You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.14 | পূর্ববঙ্গ সংগ্রাম বিষয়ে কমলকুমার মজুমদার | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

পূর্ববঙ্গ সংগ্রাম বিষয়ে
কমলকুমার মজুমদার

আমরা যদি ছাব্বিশে মার্চ হইতে অদ্যবধি বড় পালােয়ান দৈনিক ভাষা নির্বিশেষে, পর্যালােচনা করিয়া দেখি, তাহা হইলে অনুধাবন করিব যে, এক টেবিল হইতে সম্মুখের টেবিলের সহিত কোনাে সমন্বয়বিধান শৃঙ্খলা নাই, এক কলম বলিতেছে, পাক সৈন্য চল্লিশ হাজার খতম, অন্য কলমে পঞ্চাশ হাজার, কামানাের গােলা ভিজিয়া যাওয়াতে (পলাশীর যুদ্ধ) আর শব্দ শ্রুত হয় নাই, মেসিন গান হইতে গােলা নিক্ষেপ হইতেছে; কখনাে ভয়ঙ্কর কখনাে মজাদার ফোটো ছাপাইতেছে; কোথাও সগর্বে লিখিত হইয়াছে বাঁট কাটারি লইয়া সকলে ছুটিতেছে, তখনই বােমা পেটো দিয়া কী হইবে। এই একজন মরিল এই বাঁচিল, ট্যাঙ্ক পিষিয়া মারিয়াছে (না মারিয়া পিষিয়াছে) এইখানে ঐতিহাসিক কথা ‘ওরিয়েন্টাল একসাজারেসন’ উল্লেখযােগ্য।
খবর মুদ্রিত হইতেছে তাহাতে তারিখ নাই, দৈনিকে বিজ্ঞাপন যখন বেশি, তখন পূর্ববঙ্গীয় কথা ছটকাট হইতেছে। নিজস্ব সংবাদদাতার খবর অদ্ভুত, যে মনােবল তাহারা এক হাতে তৈয়ারী করিতেছেন অন্য হাতে তছনছ করিতেছেন, একদিন একস্থানের খবর পরদিন চুপ, তাই খুলনার (১) চালনার কোনাে সংবাদ নাই। আজ পর্যন্ত বরিশাল বা ফরিদপুর কী ঘটিতেছে তাহা নাই। মনােবলের নামে খালি পদ্যই দেখি। এলেনবি কয়েক কথায় বিয়ারস্যবা যুদ্ধ গাজা জয় সম্পর্কে যাহা লন্ডনস্থ যুদ্ধ দপ্তরকে পাঠাইলেন, তাহা খবর-তৃষ্ণা মিটায় নাই; যুদ্ধ দপ্তর বিশদ বিবরণ চাহিলে, ইনালজেনসের একজন পদস্থব্যক্তি সুদীর্ঘ বিবরণ in the style of an imaginative war correspondent. লিখিলেন) ইহাতে অনুমেয় যে, টেবিলে টেবিলে কোনােই যােগাযােগ নাই আমরা মনে রাখি নাই যে, যখন মুজিবর মরীয়াদের কোনাে জানপয়চানি নাই, আমাদের খবরই তাহা যােগাইতেছে, অশ্বত্থামা হত প্রতি যুদ্ধলিপ্ত দেশের বলিবার অধিকার আছে এবং ঐ দেশের বন্ধুদেরও আছে। আরও যুক্তিসঙ্গতভাবে যে, অশ্বত্থামা হত এক শক্তিশালী অস্ত্র! তবে সেখানেও এক পােক্ত সংগঠন দরকার।
এই কয়েকদিনের যুদ্ধ বিষয়, একতিল কাহারাও গর্হিত কিছু মন্তব্যের অধিকার নাই- বলিতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের উল্লাসই তাহাদের পড়িয়া মার খাওয়াইয়াছে; কোনাে বুদ্ধিমান হৃদয়বান বাঙালির ইহা করা উচিত নহে! এই কয়েকদিনের ঘটনায় ভুল বা মূঢ়তার প্রশ্নই ওঠে না! অবশ্য ইহাও ঠিক যে, মাতৃভূমি-প্রেমে বেকার মরণপণ করিতে উদ্বুদ্ধ করাও নির্বুদ্ধিতা! এমনিতেই তাহারা গুলির হদিশে এ্যাকাৰ্যাকা (জিগজাগ) ছুটিয়া পালাইতে, বােমায় মাটিতে শুইয়া পড়িতে, দাঁতে পয়সা রাখিতে, লণ্ঠনের চিমনী কাগজ মারিতে পর্যন্ত জানে না আগুন নিভাইতে যেখানে বালতির অভাব প্রচুর তাহারা ঐ এক কুটিল মহামারিত প্রাণ দিতেছে। একমাত্র তাহাদের জন্য আমরা কাঁদিতে পারি!
মুজিবর রহমান যে কী পাকা কী অটুটভাবে প্রস্তুত হইয়াছিলেন, তাহা অদ্য প্রমাণিত হয়, তাহার রাজনৈতিক লক্ষ্যই তাহার সংগঠন, ভারতীয় কাগজ ব্যতীত কোনাে পূর্ববঙ্গীয় বলিবে না যে, আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। কত পর্যন্ত প্রস্তুত যে সকলেই, যে তাহারা পাকিস্তানের মতাে সর্ব অস্ত্র সরঞ্জামিত সৈন্যদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার সাহস করিল। এক চোটে বৃহৎ আদর্শ তথা পাকিস্তান হইতে অন্য হইল, আরও যে, মানচিত্র দেখিলে প্রস্তুত বলিতে যে অর্থ হয়, যাহা এই, যেমন দুই পক্ষের এক মধ্যবর্তী এলাকা ছিল, যাহার দুইপাশে লােকে ট্রেঞ্চ খনন করিবে- তাহার কোনােই উপায় নাই; আমরা সর্বত্র ছড়াইয়া আছি, সেই প্রস্তুতি মানে ভালােমন্দ পরিণতি বিবেচনা করত এখানে বৃথা; একমাত্র নৈতিক বল স্বাধীনতা তাহা সুকুমার মতি বালিকারও আছে; এই সূত্রে মার্চ মাসের গােড়া হইতে তিনি প্রত্যহ, তাহার দেশবাসী বাঙালি মাত্রকে স্মরণ করাইয়া দিতেছিলেন এবং ঐ দেশ এমনও হলপ করিয়া বলা যায় যে, স্বাধীনতার প্রথম দিন হইতেই তৈয়ারি ছিল, যে আমরা সর্বস্ব পণ করিব!
এই বিচার জজে নিশ্চয়ই মানিবে যে, ইয়াহিয়া কোনাে ভারতীয় মন্ত্রী নহে যে, মুজিবরকে একটি লাটড্যাঙ্গা ছাড়িয়া দিবে, যাহাতে তিনি একনিষ্ঠভাবে কুচকাওয়াজ করিতে পারেন, খুব ফুর্তিতে- টুপ স্কোয়াড্রন রেজিমেন্ট ব্রিগেড ডিভিশন গড়িয়া এক তাগড় ইনফ্যানট্রি যুদ্ধ নিমিত্ত প্রস্তুত থাকিতে পারেন; কিন্তু আর এক প্রস্তুতি তাঁহার ছিল যাহার প্রবলতায়, ঐতিহাসিকের স্মর্তব্য যে, পুলিশ, ই পি আর, ই বি আর সশস্ত্র নির্ভীকভাবে তাহার দেওয়া স্বাধীনতা রাখিতে মৃত্যুপণ করিল। ইয়াহিয়া তাঁহাকে অটল প্রস্তুত না জানিলে- এই হত্যাকাণ্ডে ক্ষেপিয়া উঠিত না। ইয়াহিয়া বুঝিয়াছিল পূর্বখণ্ড হাতছাড়া হয়েছে।
এখানে প্রস্তুত কথাটা যে, কত বৃথা তাহা যদি দশাসই শক্তিগুলাের ঘটনা উল্লেখ করি তাহা হইলে আন্দাজ করিতে পারিব, যথা অতর্কিতে পার্ল হারবার; যথা ১৯৩৬-৩৮ বিমানবহর সম্পর্কে বৃটিশ সমর নায়করা দৃকপাত করে না (ফিলিপ গুয়াডেল)। অন্যপক্ষে মুজিবর বাহিনীর দৈনিক-নিন্দিত সংগঠন রাহিত্যই—বিচ্ছিন্নভাবে প্রতি ছটাক জমি হইতে নৈতিক প্রতিরােধ-বিপক্ষকে জ্বালাতন করিবার জন্য পর্যাপ্ত, ইহাই আর এক তুখােড় সংগঠন মানিতেই হইবে। দাগা-আক্রমণ (একসন) সম্পর্কে অব্যর্থ হইতে অদ্যও পারে না। পূর্ববঙ্গ ক্ষেত্রে মহা মহা রথীর প্রয়ােজন এখানে তাহা নাই। তাই এতাবত দেখা যায় যুদ্ধচালনা কমানডাে রূপই আছে অনেকটা শক-ট্রপস’ কোথাও কামান- যেখানে এল এম জি যথেষ্ট, কোথাও স্যাবার জেইট, কোথাও বিমান হইতে গুলি বর্ষণ! কখনও ইহা যেন জলযুদ্ধ, কখনও নামমাত্র ইনফ্যানট্রি! অথচ বাঙালি যেখানে নিরস্ত্র, রুগ্ন, থতমত! ইত্যাকার আক্রমণ অদ্ভুত, ক্ষেত্র-সম্মত নহে হত্যালীলার জন্যই উদ্ভাবিত!
সংগঠন শব্দটি সর্বসময়ই রণকৌশল লক্ষ্য; সংগঠন ছত্রভঙ্গ করাই যে কোনাে সেনাবাহিনীর পণ দেখা যাইবে; তাই বড় খেদে চার্চিলকে বলিতে হইয়াছিল, আমরা রণের পর রণে ভঙ্গ দিতেছি, বিতর্কের পর বিতর্ক জিতিতেছি! ইতিহাসে কৃচিতপােক্ত জঙ্গির সমক্ষে কমজোরির দাঁড়াইবার কথা উল্লেখ আছে- যাহা মিরাকল! পুরাকালে প্রবল সাহস সংখ্যা এবং প্রায় তখন হইতে মারণাস্ত্র উদ্ভাবন-বিপক্ষকে তছনছ করিয়া আসিতেছে- ফ্ল্যাঙ্কস-এর মুখে বহুতে পদানত হইল— এক এক মারাত্মক অস্ত্রের জন্য ইতিহাস ফিহাত সংগঠন ভাঙার কাহিনীতে অবাক হইয়াছে।
ঝনঝরিয়েদের অতুলনীয় তড়াকা-ছো মারাতে সকলে ত্রাহি ত্রাহি করিয়াছে। কোথাও পড়িয়া থাকি চেঙ্গিস-এর বহরের অশ্বখুর উথিত ধুলায় আকাশ কয়েক প্রহর কালাে হইয়া রহে- ‘গড ইজ ফর দ্যা বিগ বাটয়ালিয়ানস’ সেদিনও প্রমাণিত হইয়াছে, চুরুটখেগাে চার্চিল ডানকারক-এর পতনের পর বলিয়াছিল, ‘অউ! ওভারওয়েলিমিং অ-ডস’ এবং এই সূত্রে মনে করা যাক মাজিনও লাইন কী কারণে বেকার হইল। সংগঠন ভাঙাই রণকৌশল, তিনজন বিশ্ববিখ্যাত মিলিটারি জিনিয়াস আলকজান্দার, চেঙ্গিস ও নেপােলিয়ান যাহাতে দারুণ সিদ্ধ তাই তাহারা পুণ্যাশ্লোকে! কিন্তু যেখানে, ধরা যাক, দৈনিক নিন্দিত সৈন্য সংগঠন নাই সেখানে ভাঙ্গিবে কি ইহা যে মনােবল!
মুজিবর যে মনােবলের সঞ্চার করিয়াছেন তাহা অভাবনীয়, ইহা ধর্মের ডাক নহে, ধর্মহীন মূঢ় মার্কসবাদী ডাক নহে- ইহা দেশাত্মবােধ। অবশ্য মানিতে হইবে যে, এখানেও সেই ফ্যানটিসিজম-হিরােইক রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। ঐ দেশাত্মবােধেই সকলেই আত্মত্যাগে প্রস্তুত! তথা পঁচিশে মার্চ মুজিবর যে স্বাধীনতা তাহাদের দিয়াছে তাহা রক্ষার জন্যই এই যুদ্ধ।
যুদ্ধের অনেক সময় গিয়াছে, অদ্যবধি আমরা কোথা অর্থাৎ দৈনিক পূর্ববঙ্গের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্র প্রকাশিত হইতে দেখি নাই অথচ উহাদের জন্য আমাদের কী ডুকরানি! অথচ পূর্ববঙ্গে কাহার কী করা উচিত আমাদের কাগজে রকমারি ফন্দি ও ফিকির বাতলাইতে আছেন এমনকি গত দুই মহাযুদ্ধে ইংরাজ বাহিনীকে জি এইচ কিউ হইতে পরিচালনায় যে কী গর্হিত ফল হয় তাহা লিখিত আছে। আমরা সকলেই পাক সৈন্যকে আহামকের দল বলিয়া ভাবিতেছি, তাহারা যে, পােক্ত পােড়-খাওয়া সৈন্য ইহা ভুলিয়া যাই যে এবং অভিজ্ঞরা বলেন, শত্রুকে কখনওই কম-জোরি বুঝিও না! অন্যপক্ষে মুজিবর মরীয়া যাহারা ইহাও ভুলিয়াছি যে, সেখানেতেও চৌকস পদস্থ সৈন্য সামন্ত আছে, যাহারা ‘লাগে-তাক’ পদ্ধতি যুদ্ধ চালনা শিখে নাই, (অবশ্য জাঁদরেল কালুর ন্যায় অনেকেই আছে) যাহারা রক্ষণ, পরিচালনা, দাগাতে তুখােড়। আবহাওয়া তাহাদের নখদর্পণে। যে টুকু এখনও মুজিবর মরীয়াদের ঘাটতি তাহা নিঃসন্দেহে বলা যায় পাক-রণকৌশল তাহা শিখাইয়া দিবে। ঠাকুরের অমনি ইচ্ছা, পাকা জঙ্গিবাজরা সর্বসময়ই প্রতিপক্ষ অনভিজ্ঞদের তাবড় করে। আজও সঠিক পদাতিক সৈন্যবাহিনীর সহিত ছােট খাট, সময়ের দিক দিয়া, সংঘর্ষ ব্যতীত কিছু ঘটা সম্ভব হয় না। একদিকে নিরস্ত্র লােক সংখ্যা যেমন প্রচুর অন্যদিকে এক সৈনিকের হাতে হাজার লােক বলওয়ালা অস্ত্র। এইরূপ অস্ত্রধারীকে বা অস্ত্রধারীদের ঘিরিয়া মুজিবর মরীয়ারা পর্যদস্ত করিয়াছে, ইহাতে তাহাদের অস্ত্র প্রাপ্তি ঘটিয়াছে; প্রতিটি অস্ত্র ছিনাইতে জানা-নাই কত কত মানুষ মরিয়াছে, কিন্তু ক্রমে তাহারা বলীয়ান হয়।
এই সকল সংঘর্ষ, যতদূর সম্ভব খবর হয়, প্রতিক্ষেত্রেই রাস্তা-ঘাটে ঘটিতেছে- মাঠ প্রান্তর প্রতিপক্ষ লাভ করে নাই তাহা সম্ভব নহে- মুজিবর মরীয়ারা ক্রমে এক পাকা গঠনে আসিতেছে এক চরিত্রের দিকে তাহা অগ্রসর হইতেছে, যে surprise ও mobility লইয়া, প্রথম মুহূর্ত হইতে মুজিবর মরীয়ারা বুক ঠুকিয়াছে; গণনা বলে, ঐ দুই সন্তুদ্ধি তাহাদের decisive victory দিকে অগ্রসর, করিবে কেননা ঐ দুই বুদ্ধি কখনই জঙ্গিকে বেদম প্রত্যয় দেয় না। কখনই, ভাগ্য, সহকর্মীদের কার্যধারা বাহিনীর জঙ্গি পটুত্ব শত্রুপক্ষের দুর্বলতা, অস্ত্রের বা একের চৌখষতুর উপর কোনাে আঁখি-ঠারে না। সকল সময় জঙ্গি তৈয়ার। সারপ্রাইজ কথাটা জুয়া খেলার চান্স লওয়ার মতাে ব্যবহার করে না এবং safety-first লইয়া বেশি মেয়েলিপনা উহারা করিবে না। এখানে পুরাকালের সাহস ও বাহুবল আর একরূপ লইবে; ইহা ছলে কৌশলে।
আমরা দেখিতেছি পাক-সৈন্য এখন সবিশেষ নজর দিয়াছে সেই সকল জেলায়, যাহা সিনেভেল হইতে কোথাও কোথাও কিছুটা উপরে, পূর্ব-উত্তরে; গড়পড়তা ৫-১৫০ ফুট পূর্ববঙ্গের উচ্চতা, এই স্থানগুলাে প্রায়ই নিম্নবঙ্গ বা সমতটের মতাে একটানা নহে, পূর্ব অঞ্চল পার্বত্য পাদভূমি হইলেও, জমি বড় নাবাল, (মৈমনসিংহ জিলা, শ্রীহট্টর কিয়দংশ) পূর্ব দক্ষিণ কিছুটা পাহাড়ি। ইহা পাক সৈন্য নায়করা জানে, ঐ প্রদেশের কোনাে ঘেত যােগ, জঙ্গ-দপ্তরের অবিদিত নাই! কোথায় কত জল দাঁড়ায় নিশ্চয়ই তাহাদের ছিট ম্যাপে দেখানাে আছে, অতএব বুঝিতে হইবে তাহাদের বৃষ্টিতে কোনাে মুসকিল ঘটিবার নহে; তাহারা সর্বসময় চাহিতেছে, বেশ কিছু উদ্বাস্তু সৃষ্টিরা এবং ভারত হইতে যে একরত্তি যােগান আসিতেছে তাহা বন্ধ করা; ফলে ঠাকুরগাঁ, দর্শনা, রংপুর পূর্বে কুমিল্লা অঞ্চল শ্রীহট্ট তাহারা বেড় করিতেছে এবং সর্বসময়েই তাহারা ছােট দল হইয়াই আসে, কিন্তু কখন আসে, কোথা হইতে আসে, কিসে করিয়া আসে, যদি মােটর তাহা হইলে তার স্পিড কত, একই রেজিমেন্টের কিনা, কীভাবে চলিয়া আবার কোথায় যায়, তাহাদের আড়াল করিতে, কোনাে বিমান বহর ব্যবহৃত হয় কিনা, তাহা আমরা কেহই জানি না; কখন কিছু জিলার খবর সন্ধান নাই অথচ সাংবাদিক সর্বত্রে সংবাদ-দপ্তর আমাদের কিছু বলে না, অর্থাৎ নিরস্ত্রদের বা কমজোরিদের সাবধান করে না, শুধু আমরা পড়িতেছি যেখানেই কিছু মুজিবর-মরিয়া সম্ভব সেখানেই হামলা; অতএব আমাদের তরফে কোনাে গুপ্তচর নাই, অন্যদিকে যে কোনাে ভীত নিরীহ দুখীই ও অবাঙালি পাক বাহিনীর চর; ফলে আমরা তাহাদের কখনও হয়রানি করিলাম, কিন্তু তাহারা অচিরেই কোনাে স্থান পূর্ণদখল করিল, গ্রামান্তর হইতে নতুন জোয়ান যাহারা ঘৃণায় মরিয়া হইয়া আমাদের দল বুদি তাহারা খােয়া যাওয়ার বন্দুক হইল! তাহারা প্রাণ দিল!
গেরিলা যুদ্ধের অর্থই যত তাগড়া সরঞ্জামিত সৈন্য হউক না কেন, তাহাতে উরুভঙ্গ হইবার সম্ভাবনা অব্যর্থ। দেখা যায় এই গেরিলা আরও বেপরােয়া হয় যখন সুপরিকল্পিত আক্রমণের কাজে লাগিবে- সকল সময় দখলকামী সৈন্য মহড়া লয়, এখানে একমাত্র শুভ সহায়ক ব্যাপার এই যে, পাক সরঞ্জামিত বাহিনী তাহার নিজস্ব কায়দা মতাে আসিতে পারিবে না এবং যখনই সে তাহার কায়দামতাে আক্রমণ করিবে না অর্থাৎ একজন সৈনিক যেন বর্মআঁটা এই নির্ভাবনায়- তখনই মারাত্মক অস্ত্র হাতে কখনই সে নিশ্চিন্ত হইতে পারিবে না; তখনই তাহার মরাল-এ টোল খাইবে। মরাল উহাদের ক্ষেত্রে ভদ্রভাবে বলা হইল আদতে উহা মৃত্যুভীতি! এখন এই টোল খাওয়া মরালের জন্য তাহারা অনেকটা কনসক্রিপটেড সৈন্যতে পরিবর্তিত হইবে। মরাল যে কী তাহা ফোকবাজ চার্চিলের হাঁ হাঁ করা হইতে অনুমেয় এবং যেদিন মরীয়াদের বন্দুক সম্পর্কে সর্বজ্ঞান হাতের তাক পাকা হইবে তখন উহা আরও ভাঙ্গিবে। এখন পাকসেনা নিজস্ব মরাল রাখিতেই কাজে অকাজে বিমান ব্যবহার করে, দূর পাল্লার কামান ব্যবহার, ইহাতে সিদ্ধান্ত হয় যে, নিজেরা কী পরিমাণ আতঙ্কিত হইলে এইভাবে আক্রমণ করে। তাই কোথাও কোথাও অজস্র গুলি খরচ কোথাও মার-দৌড় ধরনে হামলা। যেহেতু আমরা সর্বত্রে অতএব, ঐ পাক সেনাবাহিনী এক কাজ সাজিকে, এ কাজ যে রপ্ত করিয়াছে তাহাকে অন্যত্র লাগাইতে হয়ত হইবে। এখন আমাদের খবর নাই, যে পাক সেনা কর্তারা কীভাবে তাহাদের এই হত্যালীলার ব্যবহার করিতেছে। দলের হের-ফের ছুটির বিরাম কিছুই আরাম নাই, ইহা সবাই জানেন যে, ‘স্টেইং অন’ এক বিকট বিকার আনয়ন করিয়া থাকে।
ঢাকা ও অন্যান্য শহর এখন কেল্লাবত, পুরাতন দিন হইতে এই উদাহরণ আছে, নিশ্চিন্ত শহর যখন কেল্লা হয় অর্থাৎ রসদ, দেখ-ভাল, হাসপাতাল বেশি সৈন্য আস্তানা এবং অর্থাৎ প্রত্যেকটি চিজ বাচ বহিঃস্থান হইতে সংগ্রহ করিতে হয় কোনাে উপাদানের সহিত তাহার সঠিক যােগ নাই তখনই তাহার মুশকিল! মুজিবর নির্দেশিত মন্ত্রণাই অব্যর্থ ভাতে মারব পানিতে মারব! ঐ কেল্লাতে বেগর-ছুটির সৈন্যরা ক্রমে ভার হইবে, তাহারা ছুটির নামে এক ছাউনি হইতে অন্যত্র লইতে হইবে। পিতল বােম পরিবার ফুরসত পাইবে না। ইতিমধ্যেই খবর হইয়াছে, অসামরিকদের তাহারা লুঠেরা তৈরি করিতেছে, ইহাতে অন্যদলীয় লােকও আছে। (ইহাদের উপর কি তাহারা নির্ভর করিবে?) ভালাে, কিন্তু ইহা তাহারা জানিয়াছে ঐ কল্পতরু মারাত্মক অস্ত্রের বট ব্যবহার করিতে হইবে। কেননা আমরা সর্বত্রে যাহা আপাতত আমাদের বাধা যতদিন বাধা ততদিন এই লড়াই স্টাটিক থাকিবে। (ফলত দীর্ঘস্থায়ী) এখন গেরিলা হইবে পরে আক্রমণ নিশ্চয়ই অর্থাৎ ক্রমে এই বাধাই বেপরােয়া আক্রমণ করিবে। তখনই জয় অবধারিত কেন না মনােবল এতটুকু টোল খাইবে না। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের মনােবল অর্থে, দৈনিক বল কতদিন তাহারা পাইবে তাহাই চিন্তার কথা।
* এই সূত্রে যাহার কথা মনে পড়ে, তাহাকে প্রভাংস গুপ্ত হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড বিশেষ জানেন, ঐ ব্যক্তি ইতালির পতনে বাড়িতে হরিলুট দেয়; সে এক ফিরিঙ্গী পদলেহী। ৪১-৪ শরৎ বসুর কাছে কাজ করিত; ফলে আমার কাকা শান্তি রায়চৌধুরী ব্যারিস্টারদের সহিত তাহার আলাপ হয়, সে তখন ফিছেল স্ট্র্যাটিজিস্ট,- (কনান ডয়েল-এর গুরু) বলিল পতন সিঙ্গাপুর হইবে না, পাকা ব্যবস্থা আছে। আশ্চর্য তখন যুগপৎ শােনা গেল- হাে গিয়া! লােকটি মজার পায়ে ডায়বি জুতা মালকোচামারা গায়ে পাঞ্জাবি! বেঁটে খাট। আদতে সে সাহেদ সুরাবর্দীর শিষ্য!

সূত্র: দর্পণ
১৪.০৫.১৯৭১