে পুরােপুরি কর্তৃত্ব বজায় রাখা এবং বিপজ্জনক সীমান্ত এলাকায় প্রহরা চৌকি চালু রাখা। গােপনসূত্র থেকে খবর পাওয়ামাত্র এই সমস্ত শক্ত ঘাঁটি থেকে সীমান্তে বা মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটিগুলােতে সৈন্য পাঠানাে হচ্ছে। এটা অন্তর্ঘাত দমন প্রক্রিয়া নয়। আত্মরক্ষার একটি কৌশল। যা হােক, পাকিস্তান সরকারের লক্ষ্য যদি হয় সারা দেশে সামরিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা, তা হলে বলা যেতে পারে সে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। সামরিক দিক থেকে এটা একটি শক্ত অবস্থান হলেও মুক্তিবাহিনীর গেরিলা কৌশল এই বৃত্তের প্রান্তসীমাতেই আঘাত আনতে সক্ষম। এদেরকে হতে হলে এবং তথাকথিত মুজাঞ্চল সৃষ্টি করতে হলে সম্মুখ যুদ্ধের প্রয়ােজন। এপ্রিল-মে মাসে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি থেকে এটা বােঝা গেছে যে, এই জাতীয় আক্রমণের জন্য তারা এখনাে প্রস্তুত নয়।
এটাও ধরে নেয়া খুব বাস্তব সম্মত নয় যে, কৌশলগত দিক থেকে পাকিস্তানি সামরিক আক্রমণ ব্যর্থ হয়েছে এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে তারা বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এটা সত্য যে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম সেক্টরে রেল ও সড়ক যােগাযােগের ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এই যােগাযােগ ব্যবস্থা একেবারেই ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। যা হােক, পাকিস্তান একটি হেলিকপ্টার বাহিনী ব্যবহার করছে এবং অনেক পেট্রোল বােট যেগুলাে তার পূর্ব বাংলায় ঘূণিঝড়ের সময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্যে পেয়েছিল। এগুলাের সাহায্যে যােগাযােগ ব্যবস্থা রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু সেনাবাহিনী একটি প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের রক্ষণ ব্যয় স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। আর্থিক অনটন কিছুটা হয়তাে হয়েছে। কিন্তু সমর সম্ভার নিঃশেষ হয়ে গেছে এটা ভাবার কোনাে কারণ নেই। মুক্তিবাহিনী বীরােচিত প্রচেষ্টাকে খাটো করে দেখা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু সামরিক সাফল্যের যে অবস্তিব চিত্র তুলে ধরা হচ্ছে তার একটি বাস্তব বিবরণ দেয়া প্রয়ােজন। মুক্তিবাহিনীর প্রধান কাজ হচ্ছে প্রতিরােধ। এদের কাছ থেকে সামরিক বিজয় আশা করা সঙ্গত নয়। অপর পক্ষ যেখানেই গেরিলার এবং অন্তর্ঘাতমূলক কাজে অংশগ্রহণকারীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে- সীমান্তে ঢাকা ও ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে, নৌবহরের বিরুদ্ধে, চালনা, চট্টগ্রাম ও নারায়ণগত্রে তারা শত্রুকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে সরে যেতে বাধ্য করেছে।
তারা দখলদার সরকারকে দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে প্রশাসনিক কর্তৃত্ব বজায় রাখা থেকে বিরত করেছে এবং তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মনােবল এতটা ভেঙ্গে দিতে সক্ষম হয়েছে যে বর্ধিত বেতন ও পদোন্নতির লােভ দেখিয়ে সরকারকে এখন সৈনিকদের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়বার জন্যে প্ররােচিত করতে হচ্ছে। কিন্তু এর থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌছান ঠিক হবে না যে মুক্তিবাহিনী অচিরেই একটি সামরিক বিজয় ছিনিয়ে আনতে যাচ্ছে। হিন্দুস্তান টাইম্স (নয়াদিল্লী) লে. জেনারেল এ.এ.কে নিয়াজী তার বইতে লিখেছেন, ২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পর পুলিশ, রাইফেলস, আনসার, ইস্টবেঙ্গল ব্যাটেলিয়ন, নেভী, এয়ারফোর্স পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে। এরাই পরবর্তীকালে মুক্তিবাহিনী নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সংকটকালে গােপনে সশস্ত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে এবং বামপন্থীরাও একই ধারায় অগ্রসর হয়। ছাত্র, বুদ্ধিজীবী, প্রাক্তন সেনাবাহিনীর সকলেই বিপুল সংখ্যায় মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করেন। এবং ভারত সীমান্তের কাছাকাছি ৫৯টি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করে এবং তাদেরকে উপকরণ সহায়তা করে। এদেরকে মৌলিক অস্ত্রশস্ত্র প্রশিক্ষণ, গেরিলা যুদ্ধের কলা-কৌশল, বিস্ফোরক, মাইন পুঁতে রাখা এবং গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে নাশকতা ও ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টির কলা-কৌশল শিখানাে হয়। তারা নৌপথে অচলাবস্থা সৃষ্টি করে এবং প্রায় তিনশ জন নৌসেনাকে আগরতলা থেকে কোচিংয়ে পাঠানাে হয়। যেখানে তারা আন্ডার ওয়াটার নাশকতার প্রশিক্ষণ নেয়। তাছাড়াও আরাে তিনশকে পলাশীর নিকট পশ্চিম বাংলার ভৈরব নদীতে ফগম্যান তৈরির জন্য প্রশিক্ষিত গ্রহণ করে ইন্ডিয়ান নেভী অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক দ্বারা। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান নেভীর সাবমেরিন এবং প্রশিক্ষিত ফগম্যানরা এসে মুক্তিবাহিনী সঙ্গে যােগ দেয়।
দেরাদুন লক্ষ্ণৌতে আট সদস্যের রাশিয়ান বিশেষজ্ঞ দল আর্টিলারি এবং সিগনেল ট্রেনিং প্রদান করে। তরুণ বাঙালি শিক্ষিত ছাত্রদের ভেতর থেকে কমান্ড ট্রাকচার ঠিক করার জন্য ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমির মাধ্যমে ৬শ’ জনকে ট্রেনিং দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, মুক্তিবাহিনী বেদায় এলাকায় বিমান ঘাঁটি স্থাপন করে। তাদেরকে ভারত সরকার দুটো বিমান দিয়ে সাহায্য করে। জুনের শেষ দিকে ৭০ হাজার যুবককে গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যারা বাংলাদেশের ভেতরে অক্টোবর মাসেই ঢুকে পড়ে। এবং নভেম্বর শেষ দিকে আরাে ৩০ হাজার যুবক ছােট অস্ত্র, মর্টার, গ্রেনেড, স্টেনগান এস,এল,আর এবং বিস্ফোরক নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তারা অতর্কিত গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর যােগাযােগের ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে ফেলে। সবচেয়ে বড় বিজয় ছিল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনােবলকে ভেঙে ফেলা। এ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন এস.কে.খান লিখেছেন- “মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা এক লক্ষ্যে উন্নীত করার পরিকল্পনায় ত্রিশ হাজার নিয়মিত এবং ৭০ হাজার অনিয়মিত অর্থাৎ গেরিলা বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ টগবগে তরুণদের, যারা জীবনবাজি রেখে দক্ষ গেরিলা যােদ্ধা হিসেবে তৈরি করা ছিল জরুরি। পরবর্তী পর্যায়ে আরাে ব্যাপকভাবে গেরিলাদের ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রেরিত হয়েছিল যারা দেশের অভ্যন্তরে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার সাহায্য পেয়েছিল, সহযােগিতা, আশ্রয়, খাদ্য পেয়েছিল, শ্রমিক ও কৃষকদের পক্ষ থেকে।
গেরিলার ৬২ হাজার গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং বিভিন্ন গ্রামে তারা অভয়ারণ্য গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিল। জনগণ তাদের মধ্যে বিভিন্ন মতভেদ ধামাচাপা দিয়ে দেশ স্বাধীন করা লক্ষ্যে এগিয়ে এসেছিল। কারণ বাংলাদেশের গেরিলাবাহিনী ছিল “one of the most highly educated armed forces” গেরিলাদের অপারেশন দ্রুততম সঙ্গে সাফল্যের দিকে এগিয়ে চলছিল। জনযুদ্ধ সম্পর্কে লিন বিয়াসসা যে বিখ্যাত থিসিস লিখেছেন, “জনযুদ্ধ দীর্ঘজীবী হােক” যা বাংলাদেশের গেরিলারা গ্রহণ করেছিল, কিন্তু তাদের নেতৃত্বে দিয়েছে কমুনিস্ট নয় এমপি ব্যক্তিরা। উন্নত অস্ত্রশস্ত্র হাতে পাওয়ার পর গেরিলা ও পাকিস্তানি সৈন্যদের হতাহতের অনুপাত ছিল ১:৪ এবং সেপ্টেম্বরে এ অনুপাত ছিল ১:১৫। অক্টোবরের মধ্যে ২৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য ও তাদের সহযােগী বাহিনী গেরিলাদের হাতে হতাহত হয়েছিল। এ সময় সানডে টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত সংবাদটি ছিল, বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ গেরিলাযােদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফেলে আসা অস্ত্র ডিপাে দখল করে উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে ঘােরাফিরা করছিল। এমনকি, গেরিলারা চট্টগ্রাম বন্দরের চারপাশ ঘিরে ছিল। যার ফলে প্রতিদিন যে ৬০০ টন রসদ গােলাবারুদ অপরিহার্য ছিল তা বন্ধ হয়ে যায়। এসব ঘটনাবলি ব্যাপকভাবে দেশি-বিদেশি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার ফলে বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের দিকে মােড় নেয়।
রাতেরবেলায় মুক্তিবাহিনীর কর্তৃত্ব
ঢাকা থেকে মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজ উইক’-এর বিশেষ প্রতিনিধি সিনিয়র সম্পাদক আর নাে দ্য বােরচা গ্রাফ বাংলাদেশের অবস্থার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা খুবই নির্ভরযােগ্য ও বিশ্ববাসীর কাছে তা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা বিশেষভাবে তুলে ধরতে। বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের উপর এখন মুক্তিবাহিনীর সুদৃঢ় কর্তৃত্ব স্থাপিত হয়েছে। পাকিস্তানে এগিয়ে চলেছে ধ্বংসের পথে। সারাবাংলাদেশে এখন ১ লাখের উপর গেরিলা সৈন্য পাকিস্তানি সেনাদের খতম করবার কাজে নিয়ােজিত । চরম আঘাত হেনে শক্রকে ধরাশায়ী করবার প্রস্তুতি চলছে সর্বত্র। ঘরে ঘরে আজ সত্যই দুর্গ গড়ে উঠেছে। যুদ্ধ করছে তারা পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের সত্তাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার জন্য। জয়ের চরম লগ্ন এগিয়ে আসছে। সাংবাদিক বােরা লিখেছেন, “আমি ও লন্ডন ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক ক্লার হােলিং ঢাকা থেকে ৫ মাইল দূরে মুক্ত অঞ্চলে গিয়েছিলাম। স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের সদর দফতরে আমরা দেখতে গেলাম, যােদ্ধারা প্রকাশ্যেই তাদের আস্তানার চার ধারে নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র পরিষ্কার করছে। ওদের কোনাে ভয় নেই পাকিস্তান ফেীজের জন্য। প্রত্যেকেই ওরা পরস্পরের সাথে কথা বলছিল সাধারণ কণ্ঠস্বরে। গেরিলা নেতা আবদুল মান্নান আমাদের বলেন, জনগণ আমাদের সঙ্গে আছে। আমরা তাই ভয় পাই না। পাক ফৌজ আসছে এই খবর পৌছে যায় আমাদের কাছে। যথাসময়ে জনসাধারণ আমাদের হুঁশিয়ার করে দেয় পাক ফৌজের আগমন সম্পর্কে। আমরা কেউই এখন পাক ফৌজের কোন আক্রমণের আশংকা করছি না। মান্নানের বয়স ৪৩ বছর। এক সময় সরকারি চাকুরে ছিলেন তিনি। বর্তমানে তিনি এই মুক্ত এলাকার ১৫০০০ লােকের শাসন পরিচালক ও গেরিলা নেতা। মান্নান বলেন, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর এখানে আসবার সাহস নেই । আমরা ইচ্ছা করলে যে কোনাে জায়গায় যেতে পারি। দিনের আলােতেই যেতে পারি।”
সন্ধ্যায় মান্নানের সাথে ভাত খেতে খেতে আমাদের আরাে অনেক কথা হয়। মান্নান বলেন, কদিন আগে আমরা এক ট্রাক পাকিস্তান ফৌজকে খতম করেছি। ১৯জন সৈন্য ছিল ট্রাকে। আমাদের ডুবরিরা ক্যাপ্টেন কে, এম, সাজাহানের নেতৃত্বে দুটি পাকিস্তান সামরিক জলযান ডুবিয়ে দিয়েছি। ২৫ বছর বয়সের কমান্ডাে নেতা কথার মধ্যে পাকিস্তান ফৌজকে স্ক্রিপ করে বলে ওঠেন, ‘ওরা কাপুরুষ। ওদের মত ভীতু সৈনিকের কথা কল্পনা করা যায় না। আমরা যদি নদীর এপার থেকে একটা ফাঁকা আওয়াজ করি তবে ওরা নদীর অপর পারে গিয়ে আশ্রয় নিতে চায়। আর তখনই ওরা গিয়ে পড়ে নদীর অপর পারে লুকিয়ে থাকা আমাদের অন্য গেরিলাদের হাতে। সব খতম হয় ওরা। গর্ব করে বলেন, “কদিন আগে ওরা ৩১জন পাক ফেীজ ও রাজাকারকে জ্যান্ত ধরে ফেলেন এবং পরে তাদের গুলি করে মারেন। শত্রু সৈন্যকে বন্দি করে রাখার মত কোন সংগতি নেই আমাদের। তাই গুলি করে মারতে হয় আমাদের যুদ্ধবন্দিদের। তবু রাখতাম যদি ওরা আমাদের ধৃত বন্ধুদের অমনভাবে গুলি করে হত্যা না করত।”
মান্নান আমাদের বুঝিয়ে বলেন, “গত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলাম আমরা। কিন্তু ইয়াহিয়া সেই ভােটের বিজয়কে করে পদদলিত। সামরিক বাহিনী আমাদের উপর চালায় অত্যাচার। আমরা এখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। শক্রর অত্যাচার আমাদের করে তুলেছে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আমরা যুদ্ধ করছি পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি, একটি নতুন দেশ গড়বার জন্য। নিউজ উইকের খ্যাতনামা সাংবাদিক আরাে লিখেছেন: “পাকিস্তান সেনাবাহিনী এক সময় গােলাবারুদ ও অন্ত্রে গেরিলাদের চাইতে বহুগুণে শক্তিশালী ছিল । কিন্তু এখন এই শক্তি ক্ষয়ের পথে। তারা আর এদিক থেকে গেরিলাদের চাইতে উচ্চমানসম্পন্ন নয়। বিশেষ করে পাকিস্তানের ভরসা ছিল, আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাবে। তাই তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদের ঘাটতি হবে না। কিন্তু আমেরিকার সামরিক সাহায্য বন্ধ করায় পাকিস্তানের রণসজ্জায় দারুণ আঘাত লেগেছে। বাংলাদেশে এখন সব সরকারি কর্মচারী, গ্রামের মোড়ল, সকলেই গােপনে সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। কমপক্ষে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ জায়গায়ই চলে যায় গেরিলাদের অধিকারে। এখন খেয়াঘাটে ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে কদাচিৎ পাকিস্তান ফৌজ চোখে পড়ে। শহরগুলাের বাইরে সাধারণত পাকিস্তান-ফৌজরা এখন খুব টহল দিয়ে বেড়ায় না। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নানা অত্যাচারের কাহিনী আমি শুনেছি। একটি গ্রামে ১০ বছরের একটি মেয়ের উপর বলৎকার করে ১২জন পাকিস্তান সৈন্য । তারপর তাকে হত্যা করে। এক গ্রামে সৈন্যরা গিয়ে দু’জন যুবতী মেয়ে দাবি করে। গ্রামবাসী জানায় ফৌজি বড় কর্তাকে। দুজন ফৌজকে ধরে নিয়ে যাবার আদেশ হয়। পরদিন সেনাবাহিনীর লােক এসে পুড়িয়ে দেয় সারা গ্রামটাকেই ।
৩৮ জন নিহত হয় এই ফৌজি হামলায়। যেখানেই আমি গিয়েছি মুক্তিবাহিনীর লােক ও সমর্থকরা সর্বত্রই বলছে, শেষ চুড়ান্ত বিজয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। একটা নদীর খেয়াঘাটে দেখতে পেলাম একজন পাকিস্তান সামরিক কর্মচারী একজন সাধারণ লােককে ছড়ি দিয়ে পেটাচ্ছেন। আমাকে দেখতে পেয়ে, মারা বন্ধ করেন অফিসারটি। পরে সেই মার খাওয়া লােকটি আমাকে বলেছিল; রােজ রােজ এমনি অনেক ঘটনাই ঘটে। কিন্তু প্রতিশােধের দিন আসছে। আর সেদিনটা ওদের পক্ষে হবে ভয়ঙ্কর। “আমার কাছে স্বাধীনতার যুদ্ধের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে সাধারণ মানুষের শৌর্যবীর্য তাদের সাহস আমাকে সবচাইতে বেশি অবাক করেছে। বাঙালিদের আগে ভীতু বাঙালি, অসামরিক জাতি বলে মনে করা হতাে। কিন্তু এই মুক্তিযুদ্ধ বাঙালিদের নতুন জীবন দিয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর যারা বাঙালি অফিসার ছিল তারা এসে আমাকে বলেছিল, তােমাদের এ যুদ্ধ আমাদের জাতে তুলে দিয়েছে। শিখ রাজপুতও এখন অবাক চোখে দেখে আর ভাবে, আরে বাঙালি তাে খুব সাংঘাতিক জাতি আমরাও অবাক হয়ে গিয়েছি এই দেখে যুদ্ধের অভিজ্ঞতাহীন এসব সাহসী ছেলেরা একমাস ট্রেনিং দেয়ার পর কিভাবে দুঃসাহসিক যােদ্ধায় পরিণত হয়েছিল। যেখানে কোনাে ট্রেইন্ড সােলজার যেতে সাহস করে না, তার অবলীলায় সেখানে প্রবেশ করত। অবলীলায় বাঙ্কারের কাছে গিয়ে গ্রেনেড ছুড়ে মারত। এরা তাে কোনাে বেতনভােগী যােদ্ধা ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ এক বিচিত্র ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধ যারা দেখেনি তাদের পক্ষে কল্পনা করা কঠিন যে, বাঙালি কত দুঃসাহসী জাতি হতে পারে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির গৌরব।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ