You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজনীতির অঙ্গনে কালাে থাবা - সংগ্রামের নোটবুক

রাজনীতির অঙ্গনে কালাে থাবা

চতুর্থ অধ্যায়ে আমরা লক্ষ্য করবাে রাজনৈতিক অঙ্গনে কালাে থাবা নেমে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সামরিক প্যাট এবং মার্কিন প্রভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের যতটুকু বাতাবরণ দৃশ্যমান হয়েছিল, সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সরাসরি সামরিক শাসন দেশের বুকে চেপে বসে। সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের পর স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, বাংলায় মুসলিম লীগের পতন, পাকিস্তান সরকারের নীতিতে কোনাে পরিবর্তন হবে না।’ এসময় প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান রাজনৈতিক মঞ্চে চলে আসেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ২১ দফা এড়িয়ে ‘জিরাে থিওরীতে চলে যান। আওয়ামী লীগ ও একুশ দফায় সাম্রাজ্যবাদ বিরােধীতা ও লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসনে অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এই মূল দাবি দুটি উপেক্ষিত হলাে। ফলে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ছেড়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এক অস্থির পরিস্থিতির ভিতরে ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচন দাবি করেন। কিন্তু পাকিস্তানের কুচক্রীরা দেখলেন এভাবে গণতন্ত্রের দাবী এমন এক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, যেক্ষেত্রে তাদের কায়েমী স্বার্থে প্রচন্ড আঘাত লাগবে। সেজন্য তারা সােহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবসহ নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন। সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের ফলে ছাত্রসমাজ এই প্রথমবারের মতাে ধর্মঘটের রাজনীতির দিকে অগ্রসর হয়। মূলত এ সময় ছিল বাঙালি জাতির আত্মানুসন্ধানের অভিযাত্রা।

সেই লক্ষ্যে ১৯৬২ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জামায়েতে ইসলাম, নেজামী ইসলাম ও মুসলিম লীগের একাংশ নিয়ে গঠিত হয় এন, ডি, এফ। যার লক্ষ্য ছিল সবার আগে গণতন্ত্র চাই। চারিদিকে আন্দোলন ও প্রচন্ড ছাত্র বিক্ষোভে দিশেহারা জেনারেল আইয়ুব খান আন্দোলন দমাতে কঠোর ব্যবস্থা নেন। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণায় আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দী মিস ফাতেমা জিন্নাহ রাজশাহীতে এলে শেখ মুজিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং পরিষ্কারভাবে বলেন, এখন থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে, আমাদের স্বাধীনতা পেতে হবে।] যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক প্যাক্ট গঠনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়। সিয়্যাটো স্বাক্ষরিত হয় ১৯৫৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মােহাম্মদ আলী, প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাফরুল্লাহ খান এবং অর্থমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলীর সমন্বয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার তাদের উষ্ণ আতিথেয়তা জানান। পাশাপাশি তারা অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের বিষয়ে বিস্তারিত আলােচনা করেছিলেন। সিয়্যাটো স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পাকিস্তানের রাজনীতিতে আর একবার উল্লেখযােগ্য পরিবর্তন ঘটে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের নামে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই পাকিস্তানে একটি গণপ্রতিনিধিত্বহীন গণপরিষদ ছিল। শাসনতন্ত্রের মূলনীতি’ হিসেবে লিয়াকত আলী খান মার্চ ১৯৪৯ নভেম্বর ১৯৫০ এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের ডিসেম্বর ১৯৫২ প্রদত্ত দুটি রিপাের্ট অগ্রাহ্য হয়।

১৯৫৩ সালের ৭ অক্টোবর বগুড়ার মােহাম্মদ আলী উপস্থিত করে মােহাম্মদ আলী ফর্মুলা। কিন্তু শাসনতন্ত্র প্রণীত হলাে না। গভর্নর জেনারেল তখনাে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের বলে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভােগ করেছিলেন। নাজিমুদ্দিনকে সরিয়ে বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসানাে হয়। অগণতান্ত্রিক পথটি বন্ধ করার জন্য বগুড়ার মােহাম্মদ আলী ১৯৫৪ সালের সেপ্টেম্বরে উদ্যোগ নেন। এর ফলে সকল ক্ষমতা চলে আসত মন্ত্রিপরিষদের হাতে। গভর্নর জেনারেল নিরঙ্কুশ ক্ষমতা হ্রাস পেত। ২১ সেপ্টেম্বর গণপরিষদ সে শাসনতান্ত্রিক রিপাের্টটি গ্রহণ করে, ২৭ অক্টোবর অনুষ্ঠিতব্য পরবর্তী অধিবেশনে তার ভিত্তিতে শাসনতান্ত্রিক বিল নিয়ে আলােচনা ধার্য ছিল । কিন্তু এর মধ্যেই গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ বাতিল ঘােষণা করেন। সেই সাথে সারাদেশে জরুরি অবস্থাও ঘােষিত হয়। বিশেষজ্ঞ মহল এই ঘটনাটির পেছনে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ধারণা পোষণ করেন। কেননা, গভর্নর জেনারেল যে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তরবারি উঁচিয়ে ধরার নামে পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন, সেই বগুড়ার মােহাম্মদ আলীকেই তিনি আবারও প্রধানমন্ত্রিত্ব পদে বসাতে বাধ্য হলাে ।

বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যােগদানের সময় দেশে ৯২-ক ধারা জারি হয়। ইস্কান্দার মীর্জা গভর্নর হয়ে আসেন। তার প্রকাশ্য বক্তব্য ছিল, মওলানা ভাসানী দেশে ফিরলে তাকে গুলি করা হবে। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়ে স্বয়ং কলকাতা গিয়ে মওলানা ভাসানীকে এদেশে নিয়ে আসেন। নির্বাসিত জীবনশেষে মওলানা ভাসানী ফিরে আসেন ১৯৫৫ সালের ২৫ এপ্রিল। মে মাসে এক প্রচারপত্রে তিনি পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি, সিয়্যাটো এবং বাগদাদ চুক্তি বাতিলের দাবি জনান। ৯ ও ১০ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উত্তরবঙ্গ কর্মি সম্মেলনেও তিনি একই দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৫ সালের ২১,২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়: “এই কাউন্সিল অধিবেশনের বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, পাকিস্তান সরকার বিগত কয়েক বছর পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি সম্পাদন করেছেন, যে চুক্তি দ্বারা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং দেশের অর্থনৈতিক, ব্যবসাগত ও বাণিজ্যিক স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ প্রকাশ্যেই চলতে থাকে । এর প্রথম ঘটনাটি ছিল যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন বিজয়ের পরপর। মার্কিন রাষ্ট্রদূত হােরেস হিলড্রেথ বলেন যে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের পতনে পাকিস্তান সরকারের নীতির কোনাে পরিবর্তন হবে না। সে সময়ে সারাদেশে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠে।

কিন্তু পাকিস্তান সরকার দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাকর এই বিবৃতির প্রেক্ষিতে কোনাে কথাও উচ্চারণ করেননি। প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুবের একটি বক্তব্য থেকে এর সত্যতা মেলে। ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর বগুড়ার মােহাম্মদ আলীর মন্ত্রিসভায় দেশরক্ষা মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর লাহােরের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন: “পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষণীয়। পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা নির্ভর করে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর। ভারত কখনাে হামলা করলে কিংবা দখল করে নিলে পশ্চিম পাকিস্তান দিল্লী দখল করে নেবে এবং ভারত পূর্ব বাংলা ত্যাগ করতে বাধ্য হবে। পূর্ব বাংলাকে এক ভারত ছাড়া আর কেউ আক্রমণ করবে না। তাই পূর্ব-দক্ষিণ দিকের সীমান্ত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আর এ কারণেই পূর্ব বাংলায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলার প্রয়ােজন নেই বলে পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি মনে করতেন। এমনিতর ধ্যানধারণার ফলে পূর্ব বাংলা সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত অবহেলিত হয়। শতকরা পনের ভাগেরও কম অর্থ এ প্রদেশে ব্যয়িত হয়, সশস্ত্র বাহিনীসমূহে চাকরিতে ২২৩০ জনের মধ্যে পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৮০ জন (শতকরা মাত্র ৩.৫ ভাগ) অথচ বৈদেশিক সাহায্যের বাইরেও কেবলমাত্র রাজস্ব আয়েরই শতকরা বাষটি ভাগ তখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়িত হতাে। অর্থাৎ তিনি গৃহীত সামরিক বুপ্রিন্ট নিয়েই অগ্রসর হচ্ছিলেন, যা তিনি বিশ্বাস করতেন।

‘জিরাে থিওরি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়ে পাকিস্তান-মার্কিন চুক্তি সমর্থন করেন। তার ফলে দলে ও দলের বাইরে ব্যাপক সমালােচনা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে চমক সৃষ্টি করে ১৯৫৬ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে হেলিকপ্টারে অবতরণ করেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল প্রাঙ্গণে। ছাত্রদের উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে সরকারের পররাষ্ট্রনীতির সমর্থনে জোরালাে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন: ‘যারা ভারতের অঙ্গরাজ্যে পরিণত হতে চান, তাদের আমার সাথে হাত মেলানাের প্রয়ােজন নেই। কেননা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি চাই পাকিস্তানকে। শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করতে। আমার এ হাত পাকিস্তানকে দুর্বল করার জন্য। নয়।’ প্রসঙ্গত তিনি জোটনিরপেক্ষতার ধারণার কঠোর সমালােচনা করেন। মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে তিনি বলেন: “আরব দেশগুলাের সাথে প্রতিরক্ষা সম্পর্কের অর্থ হলাে, একটি শূন্যের সাথে কয়েকটি শূন্যের যােগফলের সমান, আর একটি শূন্য। এটাই সােহরাওয়ার্দীর বিখ্যাত ‘শূন্যতত্ত্ব’। সমাবেশে উপস্থিত প্রগতিশীল ছাত্রদের অনেকে সেদিন এর প্রতিবাদ এবং প্রশ্ন করার জন্য উঠে দাড়ানাের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের বসিয়ে দেয়।

১৯৫৭ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রকাশিত সােহরাওয়ার্দীআইসেনহাওয়ার যুক্ত ঘােষণা বক্তব্য থেকে। ১৩ জুলাই প্রকাশিত যুক্ত ঘােষণায় বলা হয় : মার্কিন প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী এ বিষয়ে একমত হন যে স্বাধীন বিশ্বের নিরাপত্তার পথে আন্তর্জাতিক কমিউনিজম এক বিরাট হুমকি হিসেবে অবস্থান করছে। এশিয়ায় প্রবর্তিত সমষ্টিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি তারা পুনরায় সমর্থনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কমিউনিস্ট আক্রমণ বিরােধিতার প্রত্যয়ও পুনরায় ঘােষণা করেন। তারা ঐকমত পােষণ করেন যে সাউথ-ইস্ট এশিয়া ট্রিটি অর্গানাইজেশন, বাগদাদ চুক্তি এবং পাকিস্তান-মার্কিন পারস্পরিক নিরাপত্তা চুক্তির মাধ্যমে কমিউনিস্ট আক্রমণ বিরােধিতায় যে প্রত্যয় ঘােষিত হয়েছে, তা কমিউনিস্ট আক্রমণ প্রতিরােধে অত্যন্ত শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে ভূমিকা রেখে চলেছে, এবং এর ফলে চুক্তিভুক্ত অঞ্চলে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাদেশিক সরকারের শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের ৩১মে আসন্ন নির্বাচনে প্রস্তুতি দল ও জনশক্তি সংগঠিত করার লক্ষ্যে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পদত্যাগ করেন। অপর এক প্রস্তাবে জুনের প্রথম সপ্তাহে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এক ইউনিট সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের জনমত যাচাইয়ের পূর্ব ঘােষিত সিদ্ধান্তের আলােকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানাে হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার দৈনিক সংবাদ জানায় । সমাপ্তি অধিবেশনে দেশের স্বার্থানুকুলে সর্বমােট চল্লিশটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর বক্তব্যের তীব্র সমালােচনা করেন।

বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা এবং বিবৃতির মাধ্যমে সংগঠনের কর্মসূচী থেকে প্রধানমন্ত্রীর বিচ্যুতি এবং তার পরিপন্থী বক্তব্যের দায়িত্ব তিনি অস্বীকার করেন। ১৯৫৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী বলেন যে, সংগঠনের ঘােষিত নীতি ও কর্মসূচী পরিবর্তনের অধিকার ও ক্ষমতা একমাত্র আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভারই রয়েছে, কোনাে ব্যক্তি বিশেষের নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেন।  সােহরাওয়ার্দীর যুক্তিপূর্ণ এবং প্রাণস্পর্শী ভাষণের পর ১৯৫৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রনীতির ওপর জাতীয় পরিষদের ভােট গ্রহণ করা হয়। মুসলিম লীগসহ বিরােধী দলগুলাে ভােটদান বিরত থাকে। পক্ষে চল্লিশটি এবং বিপক্ষে দুটি ভােট দেন মিয়া ইফতিখার উদ্দিন ও মিয়া অবদুল বারী। | ১৯৫১ সনের সামরিক চুক্তি নবায়িত হয়েছিল ১৯৫৮ সালেও। এর পরও ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধ শুরু হলাে। মর্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডী এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যান্ড ম্যাকমিলানকে ভারতকে সাহায্য প্রদান না করার জন্য প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নানাভাবে চেষ্টা করেন। পাকিস্তান-মার্কিন সম্পর্ক জোটের শর্তগত বাধ্যবাধকতার উল্লেখ থেকে শুরু করে তাদের মিত্র পাকিস্তানের বিপন্ন হওয়ার আশংকা পর্যন্ত জানিয়েছেন তিনি, কিন্তু লাভ হয়নি। ভারতের হুমকির কারণে সােহরাওয়ার্দীসহ পাকিস্তানের শাসকদের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির অকার্যকরতা প্রকট হয়ে পড়ে।

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধকালেও তারা ভারতকে সাহায্য করেন। চীন-ভারত যুদ্ধের পর থেকে ভারত-মার্কিন বন্ধুত্বের নবতর অধ্যায়ে আমেরিকা এই উপমহাদেশে ‘নিরপেক্ষ হওয়ার প্রচেষ্টা নিয়েছে। আর সেজন্যই পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় আমেরিকা উভয় দেশকেই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। কাউন্সিল অধিবেশনের সিদ্ধান্ত এবং মওলানা ভাসানীর ক্রমাগত চাপের ফলে ১৯৫৭ সালের ২ মার্চ আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায় দলের এম, এল, এ-দের প্রতি অবিলম্বে প্রাদেশিক পরিষদে স্বায়ত্তশাসনের ওপর সরকারিভাবে প্রস্তাব উত্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। বলা হয়: স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পূর্ব বাংলার সর্বস্তরের মানুষ এখন এমন ঐক্যবদ্ধ যে এর বিরােধিতা করে কোনাে রাজনৈতিক দলের পক্ষেই প্রদেশের মাটিতে টিকে থাকা সম্ভব হবে না। সে দল ছােট বা বড়, নতুন বা পুরান-যাই হােক না কেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে তা বাস্তবায়নে শুরু করেন। ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত ও একুশ দফা বাস্তবায়নে গাফলতি এবং খাদ্য সংকট সমাধানে ব্যর্থতার প্রতিবাদে ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ ছেড়ে দিয়ে মওলানা ভাসানী ন্যাপ গঠন করেন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সভার নয়জন আওয়ামী লীগের সদস্য দল ছেড়ে ন্যাপে যােগ দেয়াতে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেন। তিনি তার মন্ত্রিসভাকে সুরক্ষিত করার জন্য কৃষক-প্রজা পার্টির একাংশের সমর্থন আদায়ের করার প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান বাধা সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির কোয়ালিশন প্রস্তাব ভেঙ্গে যায়। প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা করাচী ফিরে গেলেন।

অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর কার্যকলাপে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পায় রিপাবলিকান নেতা ডা. খান সাহেবের মন্তব্যে। তিনি ঢাকা ছাড়ার আগে এয়ারপাের্টে সাংবাদিকদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিষােদগার করে বললেন: “ওই দ্রলােকটি যেসব কাজ করছেন তাতে মাত্র একঘণ্টার মধ্যেই আমরা তার সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু করছি না এই কারণে যে এতে ঘন ঘন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তন সারা পৃথিবীতে দেশটি হাস্যাস্পদ হয়ে পড়বে। প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীর চরম বিরােধী মওলানা ভাসানীর প্রশংসা করে ডা. খান সাহেব বললেন: “মৌলানা সাহেব যে শুধু সৎ ও আদর্শবান তাই নয়, তিনি একজন দেশপ্রেমিকও।”  ডা, খান সাহেব মওলানা ভাসানীর প্রশংসা করলেন যা ছিল নিছক রাজনৈতিক স্বার্থে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান প্রাদেশিক সভায় মওলানার ন্যাপ দলের সদস্যদের সমর্থন প্রত্যাশা করছিলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৫৭ সালে এই “ন্যাপ ও মুসলিম লীগ সদস্যদের সঙ্গে একযোগে রিপাবলিকানরা লাহােরে একটি প্রস্তাব পাস। করালেন (পক্ষে ১৭০ ভােট বিপক্ষে মাত্র ৪ ভােট)। প্রস্তাবে দাবি করা হলাে: “অবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট প্রথা ভেঙ্গে ঐ অঞ্চলের চারটি রাজ্য পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে তাদের সাবেক অবস্থা ফিরিয়ে দেয়া হােক।” পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট প্রথা চালু করার সময় আওয়ামী লীগ তার বিরােধিতা করেছিল। পরে তা মেনে নেয়। আওয়ামী লীগ একথা বলেছিল যে, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ পশ্চিম পাকিস্তানিদের; কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানিরা তার সঙ্গে সম্পর্কিত শুধু এই কারণে যে পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সবগুলাে প্রদেশকে সংঘবদ্ধ করার সংকীর্ণ ও অসাধু উদ্দেশ্য থেকেই পাঞ্জাবি নেতা ও আমলারা এক ইউনিটের কাঠামােগত কৌশল আবিষ্কার করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সব রাজ্যের বিভিন্ন দলের নেতারা সেই এক ইউনিট ভেঙ্গে দেয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করায় আওয়ামী লীগের সন্তুষ্ট হয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী দলের সুস্পষ্ট নীতির কথা ভুলে বেঁকে বসলেন। কারণ সে সময় পাকিস্তান কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব শক্তিশালী করার লক্ষ্যে তিনিও ইস্কান্দার মীর্জার সঙ্গে আঁতাত করেন।

তাদের বক্তব্যে হবে সেপ্টেম্বর মাসে এক ইউনিট বিরােধী প্রস্তাবটি যখন লাহােরে বিধানসভায় গৃহীত হয়, সে সময় প্রধানমন্ত্রী পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন। আমি ও প্রেসিডেন্ট দুজনেই পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট ভঙিবার বিরােধিতা করব।” বিচলিত শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য আওয়ামী নেতারা তাদের নেতাকে এ ধরনের রেডিও বক্তৃতা না দিতে অনুরােধ করলেন। প্রেসিডেন্ট মীর্জার এটা ছিল একটা ষড়যন্ত্র। উদ্দেশ্য পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের তার বিরুদ্ধে একজোট করা এবং সােহরাওয়ার্দীর প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বাদ দেয়া। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ধারণা প্রেসিডেন্ট তার ওয়াদার খেলাপ করতে পারেন না। সােহরাওয়ার্দী বলেন: “এক ইউনিট ভেঙ্গে যাবার অর্থ পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া।” রেডিও পাকিস্তান তাদের পরবর্তী অধিবেশনেই জাতির উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচার করলেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব এক ইউনিট ভাঙ্গার বিরুদ্ধে এত দৃঢ়সংকল্প হয়ে উঠেছিলেন যে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের জনমতকে এ বিষয়ে তার স্বপক্ষে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক ট্যুর প্রােগ্রাম করলেন। যদিও তিনি জানতেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান তিনটি পার্লামেন্টারি পাটিই মুসলিম লীগ, রিপাবলিকান পার্টি ও ন্যাপ একমত হয়ে এক ইউনিট ভেঙে আগেকার মতাে পৃথক রাজ্যে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । রিপাবলিকান ও ন্যাপ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর উপর থেকে তাদের আস্থা তুলে নেন। এই সুযােগে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা, আবুল মনসুর আহমদকে রাষ্ট্রপতি ডাকলেন। পশ্চিম পাকিস্তানি মন্ত্রীর লেখা চিঠি পড়তে দিলেন। এরা সবাই প্রায় একই কথা লিখেছেন: “প্রাইম মিনিস্টার আমাদের এবং আমাদের পার্টিকে ট্রেটর বলে গালাগালি দিয়েছেন। এই অবস্থায় আমরা এই প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কাজ করতে অনিচ্ছুক।” ডা, খান সাহেব, মােজফফর আলী খান কিজিলবাস, পীর পাগারাে, আইয়ুব খুরাে, গাফফার খান প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ এবং সােহরাওয়ার্দী বিরােধী পূর্ব পাকিস্তানি নেতারাও প্রধানমন্ত্রীকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ শুরু করেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী ৪ অক্টোবর ১৯৫৭ সালে তার নিজের জেলা নােয়াখালিতে একটি জনসভায় প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে বিদ্রুপ করে বলেন, “যিনি নিজে এক বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনই সরকারি খরচে বিশ্ব ভ্রমণ করেন।

অথচ তিনি একথা বিস্মৃত হলেন যে, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সমর্থ হন। ডা. খান সাহেব যিনি পাকিস্তান বিরােধী ছিলেন এবং ১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তান পতাকাকে স্যালুট পর্যন্ত করেননি তিনিও বলেন: “প্রধানমন্ত্রী পদে সােহরাওয়ার্দীকে রাখতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।” ডা. খান সাহেব জানতেন যে তাঁর দল জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিলেই আওয়ামী লীগ মেজরিটি হারাবেন এবং সেই সঙ্গে চলে যাবে শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রাইম মিনিস্টারশিপ। আরেকটি কারণেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকে প্রধানমন্ত্রীর উপর এ সময় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় পরিষদে একটি বিবৃতি দিয়ে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে পাকিস্তান নিরাপত্তা (Security Act) আইনের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তা আর বাড়ানাে হবে না। কিন্তু অক্টোবর মাসের গােড়ার দিকে সােহরাওয়ার্দী একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে নিরাপত্তা আইনের বলবৎ রাখলেন। ১০ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে যুগােশ্লাভিয়ার ভাইসপ্রেসিডেন্টের সামনে একটি স্টেট রিসেপশন ছিল। বহু অতিথি এসেছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি মন্ত্রীরা একজনও আসেননি। টোটাল বয়কট । কিন্তু সারাদিন এই মন্ত্রীরা প্রেসিডেন্ট মীর্জার সঙ্গে দরবার করেছেন। ঐদিনই তিনি ইস্কান্দার মির্জার একটি “টপ সিক্রেট” চিঠি পান। প্রেসিডেন্টর প্রেরিত চিঠিটি ছিল জাতীয় পরিষদের রিপাবলিকান সদস্যদের অনাস্থার কথা। ওই চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দীকে তিনি অবিলম্বে পদত্যাগ করার পরামর্শ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী প্রেসিডেন্ট মির্জার চিঠির জবাব লিখলেন। তিনি লিখে পাঠলেন, প্রেসিডেন্ট অবিলম্বে পার্লামেন্ট ডাকুন। জাতীয় পরিষদে নিজের শক্তি পরীক্ষা না করে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারেন না।

এটা সংসদীয় গণতান্ত্রিক রীতি। প্রেসিডেন্ট ভবনে এই চিঠি পাঠানাে হলাে। সংবাদপত্রে প্রকাশের জন্যও দেয়া হলাে। প্রেসিডেন্ট মির্জার দফতর থেকে চিঠির জবাব এলাে না। বরং প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে বলা হলাে, তিনি প্রধানমন্ত্রী সােহরাওয়ার্দী পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেছেন। তিনি মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। ১৮ অক্টোবর ১৯৫৭। ১৪ জন মন্ত্রী নিয়ে আই, আই, চুণ্ডিগড় মন্ত্রিসভা গঠিত হলাে। এই মন্ত্রিসভা মুসলিম লীগ, রিপাবলিকান পার্টি, নেজামে ইসলাম ও কৃষক শ্রমিক পার্টির কোয়ালিশন । বিদায়ের আগে সােহরাওয়ার্দী একটি প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট আমার পরামর্শ গ্রহণ করেননি। আমি তাকে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকতে বলেছিলাম। সেখানে আমি আমার সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখাতে পারতাম। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আমার কথা মানলেন না। তাই পদত্যাগ করা ছাড়া আমার আর গত্যন্তর ছিল না।” | শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই উপলব্ধি করেন যে ইস্কান্দার মির্জাকে তাড়াতে হলে অবিলম্বে কেন্দ্রে সাধারণ নির্বাচন অপরিহার্য। কিন্তু কুচক্রী প্রেসিডেন্ট মির্জা তার ক্ষমতা অব্যাহত রাখার অপচেষ্টায় তৎপর। তিনি ভাষণে দেশের রাজনীতিবিদদের অকর্মন্যতা ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করেন।

সাধারণ নির্বাচনের উপযােগিতা সম্পর্কে প্রকাশ করলেন গভীর সন্দেহ। ২৭ ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে একটি বক্তৃতায় প্রেসিডেন্ট বলেন যে পাকিস্তান এক গভীর “চারিত্রিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে।” কালাে হাত প্রেসিডেন্ট মির্জা নতুন চাল খেললেন । তিনি সামরিক বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করেন । পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা বাতিলের চক্রান্ত করলেন। এক, কেন্দ্রে ও প্রদেশে বিশেষ করে পূর্ব বঙ্গ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক প্রভাব খর্ব করা, দুই. পূর্ণ সামরিক শাসন বা মিলিটারি ডিকটেটরশিপের পথ প্রশস্ত করা। ১৭-১৮ ডিসেম্বর। ১৯৫৭। মধ্যরাতে প্রেসিডেন্ট মির্জার পরামর্শে ও নির্দেশে পূর্ব-পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, এয়ারফোর্স ও নেভির ইউনিট নিয়ে গঠিত “অপারেশন ক্লোজ ডাের” নামে একটি পরিকল্পনায় সামরিক বাহিনীকে নামিয়ে দেয়া হলাে। উদ্দেশ্য : ভারতীয় সীমান্তে চোরাচালান বন্ধ করা। পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি মেজর জেনারেল উমরাও খান ১৭ ডিসেম্বর ১৯৫৭ সালে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, প্রাদেশিক সরকারের অনুরােধে তাঁরা এই দায়িত্ব নিতে এগিয়ে এসেছেন। সাংবাদিকদের একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেন, প্রাদেশিক সরকার তাদের সহায়তা দেবে। তার এই উক্তি শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি এড়ায়নি। তিনি তীব্র মন্তব্য করে বলেন, “জেনারেল উমরাও-এর ইঙ্গিত অত্যন্ত সন্দেহজনক। প্রয়ােজনে সামরিক বাহিনী অসামরিক প্রশাসনের আহবানে সাহায্যে করার কথা। কিন্তু প্রাদেশিক সরকার ও সিভিল এ্যাডমিনিস্ট্রেশন উল্টো মিলিটারিকে সহায়তা দেবে।” এ কোন্ আইন বা প্রথা? পূর্ব পাকিস্তানে আতাউর রহমান খানের আচরণ ও মনােভাবে কংগ্রেস এবং অন্য সংখ্যালঘু সদস্যরা ক্ষুব্ধ ছিলেন। ২১ মার্চ ১৯৫৮ সালে তারা মুখ্যমন্ত্রীকে জানিয়ে দেন যে তারা আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন। ফলে আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা চরম সংকটের মুখােমুখি হয়ে পড়ে।” এ সময় মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ন্যাপ সভাপতি মওলানা ভাসানী মনে করলেন যে, বিরােধী পক্ষ আওয়ামী লীগ ও এই দলের নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত করার এই একটি বড় সুযােগ।

তাই তিনি প্রস্তাব রাখেন যে ন্যাপসহ প্রাদেশিক সভায় সব বিরােধী দলের একজোট হয়ে আতাউরমন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা ভােট দেবে। মন্ত্রিদের পতন ঘটবে। কিন্তু প্রাদেশিক সভার ন্যাপ নেতারা অনেক বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তারা আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ভােটাভুটির সময় নিরপেক্ষ থাকবেন। ফলে ২২ মার্চ ১৯৫৮ সালে একটি সরকারি প্রস্তাব যখন ভােটে দেয়া হলাে তখন সরকার পক্ষ ১৩৬, বিপক্ষে ১০৬ ভােট পেয়ে সরকার টিকে গেল। মহিউদ্দিন আহমেদ বলেনন্যাপ সদস্যরা বুঝতে পেরেছিলেন যে আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভার পতন হলে কৃষক-শ্রমিক পার্টি, মুসলিম লীগ প্রভৃতি যে সব দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল বিরােধী দল সরকার গঠন করবে। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে চরম সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠীগুলাে মাথা চাড়া দেবে। বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি করবে। হিন্দু-মুসলমানে বা বাঙালি-অবাঙালিতে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধাবে। ফলে কেন্দ্রীয় সরকার এই সুযােগে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিধন করবে। দেশে সরাসরি সামরিক শাসন ও ডিকেটটরশিপ চালু করবে । ন্যাপের এই পরােক্ষ সহায়তা সত্ত্বেও মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও তাঁর সরকার বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি। মাত্র ন’দিন পরেই আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। জাতীয় নির্বাচনের দাবি চারদিকে সামরিক-বেসামরিক চক্রের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মােকাবেলায় সােহরাওয়ার্দীর কাছে একমাত্র পথ ছিল জনগণের শরণাপন্ন হওয়া, তাদের ম্যান্ডেট গ্রহণ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় গঠনতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা । সেই লক্ষ্যে তিনি দেশের বিরাজমান পরিস্থিতি, সমস্যা ও সংকট নিরসনে জনগণের কাছে চলে এলেন। হােসেন শহীদ | সােহরাওয়ার্দী ৬ জুলাই ১৯৫৮ সালে নারায়ণগঞ্জে এক বিশাল জনসভায় বলেনঃ “এগার বছরে ভারতে দু-দুবার সাধারণ নির্বাচন ইতােমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে, তৃতীয় নির্বাচনও যথারীতি হবে ।

কিন্তু আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত একটিও জাতীয় নির্বাচন হয়নি, হওয়ার কোনাে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট খান আবদুল কাইয়ুম খান প্রেসিডেন্ট মির্জাকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন: “সাধারণ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘােষণা করুন। নয় তাে দেশে রক্তের বন্যা বয়ে যাবে।” এ সময় দেশের দুই অংশেই নির্বাচনের দাবি এত সােচ্চার, এত জোরদার হয়ে উঠেছিল যে, পরিস্থিতিকে সাময়িকভাবে এড়িয়ে যাবার জন্য প্রেসিডেন্ট মির্জা ঘােষণা করেছিলেন যে, ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে জেনারেল ইলেকশন হবে। এই উদ্দেশ্যে জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নূনের উদ্যোগে গৃহীত বিলেও প্রেসিডেন্ট ১৯৫৮ সালে সেপ্টেম্বর মাসে অনুমােদন দেন। | কিন্তু একমাসের মধ্যেই অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের বুকে চেপে বসল পূর্ণ সামরিক শাসন।

জেনারেল আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল। জেনারেল আইয়ুব খানকে যদিও ইস্কান্দার মীর্জা তার কেবিনেটে প্রধানমন্ত্রী করে। ক্ষমতার অংশীদারীত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু আইয়ুব খান এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। বরং মীর্জার অধীনে প্রধানমন্ত্রী হওয়াকে অপমান হিসেবে বিবেচনা করেছেন। আইয়ুব খান দেখলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা ফিরােজ খানের নূনের ঘােষণা মতাে নির্বাচন দেবেন না বরং সংবিধান বাতিল করবেন। ইতােমধ্যে ড. খান সাহেব মে মাসে গুলিতে নিহত হয়েছেন, পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ড ঘটেছে এবং চারদিকে আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে।

৭ অক্টোবর ১৯৫৮ প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী আইয়ুব খান বরাবর পত্র লেখেন। পত্রে উল্লেখ করেন তিনি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করেছেন তাকে দেশের মঙ্গলে সর্বাত্মক দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তার দু’দিন পূর্বে ৫ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সরাসরি প্রেসিডেন্ট মীর্জার সঙ্গে দেখা করে বলেন, দায়িত্ব গ্রহণে তিনি এখনাে মনস্থির করেননি। এ সময় ইস্কান্দার মীর্জার বুদ্ধিমতি ও সুন্দরী স্ত্রী বেগম নাহিদ জেনারেল আইয়ুব খানকে শেষ করার জন্য একটি ষড়যন্ত্র করেন। ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মীর্জা জেনারেল আজম খান, জেনারেল বার্কি এবং জেনারেল শেখকে সরাসরি আইয়ুব খানের অধীনে মন্ত্রী হিসেবে নিয়ােগ দান করেন। মঞ্জুর কাদেরকে বিদেশমন্ত্রী, মােহাম্মদ শশায়েবকে অর্থ ও জুলফিকার আলি ভুট্টোকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রদান করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় জেনারেল আজম খান, বার্কি ও শেখ যারা ছিল প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানের অধীনস্থ তাদের ইস্কান্দার মীর্জার বাসভবনে গমন করেন। তারা প্রেসিডেন্টকে বলেন, অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। তাহলে আপনার জীবন রক্ষা হবে এবং আপনি পেনশনও পাবেন। কোনাে গতি না দেখে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা পদত্যাগ করেন। পদত্যাগপত্র নিয়ে তারা আইয়ুব খানকে দিলে তিনি বলেন, এসব বিষয় নিয়ে কেন আমাকে বিব্রত করছেন। ইস্কান্দার মীর্জাই তাে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারত।” একথা ছিল আইয়ুব খানের ভাওতাবাজি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জেনারেল আইয়ুব খান পরের দিন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এই ক্ষমতা গ্রহণকে তিনি বিপ্লব বলে অভিহিত করেন। আসন্ন জাতীয় নির্বাচন বাতিল হয়ে গেল। গঠনতান্ত্রিক চর্চা নিষিদ্ধ । চারদিকে ভীতিকর সামরিক সন্ত্রাস। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা ক্ষুব্ধ। নির্যাতন। গ্রেফতার।

সঙ্গিলের ডগায় বিদ্ধ গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার বাতিল । রাজনীতি নিষিদ্ধ। রাজশাহী থেকেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রথম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। সামরিক শাসন জারির বিরুদ্ধে মিছিল। বিক্ষোভ। বেপরােয়া লাঠিচার্জ। নেতা কর্মীরা গ্রেফতার। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। সামরিক আদালতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কাজী আব্দুস শহীদ লালের ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড। একই সঙ্গে বেত্রাঘাতের হুকুম । কাজী আব্দুস শহীদ লাল তখন রাজশাহী। ছাত্র সমাজে আন্দোলনের এক সাহসী নাম। বাম চেতনায় বিশ্বাসী। কিন্তু কড়া সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৯৬২ সালের পূর্বে সামগ্রিক অর্থে ছাত্র আন্দোলন রচনা সম্ভব হয়নি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক ছাত্র সমাজের বিভিন্ন দাবি ‘দিবস’ নিয়ে ব্যস্ত। দেশব্যাপী আন্দোলনের প্রস্তুতি-পর্ব। রাজশাহী ছাত্র আন্দোলনের দায়িত্ব বর্তায় মূলত নবাগত তরুণ অনার্স ছাত্রদের ওপর। | ষাটের দশক বাঙালি জাতির আত্ম-অনুষ্ঠানের অভিযাত্রা। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের লৌহ কঠিন সামরিক শাসনের কৃষ্ণ যবনিকা ছিন্ন করে স্বায়ত্তশাসন, স্বাধিকার ও বাঙালির মুক্তি আকাক্ষার এক অদমিত দশক। তারুণ্যের আবেগ, বঞ্চনা-দগ্ধ প্রত্যয় এবং মুক্তির আকাঙক্ষায় উচ্চকিত এক ঐতিহাসিক ক্রান্তিকাল উদ্বেলিত ঐতিহাসিক ঘটনাবলির বিস্ফোরণে আকীর্ণ।

১৯৬২ সালে জানুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ঢাকা এলেন । তিনি বলেন, দেশে রাজনীতি নিষিদ্ধ, রাজনীতির দলও নেই। এই অবস্থায় সকলে একসঙ্গে মিলেমিশে কাজ করাই হবে একমাত্র পথ। দলাদলি, কোন্দল এবং বিগত দিনের হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে সকলকে একই লক্ষ্যে কাজ করার আহবান জনান। তিনি বলেন যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে কোনাে ব্যক্তি, গােষ্ঠী বা দল এককভাবে কিছুই করতে পারবে না’ । ১৯৬২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জামাত-ই-ইসলাম, নিজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের একাংশ নিয়ে গঠিত হয় ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এন.ডি.এফ.), লক্ষ্য: সবার আগে গণতন্ত্র ।

জেনারেল আইয়ুব বিপদ দেখলেন ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি । হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গ্রেফতার হন। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ বিশেষত তরুণ ছাত্র সমাজ এই গ্রেফতারে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ১ ফেব্রুয়ারি। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা উপস্থিত। ছাত্র সংগঠন ধর্মঘট ডাকে। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর অবিলম্বে মুক্তি ও গণতান্ত্রিক স্লোগানে ঢাকা উচ্চকিত। সামরিক কর্তৃপক্ষ নিষেধাজ্ঞা জারি করে। গণমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা। ঢাকার কোনাে সংবাদপত্রে সত্য ঘটনা প্রকাশ করা যাবে না। তারপরও পাকিস্তান টাইমস লিখেছে, ঢাকা ছাড়াও মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, বরিশাল, পিরােজপুর, যশােরে, খুলনা, পাবনা, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী প্রভৃতি জায়গায় এ সময় প্রবল ছাত্র বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। সরকারি নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই এক মাসের জন্য রমজানের দীর্ঘ ছুটি ঘােষণা করে। রাজশাহীর ছাত্র সমাজ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও বন্দি মুক্তির আন্দোলন থেকে দূরে ছিল না। প্রথমে ছােট ছােট বৈঠক। তারপর কলা ভবনের সামনে খণ্ড মিটিংমিছিল। তারপর শহরে বিক্ষোভ চলে।

ধনীদের জন্য উচ্চ শিক্ষা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ছাত্র অসন্তোষের প্রেক্ষিতে শিক্ষা নীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠন করেন শরীফ কমিশন । শরীফ কমিশনের শিক্ষানীতিতে ঘােষিত হয় ‘ধনী’ ও ‘মেধাবী ছাত্ররাই কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার যােগ্য। দু বছরের পাস কোর্সকে তিন বছর করা হয়। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন। এ সম্পর্কে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান লিখেছেন, “১৯৬৩ সালের গােটা বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২৭দিন ক্লাস হয়েছে। আমরা দুটি প্রদেশকে সর্ববিষয়েই সমপর্যায়ে আনবার জন্য যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্র যারা। রাজনীতি করে এবং রাজনীতিবিদদের দ্বারা বিপথে চালিত হয়ে সময় নষ্ট করে, তাদের দ্বারা আমাদের অগ্রগতি বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। আমি মনে করি যে, শিক্ষা সংস্কার রীতিমতাে ভালাে ফল দিচ্ছে এবং আগামী দু’তিন বছরের ভেতরেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উন্নত ধরনের শিক্ষিত ব্যক্তিদের লাভ করব।”

শাসক গােষ্ঠীর কাছে শিক্ষা পদ্ধতির যে মৌলিক দুর্বলতা বিবেচিত হয়েছে তা হল শৃঙ্খলার অভাব, শাসক কর্তৃত্বের প্রতি অশ্রদ্ধা এবং আঞ্চলিক ও প্রাদেশিকতায় প্রভাবান্বিত হওয়া । মূলত এসবই ছিল রাজনৈতিক ইস্যু।

এই প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফেডারেশন কর্তৃক ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট বাতিল আন্দোলন ঘােষিত হয়। ঐদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয় জঙ্গি মিছিল। মিছিল হাইকোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। পুলিশের গুলিতে বাবুল, গােলাম মােস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ নিহত হয়। ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে। রাজাশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। যশােরে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষে ৪৩ জন। আহত হয়। রাজশাহী বিভাগের বগুড়া, পাবনা, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের নতুন গতি সৃষ্টি করে। ১৯৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবে রাজশাহীতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুনভাবে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। জাতীয় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার পূর্বেই রাজশাহীর একাধিক ঘটনা ছাত্র-সমাজকে সামগ্রিক আন্দোলনের দিকে ঠেলে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি ঘােষিত হয়।

সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারে সামরিক চক্রের অন্তর্ব পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজম খান মার্শাল আইয়ুব খানের বরাবর ৭ জুন ১৯৬২ সালে একটি গােপনীয় পত্র লেখেন। জেনারেল আজম খানকে আইয়ুব খান লিখেছিলেন সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানবিরােধী শক্তির সমবেশ ঘটাতে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু আজম খান আইয়ুব খানের পত্রের জবাবে বলেন, “প্রশাসক কাজের মৌলিক নীতি হচ্ছে, আইন শৃঙ্খলা কোনাে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার আগে ঘটনাস্থলে যিনি আছেন, তার সঙ্গে আলােচনা করতে হয়। যদি জনাব সােহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে কোনাে তথ্য থেকেই থাকে, তাহলে তা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতেই বেশ কিছুকাল ধরে ছিল। এটা নিশ্চয়ই গ্রেফতারের কয়েক ঘণ্টা আগে জোগাড় করা হয়নি যে আপনি বলতে পারবেন আমার সাথে আলােচনা করার মতাে সময় আপনার ছিল না। যদি এমন হতাে যে, এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কর্তব্য পালনে আমি ব্যর্থ হয়েছি, সেক্ষেত্রে আমাকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া বা আমাকে সরিয়ে দেয়াই আপনার উচিত ছিল। যেভাবে আপনি এবং আপনার সরকার বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন গভর্নর হিসেবে আমার প্রতি সুনির্দিষ্টভাবেই অবিশ্বাসের একটি পরিচয়। তিনি আরও বলেন, ব্যক্তির ইচ্ছা ও মেজাজের কারণে দেশকে যে দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছে, এর দৃঢ় নীতি ও আদর্শের পরিবর্তে প্রশাসনে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ ও ব্যক্তিগত আকাক্ষা পূরণের যে সুযোগ দেয়া হয়েছে, তা আমরা সবাই ভালােভাবে জানি। ঐ সমস্ত আদর্শের প্রশ্নে আপােস করতে হলে বিপ্লবের উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যেত।

কাজেই যখন কতগুলাে মৌলিক আদর্শ লজ্জিত হলাে, তখন পদত্যাগ করা ছাড়া আমার কোনাে বিকল্প থাকল না, যেমনটা আমি আমার ১১ মার্চের পদত্যাগপত্রে ইতােমধ্যেই উল্লেখ করেছি। ঐ পত্রের জবাবে আপনি আমাকে পাঠানাের এক জরুরি বার্তায় বলেছিলেন, যে বিষয়টা সম্পর্কে ব্যক্তিগতভাবে আলােচনার প্রয়ােজন রয়েছে বিধায় পূর্ব পাকিস্তানে আপনার পরবর্তী সফরকালে তা আমার সঙ্গে আলােচনা করবেন বলে মনস্থ করছেন। এই আলােচনা আপনি করেছিলেন, কিন্তু গভর্নর হিসেবে বহাল থাকতে অসম্মতি জানিয়ে আমি পদত্যাগের সিদ্ধান্তেই অটল থাকি এবং যথাশীঘ্র সম্ভব অব্যাহতি প্রাপ্তির ইচ্ছাও আমি প্রকাশ করি।”১৭ জেনারেল আজম খান সামরিক ব্যক্তিত্ব হলেও তিনি পূর্ব পাকিস্তানে জনপ্রিয় ছিলেন। তার পদত্যাগ জনমনে সামরিক শাসকদের মধ্যে বিরোধ প্রকাশিত হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এই সুযােগ গ্রহণ করে। আন্দোলনের প্রাথমিক পদক্ষেপ ঠিক হয়েছিল, সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণতন্ত্রের দাবিতে করাচী থেকে সর্বপ্রথম শহীদ সােহরাওয়ার্দী একটি বিবৃতি দেবেন। কিন্তু বিবৃতিদানের পূর্বেই সংবাদটি সামরিক সরকারের কাছে পৌছে যায়। ৩০ জানুয়ারি বিকেল। করাচীতে কোনাে প্রকার প্রস্তুতির সুযােগ না দিয়েই শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয় । শহীদ সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের ফলে সারাদেশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এগিয়ে আসে ছাত্রসংগঠন। মূলত আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলা এবং জনমত গড়ে তােলা সেসময় এক দুঃসাহসিক দায়িত্ব পড়েছিল ছাত্রসমাজের উপর । ছাত্র সমাজ সেই চ্যালেঞ্জটিই সেদিন গ্রহণ করেছিল ।

দীর্ঘ চার বছর পর বাষট্টিতে এসে বিক্ষোভ সমাবেশ করে জেনারেল আইয়ুবের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শহীদ সােহরাওয়ার্দী গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানাতে সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলনের সূচনা হয় ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৮ মার্চ পর্যন্ত। কর্মসূচিতে ছিল ক. আইয়ুব খান প্রবর্তিত সংবিধান বিরােধী আন্দোলন (মার্চ থেকে এপ্রিল), গ, শিক্ষা কমিশনের রিপাের্ট বাতিল, গ. রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মােহাম্মদ ফরহাদের উদ্যোগে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ একটি গােপন সভা অনুষ্ঠিত হয় ৩০ ডিসেম্বর ১৯৬১, ইস্কাটনের একটি বাড়িতে। দুই সংগঠনের প্রায় ৩০-৩৫ জন নেতা কর্মী সেই গােপন বৈঠকে যােগ দেয়। তবে আন্দোলনের চেতনার দিক থেকে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গিতে একটা পার্থক্য ছিল। ছাত্রলীগ প্রধানভাবে সামরিক শাসনের পরিবর্তে একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করার কথাই চিন্তা করেছে। নেতৃবৃন্দের একটা বড় অংশের মধ্যেই আইয়ুব খানের পরিবর্তে শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট করার ইচ্ছাই ছিল প্রধান । ছাত্রলীগ লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। অন্যদিকে ছাত্র ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবির সঙ্গে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী চেতনায় সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতাকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। তবু এই গােপন সিদ্ধান্ত হয়, যে কোনাে কিছুর বিনিময়ে সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। সামনের একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৬২) থেকেই তা শুরু করা হবে।

কিন্তু ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকার প্রয়োজন হলাে না ছাত্রদের। কেননা পহেলা তারিখে আইয়ুব খান ঢাকা পদার্পণ করলেন। আর এ দিনই  ধর্মঘট বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয়া হয়। রাত তখন দুটো। এস, এফ ও ছাত্র শক্তির নেতৃবৃন্দ চলে যাওয়ার পর সরকারি গােয়েন্দা সংস্থার লােকজন তাদের কাছ থেকে সংবাদ টুকে নিলেন ‘আগামীকাল ধর্মঘট হচ্ছে না। প্রকৃতভাবে এন, এস, এফ ও ছত্রিশক্তির সামনে পরদিনের কর্মসূচি নিলে ছাত্রনেতৃবৃন্দের গ্রেফতার হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। ধর্মঘট বানচাল হয়ে যেত। সাধারণ ছাত্র সমাজে যে স্বতঃস্ফুর্ততা ছিল নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে পুনরায় তা স্তিমিত হয়ে পড়ত। রাত দুটোর পর শুধু ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ সভায় পরদিন ধর্মঘটের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সরকারি গােয়েন্দা সংস্থা যখন উচ্চ মহলে রিপাের্ট লিখছেন, আগামীকাল ছাত্র মহলে উত্তেজনা হচ্ছে না। যৌথ সভায় আরাে সিদ্ধান্ত হলাে, ধর্মঘটটি সাধারণ ছাত্রদের দ্বারা স্বতঃর্ত হচ্ছে এমন ভাব দেখাতে হবে এবং এরকম ছাত্র সভায় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ কেউই বক্তৃতা করবেন না। বৈঠকের পর নেতৃবৃন্দ চলে যান  ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে। সেখানে অপেক্ষা করছিল বিভিন্ন শাখার নেতা ও কর্মীরা। কলেজ ও হলগুলােতে ধর্মঘটের খবর পেীছে দেয়া হলাে। পরদিন সকালে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মঘট পালিত হলাে বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। একজন নিরপেক্ষ প্রগতিশীল ছাত্রকর্মী আনিসুর রহমান তাতে বক্তৃতা করলেন।” 

ফেব্রুয়ারি ৭। পূর্ব ঘােষণা অনুযায়ী এদিন আইয়ুব খানকে ঘেরাও করার কর্মসূচি নেয়া হয়। এক বিশাল জমায়েত অনুষ্ঠিত হয় এদিন। পুলিশের সাথে সেনাবাহিনীও রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে থাকে। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের সামনে দুটি ফিল্ডকামান বসানাে হয়েছিল । এমন করে চতুর্দিকে ঘেরাও করা হয়েছিল যাতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্ররা বের না হতে পারে। কিন্তু কৌশলে ছাত্ররা এদিন শেষ পর্যন্ত মিছিল শহরে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। কার্জন হল থেকে মিছিল ঢাকা হলের ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে ছাত্ররা প্রথমে বিশ্ববিদালয় মাঠে প্রবেশ করে সেখান থেকে মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালের ভেতর দিয়ে বকশীবাজারে পুরনাে ঢাকায় প্রবেশ করে। মিছিল পুরনাে ঢাকা অতিক্রম করে হাটখােলা রােডে এসে আবার বাধার সম্মুখীন হয়। প্রচণ্ড লাঠিচার্জে মিছিল শেষ পর্যন্ত ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। | বিকেলে ঢাকা হলে ছাত্রলীগ-ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের বৈঠক ছিল। বৈঠক চলে অধিক রাত পর্যন্ত। ছাত্র নেতারা ঢাকা হল ও ফজলুল হক হলে থেকে গিয়েছিলেন। কিন্তু এ রাতেই পুলিশ ও সেনাবাহিনী হল ঘেরাও করে একটি মাত্র গেট দিয়ে ছাত্রদের বের হওয়ার নির্দেশ দেয়। হল ত্যাগ করতে বলা হয় সকল ছাত্রকে। ৭ দিন পর্যন্ত সময় লেগেছিল সমস্ত ছাত্রদের বের করতে। অনেকের বাড়ি যাওয়ার মতাে কোনাে টাকা তাদের ছিল না। তাদের টাকা পর্যন্ত দেয়া হলাে। তবু জোরপূর্বক হল ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এই ৭ দিন গােয়েন্দা পুলিশ সারাক্ষণ ছাত্রনেতাদের গ্রেফতার করা জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। বের হওয়ার আর কোনাে পথ ছিল না। সপ্তম দিবসে প্রচণ্ড ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হলে সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা গুটিয়ে গেলে সন্ধ্যার পর শেখ ফজলুল হক মণি, মােহাম্মদ ফরহাদ প্রমুখ পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয় । কিন্তু ছাত্রনেতাদের নামে হুলিয়া জারী করায় সাময়িকভাবে আন্দোলনে ভাটা পড়ে।”

এই সময় সামরিক শাসনবিরােধী ছাত্র আন্দোলনের চরম নির্যাতন নেমে আসে। সম্মুখীন হয় গ্রেফতার নির্যাতনের । কিছু দিন পর ৬২-র সংবিধান প্রশ্নে আবার ছাত্ররা সংগঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬০ সালে জানুয়ারি মাসে তার মৌলিক গণতন্ত্রে নির্বাচন শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি ৯৫.৬ শতাংশ মৌলিক গণতন্ত্রীদের আস্থা ভােটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এর দুদিন পরই তিনি শাসনতন্ত্র রচনার জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। এর সুপারিশের ভিত্তিতে ৬২ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ এবং ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের পরােক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। | এ সময় পাকিস্তানের ভাষা প্রশ্নে নতুন করে বিতর্ক উত্থাপন করা হয়। ভাষা কমিশনের কারাে কারাে অভিমত ছিল আরবী হরফে বাংলা লেখা অথবা রােমান হরফে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা প্রবর্তন। কমিশন আরাে সুপারিশ করেন যে, বিকল্পভাবে সরকারের পক্ষে তিনটি ভাষাবিদ কমিটি নিয়ােগ করা উচিত। একটি নির্দিষ্ট মানে উন্নয়নকৃত মুদ্রণযােগ্য একটি উর্দু বর্ণমালা নির্ধারণ করবে। দ্বিতীয়টি বাংলা বর্ণমালা সংস্কার করবে এবং তৃতীয়টি উর্দু ও বাংলার জন্য একটি রােমান বর্ণমালা গঠন ও মান নির্ধারণ করবে।” প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বললেন, “সব ভাষা মিলিঝুলি ‘পাকিস্তানি ভাষা তৈরি করতে হবে । সােহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের পর একই সাথে ১৯৬২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং আট মাস তাকে জেলের মধ্যে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আটকে রাখা হয়।

সবার আগে চাই গণতন্ত্র ৪ অক্টোবর। ১৯৬২। করাচী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দেশের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল দলমতনির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তােলার লক্ষ্যে এক বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “পাকিস্তান কোনাে ব্যক্তি, গ্রুপ বা দল বিশেষের নয়। দেশ পাকিস্তানি জনসাধারণের। জনসাধারণকে তাদের চিরন্তন স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের সার্বভৌম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অধিকার কারাে নেই। তিনি বলেন, “এ কথা তার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়েছে যে, পূর্ব বা পশ্চিম পাকিস্তানের হােন জাতীয় ঐক্য প্রচেষ্টায় দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এক গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের মাধ্যম ছাড়া সম্ভব নয়। যে শাসনতন্ত্র হবে দেশবাসীর ইচ্ছার সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতীক।” এই ফ্রন্টে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ কাউন্সিল, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলাম পাটি। এনডিএফ গঠনকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেন। বেসামাল হয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সােহরাওয়ার্দীকে আক্রমণ করে বলেন, ‘লােকটা তাে পাকিস্তানে বিদেশী’। পার্টিশনের অনেক পরে তিনি এ দেশে আসেন ও নাগরিকত্ব লাভ করেন। এই সব কথায় শহীদ সােহরাওয়ার্দী গুরুত্ব দিলেন না। তিনি গণসংযােগের লক্ষ্যে প্রথম পর্যায়ে ৬ অক্টোবর শনিবার সন্ধ্যায় করাচী থেকে ঢাকায় এলেন। সাংবাদিকদের বললেন, এন.ডি.এফ-এর কোনাে ন্যূনতম সর্বসম্মত কর্মসূচি নেই । শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রীকরণের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তােলাই হবে ফ্রন্টের প্রধান উদ্দেশ্য। ৭ই অক্টোবর পল্টনে জনাব নুরুল আমিনের সভাপতিত্বে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলি ও গুজরানওয়ালায় সােহরাওয়ার্দীর জীবনের উপর আক্রমণ প্রচেষ্টার প্রতিবাদে এই সভা আহত হয় । পল্টনের জনসভায় লাখ লাখ লােক সমবেত হয়।

হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দী জনসভায় বলেন, “যে পথে আমরা পা বাড়িয়েছি সে পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। আমাদের পথে আছে অজস্র কাটা। শাসনতন্ত্রে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা যদি আপনাদের কাম্য হয়ে থাকে তবে সেই কন্টকাকীর্ণ পথে পাড়ি জমাতে আপনাদের। প্রস্তুত থাকতে হবে। সমবেত লাখ লাখ মানুষকে সােহরাওয়ার্দী প্রশ্ন করলেন: “এই বিরাট জনসমুদ্রের মাঝে দাঁড়িয়ে আমি জানতে চাই- গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র আপনারা চান কি চান না?” জন সমুদ্রে সমস্বরে গর্জে উঠলেন: “চাই, চাই” । পরদিন ৮ অক্টোবর (৬২) “দৈনিক ইত্তেফাক” এই জনসভার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখলেন: “জনগণই পাকিস্তানের মালিক এই বিশ্বাসে বলীয়ান হইয়া শাসতন্ত্রের গণতন্ত্রায়নের সুস্পষ্ট ওয়াদা লইয়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল দল ও মতের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে এক কাতারে দণ্ডায়মান হইয়া সমগ্র দেশে গণঐক্যের এক অপূর্ব ইতিহাস রচনা করিয়াছেন।” সেদিনই রাতে জনাব নুরুল আমিনের বাড়িতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতাদের এক বৈঠক বসল। সেখানে শেখ মুজিব ৭ অক্টোবরের জনসভা সম্পর্কে তার অন্তরঙ্গ মহলে মন্তব্য করেছিলেন: “পল্টন ময়দানের জনসমুদ্রের এই প্রাণপ্রবাহ দেখার জন্য যদি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আজ এখানে থাকতেন, তবে তিনি বুঝতে পারতেন যে দেশের মানুষের মনে কী আগুন জ্বলছে।” ১১ অক্টোবর (‘৬২) বৃহস্পতিবার হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে তার নির্দিষ্ট গণসংযোেগ সফরের প্রথম পর্যায়ে ঢাকা থেকে যশােরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। শেখ মুজিব বললেন: “গােলামির জিঞ্জির ছিন্ন করার জন্য গ্রামে গ্রামে আন্দোলন গড়ে তুলুন।” তিনি আরও বললেন: “দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রীকরণের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।

যেহেতু জনতাই সরকার গঠন করে, তাই সরকারকে জনগণের সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে। যশাের জনসভায় সভাপতি সৈয়দ শামসুর রহমান শেখ মুজিবকে “যুব বাংলার প্রাণের প্রতীক” বলে স্বাগত জানালেন। শেখ মুজিব তার ভাষণে বললেন: “জনগণের ট্যাক্স দেবার অধিকার থাকলে ভােট দেবার অধিকার থাকবে না কেন? কিন্তু ট্যাক্সের বােঝা যতই বেড়ে চলেছে ততই তাদের মৌলিক অধিকারও হরণ করা হচ্ছে। শেখ মুজিব আরও বলেন: “আজ আমাদের কোন দল নেই। আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বলে আজ আর আলাদা আলাদা কোন দল নেই। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য, একমাত্র পথ হলাে: দলমত নির্বাসন দিয়ে প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কায়েম করা।” যশাের থেকে খুলনা। খুলনা থেকে বরিশাল। বরিশাল থেকে চাঁদপুর হয়ে ঢাকা ফিরে আবার রাজশাহী যাত্রা। প্রদেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঝটিকা সফর। আতাউর রহমান খান তার “স্বৈরাচারের দশ বছর” বইতে সােহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব ও অন্য পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের এই সফরের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন: “সারাদেশ জেগে উঠল। মানুষ অভূতপূর্ব উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে উঠল। রাস্তাঘাট, ট্রেন-স্টিমার, হাট-ঘাট, বাজার-বন্দর লােকে লােকারণ্য। জনসভায় তিল ধারণের স্থান নেই। জাগরণের হিল্লোলে দেশ কাপায়ে তুলল।” উপরের সফরসূচী ছাড়াও জনতার আগ্রহে, অনুরােধে পথে বহু জায়গায় সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবকে আকস্মিকভাবে জনসভা করতে হয়েছে। ভাষণ দিতে হয়েছে। বিভিন্ন জনসভায় শহীদ সােহরাওয়ার্দী বলেন: “আমাদের মধ্যে আর কোনাে দলাদলি নেই।

বিবাদ নেই। জাতির জীবনে আজ গভীর সংকট। আমরা যদি দলাদলি করি তাহলে আমরা ধবংস হয়ে যাব। আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, কিন্তু ভেতরে বাইরে অপচেষ্টা চলছে এই ঐক্যকে বিনষ্ট করার। আপনারা শত্রুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নীতিগুলাে প্রচারে সাহায্য করুন। পাকিস্তানকে দেশী সাম্রাজ্যবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করুন। শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন ভাষণে বলেন: “পাকিস্তানের জনসাধারণই দেশের একমাত্র মালিক এবং দেশকে শাসন করার অধিকার একমাত্র তাদেরই। তাই পাকিস্তানে জনগণের শাসন কায়েমই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। যে কোনাে ত্যাগের বিনিময়ে দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অব্যাহত রাখার জন্য একতাবদ্ধ হােন।” আবেগে উদ্বেল হয়ে শেখ মুজিব জনতার উদ্দেশে বলেন: “আমরা কেউ আজ আর আপনাদের নেতা নই । আপনাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার এই সংগ্রামে আমরা সবাই জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নগণ্য স্বেচ্ছাসেবক মাত্র। আজ সবাই আমরা গণতান্ত্রিক শিবিরের কর্মী, সবাই আমরা একই কাফেলায়।” ৬২ সালের ২৫ অক্টোবর তারা দুজনে ঢাকায় ফিরে এলেন। পরদিন ময়মনসিংহে সার্কিট হাউজ ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিলেন। শহীদ সােহরাওয়ার্দী গণসংযােগ সফরের প্রথম পর্যায় শেষ হলাে ।

১৯৬২ সালের অক্টোবর মাস। ঠিক সেই সময় আন্তর্জাতিক জগতে অত্যন্ত গুরুতর দুটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে। একটি পূর্ব পাকিস্তানের সীমানা থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে কিউবায় সংকট উপলক্ষ করে দুনিয়ার বৃহত্তম দুটি শক্তি রাশিয়া ও আমেরিকা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিনারায় এসে দাঁড়ায়। আরেকটি পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় দ্বারপ্রান্তে নেফায় ও আসামে চীন-ভারত সংঘর্ষ। পূর্ব ভারতে চীনা অভিযান নিয়ে পূর্ব বঙ্গের মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে স্বভাবতই যথেষ্ট উত্তেজনা ও উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছিল, কারণ এই যুদ্ধ হচ্ছিল পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় দ্বারপ্রান্তে। এই সময় জনাব সােহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে তার গণসংযােগ সফরের দ্বিতীয় পর্যায়ে ৭ নভেম্বর মাদারীপুরে গেলেন। সেখানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব বললেন: “শাসনতন্ত্র গণতন্ত্রায়নের মধ্যেই আমাদের জাতীয় সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। ১০ নভেম্বর শনিবার তারা গেলেন সিলেট । সেখানে এক উদ্দীপ্ত ভাষণে শেখ মুজিব বলেন: “প্রায় পাঁচ বছর পরে আমার আবার সিলেট আসার সুযােগ হলাে। এর মধ্যে দীর্ঘ চার বছর ধরেই আমাদের দেশে সামরিক শাসন চলছে।

এই রাষ্ট্র আপনাদের বেদখল হয়ে গিয়েছে। একে আবার দখল করতে হবে। এর জন্য আমাদের বহু ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।” ১১ নভেম্বর রবিবার নােয়াখালীতে শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন : “শত দমননীতির মুখেও জনগণের কাফেলা চলতে থাকবে।” জনাব সােহরাওয়ার্দী ১৩ নভেম্বর করাচী ফিরে গেলেন, কিন্তু যাওয়ার আগে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে “জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের” সংগঠন ও কমিটি করেন। জনাব নুরুল আমিনকে করা হয়েছিল আহ্বায়ক। সােহরাওয়ার্দী নুরুল আমিনকে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের” পূর্ব পাকিস্তান শাখার নেতা নির্বাচিত করায় শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন: “নুরুল আমিনের মতাে একজন প্রতিক্রিয়াশীল ও সুবিধাবাদী রাজনীতিবিদের অধীনে কাজ করা আমাদের পক্ষে কি করে সম্ভব?” তখন সােহরাওয়ার্দী মুজিবকে বােঝালেন যে, একটি ঝটিকা-ঝঞাবিক্ষুব্ধ বন্যাপ্লাবিত দ্বীপে মানুষ, বাঘ, সাপ, সিংহ সবাইকে সহাবস্থান করতে হয় এবং দুর্যোগের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়। সে সময় কে ভালাে, কে মন্দ তা নিয়ে মাথা ঘামালে চলে না। ঘাের অনিচ্ছা সত্ত্বেও শেখ মুজিব তার নেতার নির্দেশ মেনে নিলেন। কিন্তু তিনি কোনাে দিন মনে-প্রাণে এন.ডি. এফ-এর নেতৃত্বে নুরুল আমিনের অবস্থিতিকে গ্রহণ করতে পারেননি। ১৪ নভেম্বর শেখ মুজিব শেরে বাংলার স্মৃতিসৌধ কমিটি পুনর্গঠনের দাবি জানালেন। বললেন: “বর্তমান কমিটি বাস্তবে কোন কাজই করেনি।” জনাব সােহরাওয়ার্দী তার গণসংযােগ সফরের তৃতীয় পর্যায়ে আবার ঢাকায় এলেন। ২৩ নভেম্বর ফরিদপুরে ও পরদিন ২৪ নভেম্বর কুষ্টিয়ায় দুটি বিশাল জনসভায় তিনি ও শেখ মুজিব ভাষণ দিলেন। শেখ মুজিব বলেন: “প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের এই গণতন্ত্র বিরাট এক ধাপ্পা।

জঙ্গীশাহীর হাত থেকে পূর্ণ গণতান্ত্রিক অধিকার আমাদের ছিনিয়ে আনতে হবে । আপনারা প্রস্তুত হন। আর সময় নেই।” জনাব সােহরাওয়ার্দী তাঁর সফরসূচীর চতুর্থ পর্যায়ে ৩ ডিসেম্বর (‘৬২) পুনরায় পূর্ববঙ্গে এলেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব ৫ ডিসেম্বর উত্তর বাংলা সফরে বেরুলেন। ৫ ডিসেম্বর বগুড়ায়, ৬ দিনাজপুরে ও ৭ পাবনায় জনসভায় তারা ভাষণ দিলেন। তারা বলেন: “বহুমুখী জাতীয় সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। পূর্ব বাংলার মাটিতে জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এই শেষ পরিক্রমা। এবার ঢাকা বিমানবন্দর থেকে তিনি যে বিদায় নিলেন, পূর্ব-পাকিস্তান থেকে সােহরাওয়ার্দীর সেই শেষ যাত্র। | ১৯৬২ সালে উদ্বিগ্ন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ১৮ ডিসেম্বর নদিনের সফরে পূর্ব পাকিস্তানে এলেন। সিলেট গেলেন। রাজশাহীতে গেলেন। ভেবেছিলেন তিনি। একবার গিয়ে দাঁড়ালেই সােহরাওয়ার্দী মুজিবের সফরের প্রভাব তিনি কাটিয়ে দিতে পারবেন। ২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় আইনজীবীদের এক সম্মেলনে আইয়ুব বেশ আত্মপ্রসাদের সঙ্গে বললেন: “আমার দেয়া শাসনতন্ত্র পুরােপুরি গণতান্ত্রিক। এই শাসনতন্ত্র সব গণতান্ত্রিক অধিকারের গ্যারান্টি স্বরূপ।” কিন্তু রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র লিপ্ত হলেন।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব দুটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। ১. “এবভাে” করা  রাজনীতিবিদরা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত বা রাজনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকতে পারবেন না। এ ছাড়া তাদের কোনাে জনসভায় বক্তৃতা বা রাজনৈতিক বিবৃতি দেয়া এমন কি প্রেস-কনফারেন্সে কিছু বলাও ছ-মাসের জন্য নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারকে দেয়া হলাে। ২. অর্ডিনান্সটিতে প্রেসিডেন্ট এবডাে” করা রাজনীতিবিদরা আবেদন জানালে তাদের অযােগ্যতার মেয়াদ কমিয়ে দেয়ার বা মওকুব করার বিষয়টি স্বহস্তে গ্রহণ করলেন। ঠিক এ সময়ে এ দুটি অর্ডিনান্স থেকে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল যে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব এবড়াে করা রাজনীতিবিদদের নিজের শক্তিশালী প্রতিপক্ষ বলেই গণ্য করছেন। তাই নতুন করে এসব বাধা-নিষেধ যার মূল উদ্দেশ্য ছিল “জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট” ও এর সঙ্গে যুক্ত এবডাে” করা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অধিকার খর্ব করা। সংগঠন ছত্রভঙ্গ করে দেয়া। অন্যদিকে পােডাে অর্থাৎ সরকারি পদলাভে অযােগ্যতা, সে সকল অফিসার ও কর্মকর্তার বাংলাদেশের প্রতি অধিক অনুগত তাদের চাকরি থেকে বিদায়ের ব্যবস্থাকরণ। জনাব সােহরাওয়ার্দী করাচীর জিন্না সেন্ট্রাল হাসপাতালে তার রােগ শয্যা থেকে | একটি বিবৃতিতে আইয়ুবের নয়া অর্ডিনান্স-দুটির তীব্র সমালােচনা করে বললেন: “This is the most blatant form of corruption on the one hand and coercion and suppression on the other”, এমন কি করাচীর ঘাের প্রতিক্রিয়াশীল “ডন” পত্রিকাও ৯ জানুয়ারি (‘৬৩) তাদের সম্পাদকীয়তে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের এই পদক্ষেপকে “descent to pettiness” বলে মন্তব্য করলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ৮ জানুয়ারি (৬৩) একটি বিবৃতিতে বললেন : “এবডােভুক্ত রাজনীতিকদের উপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরােপ করে প্রেসিডেন্ট যে নয়া অর্ডিনান্স জারি করেছেন তা এই শাসন ব্যবস্থার দমনমূলক আইনগুলাের ক্ষেত্রে একটি নতুন অধ্যায়ের সংযােজন করেছে। পৃথিবীর কোনাে গণতান্ত্রিক দেশেই এর দ্বিতীয় নজির পাওয়া যাবে না।

অর্ডিনান্স দুটি শুধু এবডােভুক্ত রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধেই প্রযুক্ত হয়নি, বস্তুত এগুলাে গােটা জাতির কণ্ঠরােধেরই একটি ব্যবস্থা। জনসাধারণের ধৈর্য চরম সীমায় এসে পৌঁছেছে। তারা শাসক কর্তৃপক্ষের এই অবৈধ হস্তক্ষেপের কাছে কোনােমতেই নতিস্বীকার করবে না।” এদিকে ঢাকায় প্রবল ছাত্র বিক্ষোভ ও ছাত্র প্রতিরােধের সামনে দিশাহারা প্রাদেশিক সরকার আকস্মিকভাবে রমজান মাসকে ছুটি হিসেবে গণ্য করে ১৬ জানুয়ারি (‘৬৩) থেকে ২ মার্চ (‘৬৩) পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার আদেশ দিতে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করেছিলেন। প্রসঙ্গত এই সময় ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন এবং ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মণি ।। | ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলার বিশিষ্ট পণ্ডিত জনাব মাহমুদ হােসেন, এভাবে দীর্ঘ ছুটি দেয়ার সরকারি চাপ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনে সরকারি হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করতে পারছিলেন না। এ ছাড়া যখন তখন সরকারি হুকুমে ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা ও অন্যান্য শিক্ষা ও ছাত্র-দলন নীতি ইত্যাদি ব্যাপারে সরকারি নির্দেশ বিশেষত অশিক্ষিত” গভর্নর মােনায়েম খানের হুকুমনামা মেনে চলা মাহমুদ হােসেন সাহেবের পক্ষে একেবারেই সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি নিউকিভাবে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর মােনায়েম খানের কাছে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন। ক্রমে মােনায়েম খানের অসভ্যতা ও অভব্যতা এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়াল যে ভাইস চ্যান্সেলর মাহমুদ হােসেন হতাশা বিরক্তির এক চরম মুহূর্তে নিজের আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে পদত্যাগ করলেন ১২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৩। মওলানা ভাসানী ‘৫৮ সাল থেকেই বন্দি ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২৭ অক্টোবর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ।

সােহরাওয়ার্দী, নূরুল আমীন, আবু হােসেন সরকার, হামিদুল হক চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমানসহ অনেক নেতা হাসপাতালে ভাসানীকে দেখতে যান ২৯ অক্টোবর। তারা তাকে অনশন ভঙ্গের জন্য অনুরােধ করেন। তা ছাড়া সরকারের প্রতিও তারা জোর দাবি জানান তাকে মুক্তি দেয়ার জন্য । সকলের চাপের মুখে ‘৬২-র ৩ নভেম্বর ভাসানী মুক্তি পান। অভ্যন্তরীণ অবস্থা থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি সন্তোষে চলে যান। ১৬ নভেম্বর অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতাে নিষিদ্ধ ঘােষিত প্রাদেশিক ন্যাপের নির্বাহী পরিষদের এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। সেখানে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি আলােচিত হয়। ভাসানী সন্তোষে ছিলেন বলে দলের এক উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সেখানে গিয়ে তার মতামত নিয়ে আসেন। তিনি সােহরাওয়ার্দী গঠিত এনডিএফ-এর সঙ্গে ন্যাপ নেতাদের কাজ করার অনুমতি

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আইয়ুব খান প্রবর্তিত মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের ভােটে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় । ৮ মার্চ ৬৩ ঢাকা। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন। ১৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে দেশরক্ষা বিভাগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি কাশেম মালিক বিরােধী দলের তীর্যক প্রশ্নের জবাবে বলতে বাধ্য হন যে, পূর্ব পাকিস্তানে কোনাে সামরিক স্কুল, কলেজ বা অর্ডিনান্স ফ্যাক্টোরি স্থাপনের কোনাে ইচ্ছা কেন্দ্রের নেই। তিনি বলতে বাধ্য হন। আইয়ুবের আমলে ৭৯০ জন সেকশন অফিসারের যে নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছিল তার মধ্যে বাঙালির সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ জন। স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তানের ৩০৭ জন অফিসারের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানি ছিল মাত্র ১৪ জন । ৭ এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেরিতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন জেলা থেকে আগত নেতাকর্মীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সম্মেলনে প্রস্তাব গৃহীত হয় লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। জনসাধারণ ও আইন সভার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, ফেডারেল ও পার্লামেন্টারি পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা, প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের প্রবর্তন।

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঐ দিন ঢাকায় ছিলেন। আওয়ামী লীগ সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট হাউসে প্রেস কনফারেন্সে বলেন, “গণতন্ত্র একটি বিদেশী মাল। আমি উদ্ৰান্ত দার্শনিক নই। দেশকে একটি উপযুক্ত শাসনতন্ত্র দেয়াই আমার কাজ ছিল এবং আমার বিশ্বাস যে বর্তমান শাসনতন্ত্রই দেশের পক্ষে উপযুক্ত। এ সময় রেল শ্রমিকরা ধর্মঘট করছিল। তার সমর্থনে ছাত্ররা কার্জন হলে বিক্ষোভরত থাকা অবস্থায় ১০ এপ্রিল পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ৭ মে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে পশ্চিম পাকিস্তানে এনডিএফ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, খাজা মােহাম্মদ রফিক, ন্যাপের মােহাম্মদ আলী কাসুরী এদের গ্রেফতার করা হল। পূর্ব পাকিস্তানে জুলাই মাসের ৩,৪,৫ তারিখে নুরুল আমিনের বাসভবনে এনডিএফ-এর বৈঠক বসে এবং বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় প্রতিটি জেলায় এর শাখা গঠন করা হবে। কিছুদিন পর এনডিএফ থেকে মওলানা ভাসানী নিজেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। ভাসানীকে অনুরােধ করা হলে তিনি বলেন, “হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বা নুরুল আমিনের সঙ্গে তিনি কিভাবে কাজ করেন?” ১৯ জুলাই জাতীয় পরিষদের ১৭ জন পূর্ব পাকিস্তানের সদস্য কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকায় স্থানন্তরের দাবি জানান। এ দাবি সমর্থন করে এনডিএফ নেতারা বললেন, ঢাকায় দেশের কেন্দ্রীয় রাজধানীর স্থানান্তরের প্রশ্নে পূর্ব পাকিস্তানের সকল জনগণ একমত ও ঐক্যবদ্ধ ।

আইয়ুবের চাল

জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনে এনডিএফ সম্মিলিতভাবে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর প্রেক্ষিতে, ২৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট আইয়ুব একটি অর্ডিনান্স জারি করে ফতােয়া দিয়েছেন যে জাতীয় বা প্রাদেশিক পরিষদের জন্য কোনাে নির্বাচনে বা উপনির্বাচনের প্রচার অভিযানে প্রেসিডেন্ট, প্রাদেশিক গভর্নর বা মন্ত্রীদের অংশগ্রহণের কোনাে বাধা থাকবে না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের এই অর্ডিনান্স পাকিস্তানে প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের পথ সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে দিল।

শেখ মুজিবকে লন্ডনে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বলেছিলেন যে, তিনি তখনও পার্টি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবনের বিরােধী। তিনি তখনও মনে করতেন যে, “জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের মাধ্যমেই দলহীন রাজনীতি দ্বারা দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা উচিত। তখনও তার বিশ্বাস ছিল যে গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট ভেঙ্গে দিয়ে দলাদলি করতে গেলে দেশের মানুষ আবার হতাশ এবং দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়বে। ২ সেপ্টেম্বর (‘৬৩) জঙ্গী শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আবার তার হিংস্র রূপ প্রকাশ করলেন। তিনি এক নয়া অর্ডিনান্স জারি করে সারা পাকিস্তানে সংবাদপত্র ও পত্র-পত্রিকার উপর নানা বিধি-নিষেধের আরােপ করেন। প্রাদেশিক বা জাতীয় পরিষদের অথবা হাইকোর্টের কার্যবিবরণী স্পিকার অথবা চিফ জাস্টিস বা তাদের দ্বারা নিযুক্ত অফিসারদের দিয়ে পরীক্ষা না করিয়ে ছাপা যাবে না। প্রাদেশিক বা

কেন্দ্রীয় সরকার প্রচারিত প্রেস নােট প্রকাশ করলে তা পুরাপুরিই ছাপতে হবে। এর অন্যথা হলে সংশ্লিষ্ট পত্রিকার ছাপাখানা সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবে। একজন সাহসী সাংবাদিক পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী জনাব গােলাম নবী মেননকে জিজ্ঞেস করেন: “স্যার, ডাষাগত ভুল থাকলেও কি প্রেস নােট হুবহু ছাপতে হবে?” উজির সাহেব অম্লান বদনে জবাব দিয়েছিলেন: “হ্যা”। এই কুখ্যাত অর্ডিনান্সে। আরও বলা হয়েছিল যে, যে কোনাে ছাপাখানা বা সংবাদপত্র সম্পর্কে তদন্ত কমিশন গঠনের পূর্ণ ক্ষমতা সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে। ২০ অক্টোবর (‘৬৩) রবিবার শেখ মুজিব ঢাকায় ধানমণ্ডিতে তার বাসভবনে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে গােপালগঞ্জে ও খুলনায় উপনির্বাচনের গভর্নর থেকে শুরু করে চৌকিদার পর্যন্ত সরকারি কর্মচারীরা কীভাবে ন্যক্কারজনকভাবে হস্তক্ষেপ করেছেন, ভােটারদের বিশেষত সংখ্যালঘু ভােটারদের কি জঘন্যভাবে ভীতি প্রদর্শন করেছেন তার এক নগ্ন চিত্র তুলে ধরেন। বলেন যে, এত যে কম সংখ্যক ভােটার তারাও স্বাধীনভাবে ভােট দিতে পারেননি। শেখ মুজিব আরও বলেন যে, দেশের এই নিদারুণ পরিস্থিতিতে আজ আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি যে পূর্ব পাকিস্তান পিডি-করাচীর একটি কলোনিতে পর্যবসিত হয়েছে এবং এও আমরা বুঝতে পারছি যে, ঔপনিবেশিকতার এই শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত হতে হলে আমাদের অবিরাম সংগ্রাম করে যেতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী, কেন্দ্রীয় রাজধানী, পুঁজি গঠন, সেনাবাহিনী এবং রাজনৈতিক সমতা এই পাঁচটি বিষয়কে শেখ মুজিব রাষ্ট্র পরিচালনা ক্ষেত্রের পাঁচটি স্তম্ভ হিসেবে বর্ণনা করে বললেন: “এই পাঁচটি স্তম্ভের চারটিতে পূর্ব পাকিস্তানিদের কোন অধিকার এখন নেই বা আগেও ছিল না। বাঙালিদের একমাত্র অধিকার ছিল রাজনৈতিক । কিন্তু আজ তাও নেই। প্রেস কনফারেন্স শেষে শেখ মুজিব আইয়ুব ও তার তল্পিবাহক সরকারকে হুঁশিয়ারি জানিয়ে বললেন: বাঙালিদের আশা আকাঙ্ক্ষা ও দাবি-দাওয়ার প্রতি ক্রমাগত উপেক্ষা প্রদর্শন করে রাওয়ালপিন্ডি যে খেলায় মেতে উঠেছে তা আগুন নিয়ে খেলারই শামিল এবং এই বিপজ্জনক খেলার ভয়াবহ পরিণতি একদিন এই তথাকথিত রাষ্ট্রনায়কদের অবশ্যই ভােগ করতে হবে। | হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ২৯ নভেম্বর তার ইন্তেকালের মাত্র দু-দিন আগে বৈরুত থেকে তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়াকে নিজের হাতে লেখা একটি চিঠিতে বলেছিলেন : একথা ক’টি শুধু তােমারই জন্য। মরতে পারলেই আমি সুখী হব। বেঁচে থাকার আর কি সার্থকতা? কারাে কোন কাজে আমি আর আসব না। কেবল নিজের জন্যই যদি বাচতে হয়, তবে সে বাঁচায় আর লাভ কি?” | ২৯ নভেম্বর এই চিঠিতে অর্থাৎ সম্ভবত পূর্ব-পাকিস্তানের কোনাে সহকর্মীকে লেখা তাঁর জীবনের এই শেষ চিঠি আরম্ভেই সােহরাওয়ার্দী সাহেব শেখ মুজিবুর রহমানের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন: “আমাকে দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য তাগিদ দেয়ার প্রয়ােজন নেই। আমার একান্ত ইচ্ছা এ মাসের শেষ দিকে আমি দেশে ফিরে আসব।” কিন্তু সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

আইয়ুব খানকে কালাে পতাকা

১৯৬২ সালের জানুয়ারি শেষ সপ্তাহে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের রাজশাহী সফরকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে ওঠে। লৌহ শাসনের এই দুঃসহ দিনগুলাে তাঁর বিরুদ্ধে যে কোনাে পদক্ষেপ গ্রহণ সাংঘাতিক দুঃসাহস। রাজশাহীর ছাত্র-সমাজ দুঃসাহসে ভর করে ভয়ানক ঝুঁকি মাথায় তুলে নেয়। মিটিং বসে ফুলার হােস্টেলের ছাদে। আইয়ুব খানকে কালােপতাকা দেখানোের সিদ্ধান্ত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তখন এলােমেলাে, অসংগঠিত। আইয়ুবের আগমনের একমাস পূর্ব থেকে নাটোর-রাজশাহী রােডে পুলিশের টহল। নিরাপত্তা মহড়া । বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ পোেস্ট বসানাে হয়। প্রশাসনিক ব্যবস্থা জোরদার । এসবের বিরুদ্ধে ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া ঘনীভূত। এ যেন ভিন দেশি রাজার আগমন ছাত্রদের বৈঠক। ছােট আকারে। এ সভায় সরদার আমজাদ হােসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস্তব পরিস্থিতি ও সাংগঠনিক শক্তি তুলে ধরেন। রাজশাহী সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদ নির্বাচনে আবু আলম ভি.পি, এবং মােঃ রফিক, প্রাে ভি. পি, নির্বাচিত হন। সে দিন রাজশাহী কলেজে আবু আলমের সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত হয় যে, আইয়ুব খানের গাড়ির ওপর ইস্টক বর্ষণ, কালােপতাকা প্রদর্শন ও আইয়ুব বিরোধী শ্লোগান তােলা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিও সভা থেকে একই পদক্ষেপ গ্রহণ করার দাবি করা হয়। আইয়ুবের রাজশাহী আগমনের দিনে রাজশাহী কলেজের ছাত্রদের সেই দুঃসাহসী অভিযান। বিদ্রোহে বিক্ষুব্ধ । প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিরােধের শক্তি নিয়ে পাকিস্তানি সেনাপ্রধান, প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের গাড়িবহরকে সার্কিট হাউসের যাত্রাপথে রাজশাহী কলেজের সামনে ছাত্ররা রুখে দেয়। সাহেব বাজারের তত্ত্বালীন সরু অপ্রশস্ত রাস্তার মুখে রাজশাহী কলেজের গেটের সামনে উম্মত্ত স্লোগান । পুলিশের বেপরােয়া লাঠিচার্জ। পরিণত হলাে ভয়াল আর্তচিৎকার । নিউ হােস্টেলের সামনে তৎকালীন ‘আল হেলাল মেডিক্যাল হােস্টেলের মাঝের রাস্তায় আইয়ুব খানের কালাে শেভ্রোলেট। হােস্টেলের ছাদ থেকে অসংখ্য ইট ও মাটির কলস তাঁর গাড়ি বহরে নিক্ষিপ্ত হয় । নিউ হােস্টেলের ভেতরে ঢুকে সরকারি পারা সাধারণ ছাত্রদের বেধড়ক পিটাল। নির্যাতনের এক করুণ কাহিনী । প্রতিটি কামরায় ভাংচুর আর নিরপরাধদের ওপর নির্দয় হামলা, মারপিট। জঘন্য নির্যাতন। আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন আবু আলম, রফিক, মাইদুল ইসলাম মুকুল, মঞ্জুর হােসেন, মাইদুল ইসলাম, রফিকসহ ছাত্রনেতারা। প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক শক্তির ওপর নির্যাতনের নেতৃত্ব দেন মুসলিম লীগ নেতা এবং তৎকালীন পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি জনাব মুহম্মদ আয়েনুদ্দীন এবং সরকারি দলের ছাত্রনেতা এন, এস, এফ-এর জাফর ইমাম।

১৯৬৩ সালের ১১ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। ছাত্রলীগ দেশব্যাপী আন্দোলন কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এসময় আন্দোলন চালিয়ে নেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে গভর্নর ও চ্যান্সেলর মােনায়েম খান

তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর জনাব মাহমুদ হােসেনকে শিক্ষক ছাত্রদের বিরুদ্ধে। ব্যবস্থা নিতে বললে তিনি অস্বীকৃতি জানান। তিনি ১২ ফেব্রুয়ারি বলেন, “কোন শিক্ষাবিদ কখনাে পুলিশের মনােভাব নিতে পারেন না । গভর্নর মােনায়েম খান তার বশংবদ ময়মনসিংহ কৃষি মহাবিদ্যালয় অধ্যক্ষ ড. এম, ওসমান গনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত করেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি সামরিক শাসন-উত্তর প্রথম শহীদ দিবসে ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি ঘােষণা করা হয় । ডাকসু ও সংসদের ২৯ জন ছাত্রনেতাদের স্বাক্ষরে গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অটল থাকার লক্ষ্যে প্রতিজ্ঞা ও কর্মে, শপথে ও সংকল্পে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের সামনে আমতলায় অস্থায়ী শহীদ মিনার তৈরি করে এই প্রথমবারের মতাে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। কালাে ব্যাচ ধারণ, আলােচনা সভা, কবিতা আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ছাত্রনেতৃবৃন্দের সঙ্গে বাংলা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকগণ এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

ছাত্র রাজনীতির বৈশিষ্ট্য

ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতির বৈশিষ্ট্য হলাে ছাত্র রাজনীতি ও ছাত্র সংগঠন কর্তৃক রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তির প্রতি অনীহা । ছাত্র সংগঠনগুলাে আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। সে সময়ে ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দলগুলাের অগ্রবাহিনী হিসেবে আন্দোলন পরিচালনা করেছে। তার অর্থ এই নয় যে, রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে তাদের যােগাযােগ ছিল না। অপরিহার্য না হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বও ছাত্রদের সরাসরি ব্যবহার করতে আসেনি। তবে ছাত্র রাজনীতিতে দমন-পীড়নে রাজনৈতিক দলগুলাে প্রতিবাদ জানাতেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদ ছাত্রদের উপর যেকোনাে হামলা, গ্রেফতার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন। ১৯৬৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি । শেখ মুজিব সরাসরি এক বিবৃতিতে বলেন: “বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যে কেবল দেশের প্রশাসন ক্ষেত্রেই নয়, বস্তুত শিক্ষাব্যবস্থার অঙ্গনে পর্যন্ত বল প্রয়ােগ ও দমননীতির আশ্রয় গ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরকে পদত্যাগে বাধ্য করা তার একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের এই জঘন্য কার্যকলাপ নিজেদের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ব্যবহার করার ব্যাপারে তাদের প্রয়ােগের এক নগ্ন কারসাজি ছাড়া আর কিছু নয়।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের ক্ষুব্ধ পদত্যাগ ও সরকারের নগ্ন হস্তক্ষেপে ছাত্র সমাজের মধ্যে যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া শেখ মুজিবুর রহমানের প্রকাশ্য এই প্রতিবাদ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তার গ্রহণযােগ্যতার মাপকাঠিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।

নিচের অনুচ্ছেদগুলােতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ষাটের দশকের ছাত্র সংগঠন ও আন্দোলন সম্পর্কে ঐতিহাসিক কারণেই কিছু আলােকপাত করা প্রয়ােজন। কেননা পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকা ব্যতীত মাত্র আর একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলাে রাজশাহী।

বিশ্ববিদ্যালয় । বৃহত্তর খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রধানত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতেন। তাছাড়া রাজশাহী সরকারি কলেজ ব্রিটিশ আমল থেকেই সুনাম অর্জন করেছিল। রাজশাহী কলেজে আইয়ুববিরােধী আন্দোলনের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনের কাজ শুরু হয়। ১৯৬৩-৬৪ সালে রাকসুতে সৈয়দ মাযহারুল হক বাকি সহ-সভাপতি ও আব্দুর রউফ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। শাহ মখদুম ছাত্রাবাস ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রাবাস। শাহ মখদুম ছাত্রাবাসের প্রথম সংসদ নির্বাচনে মুহম্মদ জাকারিয়া সহসভাপতি এবং সরদার আমজাদ হােসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সংকটের সময়ে স্বৈরচারীর শাসনের বিরুদ্ধে। সরকারবিরােধী সাহিত্য-স্মরণিকার দায়িত্ব পালন করেন আবু সাইয়িদ। রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে নিদারুণ আর্থিক সংকট ছিল। ছাত্ররা নিজেরা স্বপ্রণােদিতভাবে চাঁদা দিয়ে তহবিল সংগ্রহ করতেন। বাইরে থেকে অর্থ প্রাপ্তির তেমন কোনাে সুযােগ ছিল না। ছাত্ররাও সুনজরে দেখেনি। স্বাধীনতার ভাবনা ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি কে, এম, ওবায়দুর রহমান এবং সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল আলম খান। এ সময় রাজশাহীর ছাত্রনেতা আবু সাইয়িদ ঢাকায় এসে ইকবাল হলের একটি রুমে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠন সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। আলােচনার এক পর্যায়ে তিনি আবু সাইয়িদকে নিয়ে ইকবাল হল সংলগ্ন পুকুরের দক্ষিণ পার্শ্বের মাঠে বসেন। তিনি পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যাপক বৈষম্য তুলে ধরেন। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারায় পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এক ছাত্রনেতার কাছ থেকে সরাসরি স্বাধীন বাংলার মন্ত্র উচ্চারিত হওয়া নিঃসন্দেহে অগ্রিম বার্তা হিসেবে বিবেচ্য। মূলত এ সময় থেকেই স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। পরবর্তীকালে জানতে পেরেছি স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য এ সময় “নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়। পরবর্তীতে জননেতা আবদুর রাজ্জাক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য “নিউক্লিয়াস’ গঠন করা হয়। উক্ত নিউক্লিয়াস’এ সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আরেফ আহমেদ ও পরবর্তীতে তােফায়েল আহমেদ যুক্ত ছিলেন। ‘৬২ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হকের মৃত্যু, ‘৬৩-এ হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু, এবডাের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের ‘৬২ সালের নির্বাচনে বঞ্চিতকরণ, নতুন শিক্ষা কমিশনের রিপাের্টে রােমান হরফে বাংলা লেখা, রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধের উদ্যোগ এবং ব্যাপক শশাষণ-বৈষম্য ও স্বৈরশাসন, জেল-জুলুম দেশব্যাপী বৃহত্তর আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল, ঠিক এমনি সময়ে ছাত্র সমাজের মাঝে নতুন করে সরকারবিরােধী পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

আওয়ামী লীগ সম্মেলন

১৯৬৪ সালের ৬ মার্চ গ্রীন রােডে আমবাগানে মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয় । সাবেক মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান ৬ মার্চ আওয়ামী লীগে যােগ দেন। সম্মেলনে মূল দাবি প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকার, প্রত্যক্ষ নির্বাচন, স্বায়ত্তশাসন এবং বৈষ্যমের অবসান। রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবনের পূর্বেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের শাখা গঠিত হয়। ১৯৬৪ সালে শাহজাহান বিশ্বাস সভাপতি এবং সালাহউদ্দিন আহমেদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অনুরূপভাবে নুরুল ইসলাম ঠাণ্ডকে আহ্বায়ক করে রাজশাহী জেলা ছাত্রলীগ গঠিত হয় । ঐ সময় রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্রলীগের গােড়া পত্তন করেন নুরুল আলম, সাইফুল ইসলাম, মােস্তাক আহমেদ, ফকির আব্দুর রাজ্জাক, মােজাফফর হােসেন, নাজির উদ্দিন, শফিউল ইসলাম, সোহরাব হােসেন রবি, নজরুল ইসলাম, আবদুল করিম প্রমুখ, তাদের নিয়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয়।

মােনায়েম খানের ভাষা তলিয়ে যায়

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাজহারুল হক বাকি ও সিরাজুল ইসলামের কর্মতৎপরতায় অনার্স ছাত্রদের মধ্যে আওয়ামীকেন্দ্রিক একটি টিম গড়ে ওঠে। যা পরবর্তীতে আন্দোলন, সংগঠন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্বিক বিষয়ে প্রতিবাদী শক্তি নিউক্লিয়াস’ হিসেবে কাজ করে। এ টিমে ছাত্রদের মধ্যে শাহজাহান বিশ্বাস, সালাহউদ্দীন আহমেদ, আয়েশ উদ্দীন, নেফাজ উদ্দীন, সরদার আমজাদ হােসেন, আবু সাইয়িদ, মােজাফফর আহমেদ, হামিদুর রহমান, খলিলুর রহমান, আহসান হাবিব, জুলফিকার মতিন প্রমুখ উল্লেখ্য। দেশের বিরাজমান অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফ হতে সমাবর্তনের ঘােষণা আসে। গভর্নর মােনায়েম খান বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ডিগ্রিপ্রাপ্ত ছাত্রদের মধ্যে সার্টিফিকেট বিতরণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেবেন। এ ব্যাপারটি ছাত্র সমাজ মেনে নিতে পারেনি। সমাবর্তনের ঘােষণা হওয়ার পর থেকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে এক অস্বস্তিকর থমথমে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তৎকালিন উপাচার্য ড. মােমতাজ উদ্দীন আহমেদ ছিলেন মােনায়েম খানের বিশ্বস্ত ব্যক্তি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিবেশ শান্ত এবং কনভােকেশন সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেন। জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি জিন্নাহ হলের প্রভােস্ট অফিসে নির্বাচিত ছাত্র নেতাদের ডাকেন। সভায় হল ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সহসভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। প্রথমে তিনি শান্ত’ ও ‘দ্রভাবে কনভােকেশন সম্পর্কে একাডেমিক কর্তব্য ব্যাখ্যা করেন। তারপর এ অনুষ্ঠানে তার করণীয় সম্পর্কে খােলামেলাভাবে তুলে ধরেন। প্রথম দিকে স্বাভাবিকভাবে সভা শুরু হয়। এক পর্যায়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের ভি.পি. মাজহারুল

হক বাকি, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রউফ মােনায়েম খানকে ‘খুনি’ ও আইয়ুব খানের ‘লাঠিয়াল’ হিসেবে উল্লেখ করেন। ছাত্রনেতাদের মুক্তি দাবি করেন। বৈঠক শেষ হয় অস্বাভাবিকভাবে। কারণ ছাত্র প্রতিনিধিরা পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, তারা গভর্নরের আগমনকে প্রতিরােধ করবেন।” ভিসির সাথে উত্তপ্ত কথা কাটাকাটি হয়। তিনি হুমকি দেন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের । ভি.সি’র সাথে বৈঠকের পর পরই ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে সপ্তাহব্যাপী মিটিং মিছিল সমাবেশ ঘােষণা করা হয় । বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর গরম হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফিজিক্স বিল্ডিংয়ের পেছনে প্যান্ডেল তৈরি শুরু হয়। ডেকোরেটরদের নির্মাণ সামগ্রী আসছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রাজুয়েট এবং মাস্টার ডিগ্রিধারী ছাত্ররাও আসতে শুরু করেছে। সার্টিফিকেট গ্রহণের নিয়মাবলি পালনে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যাতায়াত শুরু করেন। অন্যদিকে ব্যাপক মিছিল। প্রতিবাদ। সমাবেশ। ১৪ তারিখ বিকেলে কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়ার সামনে ছাত্র জমায়েত। এ সভায় দৃঢ়ভাবে রাজশাহীতে উপস্থিত সার্টিফিকেট গ্রহণকারী ছাত্রদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়। এ সভায় মাজহারুল বাকি সভাপতিত্ব করেন। আবদুর রউফ, সরদার আমজাদ হােসেন, মুহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন। বিশেষভাবে বক্তব্য রাখেন। আবদুর রৌফ চৌধুরী। রাতের মধ্যেই আগতদের ক্যাম্পাস ত্যাগ করার আহবান জানানাে হয়। এছাড়া তাদের ভয়াবহ পরিণতির জন্য তারাই দায়ী হবেন। পুলিশ। রাতে আবদুর রউফসহ বহু সংখ্যক ছাত্রকে গ্রেফতার করল। সহ-সভাপতি। মাজহারুল হক বাকি ও সরদার আমজাদ প্রমুখ ছাত্র নেতা আত্মগােপন করেন। অন্ধকার রাতে নির্ধারিত প্যান্ডেলের এক অংশে আগুন ধরে। ক্যাম্পাসে আস ছড়িয়ে পড়ে। সকাল ১০টায় নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিয়ে গভর্নর এবং চ্যান্সেলর আব্দুল মমানায়েম খান ফিজিক্স বিল্ডিংয়ের পেছনের গেটে হেলিকপ্টারে নামলে ছাত্ররা প্রতিরােধ করে। পুলিশ লাটিচার্জ করে। ছাত্ররা ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে। বাইরে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। কনভােকেশন প্যান্ডেলে প্রখ্যাত ছাত্র নেতা আব্দুর রৌফ চৌধুরী ও যশােরের রেজা শাজাহানের নেতৃত্বে প্যান্ডেলের ভেতরে “নিরাপত্তা কার্ডধারী’ ছাত্রদের মধ্য থেকে স্লোগান শুরু হয়। অত্যন্ত তাড়াহুড়া করে চ্যান্সেলর মােনায়েম খান কিছু প্রতীকী সাটিফিকেট প্রদান করেন। প্যান্ডেলের মধ্যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি ও সরকারবিরােধী স্লোগানে তার ভাষণ তলিয়ে যায় । মঞ্চ থেকে তিনি নেমে যেতে বাধ্য হন।

রাজশাহীতে শেখ মুজিব: আপদ-বিপদ-মুসিবৎ

১৯৬৪ সালের মে মাস। রাজশাহী নগর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি মনিরুজ্জামান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মে রাজশাহীতে জনসভা করবেন। তিনি প্রচার-প্রচারণায় ছাত্রদের সহযােগিতা চান। শাহজাহান বিশ্বাস, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সরদার আমজাদ হােসেন, আবু সাইয়িদ, নাজিম উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ শেখ মুজিবের জনসভাকে সফল করার কর্মপন্থা গ্রহণ করে। মাইকিং করার জন্য চট্টগ্রামের নাজিম উদ্দিনকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ছাত্রনেতা

নাজিম উদ্দিনের যেমন ছিল শক্ত শরীর তেমনি ভারি কণ্ঠ। সাহস ছিল প্রচণ্ড। ৫ মে মাইকিং করতে গেলে হেতেম খানার মােড়ে তাকে এন.এস.এফ.-এর ছাত্র নামধারী পান্ডারা বেদম প্রহার করে। তার মাথা ফেটে যায়। সারাশরীরে রক্ত। গভর্নর মােনায়েম খানের গুন্ডারা প্রকাশ্যে হুমকি দেয়, ‘শেখ মুজিবকে সভা করতে দেয়া হবে না। চারদিকে সন্ত্রাসের রাজত্ব। এমনি অবস্থায় রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভােকেট মুজিবর রহমান উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। পরিস্থিতির পর্যালােচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের একটি ঘরােয়া বৈঠক বসে। বৈঠক চলাকালীন মুজিবুর রহমানের অনুজ মােঃ রফিক এসে উপস্থিত হন। সিদ্ধান্ত হয় অশুভ শক্তির মােকাবেলায় শক্তি প্রয়ােগের । এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে রফিক, আবু সাইয়িদ প্রমুখ। রাজশাহীর দুর্গাপাড়ায় আনফোরের কাছে যায়। পুনরায় প্রচার কাজ শুরু হলে মােনায়েম-এর পান্ডারা হামলা করলে আনফোরের নেতৃত্বে ছাত্র-যুবকেরা তা। প্রতিহত করে। এই প্রতিরোধে রাজশাহী শহরের ছাত্ররা নূরুল ইসলাম ঠাণ্ডুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে। আনফোর দর্গাপাড়ায় সাহসী একটি গােষ্ঠীর নেতৃত্ব দিত। তার সক্রিয় সহযােগিতায় প্রচার কাজ সম্পন্ন হয় ।

৭ মে। ১৯৬৪ সাল। রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ভবন মােহন পার্ক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিরাট মিছিলসহকারে উক্ত জনসভায় ছাত্ররা যোেগ দেন। শ্লোগান ছিল “আইয়ুব-মােনায়েমের গুন্ডারা হুঁশিয়ার সাবধান”, “জনসভায় যােগ দিন” ইত্যাদি। সন্ধ্যার আগেই শেখ মুজিব জনসভায় ভাষণ দিতে ওঠেন। শুরু হয়ে যায় গণ্ডগােল। মােনায়েম খানের গুন্ডারা মিটিংয়ে হামলা করে। ডানপাশে রাস্তার উপরে মাইক ভাংচুর করে। হৈ চৈ! স্লোগান: “ভারতের দালাল হুশিয়ার, সাবধান।” লাঠি। রামদা । খােলা তলােয়ার নিয়ে “আল্লাহ আকবার” স্লোগান দিয়ে তারা সমাগত জনতার উপর আক্রমণ করে। সভায় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। এসময়ে মঞ্চে রক্তাক্ত অবস্থায় ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয় মােটর শ্রমিক ইউনিয়নের সেক্রেটারি মাতব্বর হােসেনকে। | শেখ মুজিব গর্জে ওঠেন। মাইকে তিনি বলতে থাকেন, “কে আছিস আয়? আহসান মঞ্জিলের গুন্ডাদের শায়েস্তা করেছি, এদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে। তিনি মঞ্চ থেকে মাইক স্ট্যান্ড খুলে নিয়ে নিচে নামতে উদ্যত হন। ছাত্রনেতৃবৃন্দ মঞ্চে ও মঞ্চের আশেপাশে অবস্থান করছিল। মঞ্চের নিচে বাঁশের লাঠি তৈরি । ছাত্র-জনতা গুন্ডাদের প্রতিরােধ করে। জনগণ তাদের ধাওয়া দেয় । আবার জনসভা শুরু হয়। জনসভায় তিনি বলেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমপাকিস্তানে জৌলুসের সমারােহ চালাচ্ছে আর পূর্ব পাকিস্তানকে পরিণত করেছে কাঙালে, ভিখারিতে । আপদ-বিপদ ও মুসিবৎ এই তিনটি বস্তু আজ দেশবাসীর উপর সওয়ার হয়েছে। সম্রাট দেশ শাসন করছে। রাজপুরুষরা যেখানেই তশরিফ রাখেন সেখানেই আপদ-বিপদ-মুসিবৎ নেমে আসে। শেখ মুজিব আইয়ুবমােনায়েমকে হুশিয়ারি জানিয়ে বলেন, সেদিন সুদূর নয় যখন জনগণের রুদ্র রােষে ক্ষমতাসীনদের হাওয়াই প্রাসাদ ধ্বসে পড়বে। দেশবাসীকে ভােটাধিকার থেকে। বঞ্চিত করে বর্তমান শাসকগােষ্ঠী জাতির কপালে অবিশ্বাসের যে তিলক এঁকে

দিয়েছে সেই গ্লানি মুছবার জন্য আজ দেশবাসিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দুর্বার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এই মিটিংয়ে যেসব ভাড়াটে গুন্ডারা হামলা করেছিল তাদের মধ্যে হাতকাটা হাকিম, ডাইলমন্ত্রী আমজাদ, শাহ আলম কসাই, হাতেম, এতিম, বেন্টু এবং এন.এস.এফ.-এর জাফর ইমাম, মন্টু সিং, সন্টু, মঈদ, মােকছেদ অন্যতম। রাজশাহীর নওগাঁ মহকুমা সদরে মুক্তি সিনেমা হলে ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে যে ছেলেটি নিহত হয়েছিল সে ছিল পার-নওগাঁর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তৎকালীন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ডা. মঞ্জুর হােসেনের অনুজ। পাকিস্তান দিবসের অনুষ্ঠানের চেয়ারে বসা নিয়ে কথা কাটাকাটির সৃষ্টি। উত্তেজিত পুলিশ সিনেমা হলের মধ্যে গুলি চালায়। সাথে সাথেই সে নিহত হয়। এ হত্যার প্রতিবাদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ডাকা হয়। মিছিল হয়। রাতে দেয়ালে দেয়ালে পােস্টার লাগানাে হয়। পুলিশ হলগুলাে ঘেরাও করে। ভােরে পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র শরীফ উল্লাহ বাইরে গেলে দেখতে পান হলের অদূরে ব্যাপক পুলিশের উপস্থিতি। তিনি দ্রুত এসে খবর দেন। অনেকেই বাইরে চলে যেতে সক্ষম হন। জনাব গােলাম কিবরিয়া রাজশাহীর এস.পি,। সেদিনের অপারেশনের দায়িত্বে এস,পি স্বয়ং। ঘুম থেকে উঠিয়ে শেষ রাতে গ্রেফতার করল অনেককে। তাদেরকে জিন্নাহ হলের বারান্দায় নিয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড় করিয়ে নামের তালিকা করেন এস.ডি.ও আব্দুল মালেক। জিন্নাহ হলের বারান্দায় তালিকা তৈরি পূর্বক সিরাজুল হক, নজরুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, সরদার আমজাদ হােসেন, আব্দুর রশীদ, অর্থনীতির আব্দুর রশিদসহ ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পরের দিন পুনরায় হরতাল। হরতালের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জঙ্গি মিছিল রাজশাহীর সাহেব বাজার পর্যন্ত গিয়ে সভা করে। আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষিত হয়। এ সময় সাহেব বাজারের মােড়ে স্টার স্টুডিও থেকে এ সব মিছিলের ছবি ভােলা হতাে। মিছিলটি ফেরার পথে সরকারি গুন্ডারা আক্রমণ করে। আহত হন নেফাজ উদ্দিন, আয়েস উদ্দিন, নজরুল ইসলাম প্রমুখ। ড. এ. আর. মল্লিক তখন জিন্নাহ হলের এবং ডক্টর এনামুল হক এস,এম, হলের প্রভােষ্ট। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এ দুটি হলের প্রভােস্টদের পরামর্শ ছাত্রদের মানসিক ও মানবিক চাপের হ্রাস হয়। শিক্ষা জগতের দু’বরেণ্য দিকপাল ড: মল্লিক ও ড. এনামুল হকের প্রচেষ্টায় ৭ দিনের মধ্যেই বন্দিয়া কারাগার। থেকে মুক্তি পান।”

‘আমাদের স্বাধীনতা পেতে হবে

১৯৬৪ সালে ২২ ডিসেম্বর। রাজশাহীতে আসন্ন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রজেকশন মিটিং। রাজশাহী স্টেডিয়াম। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলাে থেকে বেসিক ডেমােক্রেসির সদস্যগণ উক্ত মিটিংয়ে যােগদানের জন্য এসেছেন। এসেছেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান, তার মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা কায়দে আযম মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভগ্নি মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ ও অন্যান্য প্রার্থীরা। আইয়ুব খান ছিলেন সার্কিট হাউসে। সম্মিলিত বিরােধী দলের

প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহর থাকার জায়গা ছিল জেলা পরিষদ ডাকবাংলাে। ডাক বাংলাের অবস্থা শুনে ফাতেমা জিন্নাহ রাজশাহী স্টেশনে রেলের মধ্যেই একটা সেলুনে অবস্থান করছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিছিল নিয়ে রেলওয়ে সেলুনের দিকে ভিড় জমায়। মিছিলের আওয়াজে ফাতেমা জিন্নাহ কোচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত কর্কশ স্বরে বলে ওঠেন, “স্টপ জিন্দাবাদ, মুর্দাবাদ!” ছাত্ররা তখন মাদারে মিল্লাত জিন্দাবাদ, আইয়ুব খান মুর্দাবাদ স্লোগান দিচ্ছিল। মাদারে মিল্লাতের ধমক খেয়ে ছাত্ররা চুপসে যায়। এক পর্যায়ে তারা স্টেডিয়ামের দিকে অগ্রসর হয়। | রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে সাহেব বাজার ও স্টেডিয়াম পর্যন্ত ছিল জনারণ্য। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের প্রজেকশন সভায় পৌছার পথে রেল স্টেশন ও স্টেডিয়ামের মুখে ছাত্র-জনতার প্রতিরােধে তিনি বাধাগ্রস্ত হন। পুলিশ, ইপিআর এবং সেনাবাহিনী ব্যাপক লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। চারদিকে তুমুল বিশৃঙ্খলা। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর আজম খান রেলওয়ের কবরখানার পাশে পড়ে যান। লাঠিচার্জে আহত হন। এ সময় ঢাকা থেকে আগত ছাত্রনেতা সফিউদ্দিন আহমেদ, লুৎফুল হাই সাচ্চু, আব্দুর রউফ, সিরাজুল হক সহ বেশ কজন ছাত্র নেতা আহত হন। তাদেরকে নিয়ে সরদার আমজাদ হােসেন, শাহজাহান বিশ্বাস, আবু সাইয়িদ, নুরুল ইসলাম ঠাণু প্রমুখ সেরিকালচারের পেছনে একটি ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান। এ সময়ে গুরুতর আহত হন তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য শাহাজাদপুর থেকে নির্বাচিত সৈয়দ হােসেন মুনসুর। তাকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তাকে দেখতে যান। পথে মােনায়েম খানের পান্ডারা হেতেম খানার মােড়ে তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। শেখ মুজিব জীপ থেকে নেমে পথে দাঁড়ান । তিনি তাদের ধমক দেন। তাঁর ধমকে এন,এস,এফ পান্ডারা থমকে দাঁড়ায় । শেখ মুজিব বলেন, “মােনায়েম খান দেশ ছেড়ে পালাবে। তােরা কি করবি?’ সংবাদ পেয়ে লুৎফুল হাই সাঙ্গু, শাহজাহান বিশ্বাস, নাজিম উদ্দিন, আবু সাইয়িদ প্রমুখ রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের দিকে দ্রুত রওনা হয়। কিন্তু ততক্ষণে শেখ মুজিবুর রহমান রেলওয়ে সেলুনে ফিরে এসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাত্রনেতৃবৃন্দ সেলুনে উপস্থিত হন। সাঙ্গু ভাই ছাত্র নেতাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, “তােরা ছাত্রলীগকে সংগঠিত কর। লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছে, আমরা লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতেই স্বায়ত্তশাসন চাই। আমাদের স্বাধীনতা পেতে হবে।”

পূর্ব পাকিস্তান রুখে দাঁড়াও

দেশের এমনি ভয়াবহ অবস্থায় ঢাকায় আইয়ুববিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হােসেন মানিক মিয়ার সভাপতিত্বে এক সভায় মিলিত হয়ে দাঙ্গা প্রতিরােধ কমিটি গঠন করেন এবং একটি ইশতেহার প্রকাশ করেন। ১৭ জানুয়ারি ইত্তেফাক, আজাদ ও সংবাদের প্রথম পৃষ্ঠায় পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামে এই ইশতেহার প্রকাশিত হলে তা এক ঐতিহাসিক

আবেদন হিসেবে পরিগণিত হয়। আবেদনটি প্রচারপত্র হিসেবে ছাপিয়েও বিলি করা হয়। ১৯৬৪-এর ৩০ এপ্রিল এই আবেদন ছাপানাের অপরাধে মােনায়েম খাঁ সরকার ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ঢাকা মহকুমা প্রশাসকের এজলাসে এক মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর ধরে এই মামলা নিয়ে হয়রানি চলতে থাকে। অবশেষে ১৯৬৯ সালে ৫ এপ্রিল এই মামলা প্রত্যাহার করা হয়।

ঢাকায় সমাবর্তন

মােনায়েম খান গভর্নর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য ছিলেন। তাঁর শখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনের অনুষ্ঠানগুলােতে তিনি যােগদান করবেন। প্রথম পর্যায়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠান অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ও হট্টগােলের মধ্যে দিয়ে শেষ করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে এসে ছাত্রদের দ্বারা তিনি ব্যাপক বাধার সম্মুখীন হন। এক বিশৃঙ্খলা অবস্থার সৃষ্টি হয়। ২২ মার্চ, ‘৬৪, কার্জন হলে সমাবর্তনের এই অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল। ছাত্ররা পূর্বেই মােনায়েম খান কর্তৃক সনদপত্র বিতরণে অস্বীকার ও আপত্তি করছিল এবং প্রতিবাদে খণ্ড খণ্ড বিক্ষোভ হচ্ছিল। আইয়ুব খান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে ছাত্র অসন্তোষের কারণসমূহ বের করার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন। কিন্তু হামিদুর রহমান অনাহুতই ছাত্রদের সম্বন্ধে বিভিন্ন অপ্রীতিকর মন্তব্য করে সমস্যা বৃদ্ধি করেন। তিনি শরীফ কমিশনের প্রতিবেদনের প্রতি সমর্থন ঘােষণা করেন। ছাত্ররা এই কমিশনের প্রতিবেদন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে। এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেই ছাত্রদের আবার নতুন করে রাজপথে নামতে হয় । কিন্তু হামিদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার আগেই ১৯৬৫ সালে ছাত্রদের কাছে আগমন করে নতুন রকম সংকটের বছর হিসেবে। এ বছর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আইয়ুব। খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরােধী দলের প্রার্থী হলাে মিস্ ফাতেমা জিন্নাহ্। আইয়ুব বিরােধী ছাত্র সমাজ এই নির্বাচন নিয়ে মাঠে নামে। প্রবল গণজোয়ার সৃষ্টি হয় । কিন্তু সাধারণ মানুষের ভােটাধিকার ছিল না। ভােটার ছিলেন মৌলিক গণতন্ত্রীরা। এদের সংখ্যা সমগ্র পাকিস্তানে ছিল ৮০হাজার। চরম দুর্নীতি ও ভয়-ভীতি দেখিয়ে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে মাত্র আড়াই হাজার ভােট বেশি পান।”

ছাত্র আন্দোলনের মূল সংকট দেখা দেয় ছাত্র ইউনিয়নের ডাঙন নিয়ে। ৬৫ সালেই ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া চৌধুরী ও রাশেদ খান মেননের দুই বিবদমান নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তারপর আসে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যকার অনাকাক্ষিত যুদ্ধ। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধের ফলাফল যাই হােক না কেন, এই যুদ্ধ দুটি বিষয়ে বাঙালি জাতির কাছে দৃশ্যমান হয়ে উঠে।  এক, এতদিন পর্যন্ত পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী স্লোগান দিয়ে আসছিল যে, শক্তিশালী কেন্দ্র ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুর্জয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তার রক্ষার কবজ। কিন্তু যুদ্ধের সময় দেখা গেল ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তানের লাহাের পর্যন্ত প্রায় ঢুকে পড়েছিল, তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেই রক্ষা করতে নাকানি-চুবানি খেয়েছে। ভুট্টো অবশ্য বলেছিল, তারা নাকি চীনের হাতে পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল। সেই ভয়ে ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করেনি। এটা ছিল। ভাওতাবাজি। দুই. এই যুদ্ধে বাঙালিরা পশ্চিম রণাঙ্গনে প্রমাণ করেছে তারা সুদক্ষ সৈনিক ও যুদ্ধে পারদর্শী। এতদিন পশ্চিম পাকিস্তানিরা বলত যে বাঙালিরা ভীত, তারা যুদ্ধ করতে সক্ষম নয়। এই কথাটি এই যুদ্ধে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বাঙালিদের মধ্যে এমন প্রত্যয় ফিরে আসে তারা প্রয়ােজনে যুদ্ধ করতেও সক্ষম।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ