অসহযােগিতার নেপথ্যে রাজনৈতিক দাবাখেলা
সপ্তম অধ্যায়ে পাকিস্তানের চক্রান্ত ষড়যন্ত্রে রাজনৈতিক দাবাখেলার দিকটি তুলে ধরা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে অনেকেই মনে করেছেন, ইয়াহিয়া খান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপ্রতিনিধি নেতা শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন, কিন্তু প্রকৃত অর্থে এটি ছিল একটি ভাওতাবাজি। ৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাতে পূর্ব পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করতে পারে তা নিয়েও ইয়াহিয়া খান কুটকৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর গণসংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন, তার জনসভায় (যেমনটি সিদ্দিক সালিক লিখেছেন) লােক সমাগমের জন্য এন ও যানবাহনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক বৈঠকে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘মুজিবকে ক্ষমতা দেবেন না সে একজন বিশ্বাসঘাতক’। ঐ বৈঠকে উপস্থিত রাও ফরমান আলী একথা লিখেছেন। এসময় আরাে লক্ষণীয় বাঙালি সেনাকর্মকর্তা মেজর (পরবর্তীকালে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) জিয়াউর রহমান ৭০-এর নির্বাচনের আগে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে নির্বাচনের বিষয়ে আলােচনা করেন। কিন্তু তিনি ‘ভােটের আগে ভাত চাই’ স্লোগান দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাড়ান। সেসময় গােয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল আকবরের নির্দেশে কর্মরত জিয়াউর রহমান তার উর্ধতন কর্মকর্তার নির্দেশে মওলানা ভাসানী ও ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমানকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করেছিলেন । কিন্তু নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু নিরংকুশ বিজয় লাভ করেন। ৩ মার্চ আহুত জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত হয়। প্রচন্ড আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে । ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের ঘােষণা দেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এসব চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার লক্ষ্যে অসহযােগ আন্দোলনের নেপথ্যে সশস্ত্রভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য জনযুদ্ধের ঘােষণা দেন। যার যা আছে তাই নিয়ে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােলার আহ্বান জানান। এমনকি তিনি ১৫ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যখন তার সঙ্গে আলােচনার জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আসছিলেন তখন শেখ মুজিব তাকে ‘অতিথি হিসাবে আখ্যায়িত করে বুঝিয়ে দিলেন অখন্ড পাকিস্তান আর নেই। তার পূর্বেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের নাম দিয়েছিলেন বাংলাদেশ। পতাকা তৈরী হয়েছিল। জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারিত হয়েছিল এবং একটি সুনির্দিষ্ট ভূখন্ড পতাকার লাল সূর্যের বৃত্তের মধ্যে দৃশ্যমান করা হয়েছিল ।
ব্রিগেডিয়ার আব্দুল রহমান সিদ্দিকী বলেছেন, জেনারেল ইয়াহিয়া আইয়ুব খানকে বাধ্য করেছিলেন ক্ষমতা ছাড়তে। ইয়াহিয়ার চারপাশে ক্ষমতালােভী যে সব জেনারেল জড়াে হয়েছিলেন তাদের কারাে ইচ্ছা ছিল না ক্ষমতা ছাড়ার । এ কথাটি ইতিহাসের মুনতাসীর মামুন লিখিত বইটির বহু জায়গায় বহুজনের কথায় উল্লিখিত হয়েছে। ১৯৬৯ মে মাসে ইয়াহিয়া খান অ্যাবােটাবাদে লে. কর্নেল এবং তার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলেছিলেন আগামী ১৪ বছর পূর্ব পাকিস্তানকে শাসন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি নেকড়েদের মুখে দেশটিকে ছেড়ে দিতে পারি না। প্রয়ােজন হলে একের পর এক সেনাকমাও আসবে, তাদের কজায় থাকবে দেশটি। অনেকেই ধারণা করেন প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা হস্তান্তরের ইচ্ছা ছিল । আসলে বর্তমানে বিভিন্ন সাক্ষাঙ্কার ও তথ্য থেকে জানা যায়, এটা ছিল একটা লােক দেখানাে ধাপ্পাবাজি। ইয়াহিয়া ক্ষমতায় এসেই জেনারেল শের আলীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, যিনি ছিলেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে, ইসলাম আদর্শ জোরেশােরে তুলে ধরতে। শের আলীর কৌশল ছিল সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছাড়বে না বরং রাষ্ট্র ও জাতিকে সেনাবাহিনী কজায় রাখবে। ইয়াহিয়ার প্রধান স্টাফ অফিসার ছিলেন জেনারেল পীরজাদা । ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিকী। তার মাধ্যমে চেয়েছিলেন শের আলীকে নিরস্ত করতে। পীরজাদা বলেছিলেন, কীভাবে তিনি শের আলীকে নিরস্ত্র করবেন যেখানে তিনজন পাঞ্জাবি তার গােয়েন্দা সংস্থার প্রধান। এরা ছিলেন মেজর জেনারেল আকবর খান (মহাপরিচালক, আইএসআই), রিজভী (পরিচালক ইনটেলিজেন্স ব্যুরাে ও উমর (এনএসসি)। এ মন্তব্যে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়। জেনারেলদের চক্রের মধ্যেও আধিপত্য বিস্তার করেছিল পাঞ্জাবিরা।
শেষ পর্যায়ে সিদ্দিকী লিখেছেন, সামরিক শাসনে বিরাজনীতিকরণ, ইসলামের জিগির বৃদ্ধি এবং বাঙালিদের কোনােরকম ছাড় না দিয়ে শাসন করার লক্ষ্যে তারা দৃঢ় করেছিল। সংখ্যাগষ্ঠিতার কারণে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে বাঙালির অধিকার আছে তার নৈতিক ও আইনগত দিকটি তারা উপেক্ষা করেছিল। ২৮ নভেম্বর ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়া নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার পাঁচ শর্ত বা এল, এফ, ও (লিগ্যাল ফ্রেম অর্ডার) ঘােষণা করলেন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু হলাে। পাকিস্তানে দু অংশে জামায়াত দুটি পত্রিকা বের করল। করাচি থেকে দৈনিক মুসাওয়াত ও ঢাকা থেকে দৈনিক সংগ্রাম। দুটি পত্রিকাকেই নৈতিক ও আর্থিক সমর্থন দিল আইএসআই। এ সময় জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে আধিপত্য বিস্তার করেন মেজর জেনারেল উমর। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের সশখ মুজিবের দাপট কমানাের জন্য মওলানা ভাসানীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য প্রায় আড়াই কোটি টাকা দেয়ার বিষয়টি ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলেন। ইয়াহিয়া থান লাহাের হাইকোর্টে তার প্রদত্ত হলফনামায় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে তার বৈঠকের কথা উল্লেখ করে বলেন, “ন্যাপ সভাপতি তাকে বলেছেন, ‘সব কিছু ভুলে যান এবং দেশ শাসন করুন। অবশ্য একই সাথে মওলানা ভাসানী দুর্নীতি দূরীকরণ, বাঙালিদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে ৯০ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেন জে. ইয়াহিয়ার কাছে। এসব দাবি পূরণ করায় নিজ আগ্রহ ও ঐকান্তিকতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট মওলানা ভাসানীর কাছে এ সংক্রান্ত সম্ভাব্য সমাধানের ব্যাপারে জানতে চান। ভাসানী কোনাে সমাধান না দিয়েই বলেন, আপনি একজন প্রশাসক আর আমি একজন এজিটেটর। সমস্যার সমাধান বের করার দায়িত্ব তাই আপনার, আমার নয়। মওলানা ভাসানী আরাে বলেছিলেন, “মুজিবকে ক্ষমতা দিবেন না, সে একজন বিশ্বাসঘাতক। ইয়াহিয়া খান বলেন, আমি তাে সৈনিক, রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকেই মুজিবের সঙ্গে কথা বলা উচিত।’ এ সম্পর্কে মেজরজেনারেল রাও ফরমান আলী লিখেছেন, ঐ বৈঠকের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন। এই লক্ষ্যে সামরিক জান্তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ভেতরে বিভক্তির কৌশল গ্রহণ করে। ফরমান আলী আরাে বলেছেন, নির্বাচনে সেনাবাহিনী ডানপন্থী দলগুলােকে অর্থ দিয়ে সাহায্য করে।
শেখ মুজিব তা জানতে পারেন। অন্যদিকে সামরিক চক্র জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উৎসাহিত করেছিলেন যাতে শেখ মুজিব নির্বাচনে বিজয়ী বা ক্ষমতায় না যেতে পারে। জেনারেল গুল হাসান বিভিন্ন সময়ে তার আপন লোেকদের বলেছেন, শেখ মুজিব সেনাবাহিনীর বন্ধু নয়। ক্ষমতায় এসে তিনি সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি হ্রাস করতে চাইবেন যা বিদ্যমান ব্যবস্থার পরিপন্থী। ইয়াহিয়া এর মধ্যে ঢাকা এলেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে সাংবাদিকদের জানালেন, মুজিবই হচ্ছেন পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী। তার এই বাক্যটিকে অনেকে তার ভালােমানুষী ও ক্ষমতা হস্তান্তরের সদিচ্ছা হিসেবে দেখেছেন। কিন্তু সিদ্দিকী জানাচ্ছেন অন্য তথ্য । তার মতে এটি হঠাৎ মুখ ফসকে কোনাে কথা নয়, ভেবে চিন্তেই ইয়াহিয়া তা বলেছিলেন। প্রথমত এই মন্তব্যের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে মুজিবের বিরুদ্ধে সজাগ করেছিলেন এবং ভুট্টোকে প্ররােচিত করেছিলেন। তারপর লারকানায় ভুট্টোর আতিথেয়তা গ্রহণ করলেন ইয়াহিয়া । সেনাবাহিনী বা জুন্তা তখন আরাে দৃঢ় হলাে যে, কোনাে বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী করা যাবে না। এবং ভুট্টোও তখন ক্ষমতার অংশীদার হতে চাইলেন। ভুট্টো ঘােষণা করলেন, জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যােগ দিতে ঢাকা যাবেন না। জেনারেল উমর ছােট ছােট দলের নেতা যারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন, তাদের কাছে যাতায়াত শুরু করলেন এই অনুরােধ নিয়ে যেন তারা ঢাকা না যান। ক্যান্টনমেন্টে সিদ্দিকীকে একদিন এক অফিসার বলছেন, বাঙালিরা সব বিশ্বাসঘাতক, এদের কাউকে বিশ্বাস করা যায় না, এমনকি যারা ইউনিফর্মে আছে তাদেরও। সিদ্দিকী জানতে চাইলেন সৈনিক, ইবিআর, ইপিআর মিলিয়ে বাঙালির সংখ্যা কুড়ি হাজারের মতাে, কী করা যাবে এদের নিয়ে। কোনাে সমস্যা নয়।
এই জারজগুলাে কাপুরুষ। এখনই তাদের নিরস্ত্র করে ব্যারাকে রাখা উচিত । তাদের দরকার নেই। সরে যাক তারা আমাদের পথ থেকে। জেনারেল পীরজাদা ফরমান আলীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন মুজিব যদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়, তাহলে কী ধরনের পাকিস্তান হবে? জেনারেল ফরমান উত্তরে বলেছিলেন, একটি দুর্বল ও শিথিল পাকিস্তান। পীরজাদা বলেন, আমরা চাই শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান। আমরা মুজিবকে সে পথে যেতে দেব ।
মওলানা ভাসানীর সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সাক্ষাৎ
মশিউর রহমানের বক্তব্যে থেকে জানা যায়-৭০ সালে আমরা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। যদি আমরা ঐকবদ্ধ থাকতাম এবং নির্বাচন করতাম তবে ২৫টা আসন অন্তত নিশ্চয়ই পেতাম। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের চারজন ভুট্টোর সাথে যােগ দিয়ে জিতেছিলেন, এটা অনেকেই হয় তাে জানেন। সেদিন নির্বাচন বিরােধিতার ডামাডােলের সময় কিন্তু এমন কয়েকজন ছিলেন আনােয়ার জাহিদ, নুরুল হুদা, কাদের বকশ, মােহাম্মদ সুলতান এবং শ্রদ্ধেয় হাজী দানেশ, যারা ন্যাপের নির্বাচন করার স্বপক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিলেন। খুলনায় ঐ সময় ভাসানী ন্যাপের কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। মশিউর রহমান ওই অধিবেশনেই দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সে কারণে দলের বামপন্থী উপদল অধিকতর ক্ষুব্ধ হন। তিনি বলেছেন, “৬৯-এর মাঝামাঝির দিকে ইন্টেলিজেন্সের এক অফিসার মেজর কমল (মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান) দেখা করেছিলেন মওলানার সাথে। কমল ছিল জিয়াউর রহমানের ডাক নাম। তখন ইন্টেলিজেন্সের চিফ ছিলেন জেনারেল আকবর। মেজর কমল মওলানার সাথে স্বাধীনতার প্রশ্নে আলােচনা করেছিলেন। পূর্বাপর বিচার করে মওলানা ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েন এবং এ সময় আমার সাথে তাঁর বহু আলাপ হয়, যা। আমার জন্যে এক বিরাট অভিজ্ঞতা। আমাদের নিজেদের পার্টি তখন ক্ষত-বিক্ষত। সাধারণ নেতা এবং কর্মীরা বিভ্রান্ত। বামপন্থী বন্ধুরা নৈরাশ্যের ঘােরে আচ্ছন্ন প্রায় সবাই ।
এমনি এক অবস্থায় রাজনীতির ঘােরপ্যাচ বেড়ে চলল নেপথ্যে। এ সময় ঘােষিত হলাে, ইয়াহিয়া চীন যাচ্ছেন সেপ্টেম্বর মাসে। মওলানা আমাকে বললেন, “প্রগতিশীল বামপন্থী রাজনীতি বাঁচাতে হলে ইলেকশন বন্ধ ছাড়া কোনাে উপায় নেই। কারণ ইলেকশন হলেই ৬ দফার আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নেবে। সুতরাং ইলেকশন আপাতত স্থগিত রাখার জন্যে যদি কিছু করা যায় তাে তাই কর।” তিনি আরাে বলেন, “আমি পাকিস্তানে চীনা রাষ্ট্রদূত, যিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার সাথে পিকিং যাচ্ছিলেন তাকে বললাম, আপনি প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাইকে আমার এই ছােট্ট চিরকুটটি পেীছে দেবেন। | চীন থেকে ফিরে এলেন ইয়াহিয়া । সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউসে আমি তার সাথে দেখা করলাম। তার সাথে হুজুরের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আলােচনা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন, প্রধানমন্ত্রী চৌ-সেই জ্ঞানী বৃদ্ধও এমনি আশংকার কথা আমাকে বলেছেন। কিন্তু আমি বলছি, বেশি খারাপ অবস্থা দেখলে আমি ক্ষমতা হস্তান্তর করব না। তাকে আমি বােঝতেই পারলাম না যে, কোন পথে এর সমাধান নিহিত। তিনিও বুঝতে চাইলেন না, সেতুর কোন পারে সংকট থেকে মুক্তি।
এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে সামরিক গােয়েন্দা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান কেন কি জন্য মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন? ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে এ সময় সামরিক গােয়েন্দা বাহিনী অত্যন্ত তৎপর ছিল যাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন না পান। জিয়াউর রহমান যদি সেই বার্তা বহন করে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি মওলানা সাহেবকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়টি উত্থাপন করেছিলেন। ন্যাপের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান নির্বাচনে ‘অন্তত ২৫টা আসনের আশা করলেও আওয়ামী লীগের উত্তাল জনপ্রিয়তার মুখে কয়েকটি আসন দখল করলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতে ব্যর্থ হতাে। পরিণামে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যেত। আওয়ামী লীগের ছয় দফার জোয়ারের মুখে মওলানা ভাসানী সে পথে অগ্রসর হননি। তিনি মনে করেছেন তারা দু চারটি আসন পেলেও অতাে আসনে বিজয়ী হতে পারবেন না, সেটা ভাসানীর মতাে বিচক্ষণ রাজনীতিকের উপলব্ধি করতে অসুবিধা হয়নি। তিনি নির্বাচনের ব্যাপারে একেবারে নিরুৎসাহী ছিলেন। বামপন্থীরা নির্বাচন না করার জন্য এবং দক্ষিণপন্থীরা যখন ভাসানীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করছিলেন তখন তিনি সেই কাউন্সিল অধিবেশনে তিনটি শর্ত আরােপ করেন, যেমন: ১. আইনগত কাঠামাে আদেশ সংশােধন, ২. সামরিক আইনে সাজাপ্রাপ্ত সকল শ্রমিক, কৃষক, ছাত্রনেতা ও কর্মীকে অবিলমে মুক্তিদান, তাঁদের হুলিয়া ও মামলা প্রত্যাহার, এবং ৩. ১৯৭১-এর মার্চ মাসের দিকে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ।
বলাবাহুল্য, এ শর্ত পূরণ করা সম্ভব ছিল না ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষে। কারণ দেশের সকল প্রধান দল তখন নির্বাচনের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। যে কারণেই হােক মওলানা জিয়াউর রহমানের বৈঠকের নেপথ্য রহস্য অজানা থাকলেও মওলানা ভাসানী সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বলেই ইতিহাসে লিখিত থাকবে। | ‘৭০-এর সাধারণ নির্বাচনের ব্যাপারে ভাসানীর রহস্যজনক নিষ্ক্রিয়তা সম্পর্কে নানা ব্যক্তি নানা ধরনের ব্যাখ্যা করেন। তাঁর দলীয় নেতা-কর্মীদের ব্যাখ্যা একরকম, বিরােধী দলীয়দের ব্যাখ্যা ভিন্ন। এ প্রসঙ্গে কাদের সিদ্দিকী (বীরােত্তম) যিনি ‘৭২-পরবর্তীকালে ভাসানী-মুজিব উভয়েরই বিশেষ স্নেহভাজনে পরিণত হন এবং তাদের সঙ্গে রাখতেন অব্যাহত যােগাযোেগ, তিনি লিখেছেন: ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তখন সমগ্র জাতিকে মােহিত করে ফেলেছিল। পরবর্তীতে মহান নেতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে যতােই মিশেছি, ততােই বুঝেছি-কেন তিনি অমন করেছিলেন । কিন্তু ‘৬৯-৭০-এর তার কাজকর্ম সত্যি বুঝিনি। আমার কাছেও বেখাপ্পা ঠেকেছে। সাধারণ লােককে আমি বলতে শুনেছি “ভােটর সময় যাও-বা দুই একটা পানবিড়ি সিগারেট পামু, ভােট বন্ধ করে দেখতাছি হুজুর তাও পাবার দিবার চায় না। ভাত দেওয়া কি সােজা কথা। রেজেক-হেডা অইলাে আল্লার কাম।” লােকজনের কথা শুনে আমারও মনে হয়েছে, সত্যি হুজুর ভেজাল করছেন। নির্বাচন যতােই ঘনিয়ে এলাে, হুজুর ততােই নিষ্ক্রিয় হতে লাগলেন। তিনি আর তেমন ভােটের বাক্সে লাথি মারতে চান না। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তাে একেবারেই মুখ খুললেন না। যাওবা দুই একবার খুললেন, তা বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই- “মুজিবর তাে আমার পােলার মতাে। আমার হয়ডা সেক্রেটারির মধ্যে মজিবর আছিল এক নম্বর। মজিবরের মতাে ভালাে সংগঠক আবার হয় নাকি?” আমি তখন বুঝিনি, পরে শুনেছি, আগরতলা মামলা থেকে বেরিয়ে বঙ্গবন্ধু হবার পর সবকটি বড় বড় সিদ্ধান্তে তিনি হুজুরের পরামর্শ ও আশীর্বাদ নিয়েছেন। স্বাধীনতার পর দিনের পর দিন তার সঙ্গে কথা বলে পরিষ্কার জেনেছিলাম, ‘৭০-এর জানুয়ারি থেকে নির্বাচনের ফল ঘােষণা পর্যন্ত হুজুর যা কিছু করেছেন, যাতে তার মজিবরের সুবিধা হয়, সেভাবেই করেছেন।
ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে পাকিস্তানের সামরিক ও বেসামরিক আমলা এবং এক শ্রেণীর গণবিরােধী ও স্বার্থন্বেষী রাজনীতিতে নতুন ষড়যন্ত্রের রাস্তা খুঁজছিল। নির্বাচন হলে অসামরিক সরকার গঠিত হলে আমলাদের ক্ষমতার দাপট ক্ষুন্ন হবে। এজন্য নির্বাচন বানচালের উদ্দেশ্যে আর একটি সামরিক আইন পর্যন্ত জারি করা যায় কিনা তারও চিন্তা-ভাবনা চলে কোনাে কোনাে স্বার্থন্বেষী মহলে। ভাসানীর কাছে তা অজ্ঞাত ছিল না এবং তার নিজের দলেই এমন অনেকে ছিলেন যাঁদের গণবিরােধী চরিত্র সম্পর্কে তিনি ছিলেন অবহিত । এই শ্রেণীর রাজনীতিকগণ ভাসানীকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তাদের সেঅভিসন্ধি বানচাল করে দেন। সাংবাদিক আরাে লিখেছেন, “মধ্যাহ্নভােজনের পূর্বেই প্রেসিডেন্ট ভবনের গাড়ি এসে পিভির ফ্লাসম্যান হােটেল থেকে উন্নতশির মওলানা ভাসানীকে আলােচনা স্থানে নিয়ে যায়। দু’ঘণ্টারও বেশি দীর্ঘ সময় ধরে রাজনৈতিক আলােচনার মধ্যে মওলানা সাহেব সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলেন: “দেশটা তােমার বা আমার কারাে বাপের সম্পত্তি নয়। দেশের জনগণ যা চায় তা দিয়ে চক্রান্তের সুযােগ আর সৃষ্টি করাে না। এসব করে এমনিই তাে এ দেশটারও যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। আর বেশি ক্ষতি করার চেষ্টা করলে কারাে লাভ হবে না। সে দিনের বিকেলের লিয়াকতৰাগের এক বিশাল জনসভায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে তার আলােচনার এ সব কথা বক্তৃতা প্রসঙ্গে জানালে সেখানে উপস্থিত শ্রোতাদের তিনি সহৰ্য অভিনন্দন লাভ করেন। তার সমর্থকসূচক বলিষ্ঠ স্লোগানে পিন্ডির আকাশ-বাতাস সে দিন মুখরিত হয়ে উঠেছিল। সেদিন পিন্ডিতে অবস্থানকারী অন্যান্য কয়েকজন সংবাদ রিপাের্টারের মতাে আমিও ক্লাসম্যান হােটেলে গিয়েছিলাম। ভাসানী-ইয়াহিয়া আলােচনা সংশ্লিষ্ট সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়ে ভুল করে যাদু মিয়ার হােটেল কামরায় ঢুকে পড়েছিলাম। সে কামরায় পাক-বাহিনীর আমলাচক্রের বেশ কয়েকটি বিশেষ চেনামুখ” আমার নজরে এসেছিল। সেখানে ঢুকতে দেখেই যাদু মিয়া বিরক্ত হয়ে আমাকে বলেছিলেন, এখানে কেন আসছেন? বুড়ােটা ঐ পাশের কামরায় রয়েছে। সেখানে যান। বুড়ােটা’ অর্থাৎ মওলানা ভাসানীর সম্পর্কে সামান্যতম শ্রদ্ধার ভাবও তখন তার সেই কণ্ঠস্বরে আমি দেখতে পাইনি।
মওলানা সাহেব সেদিন তাদের সবাইকে হতাশ করেছিলেন বলে আমার ধারণা জন্মেছিল। ঢাকা থেকে লাহাের পৌছালে তাঁকে লালটুপি-পরা হাজার হাজার জনতা সংবর্ধনা দেয়। তিনি ছিলেন মিয়া ইফতেখারউদ্দিনের পুত্র ন্যাপনেতা মিয়া আরিফ ইফতেখারের অতিথি। তাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেখানকার ন্যাপ প্রার্থীদের নির্বাচনী প্রচারণার উদ্দেশ্যে। ১৩দিন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। সেখানে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন, জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন এবং সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নানা পত্র-পত্রিকায়। সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে তিনি এমন খােলামেলা বক্তব্য রেখেছেন যা সেখানকার ন্যাপ নেতাদের জন্যে ছিল বিব্রতকর। তার একজন সফরসঙ্গী লিখেছেন: ১৩দিনের এই সফরে মওলানা সাহেব ছােট বড় সর্বমােট ১২টি জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন এবং ৪ জায়গায় লাহাের, মুলতান, কোয়েটা, করাচীতে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য পেশ করেছেন। মওলানা ভাসানীর সহযােগীদের অনেকের অভিমত, তখন তিনি সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান গিয়েছিলেন। সে দেশে সেটাই তার শেষ সফর।” ১২ নভেম্বর দেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে সর্বকালের নৃশংসতম ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাস। সংবাদপত্রে হােক, রেডিওতে হােক খবরটি তৎক্ষণাৎ দেশবাসী জানতে পারেনি। দুই দিন পরে বিবিসি-র প্রাথমিক খবরে বলা হয়: ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসে পঞ্চাশ হাজার মানুষ হয় নিহত হয়েছে অথবা বঙ্গোপসাগরে ভেসে গেছে।
কয়েক দিনের মধ্যেই অবশ্য জানা যায় এই প্রাণহানির সংখ্যা দশ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। উপকূল এলাকার কোনাে কোনাে জনবহুল জনপদে জনমানবের চিহ্ন নেই। ১০ নভেম্বর, ভাসানী জ্বর-কাশি ও আরাে কিছু উপসর্গ নিয়ে ঢাকার ধানমণ্ডির একটি নার্সিং হােমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীসহ কয়েকজন বিশিষ্ট চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে ছিলেন তিনি। বিবিসিতে পঞ্চাশ হাজার নিহত হওয়ার কথা শােনামাত্রই তিনি রােগশয্যা থেকে উঠে বসেন এবং সহকারীদের বলেন: আমার চট্টগ্রাম যাওয়ার ব্যবস্থা করে। ডা. রাব্বী বললেন: এ শরীরে আপনার কোথাও যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু মওলানার তখন কারাে কথায় কান দেয়ার সময় নেই। তিনি শুধু বললেন: আমার জীবনের গ্যারান্টি দেয়ার মালিক একমাত্র আল্লাহতালা। তােমাদের কথা আমি শুনবাে না আমাকে যেতেই হবে ভােলা-সন্দ্বীপ। ১৬ নভেম্বর রাতের ট্রেনে তিনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পৌঁছেন। সেটি ছিল রমজান মাস। তিনি নিয়মিত রোজও রাখছিলেন। চট্টগাম থেকে বহু কষ্টে একটি জলযানে ১৮ নভেম্বর হাতিয়া, ১৯ নভেম্বর রামগতি, ২০ নভেম্বর ভােলা এবং ২১ নভেম্বর বরিশালের বিভিন্ন অঞ্চলে কখনাে নৌকায়, কখনাে হেঁটে প্রলয়বিধ্বস্ত এলাকা ঘুরে তিনি শিশুর মতাে কেঁদে ফেললেন। তখন সেখানে শুধু লাশ আর লাশ। শুধু মানুষের নয় গবাদিপশু পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর। সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিমেয়। ২২ নভেম্বর তিনি ঢাকা পৌছে এক সাংবাদিক সম্মেলনে উদ্রুত এলাকার বিবরণ দেন বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে, কিন্তু সাংবাদিকরা লক্ষ্য করেন, চোখে তার আগুন। তার বক্তব্যের মূল কথাটি ছিল: এই দুর্দিনেও ওরা (পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক) কেউ আসেনি। তিনি বিশ্ববাসীর কাছে ত্রাণসামগ্রী পাঠাবার আকুল আবেদন জানান। ইতােমধ্যেই অবশ্য ভারত, চীন, সােভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে ত্রাণসামগ্রী পাঠানাের আশ্বাস পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বাঙালির এই মহাদুর্দিনে আমাদের পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইয়েরা সেখানকার শাসকবর্গ ও রাজনৈতিক নেতারা- রইলেন নিচুপ।
২৩ নভেম্বর তড়িঘড়ি করে ভাসানী পল্টন ময়দানে এক জনসভা করেন। জাতির ইতিহাসে সে ছিল এ ঐতিহাসিক জনসভা। ক্ষয়ক্ষতি বর্ণনার পরে সকলকে বিস্মিত করে দিয়ে তিনি সেই সভায় স্লোগান দেন: “স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। তার সেই অবিস্মরণীয় ভাষণ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ওই দিনই রাতে এবং পরদিন আকাশবাণী থেকে প্রচারিত হয়: “পূর্ব পাকিস্তানে বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা ভাসানী স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন।
মুজিবকে বেঁধে ফেলা হলাে
২৮ মার্চ ‘৭০ ইয়াহিয়া আরেকটি ভাষণ দেন, তাতেও নানা আদেশ-নির্দেশ ছিল। ৩০ মার্চ ‘আইনগত কাঠামাে’ Legal Framework Order, 1970 ঘােষিত হয়। এই ঘােষণার রূপরেখার ভিত্তিতেই প্রণীত হবে নতুন সংবিধান। এতে ‘৫৬ ও ‘৬২ সালের শাসনতন্ত্রের সংখ্যাসাম্য নীতির অবসান ঘটে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের বিজয় হয়। জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের আসন বণ্টন করা হয় এ ভাবে: পূর্ব পাকিস্তান ১৬৯টি-এর মধ্যে মহিলা আসন ৭টি, পাঞ্জাব। ৮৫টি-এর মধ্যে মহিলা আসন ৩টি, সিন্ধু ২৮টি-এর মধ্যে মহিলা আসন ১টি, বেলুচিস্তান ৫টি-এর মধ্যে মহিলা আসন ১টি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ১৯টি-এর মধ্যে মহিলা আসন ১টি, কেন্দ্ৰ শাসিত উপজাতি অঞ্চলসমূহ ৭টি, মহিলা আসন নেই । সর্বমােট ৩১৩টি আসন। পাঁচটি প্রাদেশিক পরিষদের ৬০০ আসনের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল ৩০০ মহিলা ১০, পাঞ্জাবে ১৮০, মহিলা ৬ ইত্যাদি । পূর্বেই ঘােষিত হয়েছিল প্রত্যক্ষ ভােটে নির্বাচন হবে এবং নির্বাচন হবে যুক্ত-নির্বাচন পদ্ধতিতে। ‘আইনগত কাঠমােতে আরাে বলা হয়েছিল পাকিস্তানের ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের নাম হবে ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’। যে ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা সংরক্ষণ করতে হবে, রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলমান, প্রদেশগুলাের থাকবে সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি। আইনগত কাঠামাে ঘােষণার পরদিনই ভাসানী এক বিবৃতি দিয়ে ইয়াহিয়ার পূর্ববর্তী ভাষণসমূহ ও তাঁর প্রণীত আইনগত কাঠামাের সমালােচনা করেন। প্রেসিডেন্টের ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেক পাকিস্তানিরই এই ধারণা হবে যে, শাসনতন্ত্রের চূড়ান্ত কাঠামাের ব্যাপারে নির্বাচিত সদস্যদের কোনাে কথা বলারই অধিকার থাকবে না। শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত দলের নির্বাহী পরিষদের সভায় “প্রেসিডেন্টকে গণতন্ত্রের মূলনীতির সাথে সামঞ্জস্য আনয়নের জন্য আইনগত কাঠামাের নির্দেশ যথাযথভাবে সংশােধনের আহ্বান জানানাে হয়। অন্য কয়েকটি দল ও সংগঠনও আইনগত কাঠামাে’র শর্তাবলির সমালোচনা করে। সামরিক শাসকবৃন্দ মনে করলেন এল, এফ, ওর মাধ্যমে শেখ মুজিবের হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। ৬ দফা বাস্তবায়িত হবে না। শেখ মুজিব বললেন, ৬ দফার ভিত্তিতে তিনি নির্বাচনে যাবেন। তিনি বলেন এটা হলাে বাংলার জনগণের জন্য রেফারেন্ডাম। তিনি আরাে বলেন, তিনি বিজয়ী হলে যেমনটি সিদ্দিকী সালিক লিখেছেন ‘এল, এফ-ও’ টুকরাে টুকরাে করে ছিড়ে ফেলে দেবেন।”
ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে কথােপকথন হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্তসার বর্ণনা দিয়েছেন হাসান জহির। সেজন্য নিজস্ব ভাষ্যে না গিয়ে হাসান জহির থেকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত হওয়া হবে শ্রেয়। নির্বাচনের পর ইয়াহিয়া ঠিক করলেন পূর্ব পাকিস্তান সফর করবেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করবেন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন মুজিব যাতে বুঝতে পারেন যে, তিনি ক্ষমতা ছেড়ে ইয়াহিয়া চলে যাবেন ব্যারাকে, এটাই তাে হওয়ার কথা। শেখ মুজিবকে বােঝাবার কী ছিল? এখানেই ইয়াহিয়া মূল কথাটা বলে ফেলেছেন। “আমি জানতাম এর দরকার আছে”, লিখেছেন ইয়াহিয়া, কারণ ভারতীয় এজেন্টরা তার মধ্যে সেনাবিরােধী ফোবিয়া ঢুকিয়ে দিয়েছে।” ইয়াহিয়া শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার কি ধারণা প্রেসিডেন্টের আসলে কোনাে ক্ষমতা নেই? শেখ সাহেব ঠিকই উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, যতদিন জেনারেলরা তার সঙ্গে আছে ততদিনই তিনি ক্ষমতাধর। ইয়াহিয়া লিখেছেন, তিনি শেখ মুজিবের কাছ থেকে জানতে চাচ্ছিলেন পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর ‘ট্রেন্ডস’ সম্পর্কে তিনি কী জানেন? এবং ইয়াহিয়া বিস্মিত হলেন জেনে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ধারা সম্পর্কে শেখ মুজিব যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। ইয়াহিয়া বলেছিলেন, তিনি চেয়েছিলেন শেখ মুজিবের আশপাশে যেসব পাকিস্তানবিরােধী আছে তাদের প্রভাব ক্ষুন্ন করে মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে। এটি যে মিথ্যা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার জন্যই তাে শেখ মুজিব ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তাকে মানসিকভাবে ইয়াহিয়া কী প্রস্তুত করবেন? ইয়াহিয়া বলছেন, তিনি শেখ মুজিবকে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক করতে চেয়েছিলেন। ছেলেমানুষী প্রস্তাব বলে মুজিব তা উড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং তা যথাযথই ছিল। তখন ইয়াহিয়া প্রস্তাব করেছিলেন এমন কোনাে সেনা অফিসার যাকে তিনি বিশ্বাস করেন, তাকে ইয়াহিয়া সামরিক আইন প্রশাসনের কাঠামােয় স্থান দেবেন। মুজিব বললেন, তিনি পরামর্শ করে জানাবেন। ইয়াহিয়া লিখেছেন, এই পরামর্শের কথা শুনেই বুঝে নিলেন প্রস্তাবটি মাঠে মারা গেছে এবং ঠিক তাই হলাে। তিনি পরে জানালেন, সেনাবাহিনীর ৭৫% ছাঁটাই করে দিতে হবে।
ইয়াহিয়া কি আর তা মানতে পারেন। তবে ইয়াহিয়ার মতে, তিনি যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন শেখ মুজিবের আস্থা অর্জনে এবং এক সময় তার মনে হয়েছে, মুজিব তাকে বিশ্বাসও করেছেন। কিন্তু সেনাবাহিনীকে তিনি কখনাে বিশ্বাস করেননি এবং কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি নেতা এতে আরাে ফাটল ধরিয়েছেন। তবে ইয়াহিয়া তাদের নাম বলেননি। এরপর ইয়াহিয়া কী করতে চেয়েছিলেন তা বর্ণনা করেছেন। সেটি বড় কথা নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলাে তার এই মন্তব্য যে, ভুট্টোকে তিনি সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন ভুট্টো যখন বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে, কিন্তু তার একক ইচ্ছায় শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করতে দিতে পারা যায় না, তখন ইয়াহিয়া মনে করেন, এটি “ভ্যালিড পয়েন্ট”। কিন্তু গণতন্ত্র মানলে ভুট্টোর দাবিকে “ভ্যালিড পয়েন্ট” বলা যায় না। | ১১ জানুয়ারি ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়া এসেছিলেন ঢাকায়। শেখ মুজিবকে তিনি জানিয়েছিলেন, প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ফেব্রুয়ারির আগে সংসদের অধিবেশনে ডাকা যাবে না, তখনই তিনি কঠোর এবং বৈরীভাবাপন্ন হয়ে উঠলেন। তিনি জানালেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে অধিবেশন ডাকতে হবে। এবং এ ব্যাপারে তিনি কারও সঙ্গে আলাপ করতে ইচ্ছুক নন। ইয়াহিয়া লিখেছেন, “আমি বলব এটি আন্তরিক মনোভাব নয়, যদিও এ লজিক অস্বীকার করা যায় না। এই একটি মন্তব্য থেকে বােঝা যায়, শাসকরা কীভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যে ইয়াহিয়ার কথায় কান দিলেন না এর ফলে সৃষ্টি হলাে তিক্ততা। ৭ ঘণ্টার অধিকাল স্থায়ী ইয়াহিয়া-মুজিব শীর্ষ বৈঠক ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। ধারণা দেয়া হয়েছিল ইয়াহিয়া মুজিব সমঝােতা হয়েছে। বাস্তবে তা ছিল ফাকা বুলি। রাজনৈতিক সমাধানের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পার্লামেন্ট ডাকার যে দাবি জানাচ্ছিলেন, ইয়াহিয়া খান তা কৌশলে এড়িয়ে যান। এর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ভুট্টো ও জেনারেলরা একজোট হওয়ার সময় পেয়ে গেল।
একদিকে শেখ মুজিবকে ধোঁকা দেয়া ও অন্যদিকে প্রকাশ্যে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন একথা বলার মাধ্যমে তিনি একদিকে যেমন জনগণকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন অন্যদিকে জেনারেলদের কাছে বার্তা পাঠালেন যে তারা একজন পূর্ব পাকিস্তানির অধীন হতে যাচ্ছেন। ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৭ ফেব্রুয়ারি ভুট্টোর বাড়িতে যান এবং ভুট্টো জেনারেলদের ভেতরে এক বন্ধুত্বপূর্ণ আলােচনা বৈঠক হয়। বৈঠকে। তারা বাঙালিদের প্রচেষ্টা নস্যাৎ করার জন্য কৌশল সম্পর্কে আলােচনা করেন। ইয়াহিয়ার পরামর্শে ২৭ জানুয়ারি একটি বৃহৎ দল নিয়ে ভুট্টো ঢাকায় আসেন। ভুট্টো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে ক্ষমতার অংশীদারিত্বের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মুজিব তা। প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘ছয় দফার ব্যাপারে কোন দরকষাকষি চলবে না।” অধিবেশন আহবানে বিলম্ব ও ইয়াহিয়া ভুট্টোর ষড়যন্ত্র বাঙালিদের ক্ষুব্ধ করে তােলে। বাধ্য হয়ে ইয়াহিয়া গােয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে রিপাের্ট পেয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি ঘােষণা করেন যে, ৩ মার্চ ‘৭১ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। অধিবেশনকে সামনে রেখে ইঞ্জিনিয়ার ইনস্টিটিউটের এক সভায় শেখ মুজিবুর রহমান সংসদীয় দলের নেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা এবং পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের নেতা নির্বাচিত হন এম মনসুর আলী। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘােষণা করেন তার দল ঢাকা অধিবেশনের যােগদান করবে না কারণ জাতীয় পরিষদ হবে ‘কসাইখানার মতাে, অধিবেশনে ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দেয়া হবে। তিনি বলেন, যেসব ক্ষুদ্র দলের সদস্যরা রয়েছেন তারা অধিবেশনে যােগ দিতে গেলে তাদের ঠ্যাং ভেঙ্গে দেয়া হবে। কারণ ভুট্টোর দলের ভেতরেই গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। তাদেরকে সামলে রেখে ভুট্টো বললেন, ‘খাইবার থেকে করাচী পর্যন্ত আইন অমান্য করা হবে এবং যারা যাবে তাদের খতম করে দেয়া হবে। অন্য এক সূত্রে জানা যায় জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান জেনারেল ওমর জাতীয় পরিষদের সদস্য যারা পিপিপির সদস্য নয় তাদেরকে অধিবেশন বর্জনের জন্য ইয়াহিয়া খানের বার্তা পৌছে দেয়।”
১৯৭১ সালের আগেই পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আস্থা তারা হারিয়েছিলেন এবং মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, দীর্ঘস্থায়ী সামরিক শাসনের কারণে আমরা পাকিস্তানিরা এই দাম দিয়েছি। পূর্ব পাকিস্তান ভারতীয় বাহিনী জয় করেনি। তাদের সাহায্যে স্থানীয় জনগণই তা নিয়েছে।” পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি যখন এ রকম, তখন ইয়াহিয়া বার বার শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলেন যে, যেহেতু তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন সেহেতু তিনি যেন সংযম প্রদর্শন করেন। কিন্তু তার হঠাৎ মনে হলাে, মুজিব যেন আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না। তিনি নিজেই নতুন একটি রাষ্ট্রের পিতা হতে চান। নিজেকে তিনি বিচার করেছেন তখন আব্রাহাম লিঙ্কন অথবা কায়েদে আযমের কাতারে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন ম্যাগাললাম্যানিয়াক। এ ক্ষেত্রে তিনি অবশ্য একা ছিলেন না। অনেকের মধ্যেই এই ধারা দেখা দিচ্ছিল।” এই অনেকের নাম অবশ্য ইয়াহিয়া উল্লেখ করেননি।
২৮ ফেব্রুয়ারি। প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেঃ জেঃ এস, পি, এম পীরজাদা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আহসানকে টেলিফোনে বললেন ৩ মার্চের আহূত পরিষদে অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করা হয়েছে। পীরজাদার ইচ্ছানুসারে সন্ধ্যা সাতটায় গভর্নর হাউসে ভাইস এ্যাডমিরাল এস, এম, আহসান শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার কথা অবহিত করালেন। আশ্চর্যের বিষয় মুজিব কোনাে উদ্বেগই প্রকাশ করলেন না বরং যুক্তি সহকারে বললেন মার্চে অধিবেশন পুনঃ আহবান করলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এপ্রিল হলে বড় অসুবিধা হবে এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদ স্থগিত হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ঐদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবের প্রতিক্রিয়া রাওয়ালপিন্ডিকে জানানাে হয়। এবং বলা হয় এই ঘােষণায় যেন পার্লামেন্ট বসবার নতুন তারিখ থাকে। এর জবাবে রাওয়াপিভি ঠাণ্ডাভাবে শুধু বলে পাঠায় ইয়াের মেসেজ ফুললী আন্ডারস্টুড’। এক গভীর ষড়যন্ত্রের আবর্তে সেদিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আবর্তিত হয়েছিল তারই প্রমাণ প্রেসিডেন্টের ১ মার্চের ভাষণ। | সিদ্দিকী সালিক লিখেছেন, পরিষদে অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার সম্পর্কে শেখ মুজিব পূর্বেই অবগত ছিলেন বলে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্য বেশ সময় পেয়েছিলেন। ঘােষণার আধা ঘণ্টার মধ্যে ক্রুদ্ধ জনতা বাঁশের লাঠি, লােহার রড এবং আপত্তিকর স্লোগানে রাস্তায় নেমে আসে। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলার প্যান্ডেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। কেননা শেখ মুজিব ওই পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তার দলীয় কর্মীদের সংগঠিত করার সময় পেয়েছিলেন।
শেখ মুজিব এ পরিস্থিতিতে হােটেল পূর্বাণীতে আয়ােজিত জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন “উই ক্যান নট লেট ইট গাে আনচ্যালেঞ্জড। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল এবং ৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে হরতাল আহ্বান করেন এবং সরকারকে চিন্তা করার জন্য তিনি দিনের সময় প্রদান করে বঙ্গবন্ধু বলেন, আগামী ৭ মার্চ তিনি জনসভায় তার পরবর্তী কর্মসূচি ঘােষণা করবেন। এ প্রসঙ্গে সিদ্দিকী সালিক লিখেছেন: জনগণের সামনে কঠিন মনােভাব দেখানাের পর শেখ মুজিব গভর্নমেন্ট হাউসে এসে বললেন, এখনাে সময় আছে যদি অধিবেশন বসার নতুন তারিখ প্রদান করা হয় তবে জনগণের ক্রোধ প্রশমিত করা যাবে, তার পরে হলে ‘ইট উইল টু লেট’। ঢাকায় মুখ্য সামরিক কর্মকর্তাগণ চেষ্টা করেন, কিন্তু প্রত্যুত্তরে শেষ রাতে জেনারেল পীরজাদা জেনারেল ইয়াকুবকে এ্যাডমিরাল আহসানের কাছে থেকে ক্ষমতা অধিগ্রহণের কথা ফোনে জানালেন।”
এরপর শেখ মুজিব ষড়যন্ত্র বিষয়ক কথিত ধারণায় বদ্ধমূল হলেন। এ প্রসঙ্গে আসগর খানের বক্তব্যে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একান্ত এক আলােচনায় তিনি বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কি রূপ নেবে এবং অচলাবস্থার অবসান কিভাবে সম্ভব? উত্তরে শেখ মুজিব বলেছিলেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত সহজ। ইয়াহিয়া খান প্রথম ঢাকা আসবেন, এম, এম, আহমদ (প্ল্যানিং কমিশনের প্রধান) তাকে অনুসরণ করবেন। ভুট্টো আসবেন, আলােচনা ভেঙ্গে যাবে । ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেবেন। তারপরই পাকিস্তানের শেষ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান লিখেছেন, “ফেব্রুয়ারির গােড়ার দিকে আমি পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে লারকানায় গেলাম জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করতে। শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় তিনি প্রস্তুত ছিলেন। তবে তিনি অনুরােধ জানালেন, জাতীয় সংসদ বসার আগে এ ধরনের আলােচনার পর পিপিপি নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে এলেন। আমাকে জানানাে হলাে, দুটি প্রধান দলের মধ্যে আরাে আলােচনা প্রয়ােজন। আমি নিশ্চিত হলাম যে, দুপক্ষের মধ্যে সমঝােতার অবকাশ আছে। এখানে যে বিষয়টি ইয়াহিয়া তুলে ধরেছেন তা হলাে ভুঠো আলােচনায় প্রস্তুত ছিলেন এবং সামগ্রিক বিষয়ে তার কোনাে ভূমিকা ছিল না। ফেব্রুয়ারি থেকে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় সংসদে অধিবেশন আহ্বান করা ছাড়া উপায় ছিল না। প্রেসিডেন্ট অধিবেশনে আহবান করলেন। কিন্তু তখনই পিপিপি অধিবেশনে যােগ দিতে অস্বীকার করল। তারা উত্তেজনার সৃষ্টি করতে লাগল। কেন তারা এমন করছিল সেটা জুলফিকার আলী ভুট্টোই কমিশনকে বলতে পারেন। ইয়াহিয়ার এতে একটু খারাপ লেগেছিল। কারণ সৈনিক হিসেবে তিনি রাজনীতির ব্যাপার-স্যাপারগুলাে বুঝছিলেন না। তার ভাষায়, তিনি রাজনৈতিক পরিস্থিতির কবলে বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।
পরিস্থিতি আরাে সঙ্কটময় হয়ে উঠলে জেনারেল ইয়াকুবকে গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হলাে। ইয়াহিয়া লিখেছিলেন, মার্চের ২,৩ তারিখে তিনি ইয়াকুবকে লিখিতভাবে সুস্পষ্ট নির্দেশ দিলেন, যে কোনাে মূল্যে পূর্ব পাকিস্তানের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে। আনতে। সে সময় ভুট্টো ইয়াহিয়ার রুমে ছিলেন। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, ভুট্টো কেন সে সময় ইয়াহিয়ার রুমে ছিলেন এবং ইয়াহিয়া তার সামনেইবা কেন ইয়াকুবকে নির্দেশ দিলেন। ইয়াহিয়া এর ব্যাখ্যা দেননি। তিনি লিখেছেন, “ডুঠো উৎসাহের সঙ্গে আমাকে সমর্থন জানালেন, বললেন, জেনারেল আপনি পাকিস্তানকে রক্ষা করেছেন। আমার নিজের অবশ্য তা মনে হচ্ছিল না, বুঝছিলাম পাকিস্তান ভেঙ্গে যাচ্ছে। জুলফিকার ভুট্টোকে বললাম, “মনে রাখবেন এর মূল্যে হয় তাে পাকিস্তান নিজেই। ভুট্টো এটা তাে চিন্তার মধ্যে আনলেনই না বরং বখে যাওয়া ছেলের মতাে ব্যবহার করলেন।”
“জেনারেল ইয়াকুব এর মধ্যে পদত্যাগ করলেন। এ পদত্যাগের ইয়াহিয়া। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিল। তিনি ইয়াকুবকে কাপুরুষই শুধু বলেননি, বিদেশি চর হিসেবেও ইঙ্গিত করেছেন। আরাে অনেক সেনা কর্মকর্তাও চলে আসতে চাচ্ছিলেন। ইয়াহিয়া লিখেছেন, তিনিই শুধু তার স্থানে অটল ছিলেন এবং তারপর কেন তাকে এভাবে রাখা হয়েছে তাতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।” আই ওন্ট বি দেয়ার: ইয়াহিয়া ১২ জানুয়ারি। ৭০ সাল। জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকা এলেন। সাথে এলাে তার প্রিন্সিপ্যাল স্টাফ অফিসার লেঃ জেনারেল এস,জি,এম, পীরজাদা । মুখােমুখি বৈঠক। একদিকে ইয়াহিয়া খান ও তার সহযােগী। অপর দিকে বঙ্গবন্ধু মুজিব এবং হাইকমান্ড। বঙ্গবন্ধু দু’দফা থেকে একচুলও নড়লেন না। দু’দফার বিস্তৃত ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, এতে কি অন্যায় ও আপত্তিকর কিছু আছে। ইয়াহিয়া বলল, আই একসেপ্ট ইয়াের সিক্স পয়েন্ট। প্রফেসর এ. ডব্লিউ চৌধুরীকে রাতে জেনারেল ইয়াহিয়া ডেকে পাঠালেন। রমনা গ্রীন সংলগ্ন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ। ইয়াহিয়া বিমর্ষ। হতাশ। বললেন, মুজিব হ্যাজ লেট মি ডাউন।” বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের উত্তরে মুজিবকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করে বললেন , শীঘই তার সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে । আই ওন্ট বি দেয়ার । মূল কথা ছিল এটাই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে কোনােভাবেই শাসনতান্ত্রিক প্রধান করার কোনাে প্রকার ইঙ্গিত প্রদান করেননি। ফলে ইয়াহিয়া খান বিমর্ষ হৃদয় নিয়ে করাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করলেন।
ইয়াহিয়ার পাখি শিকার: নবতর চক্রান্ত জানুয়ারি ১৯৭১। জানুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পাখি শিকারে নিদারুণ শখ। অত্যন্ত উৎফুল্লভাবে তিনি বিগত দশদিন ধরে অবিরাম পাতিহাঁস ও তিতির পাখি শিকারের আনুক্রমিক দৃশ্যাবলী উপভােগ করছেন। করাচী-লাহাের, লাহাের থেকে হায়দ্রাবাদ হয়ে সিন্ধুর লারকানায় এলেন। লারকানার জমিদার তনয় পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো অত্যন্ত জাঁকজমক ও উষ্ণতার সঙ্গে তাকে আপ্যায়িত করলেন। আলােচনা হলাে।
কেন্দ্র কি হাতছাড়া হবে। সামরিক বাহিনীর স্বার্থ কি অক্ষুন্ন থাকবে? ভুট্টো বললেন, ক্ষমতা থেকে দূরে থাকার জন্য আমি নির্বাচন করিনি।” প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হাসলেন অর্থপূর্ণভাবে। ইয়াহিয়ার সাথে উপস্থিত থাকলেন প্রধান সেনাপতি জেনারেল হামিদ । ভুট্টো দেখলেন, ইয়াহিয়া কোনােভাবেই মুজিবের হাতে ক্ষমতা না ছাড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ । দু’জনের সলাপরামর্শ হলাে। সমঝােতা হলাে। তৈরি হলাে এক অলিখিত বু-প্রিন্ট। ব্ল্যাক বাস্টার্ডদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া যাবে না।” দরজা খােলা থাকবে ১৯৭১ সালের ২৭ জানুয়ারি । ৩২নং ধানমণ্ডি । জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় এলেন। নিরাসক্ত। নির্লিপ্ত। ক্ষমতার অংশীদারিত্ব নয় বরং আলােচনা হলাে ছ’দফা নিয়ে। শাসনতান্ত্রিক বিষয়দি নিয়ে। সামরিক চক্রকে হটানাের ফর্মুলা বা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরামর্শ কিছুই আলােচনার টেবিলে এলাে না। ভুট্টো বললেন, তার পার্টি বিচ্ছিন্নতাবাদের এই পরিকল্পিত কর্মসূচি সমর্থন করতে পারে না।” মুখরক্ষার জন্য বলে গেলেন, আলােচনার দরজা খােলা রইল।’ বঙ্গবন্ধু চক্রান্ত ও আঁতাত ধরে ফেললেন। | ১০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলার মানুষ রক্ত দিতে শিখেছে। এবার বাঙালি বিশ্বে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। তিনি এই প্রেক্ষিতে বললেন, ‘বাংলার মানুষকে বৃহত্তর আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।’ রেডিও পাকিস্তানের সম্প্রচারে যখন জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘােষণা দেয়া হয় তখনাে ঢাকার একটি হােটেলে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। বাস্তবিকপক্ষে গােটা ঢাকা নগর ঐ ঘােষণার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পরেই কেবল তারা এ ঘটনার কথা অবহিত হন। সরকারি অফিস, আদালত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প স্থাপনা ইত্যাদি থেকে লােকজন শশাভাযাত্রা করে হয় পূর্বাণী হােটেলে কিংবা পল্টন ময়দানে পৌছায়। “ইয়াহিয়ার ঘােষণা, বাঙালিরা মানে না”- স্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। নগরের বাস সার্ভিসের চলাচলে থেমে যায়, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা স্টেডিয়ামে এ সময় একটি আন্তর্জাতিক খেলা পরিত্যক্ত হয়।”
পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগ ও ডাকসুর নেতৃবৃন্দ এবং শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমাবিট জনতার উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। এ জনতা জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদ জ্ঞাপন করে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে তাদের আস্থা পুনর্ব্যক্ত করে। ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী জানান যে পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দেয়ার আগে তিনি নিজে, ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদুস মাখন এবং তােফায়েল আহমেদ এমএনএ পূর্বাণী হােটেলে শেখ মুজিবের সাথে মিলিত হন। তার পরামর্শ অনুযায়ী শেখ ফজলুল হক মণি ও তারা তিনজন কোনাে কোনাে ছাত্র ইউনিয়ন নেতার সাথে আলােচনা করেন। কিন্তু সর্বসম্মত ঐকমত্যে পৌছানাে সম্ভব হয়নি। তাই ঐ নেতারা অনতিবিলম্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়ে শেখ মুজিবের পরামর্শ অনুযায়ী পল্টন ময়দানে যান। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে নূরে আলম সিদ্দিকী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কথা ঘােষণা করেন। তিনি আরাে ঘােষণা করেন যে, এখন থেকে প্রতিটি আঘাতের বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হেনে জবাব দেওয়া হবে।” তাঁদের সবাই স্বাধীন বাংলা” প্রতিষ্ঠার আহ্বান জাননা। নূরে আলম সিদ্দিকি বলেন, এত তাড়াতাড়ি “স্বাধীন বাংলার” স্লোগান তােলার জন্য কোনাে কোনাে মহল থেকে তাদের তীব্র সমালােচনা করা হয়। আর তাতে করে শেখ মুজিবের ওপর চাপ বাড়ে। তবে এটি বুঝতে অসুবিধা হয় না, শেখ মুজিবের প্রচ্ছন্ন অনুমােদন ছাড়া ছাত্ররা এটা করতে পারত না। প্রেসিডেন্টের ঘােষণাকে আওয়ামী লীগ চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেয়। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের জানান যে, একটি সংখ্যালঘিষ্ঠ দলকে তােষামােদ করার নীতিকে বিনাপ্রতিবাদে মেনে নেওয়া যায় না। তবে এ ধরনের অসন্তোষের চূড়ান্ত অভিব্যক্তি প্রকাশের পূর্বে প্রাথমিক প্রতিবাদের পর সরকারের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা সময়ের দরকার ছিল।
তাই শেখ মুজিব ইতােমধ্যে পরিস্থিতিতে যথেষ্ট পরিবর্তন না ঘটলে আগামী কর্মসূচি কী হবে সে বিষয়ে তিনি ৭ মার্চ এক জনসভায় ঘােষণা দেয়ার অঙ্গীকার করেন। ইতােমধ্যে ঢাকা ও গােটা প্রদেশে যথাক্রমে ২ ও ৩ মার্চ হরতাল পালনের কথা বলা হয়। তিনি ঘােষণা করেন, অতঃপর যা কিছু ঘটবে তার পরিণতির জন্য তিনি জবাবদিহি হবেন । পরের দিন কেবল ঢাকার জন্য হরতাল ডাকা হলেও তা গােটা পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয়। এতে সন্দেহতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, জনসমষ্টির অংশবিশেষ কিংবা আওয়ামী লীগের গােষ্ঠীবিশেষই শুধু নয় বরং পূর্ব পাকিস্তানের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সাথে একাত্ম রয়েছে। ১ ও ২ মার্চ কোনাে কোনাে স্থানে বিক্ষিপ্ত সহিংসতা ঘটে। তবে আরাে বেশি সহিংসতা হবে বলেই আশঙ্কা করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর অ্যাডমিরাল আহসানকে ঐ দিনই তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুবকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। তিনি অনতিবিলম্বে সংবাদপত্রের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরােপ করেন যদিও তা আদৌ তেমন প্রতিপালিত হয়নি। মনে করা হয়ে থাকে যে, এ্যাডমিরাল আহসান মুজিবের সাথে সংঘাতে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন ইয়াহিয়াকে, কেননা তা পাকিস্তানের জন্য বিপর্যয়কর হবে। নেপথ্যে সশন্ত্রকরণ পরিকল্পনা নাটকীয়ভাবে ৩ মার্চের অধিবেশ স্থগিত হলাে। সারাবাংলা জেগে উঠল । গর্জে উঠল। ৭ মার্চ ঘােষিত হলাে অসহযােগ ও স্বাধীনতার বজ্রবাণী । চলল অসহযােগ। অভূতপূর্ব। ৩ মার্চেও স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন ও স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করা হলাে। ঘােষণায় বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক ও জাতির পিতা অভিহিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েমের লক্ষ্যে পল্টনের জনসভায় ইস্তেহার পাঠ করা হলাে। সমগ্র বাংলায় আওয়াজ উঠল বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে- বাংলাদেশ স্বাধীন করাে।’ স্লোগান দেয়া হচ্ছিল, স্বাধীনতার এবং সশস্ত্র সংগ্রামের।
৩ মার্চ। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘােষণা করা হলাে। গত তেইশ বছরের শােষণ, কুশাসন ও নির্যাতনে একথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত করেছে যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে গাে লামে পরিণত করার জন্য বিদেশি পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তা থেকে বাঙালির মুক্তির একমাত্র পথ স্বাধীন জাতি হিসেবে স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হয়ে বেঁচে থাকা। নির্বাচনের গণরায়কে বানচাল করতে শেষবারের মতাে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শােষক গােষ্ঠী সামরিক বাহিনীকে শেষ আশ্রয় হিসেবে ভরসা করেছে। ৫৪ হাজার ৫শত ৬ বর্গমাইল বিস্তৃত ভৌগােলিক এলাকার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জন্য আবাসিক ভূমি হিসেবে স্বাধীন ও সার্বভৌম এ রাষ্ট্রের নাম বাংলাদেশ’। এজন্য তিনটি লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। ১. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ’ গঠন করে পৃথিবীর বুকে একটি বলিষ্ঠ বাঙালি জাতি সৃষ্টি ও বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ২. অঞ্চলেঅঞ্চলে ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য নিরসন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করে। কৃষক-শ্রমিক রাজ কায়েম করতে হবে। ৩. ব্যক্তি, বাক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নির্ভেজাল গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে ! একই সঙ্গে কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে- ক. প্রতিটি গ্রাম, থানা, মহকুমা, শহর ও জেলায় ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে। খ, সকল শ্রেণীর জনসাধারণের সহযােগিতা কামনা ও তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। গ, শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক ও গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের সুসংগঠিত করে গ্রামে গ্রামে ও এলাকায় এলাকায় মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে। ঘ. হিন্দু-মুসলমান ও বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক মনােভাব পরিহার করতে হবে এবং সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। . স্বাধীনতা সংগ্রামকে সুশৃঙ্খলার সাথে এগিয়ে নিয়ে রাখার জন্য পারস্পরিক যােগাযােগ করতে হবে এবং লুটতরাজসহ সকল প্রকার সমাজবিরােধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে।
ছাত্রলীগ ও ডাকসু ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রেডিওতে প্রচারের দাবি জানায়। এদিন ছিল ৫ দিনব্যাপী হরতালের শেষ দিন। ৫ মার্চ। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিবৃতিতে বলেন, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেট ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে নিরস্ত্র জনতাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে আমি তার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।’ তাজউদ্দীন বলেন, সেনাবাহিনীর এই নির্যাতনমূলক কাজের নিন্দা করা ছাড়া আর কোনাে উপায় নেই অথচ আমরা জানি বিদেশেী হামলা থেকে দেশকে রক্ষার জন্যই এই সব অস্ত্র ব্যবহৃত হবার কথা। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সাধারণ মানুষের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি। বিভিন্ন মহল থেকে প্রতি আহ্বান সােচ্চার হয়ে উঠেছে। এই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষেরও উচিত বাংলাদেশের নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর গণহত্যা বন্ধের দাবি তােলা। ঐদিন পিপিপির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যকার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের সাথে আলাপ-আলােচনা কালে বলেন, ‘জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্বল্পকালীন স্থগিত ঘোষণার জন্য পিপিপি অনুরােধ জানিয়েছিল এ কথা ঠিক, তবে ইচ্ছা ছিল এই সময়ের ছয় দফা প্রশ্নে আলাপআলােচনা করে একটা সমঝােতায় পৌছে যাবে। অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার অর্থ অধিবেশন বাতিল বা অন্য কিছু নয়। এটা সামান্য সময়ের বিলম্ব মাত্র । কিন্তু এর ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার কল্পনাও আমরা করিনি। আমরা এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী নই। আওয়ামী লীগ যে ভূমিকা গ্রহণ করেছে তা ঠিক হয়নি। দেশের পরিস্থিতি যদি আরাে খারাপ হয়, তবে যারা এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, তাদের ওপরই সম্পূর্ণ দায়িত্ব গিয়ে পড়বে। অখণ্ডতা প্রসঙ্গে পীরজাদা বলেন, পাকিস্তান দুটি হবে না একটি থাকবে তা এখন সম্পূর্ণ আওয়ামী লীগের দেখার ব্যাপার। পিপিপি শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে আলাপআলােচনার জন্য আরাে সময় চায়, কারণ এই দল মনে করে যে, আওয়ামী লীগের শাসনতান্ত্রিক ফর্মুলা দেশের ঐক্য সংহতি রক্ষার প্রতিকূলে।
৬ মার্চ ৭১ গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একতরফাভাবে। স্বাধীনতা ঘােষণা দেবেন। এই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ জনগণের প্রত্যাশাকে সামনে রেখে এবং আওয়ামী লীগের উগ্র স্বাধীনতাকামীরা বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিয়ে যাচ্ছিলেন একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার । ঐদিন রাতে আওয়ামী লীগ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেয়া সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর সভা গভীর রাতে মুলতবি হয়ে যায়। এই রাতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দীর্ঘক্ষণ টেলিফোনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলেন এবং বলেন আপনি তাড়াহুড়া করে কোনাে সিদ্ধান্ত নেবেন না। আমি শীঘ্রই ঢাকা আসছি এবং এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করব। সিদ্দিকী সালিক তার বইতে লিখেছেন, আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আপনার আকাক্ষা এবং জনগণের প্রতি দেয়া আপনার প্রতিশ্রুতির পুরােপুরি মর্যাদা দেবাে। আমার কাছে একটি পরিকল্পনা আছে-যা আপনাকে ছয় দফা’ থেকেও বেশি খুশি করবে। আমি সনির্বন্ধ অনুরােধ করছি কোনাে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন না। ঐ রাতেই ঢাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ পাঠান আওয়ামী লীগের (স্বাধীনতার ঘােষণা বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে। দ্বিতীয় ঘটনাটি হলাে আওয়ামী লীগের পক্ষে দুজন ব্যক্তি শেখ সাহেবের নাম করে পূর্ব পাকিস্তানের জিওসির সঙ্গে দেখা করে বলেন, স্বাধীনতা ঘােষণা দেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু খুব চাপের মধ্যে আছেন। তাকে গ্রেফতার করে সেফ কাস্টডিতে আনার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। জিওসি বলেন, শেখ মুজিবের মতাে জনপ্রিয় নেতা কীভাবে এইসব চাপ মােকাবেলা করতে হয় তা তার জানা আছে। তাকে বলবেন এইসব স্বাধীনতাকামী উগ্রবাদীর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আমরা রেসকোর্সের পাশেই থাকব।
তাকে বলে দেবেন তিনি পাকিস্তান সংহতির বিরুদ্ধে কথা বললে আমি ট্যাংক, আর্টিলারি এবং মেশিনগান দ্বারা সবাইকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবাে। তখন কেউ শাসন করার জন্য থাকবে না, শাসিত হওয়ার জন্যওগেরিলা যুদ্ধের দিক-নির্দেশনা ইয়াকুবের বরাত দিয়ে লে.জে কামাল মতিনউদ্দিন লিখেছেন, কড়াকড়িভাবে সামরিক শাসন দিলেও যে ধরনের হতাহত হতাে তাতে জনসাধারণের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থেকেই যেত। সে কারণে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত অকার্যকর হতাে। তারপরেও যদি আমরা শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে বিদ্যমান পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতাম তাহলে হয়তাে সাময়িকভাবে আমরা সাফল্য পেতাম কিন্তু সেটা হতাে আমাদের ব্যর্থতা।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে সরকারি প্রতিক্রিয়া প্রসঙ্গে সিদ্দিকি সালিকের বিবরণ উল্লেখ্য। তিনি লিখেছেন: ‘৭ মার্চ পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মি: ফরল্যান্ড মুজিবের সঙ্গে দেখা করলেন। কিছুক্ষণ পর এক বাঙালি সাংবাদিক, নাম মি: রহমান, টেলিফোনে আমাকে বললেন, একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছে। মুজিব-ফরল্যান্ড বৈঠক সম্পর্কে জি ডাবলিউ চৌধুরী বলেছেন, রাষ্ট্রদূত ফরল্যান্ড মুজিবের কাছে আমেরিকার নীতিমালা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেন। তিনি মুজিবকে জানিয়ে দেন বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনায় তিনি যেন ওয়াশিংটনের দিকে না তাকান। তিনি তার বক্তব্যে বলেছেন, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বক্তৃতা করেছেন সেখানে একতরফা স্বাধীনতার ঘােষণা ছিল না। কিন্তু তিনি অসাধারণ তেজদৃপ্ত কণ্ঠে যে আবেগময় যুক্তিপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন তা ছিল মন্ত্রমুগ্ধকর ও ক্ষুব্ধতায় ভরা । সমগ্ৰ পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে ছিল। যদিও উগ্রপন্থী ছাত্ররা তাকে স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল, তিনি সরাসরি এড়িয়ে গেলেও স্বাধীনতার কথা বলেন। এবং স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রায় পুরাে দিক-নির্দেশনা প্রদান করেন। সাংবাদিকদের জবাবে তিনি বলেন, একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা এখন নয়। তার ভাষণ এমন তেজদৃপ্ত ছিল যা পাথরকে ও বৃক্ষকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। তার বকষ্ঠে মনে হয়েছিল সমগ্র জনগণ উদ্দীপ্ত। ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে রিপাের্ট পাঠিয়েছিল সেনাবাহিনীকে। যেক্ষেত্রে জনগণ ছিল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এবং অসহযােগিতামূলক।
তিনি অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেন। যার মূল দশটি পয়েন্ট ছিল: ১. বাঙালিরা সরকারকে কোন খাজনা কর দেবে না। ২. সমস্ত সরকারি কর্মচারীরা হরতাল পালন করবে এবং অফিসে যাবে না। ৩. রেলওয়ে এবং বন্ধ শ্রমিকরা সরকারের সঙ্গে সহযােগিতা করবে না। ৪. রেডিও টেলিভিশন আওয়ামী লীগের নির্দেশনাবলি প্রচার করবে। সেনাবাহিনী কর্তৃক ‘atrocities’ প্রচার করতে হবে। ৫. শুধু স্থানীয় ও জেলা পর্যায়ে টেলিফোন কাজ করবে। ৬. সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ৭. পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাংক কোন টাকা পাঠাতে পারবে না। ৮, সমস্ত বিন্ডিং, দোকান ও পরিবহনে কালাে পতাকা উড়বে। ৯. হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং ১০. সংগ্রাম পরিষদ জেলা, থানা, ইউনিয়ন ও মহল্লায় গঠিত হবে।
শেখ মুজিবের ভাষণ দেয়ার কথা ছিল ২টা ৩০ মিনিটে (স্থানীয় সময়)। রেডিও পাকিস্তানের ঢাকা কেন্দ্র নিজ উদ্যোগে সরাসরি তাঁর ভাষণ প্রচারের ব্যবস্থা সম্পন্ন করল। রেডিওর ঘােষকরা আগে থেকেই ইস্পাত দৃঢ় লাখ লাখ দর্শকের নজিরবিহীন উদ্দীপনার কথা প্রচার করতে শুরু করল। সামরিক প্রশাসকদের দফতর এতে হস্তক্ষেপ করে এ বাজে ব্যাপারটি বন্ধ করার নির্দেশ দিলেন। “আমি বেতার কেন্দ্রে আদেশটি জানিয়ে দিলাম । আদেশটি শােনার সঙ্গে সঙ্গে ফোনের অপর প্রান্তের বাঙালি বন্ধুটি উত্তেজিত হয়ে বললেন, ‘আমরা যদি সাড়ে সাত কোটি জনগণের কণ্ঠকে প্রচার করতে না পারি তাহলে আমরা কাজই করব না’ । এই কথার সাথে সাথে বেতার কেন্দ্র নীরব হয়ে গেল। বেতারের সকল কর্মচারী মুহূর্তের মধ্যেই ধর্মঘট শুরু করলেন। যে মুজিব ৩ মার্চের মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে ছাত্র নেতাদের দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের দৃশ্য দেখেছিলেন এবং সেদিন থেকে সেই পতাকা ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউস ছাড়া সকল সরকারি বেসরকারি অফিস আদালতে শােভা পাচ্ছিল। উত্তেজনা ধীরে ধীরে কুণ্ডলী পাকিয়ে জমা হচ্ছিল। তিনি মঞ্চে আরােহণ করলেন। একটি ঘােষণার জন্য অপেক্ষমাণ বিশাল জনসমুদ্রের দিকে তাকালেন। মুজিব তার স্বভাবসুলভ বজ্রকণ্ঠে শুরু করলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে কণ্ঠস্বর নিচুতে নামিয়ে আনলেন বক্তব্যের বিষয়বস্তুর সাথে খাপ খাইয়ে নেবার জন্য। তিনি একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা করলেন না। কিন্তু ২৫ মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের বিষয়ে চারটি শর্তারােপ করলেন। এগুলাে হলাে: (১) মার্শাল ল’ তুলে নিতে হবে। (২) জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। (৩) সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। (৪) বাঙালি হত্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ঢেউয়ের প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে রেসকোর্স ভেঙ্গে পড়েছিল-ভাটার টানধরা জোয়ারের মতাে তারা ঘরে ফিরে চলল তাদের ভেতরকার সে আগুন যেন থিতিয়ে গেছে ।
ইচ্ছা করলে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে সে আগুনকে ধাবিত করা যেত। আমাদের অনেকেরই আশংকা ছিল এরকমই। এ বক্তৃতা সামরিক আইন সদর দফতরে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দিল। সদর দফতর থেকে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান যে, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বলেছেন, এই পরিস্থিতিতে এটাই সবচেয়ে উত্তম ভাষণ।” ৭ মার্চ টিক্কা খান যখন বিমানে ঢাকায় অবতরণের জন্য আসছিলেন তিনি। দেখতে পেলেন বিশাল জনগণ উত্তেজিতভাবে রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবের ভাষণ শুনছেন। এমনকি তিনি এও দেখলেন যে, গােয়েন্দা সংস্থার একটি হেলিকপ্টার আকাশে উড়ছিল। সেই হেলিকপ্টারকে শাসানাের জন্য লাঠি ও দেশি অস্ত্র দেখিয়ে যাচ্ছিল। পরে অবশ্য গােয়েন্দা রিপাের্টে তিনি জেনেছেন হেলিকপ্টারকে লক্ষ্য করে বন্দুকের গুলি ছােড়া হয়েছে। যার যা আছে তাই নিয়ে… স্বাধীনতার স্লোগানকে কার্যে পরিণত করার জন্য কৌশল গ্রহণ করা অপরিহার্য ছিল। ত্বরিত ও প্রস্তুতিবিহীন সিদ্ধান্ত জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই শেষ করে দেবে। দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্যে গড়ে ওঠা বাঙালির বিজয়কে অনিবার্য করে তুলতে হলে সরকারের সকল যন্ত্রকে অচল করে দিতে হবে, আন্দোলনকে গ্রামের তৃণমূল জনগােষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষক শ্রমিককে, বাংলার গ্রাম ও শহরকে একই সাথে ও সূত্রে স্বাধীনতার লক্ষ্যে সংগঠিত করতে হবে। সেনাবাহিনী, ই.পি.আর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীকে আন্দোলন শক্তি হিসেবে দাঁড় করতে হবে। সশস্ত্র গ্রুপ ও সেল গঠন করতে হবে। বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযােগিতার ডাক দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকে সশস্ত্রকরণের প্রক্রিয়ার দিকে এগিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়দৃষ্টিসম্পন্ন সেনাপতির মতাে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে কনভেনশনাল ওয়ারে জয়যুক্ত হওয়া যাবে না । স্বাধীনতা অর্জনে গেরিলা পদ্ধতি গ্রহণ করে বাংলার মাটি হতে পাকিস্তান বাহিনীকে উৎখাত করতে হবে। এই গেরিলা পদ্ধতির রূপরেখা তিনি ঘােষণা করেন।
তিনি বলেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে, যার যা আছে তাই শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে, রাস্তাঘাট বন্ধ করতে হবে, তাতে ও পানিতে মারতে হবে, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। নির্বাচিত এম,এল-এ হিসেবে মঞ্চের অদূরে বসেছিলাম। ভাষণ শেষ করেন জয়বাংলা স্লোগানে। স্বাধীনতার সংগ্রাম সফলভাবে অসহযােগ আন্দোলন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। গ্রাম জেগে উঠল। জঙ্গি হলাে। প্রত্যেক থানায় ছাত্র-যুবক দ্রুত অস্ত্র প্রশিক্ষণে নিয়ােজিত হলাে। যুদ্ধের কলাকৌশল, প্রশিক্ষণ চলল। দেশের সর্বত্র প্রায় প্রতিটি থানায় পুলিশের কাছে হতে অস্ত্র নিয়ে নেয়া হলাে। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন নির্দেশ জারি করে বিকল্প সরকার চালাতে লাগলেন। সর্ব পেশা ও শ্রেণীর সরকারি কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহ জনগণ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতাে এগুতে লাগল । ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে ঘােষণা করলেন: বাঙালিদের স্বাধীনতার উদ্দীপনা কেউ দমাতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধু স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করেন এই লক্ষ্যে ১৫টি নির্দেশনা জারি করেন। অফিস, আদালত, কোর্ট-কাচারী কীভাবে চলবে প্রশাসন যন্ত্র কীভাবে চলবে তারও দিক-নির্দেশনা দেন। সরকারি কর্মচারী, বেসরকারি ব্যাংক-বীমা, শ্রমিক-সংস্থা, আইনজীবী, বেতার-টিভি সবকিছুই বঙ্গবন্ধুর আদেশে-নির্দেশে চলতে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীনতা ঘােষণার পূর্বাপর যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল পাশাপাশি মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে বঙ্গবন্ধু যে ৩৫টি নির্দেশ দিয়েছিলেন তার সঙ্গে যথেষ্ট মিল রয়েছে। পাশাপাশি সামরিক কর্তৃপক্ষ ১১৫ নম্বর সামরিক আইন জারি করেন। তাজউদ্দীন আহমদ এর প্রতিবাদ করে বললেন, ‘এইসব সামরিক ফরমান মানি না। আমরা আমাদের মতাে চলবাে।’ ১৫ মার্চ। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে আগমন করেন। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্টকে ‘অতিথি হিসেবে উল্লেখ করে তার কর্মীদের উদ্দেশে বললেন, ‘তার যেন কোন অপমান না হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে ‘অতিথি’ বলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বুঝাতে চেয়েছিলেন তিনি একটি নতুন রাষ্ট্রে পদার্পণ করেছেন। যে নবরাষ্ট্রের নাম ‘বাংলাদেশ’, যার পতাকা নির্ধারিত এবং দেশটির জাতীয় সঙ্গীতও বিদ্যমান।
সর্বোপরি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জনগণ এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে সর্বাধিনায়ক ও রাষ্ট্রপতি পদে ৩ মার্চ বরণ করেছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের সঙ্গে শাসনতান্ত্রিক ব্যাপারে আরাে আলাপ-আলোচনার জন্যে ঢাকা এলেন। সেদিন “টাইম সাময়িকী নিউ ইয়র্ক থেকে লিখলেন, আসন্ন বিভক্তির (পাকিস্তানকে দুটি পৃথক রাষ্ট্রে পরিণতকরণ) পশ্চাতে যে মানবটি রয়েছেন তিনি হচ্ছেন শেখ মুজিবুর রহমান। গত সপ্তাহে ঢাকায় শেখ মুজিব ‘টাইম’ এর সংবাদদাতা ডন গিনকে বলেন, বর্তমান পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে, সমঝোতার আর কোনাে আশা নেই। তিনি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্যে পৃথক পৃথক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কথা বলেন এবং জানান যে তার অনুগামীরা কেন্দ্রীয় সরকারের কর দিতে অস্বীকার করেছে, যা কিনা পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত। মনে হচ্ছে তিনি তাঁর ভাষায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। এর দুদিন আগে পূর্ব পাকিস্তানের এই নেতা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সম্পর্কে বলেন, “আমি তাদেরকে পঙ্গু করে দেব এবং তাদেরকে নতিস্বীকার করতে বাধ্য করব।” এধরনের একটি বিবৃতির পর সােজাসুজি স্বাধীনতা ঘােষণা আর অতি নাটকীয় কিছু নয়। | ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। সেদিন বিদেশি সাংবাদিকরা ৫২তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে তিনি বলেন, ‘আমি জীবনে কখনাে আমার জন্মদিন পালন করিনি। আপনারা আমার দেশের মানুষের অবস্থা জানেন, তাদের জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, যখন কেউ ভাবতেও পারে না মরার কথা তখন তারা মরে। যখন কেউ ইচ্ছা করে তখন তাঁদের মরতে হয় । গভীর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আবার বলেন, আমার আবার জন্মদিন কী, মৃত্যু দিবসই বা কী? আমার জীবনই বা কী? মৃত্যুদিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।
ঘরােয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘সাত কোটি মানুষ যখন পাহাড়ের মতাে আমার এবং আমার দলের পশ্চাতে একতাবদ্ধ হয়েছে। তখন আমার চেয়ে সুখী মানুষ আর কে হতে পারে?’ ‘আমার জনগণের মন ভার হয়নি। তারা লক্ষ্য অর্জনের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’ তিনি বলেন, “কি নেই আমার দেশে। পাট, চা ইত্যাদিসহ আমাদের যা প্রয়ােজন বাংলাদেশে তা আছে। কি নাই। সে সম্পর্কে জিজ্ঞাস করা হলে, তিনি বলেন ‘স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকার শুধু বাঙালিদের নেই।’ ১৭ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর একঘণ্টাব্যাপী আলােচনা হয়। আলােচনায় তিনি সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফেরত নেয়া এবং অবিলম্বে জনপ্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রস্তাব ছিল তিনি মন্ত্রিসভায় ভুট্টোর দলকে নেবেন কিনা? বঙ্গবন্ধু সরাসরি বললেন, প্রশ্নেই আসে না। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে আমি সরকার গঠন করব। এতে ইয়াহিয়া খান রাগান্বিত হয়ে ওঠেন এ কারণে যে ইয়াহিয়া খান সবসময় ডেকে এসেছেন অন্য সামরিক জেনারেলদের মতাে পশ্চিম পাকিস্তান হলাে তাদের আসল ঘাটি। সেই ঘাঁটি যাতে দুর্বল না হয় তার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা। ২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর, মার্শাল ল প্রশাসকদের নিয়ে রাওয়ালপিন্ডিতে একটি গােপনীয় মিটিং করেন। সে মিটিংয়ে চিফ অফ জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল শুল হােসেন খান, আই.এস.আই.এর ডাইরেক্টর মেজর জেনারেল আখতার, জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল গােলাম ওমর, গােয়েন্দা বুরোর ডাইরেক্টর নাসির রিজভি, পুলিশের আই জি, প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে, জেনারেল এস.জি.এম.এম, পীরজাদা উক্ত মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। ঢাকা থেকে গভর্নর ভাইস এডমিরাল এস,এম, আহসান, পূর্বাঞ্চলের কামান্ডার লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং ডেপুটি সামরিক প্রশাসক (সিভিল) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান অংশগ্রহণ করেন।
সভাটি মদ্যপানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য রক্ষার রীতি পালন করে উপমহাদেশের মানচিত্রের দিকে মনােযােগ আকর্ষণ করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলগণ প্রেসিডেন্ট কর্তৃক শেখ মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেও তার না যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সাধারণভাবে এই ধারণা জেনারেলদের প্রভাবান্বিত করে যে, শেখ মুজিবের উপরে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা দরকার যাতে তিনি তার উগ্রপন্থীদের নিয়ন্ত্রণ করেন। ইয়াহিয়া খান বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে এবং ভুট্টোর উপর চাপ সৃষ্টি করা উচিত। জেনারেল আকবর ভুট্টোর ব্যাপারে মুজিবের মতাে চাপ সৃষ্টি অপছন্দ করেন এবং তার অভিমত ছিল ভুট্টোর উপরে চাপ সৃষ্টি করলে তা পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক, জুনিয়র অফিসার ডিজি, আই, এস, আই, ক্ষুব্ধ হবে। এসময় জেনারেল পীরজাদা বলেন, সামরিক শাসন কড়াকড়িভাবে কোন অংশেই দেয়া ঠিক হবে। ইয়াহিয়া খান এ সময় বলেন, তিনি উভয় সংকটে আছেন এবং কোন রাজনৈতিক নেতাই তাকে সহযােগিতা করছে না। আলােচনাকালে সাহেবজাদা ইয়াকুব বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সংখ্যা স্বল্পতা রয়েছে। সামরিক বাহিনীকে বেসামরিক প্রশাসনের সাহায্য নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু তারা তাদের আনুগত্যে পরিবর্তন করেছে এবং নতুন সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এদেরকে অবদমন করতে হলে অধিকসংখ্যক সেনাবাহিনী প্রয়ােজন । যদি শক্তি প্রয়ােগ করা হয় তাহলে ভয়ানক ফলাফল দেখা দেবে। তিনি বলেন, মূলকথা হলাে যদি পাকিস্তানের সঙ্গতি রক্ষা করতে হয় তাহলে অধিক হতাহত হবে এবং ঘৃণা ছড়িয়ে পড়বে এবং সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে।’ যদিও আমরা অস্ত্রের সাহায্যে শক্তি প্রয়োগ করে আইন-শৃঙ্খলাকে নিয়ােগ করতে যাই তাহলে আমাদের। মূল লক্ষ্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে, তখন আমাদের বিজয় হবে, আমাদের পরাজয় ।
জেনারেল ইয়াকুব প্রস্তাব করেন, ১. বর্তমান অবস্থার রাজনৈতিক সমাধান উত্তম হবে, ২. পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে বুঝানাে উচিত অধিবেশনে তাদের যাওয়া উচিত, ৩, সেনাবাহিনী নয়, অধিবেশন স্থগিত হলে তা যেন রাজনীতিবিদদের ঘাড়ে চাপানাে যায়, ৪. উভয় নেতার উপরে চাপ সৃষ্টি করা উচিত। ইয়াহিয়া খান ১৫ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত আলােচনার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেন যে, ১. সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হবে। ২. কেন্দ্রে এবং প্রদেশে দুটি মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। ৩. জাতীয় সংসদকে পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হবে। ৪, ভৌগােলিক বিচ্ছিন্নতার কারণে পূর্ব পাকিস্তানকে অধিক স্বায়ত্তশাসন দেয়া হবে। ৫. কোনাে সামরিক ফরমান থাকবে না, থাকবে শুধু প্রােক্লেমেশন। এভাবে আওয়ামী লীগ এবং সামরিক প্রশাসকদের ভেতরে একটি সমঝােতা তৈরির দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু মার্চ ২০-২১ তারিখ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন অনির্ধারিতভাবে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রােক্লেমেশনের আওতা থেকে মুক্ত করতে হবে। ইয়াহিয়া এবং তার সহকারীরা মনে করলেন এর অর্থ হলাে মুজিব অখণ্ড পাকিস্তান রাখার পক্ষে আগ্রহী নয়।
দি বাস্টার্ড ইজ নট বিহেভিং ১৭ মার্চ। সন্ধ্যা ৭টা। প্রেসিডেন্ট হাউস। জেনারেল ইয়াহিয়া বলে উঠলেন: দি বাস্টার্ড (মুজিব) ইজ নট বিহেভিং । ইউ (টিক্কা খানকে) গেট রেডি। রাত ১০টা। জেনারেল টিক্কা খান ফোন করলেন জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হােসেনকে খাদিম ইউ ক্যান গাে এহেড। অপারেশন ব্লিৎস বাতিল। অপারেশন সার্চলাইট রচিত হলাে । নমেন্টক অপারেইয়াকুবের সবুজ প্যাড ও একটি কাঠপেন্সিল। ১৮ মার্চ সকাল আটটা। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। জিওসি অফিস। মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা ও রাও ফরমান আলী বেসিক অপারেশন প্ল্যান তৈরি করার জন্য মিলিত হলেন। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে প্রণীত জেনারেল ইয়াকুবের নির্দেশে প্রণীত ব্লিৎস অপারেশন প্ল্যান বাতিল করা হলাে। এর পরিবর্তে নতুন প্ল্যান তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে। কেননা, ইতােমধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমান সমগ্র দেশের বেসরকারি শাসনভার তার হাতে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছেন। সবুজ রঙের প্যাড। আর একটি সাধারণ কাঠপেন্সিল। জেনারেল ফরমান আলীর হাতে লিপিবদ্ধ হলাে বাঙালি জাতি হত্যার খসড়া রু-প্রিন্ট: অপারেশন সার্চ লাইট। জেনারেল খাদিম রাজা এর দ্বিতীয় ভাগ সম্পন্ন করলেন, যা সৈন্য সমাবেশ, সৈন্য পাঠানাে ও উপকরণ বিতরণ সংক্রান্ত। ১৯ মার্চ আবারাে জয়দেবপুরে বর্বর বাহিনীর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু বিবৃতিতে বলেন, যারা মনে করেন, তাদের বন্দুকের বুলেট দিয়ে জনগণের সংগ্রাম বন্ধ করতে সক্ষম হবেন, তারা আহম্মকের স্বর্গে আছেন। ইয়াহিয়ার সাথে মুজিবের বৈঠকে ইয়াহিয়া মুজিবের কাছে ‘জয়বাংলা’র ব্যাখ্যা জানতে চাইলে, মুজিব বলেন, শেষ নিশ্বাস ত্যাগের সময়েও তিনি জয়বাংলা উচ্চারণ করবেন।” | শেখ মুজিব ইয়াহিয়াকে জানান যে, আগে দুই দেশের প্রাদেশিক পরিষদ অধিবেশনে বসবে। তারা দুটি পৃথক খসড়া সংবিধান প্রস্তাব করবে। পরে দুই অঞ্চলের জাতীয় পরিষদ সদস্যরা পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য গ্রহণযােগ্য পৃথক পৃথক শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রস্তাব নিয়ে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে বসে এক ও অভিন্ন একটি সংবিধান রচনা করবে। এ প্রস্তাবে ইয়াহিয়ার দ্বিমত না থাকলেও তার সহযােগী লে, জে, পীরজাদার ঘােরতর আপত্তি থাকায় প্রস্তাবটি ইয়াহিয়া প্রত্যাখ্যান করলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চার যুব নেতাদের ডেকে বলেন, ‘কোনাে দুর্ঘটনা ঘটলে তােরা ঐ হায়নাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবি তাে? যুদ্ধের ব্যাপকতা ও নৃশংসতা সম্বন্ধে সম্যক ধারণা না থাকলেও চার যুবনেতা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে আশ্বস্ত করেছিলেন। সেদিন ঐ সমঝােতার পেছনে বা কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাবের পেছনে কোনাে ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল বা গূঢ় রহস্য ছিল তা নিন্দুকের ভাষায় সমালােচনা না করে, সময় ও পরিস্থিতির গুরুত্ব, বাস্তবতা এবং গভীরতা উপলব্ধি করে সবলতা-দুর্বলতা নির্ণয় করতে গবেষকদের জরুরি কাজ বলে মনে করি।
২৩ মার্চ, পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিক দিবসে পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে, ‘জয়বাংলা বাহিনীর চারটি পাটুন মার্চপাস্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকাকে অভিবাদন জানায় এবং পতাকা উত্তোলনের সময় ৭ মি.মি রাইফেল গুলির আওয়াজে পতাকাকে স্বাগত জানানাে হয়। পরে ‘জয়বাংলা বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তার হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর গাড়ি ও বাসভবনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। | মূলত ১ থেকে ২৫ মার্চ ‘৭১-এর কালাে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল। শেখ মুজিব প্রকৃত অর্থে ছিলেন বাংলাদেশের ডিফ্যাক্টো সরকার প্রধান। তার নির্দেশে এবং তার নামেই বাংলাদেশের রাষ্ট্র, সমাজ, জনগণ ও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, মার্চের প্রতিটি ঘটনা ও কর্মযজ্ঞের সঙ্গে জড়িত ছিল ‘নিউক্লিয়াস’ ও ‘বি এল এফ’। ২৩ মার্চ সম্পর্কে সিদ্দিকি সালিক লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগ এই দিনটিকে প্রতিরােধ দিবস’ হিসেবে ঘােষণা করল। তারা পাকিস্তানের পতাকা পােড়ালাে, কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি টুকরাে টুকরাে করে ছিড়লাে এবং তার কুশপুত্তলিকা দাহ করল । অন্যদিকে তার স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ালাে এবং জাঁকজমকের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের ছবির প্রদর্শনী করল। রেডিও এবং টেলিভিশন নতুন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সােনার বাংলা’ গানটি বাজালাে।
এ শুধু ছাত্রদের তামাশা ছিল না। মুজিব নিজেই এর অংশীদার ছিলেন। সকালে তিনি তাঁর বাড়ির ছাদে (ডিফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট ভবন) বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অনুমতি দেন। বাড়ির সামনে দিয়ে মার্চপাস্ট করে এগিয়ে যাওয়া ছাত্রদের সালাম গ্রহণ করেন। সারাশহর ছেয়ে যায় সবুজ ও লাল সূর্যের বৃত্ত রংয়ের পতাকায় । পাকিস্তানের পতাকা তখন মাত্র দুটি স্থানে দেখা গেলাে। একটি উড়ছিল গভর্নর হাউসে ও অন্যটি সামরিক আইন সদর দফতরে।”
স্বাধীনতার বিকল্প পথ
১৯৭০ সালে নির্বাচনে শেখ মুজিব নির্বাচনে বিজয়ী হলেন। জেনারেল মুকিম লিখেছেন, ইসলামাবাদের শাসকচক্র তা ভাবেনি। ফলে, তারা যে চিন্তাভাবনা করে রেখেছিল নির্বাচন-পরবর্তী সময়ের জন্য তা পাল্টাতে হলাে। আওয়ামী লীগ কিন্তু সবকিছুর জন্য প্রস্তুতি নিচিছল। এখানে তিনি একটি তথ্য দিয়েছেন যা কোথাও আগে বিস্তারিতভাবে উল্লিখিত হয়নি। তিনি লিখেছেন, আওয়ামী লীগের সামরিক পরামর্শক কর্নেল ওসমানী একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা করেছিলেন শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে। এর তিনটি পর্যায় ছিল, প্রথম পর্যায়: রাজনৈতিক আলােচনার মাধ্যমে ক্ষমতায় যাওয়া, দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য দূর করা এবং সময়-সুযােগ বুঝে স্বাধীনতা ঘােষণা করা । দ্বিতীয় পর্যায়: প্রথম পর্যায় ব্যর্থ হলে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল। এ কারণে বাংলাদেশকে ৬টি সেক্টরে ভাগ করা হলাে- ঢাকা, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা; চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা কুমিল্লা নােয়াখালী ও সিলেট জেলা; খুলনা, যশাের ও বরিশাল জেলা: দিনাজপুর, রংপুর ও বগুড়া জেলা এবং রাজশাহী ও পাবনা জেলা। প্রতিটি সেক্টরের জন্য কমান্ডার ঠিক করা হলাে। কমান্ডাররা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মারফত কাজ করবেন। কিন্তু লজিস্টি জোগাড়ের ভার থাকবে গণপ্রতিনিধিদের ওপর। তৃতীয় পর্যায়: প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় ব্যর্থ হলে জনসাধারণ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী যার যার জেলার বিপরীতে ভারতীয় ভূখণ্ডে চলে যাবে এবং যাবার সময় পােড়ামাটি নীতি গ্রহণ করবে। বস্তুত দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্য হবে, বাংলাদেশ ইস্যুর আন্তর্জাতিকীকরণ । এরপর শুরু হবে প্রতিরােধ ও গেরিলা যুদ্ধ।” এ ধরনের ইঙ্গিত আরাে অনেক করেছেন। আমাদের দেশের অনেক রাজনৈতিক নেতা ও বুদ্ধিজীবী মনে করেন, যুদ্ধের জন্য আওয়ামী লীগ প্রস্তুত ছিল । তারা পাকিস্তানের সঙ্গেই সবসময় থাকতে চেয়েছে। বাধ্য হয়ে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু জেনারেল মুকিমের তথ্য মেনে নিলে ঐ সব তত্ত্ব নাকচ হয়ে যায়। তবে মুকিমের তথ্যটি যে ষােল আনাই সঠিক এমনটি নয় এর মধ্যে কষ্ট-কল্পনা রয়েছে।
লে. জে ওয়াসিউদ্দিন এ সময় রাওয়ালপিন্ডিতে অফিসার কুরিয়ারের মাধ্যমে একটি সংবাদ পাঠিয়েছিলেন- ১. পাকিস্তানের এক অংশ থেকে অন্য অংশ প্লেন যেতে ভারত বাধা দেবে। ২. ভারত পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ। করবে যাতে পূর্ব সীমান্তে পাকিস্তান বড় ধরনের সবাবেশ ঘটাতে না পারে। ফজল মুকিমকে এসব তথ্য দিয়েছেন তিনজন বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার, লে. কর্নেল এ এস বি ইয়াসিন ও সামছুল হাসান। মুনতাসীর মামুন লিখেছেন, অন্যদের সম্পর্কে জানি না, তবে এটুকু জানি এম আর মজুমদার শুরু থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিলেন।”
ঢাকা এলেন ইয়াহিয়া খান। আলাপ-আলােচনা শুরু হলাে। এ বিবরণগুলাে মােটামুটি একই রকম। সিদ্দিকের বইতেও তা পাওয়া যাবে। যেমন, প্রথম দিন আলাপের পরই বিমর্ষ হয়ে গেলেন ইয়াহিয়া। সালিকের মন্তব্য: “Amazingly he had (apparently) failed to see the snake in the grass.” রূপক অর্থে হয়তাে এটি ব্যবহৃত কিন্তু সাপ’ বলতে তাে বাঙালিকেই বােঝাচ্ছে। এবং প্রশ্ন উঠতে পারে ইয়াহিয়া যদি এত অবুঝ হন, কিছুই না বােঝেন তা হলে প্রেসিডেন্ট ছিলেন কেন? কিন্তু এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বৃথা। তারা ইয়াহিয়া, ভুট্টো বা সামরিক কর্মকর্তাদের উচ্চাশা, দোষ- সেগুলাে শুধু আড়াল করতেই চেয়েছেন। তবে মুজিব সম্পর্কে ইয়াহিয়ার যে উক্তি সিদ্দিকি লিখেছেন, সালিকও তাই উল্লেখ করেছেন-“The bastard is not behaving. You get ready.” টিক্কা খান উঠে তখনই জিওসিকে জানালেন, সালিকের মতে, সেদিনই সেনা অ্যাকশনের সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।
তিনি লিখেছেন, মার্চের ২৫ তারিখ পর্যন্ত সেনা এসেছে এটি ঠিক নয়। তার ভাষায়- “I personally know that no additional troops were flown into Dacca from West Pakistan or from within East Pakistan during the twenty-five days of Mujib’s de fecto rule.” af Fretet fett অন্যান্য জেনারেলরাই লিখেছেন সিভিল বেশে সেনারা ঢাকা আসছিল। অপারেশন সার্চলাইট, জানাচ্ছেন সালিক, লিখেছেন ফরমান আলী, মার্চের ২০ তারিখ জেনারেল হামিদ ও টিক্কা খান তা দেখে সংশােধন করেন। সেনাকর্মকর্তারা তাদের সেনাবাহিনী সম্পর্কে কী ধরনের উচ্চাশা পােষণ করতেন তা বােঝা যাবে নিমােক্ত কথােপকথনে। | পরিকল্পনায় ছিল, বাঙালি সেনাদের নিরস্ত্র করা হবে। জেনারেল হামিদ তাতে রাজি নয়, কারণ তাহলে বিশ্বের সেনা বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবে।” | সংশােধিতরূপে বলা হলাে, প্যারা মিলিটারিদের নিরস্ত্র করা হবে। পরিকল্পনায় ছিল, আলােচনার সময় যখন আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আসবে তখন তাদের গ্রেফতার করা হবে। ইয়াহিয়া তাতে রাজি হননি। তিনি বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক হতে চান না।’ সালিক যেহেতু তখন এদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সেহেতু তার এ বিবরণ গ্রহণযােগ্য। কিন্তু তিনি লিখেছেন সেনা অভিযানের বিপরীতে জেনারেল ওসমানী প্রস্তুতি নিলেন, সেনা কর্মকর্তাদের প্রস্তুত থাকতে বললেন এবং পরিকল্পনা নিলেন তা আংশিক সত্য। এর অন্যতম কারণ তিনি স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে এ বিষয়ে জানতেন ও তৈরি ছিলেন। এম, আর মজুমদার তিনি ২৪ তারিখে গ্রেফতার হয়ে যান। কারণ, ২৫ মার্চের পর প্রায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর বাঙালি সেনা-অফিসাররা বাধ্য হয়ে ‘বিদ্রোহ করেছে। কেবল ইপিআর বাহিনীর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, মেজর খালেদ মােশাররফ, শাফায়েত জামিল এ রকম কয়েকজন অফিসার ব্যতীত কেউই স্বেচ্ছায় প্রথমে যুদ্ধে অংশ নেয়নি।
এমন কি জিয়াউর রহমান ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনা অধিনায়কের হুকুমে চট্টগ্রাম বন্দরে নােঙর করা সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে যান। যখন তার ও তার বাহিনীর উপর আক্রমণ হয়েছে তখন কেবল ‘বিদ্রোহ করেছে। এয়ার ভাইস মার্শাল আজগার খান লিখেছেন, “মার্চের প্রথম সপ্তাহে আমি ঢাকা গিয়েছিলাম । রওনা হওয়ার আগে ভুট্টোকে জানিয়েছিলাম ঢাকা যাচ্ছি। তিনি আমাকে করাচী হয়ে যেতে বললেন। করাচী গেলাম কিন্তু তিনি আমার সঙ্গে দেখা করলেন না। ঢাকায় মুজিবের সঙ্গে আমার তিনটি মিটিং হয়েছে। মুজিব জানিয়েছিলেন, তিনি নিশ্চিত যে, ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না এবং পূর্ব পাকিস্তানে শক্তি প্রয়ােগ করবেন। তিনি বলছিলেন, পাকিস্তানের জন্য যখন তারা আন্দোলন করেন তখন ভুট্টো-ইয়াহিয়া কোথায় ছিল?” “বাঙালিদের তারা কখনও মানুষ মনে করেনি।” আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন তিনি। “মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তান যাওয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল কিন্তু তিনি যাননি। কেন যাননি, এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানালেন, ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু আমার ধারণা তার ও তার ঘনিষ্ঠজনদের ধারণা হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তান গেলে তাকে হত্যা করা হবে । তা হলে ভবিষ্যতটা কী? তিনি বললেন, ইয়াহিয়া খান প্রথমে ঢাকা আসবে, তারপর আসবেন এম. এম আহমদ এবং তারপর ভুট্টো । ইয়াহিয়া খান এরপর সামরিকবাহিনী লেলিয়ে দেবেন এবং তাঁকে গ্রেফতার করা হবে। যদি গ্রেফতার করা না হয় তাহলে, পাকিস্তানি বাহিনী অথবা তার লােকেরাই তাকে হত্যা করবে। আশ্চর্য নয় কি তিনি যা বলেছিলেন ঠিক তাই ঘটেছে।” ২৪ তারিখে আওয়ামী লীগ পরিষ্কারভাবে সামরিক জান্তাকে বলে দেয় কনফেডারেশনের বদলে পাকিস্তান রাষ্ট্র একটি ইউনিয়নে পরিণত হবে এবং ভুট্টোকে তার পূর্বেকার কথা স্মরণ করে দিয়ে বলেন, ইধার হাম, উধার তুম’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভুট্টোকে এ কথাও বলেন যে, ‘ওরা প্রথমে আমাকে ধ্বংস করবে তারপর তােমাকে। ২৫ মার্চ রাতে। অপারেশন সার্চ লাইট শুরু হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যায় ঝাপিয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। অপারেশন সার্চ লাইটে লক্ষণীয়ভাবে বলা হয়, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডকে বিদ্রোহ হিসেবে মনে করে তাদের উপর আকস্মিকভাবে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।
ইপিআর বাহিনীকে নিরস্ত্র করা হবে। রাজনৈতিক ও ছাত্রনেতৃবৃন্দ শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের গ্রেফতার করতে হবে। রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টারে রাত একটায় আক্রমণ চালাতে হবে। মিসেস আনােয়ারা বেগমের বাড়ি ঘেরাও করতে হবে। অপারেশন সার্চ লাইটে যেসব ব্যক্তিদের অবস্থান এবং তাদের গ্রেফতারের জন্য বলা হয়েছিল তারা হলেন, ১. মুজিব ২. নজরুল ইসলাম ৩. তাজউদ্দীন ৪. ওসমানী ৫. সিরাজুল আলম ৬. মান্নান ৭. আতাউর রহমান ৮. প্রফেসর মােজাফফর ৯, ওলি আহাদ ১০, মতিয়া চৌধুরী ১১. ব্যারিস্টার মওদুদ ১২. ফাইজুল হক ১৩, তােফায়েল ১৪. এন এ সিদ্দিকী ১৫. রউফ ১৬. মাখন এবং অন্য ছাত্রনেতাদের। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় মওলানা ভাসানীসহ বামপন্থী কোনাে নেতা এই গ্রেফতারের তালিকায় উল্লিখিত ছিল না। ২৬ তারিখে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন এবং বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী, পাকিস্তানের শত্রু এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার জন্য তাকে সামরিক আইনে দণ্ড প্রদানের ঘােষণা দেয়া হয়। প্রেসিডেন্ট নিম্নোক্ত কথায় বিষয়টির সংক্ষিপ্তসার প্রকাশ করেন। “এটা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার উপদেষ্টারা এক পাকিস্তানের ভিত্তিতে কোনাে সমঝােতায় আসবে না বরং কোনােক্রমে আমার কাছ থেকে এমন একটা ঘােষণা প্রকাশ করিয়ে নিতে চান যা কার্যত “জাতীয় পরিষদকে দুইটি পৃথক গণপরিষদে পরিণত করবে, ফেডারেশনের পরিবর্তে একটি কনফেডারেশনের জন্ম দিবে এবং সামরিক আইনের ক্ষমতা বিলােপ করে দেশে একটা অরাজকতার সৃষ্টি করবে। এই পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা পৃথক ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। বলাবাহুল্য, তার অর্থই হচ্ছে জাতির পিতা যে অর্থে পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন তার সমাপ্তি টানা।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ