You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.01.03 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি চাই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
৩রা জানুয়ারী, ১৯৭৩, বুধবার, ১৯শে পৌষ, ১৩৭৯ বঙ্গাব্দ

দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি চাই

গত সোমবার আমেরিকান সেন্টারের সম্মুখে ভিয়েতনামে মার্কিন হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে আয়োজিত ছাত্র বিক্ষোভ মিছিলের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের দু’জন ছাত্রের অমূল্য জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে ও সাতজন ছাত্র আহত হন। আহতদের মধ্যে ‘বাংলার বাণী’র স্টাফ ফটোগ্রাফার জনাব রফিকুর রহমান রয়েছেন।
পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে নিহত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ছাত্র মতিউল ইসলাম ও ঢাকা কলেজের ছাত্র মীর্জা কাদেরুল ইসলাম।
এমন একটি দুঃখজনক ঘটনা যে ঘটতে পারে তা কেউ কল্পনাও করতে পারেননি। পুলিশের গুলিবর্ষণে দু’জন বিক্ষোভকারী ও অপর কয়েকজনের আহত হওয়ার সংবাদে সমগ্র জাতি বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছে।
এ দুঃখজনক ঘটনায় রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ গভীর দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী এক বাণীতে বলেন, ‘মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সম্মুখে সংঘটিত ঘটনা জানতে পেরে আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। আমি নিহতদের পরিবারবর্গের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন এবং নিহতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’ প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠানের নির্দেশ দান করেছেন। তিনি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘অদ্যকার দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় আমাদের দুইটি ছেলের মৃত্যু ও আরও কতিপয় ছেলে আহত হওয়ায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছি। নিহত ও আহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গের প্রতি আমি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।’ তিনি আরো বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে এবং জনগণ যাতে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার ফল ভোগ করতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করা সরকার, জনগণ, সকল রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংস্থার দায়িত্ব।’
যা হয়েছে যা ঘটেছে তাতে যে সকলেই বিক্ষুব্ধ ও মর্মাহত হবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। ভিয়েতনামে মার্কিনী বেপরোয়া বোমাবর্ষণের ফলে সকলেই আজ বিক্ষুব্ধ ও ব্যথিত। এ বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশই ঘটেছিলো বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে। বিক্ষোভকারীরা দেশের অন্যান্য শহরের কয়েকটি মার্কিন তথ্য কেন্দ্র পুড়িয়ে দিয়েছে। এমতাবস্থায় সরকারের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব হলো বিদেশী মিশনের জানমালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়া। আর এজন্যেই মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সম্মুখে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিলো। এ ব্যবস্থা গ্রহণের বিপক্ষে কারো বলার কিছু নেই। তবে প্রশ্ন হলো ‍পুলিশ ঘটনার পরিণতি হিসাবে অগ্রপশ্চাত বিবেচনা না করে এমন একটি দুঃখজনক ঘটনার সৃষ্টি করলো কেন? ঘটনার বিবরণের পরিপ্রেক্ষিতে পরিষ্কার একথাই প্রতীয়মান হয় যে, বিক্ষোভকারীরা এত উচ্ছৃঙ্খল ছিলো না। যাতে করে গুলি করার প্রয়োজন হতে পারে। অবশ্য সরকারী প্রেসনোটে বলা হয়েছে যে, ‘বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা সত্ত্বেও বিক্ষোভকারীদের কয়েকজন পুলিশের প্রতি হাতবোমা, বিস্ফোরক ও ইট-পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করে। পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে লাইব্রেরী ভবনে আগুন লাগানোর উদ্দেশ্যেই বিক্ষোভকারীরা এই কাজ করে।’ প্রেসনোটে যা বলা হয়েছে তার সত্যতা বিচার বিভাগীয় তদন্ত হলে হয়তো উদ্ঘাটিত হতে পারে। এ সম্পর্কে আমাদের বলার কিছু নেই। আমরা একথা অবশ্যই বলবো যে, বাংলাদেশ বর্তমানে একটা বিশেষ অবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের বুকে বর্তমানে নানান ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ওৎপেতে রয়েছে। তারা যে কোন অবস্থায় একটা অঘটন ঘটাতে পারলেই খুশী। তাদের পোয়া বারো। সুযোগের সন্ধানে রয়েছে ওরা। এমতাবস্থায় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা করা যেমন পুলিশের কর্তব্য তেমনি অসীম ধৈর্যের পরিচয় পুলিশকে দিতেই হবে। স্মরণ রাখতে হবে সামান্য স্ফূলিঙ্গ থেকেই দাবানলের সৃষ্টি হতে পারে। প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অঘটন ঘটিয়েছে।
আমরা অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, গত সোমবারের মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম হোত না যদি পুলিশ গুলি করার আগে অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাদি গ্রহণ করতো। আমরা জানিনা কার আদেশে পুলিশ গুলিবর্ষণ করেছে। তবে একথা সত্য যে, সরকারের প্রশাসন যন্ত্রের একটি অংশ সরকারের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী কাজ করে যাচ্ছে। তারা বাংলাদেশের জনগণ ও বঙ্গবন্ধুর সুনামকে নষ্ট করার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। এই স্বাধীনতা ও সরকার বিরোধী আমলাদের সমূলে উৎখাত করতে না পারলে এমনি ধরনের আরো ঘটনার জন্ম হওয়াটা আদৌ বিচিত্র নয। তাই আমরা একথা বলবো, বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আজ তাঁদের খুঁজে বের করতে হবে। গত সোমবারের বেদনাদায়ক ঘটনার জন্যে যেই দায়ী হোক না কেন নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিকে শাস্তি দিতেই হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন